সম্পাদকীয়

মাইলস্টোন ট্রাজেডি: আমরা কি মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছি?

অহিদুজ্জামান
অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ জুলাই ২২ ১২:৪৯:০৭
মাইলস্টোন ট্রাজেডি: আমরা কি মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছি?

মাইলস্টোন স্কুলের ভয়াবহ ট্রাজেডি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়; এটি আমাদের জাতিগত মানবিকতার গভীর সংকটকেই সামনে নিয়ে এসেছে। মৃত্যু, আতঙ্ক, কান্না আর বিভ্রান্তির চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন—আমরা কি আর মানুষ হিসেবে ভাবতে পারি?

দুর্ঘটনা পৃথিবীর যেকোনো দেশে ঘটতে পারে, এমনকি উন্নত দেশেও। কিন্তু কোনো জাতি কতটা প্রস্তুত ছিল, কতটা সংবেদনশীল ছিল, সেটিই নির্ধারণ করে একটি দুর্ঘটনা কীভাবে ট্র্যাজেডিতে রূপ নেয়। আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, এটা সত্যি। কিন্তু আরও বড় সত্য হলো, এই প্রস্তুতির অভাব শুধু প্রযুক্তিগত বা কাঠামোগত ছিল না, ছিল হৃদয়ের অভাব, ছিল মনুষ্যত্বের অভাব।

ঘটনার পরপরই কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে জানা যায়, জ্বলন্ত ভবন থেকে যখন একে একে শিশু-কিশোররা বের হয়ে আসছিল, তখন চারপাশে শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, কাচ নামানো, ফোন বের করা, ভিডিও করার জন্য। কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। কেউ তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায়নি। কিছু সিএনজি চালক বরং এই ভয়াবহ মুহূর্তেও ভাড়া বাড়িয়ে ২০০ টাকার জায়গায় ১০০০ টাকা নিচ্ছিলেন। এমনকি ৩০ টাকার রিকশা ভাড়া হয়ে যায় ১০০ টাকা। এই কি আমাদের মূল্যবোধ?

উদ্ধার অভিযানে যখন সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ বাহিনী নামে, তখন সহায়তার বদলে কিছু জনতা বাধা সৃষ্টি করে, বাকবিতণ্ডা ও বিশৃঙ্খলা শুরু করে। আর কিছু মানুষ ভিডিও বা ছবি তোলার জন্য এতটাই উদগ্রীব হয়ে পড়ে যে, উদ্ধার কাজে সহযোগিতার বদলে তারা হয়ে ওঠে একজন নির্লজ্জ দর্শক। কেউ কেউ তো কেবল মুঠোফোনের স্ক্রিনে ভিউয়ের আশায় ছুটেছে, জীবন রক্ষার দিকে ফিরেও তাকায়নি। অথচ এই সময়টাতেই তো মানবতা পরীক্ষার আসল মুহূর্ত।

সব অন্ধকারের মধ্যেও আলোর কিছু রেখা ছিল। হাতে গোনা কিছু মানুষ, যারা নিজের জীবন বাজি রেখে ছোট ছোট শিশুদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা প্রমাণ করেছেন, মানবিকতা এখনও পুরোপুরি মারা যায়নি।

এরপর নজর দিই হাসপাতালে। যেখানে শিশুগুলোর দরকার ছিল সংক্রমণমুক্ত শান্ত পরিবেশে চিকিৎসা, সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের শোডাউন শুরু হয়। শত শত কর্মী নিয়ে নেতারা হাসপাতালে ঢুকেছেন, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন, ভিডিও করেছেন। উপদেষ্টারাও তার ব্যতিক্রম নন। কেউ কেউ ভিডিও করছেন, ছবি তুলছেন। অথচ এই শিশুদের দরকার ছিল নিবিড় চিকিৎসা ও শান্ত পরিবেশ। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও শুরুতে কোনো নির্ধারিত হেল্পডেস্ক বা তথ্যকেন্দ্র ছিল না।

পরে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার মুখে কিছু বড় রাজনৈতিক দল মেডিকেল টিম পাঠায় এবং হেল্প ডেস্ক খোলে। তবে সেটা কি দায় এড়ানোর জন্য, নাকি প্রকৃত সহানুভূতি থেকে?

সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিভ্রান্তি, অশ্লীলতা আর গুজবের বাজার গরম। কেউ এআই দিয়ে বানানো মিথ্যা ভিডিও ছড়াচ্ছে, কেউ গুজব রটাচ্ছে, কেউ আবার বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সুযোগ বানাচ্ছে। এমনকি প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্তলাল নামকে ঘিরেও চলছে অতিনাটকীয় উপস্থাপন, যেন তিনি একাই পুরো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতেন।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। শিক্ষা উপদেষ্টাও পরীক্ষার সময় স্থগিত করার বিষয়ে প্রথমে গড়িমসি করেছেন। এসব কি কেবল দায়সারা দায়িত্বহীনতা, নাকি এর পেছনে গভীর উদাসীনতা লুকিয়ে আছে?

লাশের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। তবে যেসব শিশু ৩০ শতাংশের বেশি দগ্ধ, চিকিৎসকরা বলছেন, আগামী কয়েকদিনে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। আমরা এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যা নিঃসন্দেহে স্মরণকালের ভয়াবহতম বিপর্যয়। আহত ও নিহতদের পরিবার চরম ট্রমার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এরপর কী? কয়েকদিন পর হয়তো সবকিছু আবার ‘স্বাভাবিক’ হয়ে যাবে। মিডিয়ার আগ্রহ কমবে, ফেসবুক পোস্ট কমে যাবে, হ্যাশট্যাগ বদলে যাবে। কিন্তু আমাদের ভঙ্গুর রাষ্ট্র কাঠামো থাকবে অপরিবর্তিত। মানবিকতার প্রশ্নটিও থেকে যাবে অনুত্তরিত।

আরেকটি দুর্ঘটনা আসবে। আবার মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবে। কেউ ভিডিও করবে, কেউ ট্রল বানাবে। কেউ রিকশা ভাড়া বাড়াবে, কেউ পকেট ভারি করবে। আর আমাদের মানবিকতা? সেটা থাকবে হয়তো প্রোফাইল পিকচারে কালো ব্যাজ হয়ে, কিংবা একদিনের সহানুভূতির পোস্টে।

আমরা কি মানুষ হিসেবে আরও এক ধাপ নিচে নেমে যাচ্ছি? এই প্রশ্নটাই আজ আমাদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

-লেখক মো. অহিদুজ্জামান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম "সত্য নিউজ"-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

লেনদেনের শীর্ষ দশে যেসব শেয়ার

লেনদেনের শীর্ষ দশে যেসব শেয়ার

সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবস সোমবার (২১ জুলাই) দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন ছিল কিছুটা চাঙা। এই দিনে লেনদেনের... বিস্তারিত