শিক্ষায় ভ্যাট, উন্নয়নে ব্যাঘাত?

মতামত ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৪ ১৭:৫০:০৮
শিক্ষায় ভ্যাট, উন্নয়নে ব্যাঘাত?

সত্য নিউজ:গত দুই দশকে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভুবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সীমিত আসন ও অবকাঠামোগত অপ্রতুলতার কারণে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার বিকল্প পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। শুধু শিক্ষা প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটির ওপর সরকার ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করায় তৈরি হয়েছে এক ধরনের আর্থিক চাপ ও সংকট। শিক্ষা কখনোই বিলাসবস্তু নয়, বরং এটি মৌলিক মানবাধিকার এবং একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও আত্মনির্ভরতার ভিত্তি। শিক্ষা খাতে ভ্যাট আরোপ মানে সেই অধিকারকে আর্থিক শর্তে রূপ দেওয়া, যা সামাজিক সাম্য ও উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকারের নীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের দেওয়া ফি মূলত গবেষণা, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন এবং বৃত্তি প্রদানে ব্যয় হয়। সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ কোনোভাবেই যৌক্তিক বা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নয়।

বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলেই এটি আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বেসরকারি উচ্চশিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে। যেমন জাপানে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি এবং সেখানে সরকার করছাড়, গবেষণা অনুদান ও শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি জার্মানির মতো দেশেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি বৃত্তি, গবেষণা তহবিল ও নীতিগত সহায়তা পায়। এসব দেশে শিক্ষাকে অর্থনৈতিক চাপ নয়, বরং উৎপাদনশীল খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে সরকারের লক্ষ্য হয় শিক্ষাকে যতটা সম্ভব সবার কাছে সহজলভ্য করে তোলা।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই সম্ভাবনাকে মূল্যায়ন না করে সরকার এক ধরনের নিরুৎসাহমূলক নীতি অনুসরণ করছে। এর ফলে শুধু শিক্ষার্থীর ওপর আর্থিক বোঝা বাড়ছে না, বরং সমগ্র জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও মানবসম্পদ উন্নয়নের পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে রাষ্ট্র কার্যত উচ্চশিক্ষাকে সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ করছে, যা ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।

সরকার চাইলে এই পরিস্থিতির কার্যকর সমাধান করতে পারে। ভ্যাট প্রত্যাহার করে সেই অর্থ গবেষণায় পুনঃবিনিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলা যেতে পারে, তারা যেন পূর্বে ভ্যাট বাবদ যে অর্থ জমা দিত, তা গবেষণাগার উন্নয়ন, গবেষণা বৃত্তি এবং আন্তর্জাতিক একাডেমিক সহযোগিতার কাজে ব্যয় করে। এতে সরকারের রাজস্ব ঘাটতিও হবে না, আবার উচ্চশিক্ষার মানও বাড়বে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট লোন স্কিম, স্কলারশিপ কর্মসূচি ও আর্থিক সহায়তা চালু করলে নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীরাও সমান সুযোগে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে পারবে।

এ ছাড়া অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে করছাড়, দাতাদের অনুদানে কর রেয়াত, এবং নীতিগত স্বাধীনতা প্রদান করা হলে, প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গুণগত মান বজায় রেখে পরিচালিত হতে পারবে।

আমরা যদি সত্যিকারের উদ্ভাবনী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং দক্ষ মানবসম্পদনির্ভর জাতি গঠনে আগ্রহী হই, তবে উচ্চশিক্ষায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি ও সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের এই অভিযাত্রায় নির্ভরযোগ্য অংশীদার, যারা প্রতিনিয়ত দেশের অর্থনীতি, গবেষণা ও সামাজিক অগ্রগতিতে অবদান রাখছে।

একটি জাতি যখন শিক্ষায় বিনিয়োগ করে, তখন তা কেবল ভবিষ্যতের পুঁজি হিসেবেই নয়, জাতির আত্মপরিচয় ও সক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাই সময় এসেছে শিক্ষায় আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির পথে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার। রাষ্ট্রের উচিত শিক্ষা খাতে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া—চাপ নয়, সহযোগিতাই হোক শিক্ষানীতির মূলমন্ত্র।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত