ভাষান্তর
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ পর্বের প্রথমাংশ: কমিউনিজমের নীতিমালা (১-১০)

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der Kommunistischen Partei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এই এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে আমরা এর ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আজ আমরাচতুর্থ তথা শেষপর্বের প্রথমাংশে কমিউনিজমের নীতিমালারঐতিহাসিকপ্রক্ষাপট ও কমিউনিজমের নীতিমালার ১ থেকে ১০ প্রশ্নোত্তর পর্বসরল, পরিশীলিত ও ব্যাখ্যামূলক ভাষান্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি। আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।
কমিউনিজমের নীতিমালা (The Principles of Communism): ঐতিহাসিকপ্রক্ষাপট
১৮৪৭ সালে এঙ্গেলস কমিউনিস্ট লীগ-এর জন্য দুটি খসড়া কর্মসূচি রচনা করেন, উভয়টিই ‘প্রশ্নোত্তরমূলক ধর্মোপদেশ’ (catechism)-এর আকারে। প্রথমটি লেখেন জুন মাসে, এবং দ্বিতীয়টি অক্টোবর মাসে।পরবর্তীকালের দলিলটি, যা The Principles of Communism নামে পরিচিত, সর্বপ্রথম ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়।
এর আগে লেখা দলিলটি—Draft of the Communist Confession of Faith—অনুসন্ধানকারীদের হাতে আসে অনেক পরে, ১৯৬৮ সালে। এটি প্রথমবার প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, হামবুর্গে, Gründungs Dokumente des Bundes der Kommunisten (Juni bis September 1847) [কমিউনিস্ট লীগের প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত দলিলপত্র, জুন থেকে সেপ্টেম্বর ১৮৪৭] শিরোনামে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায়, যেখানে ঐতিহাসিক প্রথম কংগ্রেসের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও চারটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৮৪৭ সালের জুন মাসে “লীগ অব দ্য জাস্ট”-এর কংগ্রেসে (যা একাধারে কমিউনিস্ট লীগের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনও ছিল), সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে একটি খসড়া ‘বিশ্বাসস্বীকারোক্তি’ প্রস্তুত করে তা লীগ-এর বিভিন্ন শাখায় আলোচনার জন্য পাঠানো হবে।সম্প্রতি আবিষ্কৃত দলিলটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই সেই মূল খসড়া দলিল।
এই দুটি দলিলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, Principles of Communism হলো পূর্ববর্তী খসড়াটির একটি সংশোধিত ও পরিশীলিত সংস্করণ।
এই নতুন কর্মসূচির খসড়ায় এঙ্গেলস তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেননি, বরং দুটি জায়গায় তিনি “unchanged” (জার্মান ভাষায় “bleibt”) বলে মন্তব্য করেছেন—যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে তিনি পূর্ববর্তী খসড়ার উত্তরের সঙ্গে ঐ প্রশ্নগুলোকে অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।এই নতুন খসড়া কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন এঙ্গেলস, প্যারিসের কমিউনিস্ট লীগ-এর শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ অনুযায়ী। এই নির্দেশনা আসে ২২ অক্টোবর ১৮৪৭ তারিখে অনুষ্ঠিত কমিটি সভায়, যেখানে এঙ্গেলস “ট্রু সোশ্যালিস্ট” মোজেস হেস প্রণীত একটি কর্মসূচির খসড়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন এবং পরবর্তীতে সেটি বাতিল করা হয়।
যদিও Principles of Communism কে একটি অন্তর্বর্তী খসড়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল, তবুও ২৩–২৪ নভেম্বর ১৮৪৭ তারিখে মার্কসকে লেখা চিঠিতে এঙ্গেলস মত দেন যে পুরোনো ‘প্রশ্নোত্তর কাঠামো’ (catechistic form) পরিত্যাগ করা উচিত এবং এর পরিবর্তে একটি কর্মসূচি ঘোষণাপত্র বা Manifesto আকারে প্রণয়ন করা উচিত।
১৮৪৭ সালের ২য় কংগ্রেসে (২৯ নভেম্বর–৮ ডিসেম্বর), মার্কস ও এঙ্গেলস কমিউনিজমের মৌলিক বৈজ্ঞানিক নীতিমালার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এবং তাঁরা যৌথভাবে কমিউনিস্ট পার্টির জন্য একটি ঘোষণা আকারে কর্মসূচি লেখার দায়িত্ব পান।এই ঘোষণাপত্র রচনার সময় তাঁরা Principles of Communism-এ প্রণীত বিভিন্ন বক্তব্য ও ধারণা ব্যবহার করেন।
কমিউনিজমের নীতিমালা (The Principles of Communism)
১। কমিউনিজম কী?
-কমিউনিজম হলো প্রলেতারিয়েত শ্রেণির মুক্তির শর্তাবলির তত্ত্ব।
২। প্রলেতারিয়েত কী?
প্রলেতারিয়েত হলো সেই শ্রেণি, যাদের জীবিকা একমাত্র নির্ভর করে তাদের নিজ শ্রমশক্তি বিক্রির ওপর। এই শ্রেণির নিজের কোনো উৎপাদন উপকরণ নেই, নেই জমি, যন্ত্র, কিংবা মূলধন। তারা পুঁজির কোনো অংশীদার নয়; বরং সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল শ্রমবাজারের অস্থির চাহিদার ওপর।
এই শ্রেণির জন্য জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গ—সুখ-দুঃখ, নিরাপত্তা-অনিশ্চয়তা, এমনকি জীবন-মৃত্যুর হিসাব—সবকিছু নির্ধারিত হয় অর্থনীতির চক্র, পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ এবং পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার শীতল বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে। যখন কাজ আছে, তখন বেঁচে থাকা সম্ভব। যখন কাজ নেই, তখন অনাহার, অভাব আর অদৃষ্টের সঙ্গে লড়াই—এই হলো প্রলেতারিয়েত জীবনের নির্মম সত্য।
এই শ্রেণি কোনো স্থিতিশীলতায় বিশ্বাস করতে পারে না, কারণ তার জীবনের ভিত্তি—শ্রম—নিজেই এক অস্থির পণ্য। এদের কাছে ভবিষ্যৎ মানে অনিশ্চয়তা; এবং বর্তমান মানে টিকে থাকার এক ক্লান্তিকর সংগ্রাম।
এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা উনবিংশ শতাব্দীতে প্রথম স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়, যখন শিল্পবিপ্লবের ফলে শহুরে প্রলেতারিয়ানের উদ্ভব ঘটে। পুঁজিবাদ তার আধিপত্য কায়েম করে এবং উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিটি শাখা চলে যায় বড় পুঁজির হাতে। এর ফলেই একদিকে যেমন গড়ে ওঠে শোষণ-নির্ভর বুর্জোয়া শ্রেণি, অন্যদিকে গড়ে ওঠে উৎপাদনের মৌলিক শক্তি—প্রলেতারিয়েত।
সংক্ষেপে, প্রলেতারিয়েত হলো সেই শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী, যারা সমাজের চাকা ঘোরাতে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে, কিন্তু সবচেয়ে কম ভোগ করে। তাদের অস্তিত্ব শুধু কর্মজীবনের সঙ্গে নয়, বরং পুঁজির বিকাশ ও সংকোচনের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। তাই প্রলেতারিয়েত শুধুই একটি শ্রেণি নয়; এটি এক রাজনৈতিক অবস্থান, এক দার্শনিক সত্তা, এক বিপ্লবী সম্ভাবনা।
৩। তাহলে কি প্রলেতারিয়েত শ্রেণি সর্বদা বিদ্যমান ছিল?
-না।দারিদ্র্যপীড়িত ও শ্রমজীবী শ্রেণি সর্বদা ছিল, এবং শ্রমজীবীরাই অধিকাংশ সময় দরিদ্র ছিল।কিন্তু পূর্বে কখনোই এমন পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষ বাঁচেনি যেভাবে আজকের দিনে প্রলেতারিয়েত বাঁচছে।অর্থাৎ, অতীতে সর্বদা প্রলেতারিয়েত ছিল না, ঠিক তেমনি করে অতীতে সর্বদা অবাধ ও লাগামহীন প্রতিযোগিতাও ছিল না।
৪। প্রলেতারিয়েত শ্রেণির উদ্ভব কীভাবে ঘটল?
-প্রলেতারিয়েত শ্রেণির উৎপত্তি ঘটে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে, যা প্রথম শুরু হয় ইংল্যান্ডে, গত (অষ্টাদশ) শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে।পরবর্তীকালে তা বিশ্বের সকল সভ্য দেশে পুনরাবৃত্ত হয়।এই শিল্পবিপ্লব সূচিত হয়েছিল স্টিম ইঞ্জিন, বিভিন্ন ধরনের সুতা কাটা যন্ত্র, যান্ত্রিক তাঁত, এবং আরও বহু প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের মাধ্যমে।এই যন্ত্রগুলো ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কেবল ধনী মূলধনীরাই তা কিনতে পারত।যন্ত্রগুলো উৎপাদনের পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে রূপান্তর করে ফেলে এবং আগেকার শ্রমিকদের স্থান দখল করে নেয়,কারণ যন্ত্রের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন হতো অধিক দ্রুত এবং অধিক উন্নতমানের, যা তখনকার শ্রমিকদের অদক্ষ চাকা ও হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে সম্ভব ছিল না।ফলে শিল্প সম্পদ পুরোপুরি ধনী মূলধনীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং শ্রমিকদের সামান্য যা কিছু সম্পত্তি ছিল—যেমন হাতিয়ারের জিনিসপত্র, তাঁত ইত্যাদি—তাসম্পূর্ণভাবে মূল্যহীন হয়ে পড়ে।এইভাবে মূলধনীদের হাতে সবকিছু জমা হতে থাকে এবং শ্রমিকদের হাতে কিছুই থাকে না।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বস্ত্রশিল্পে কারখানা-ভিত্তিক উৎপাদনপদ্ধতিরসূচনা ঘটে।একবার যন্ত্র ও কারখানা-ভিত্তিক উৎপাদনের প্রবর্তন শুরু হলে, তাদ্রুত অন্যান্য শিল্পে ছড়িয়ে পড়ে—বিশেষ করে কাপড় ও বই ছাপানো, কুমারশিল্প এবং ধাতুশিল্পে।
শ্রমকে ধাপে ধাপে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলা হয়, যাতে করে পূর্বে যে শ্রমিক সম্পূর্ণ একটি কাজ করতেন, এখন তিনি কেবল একটি অংশবিশেষই তৈরি করেন।
এই শ্রমবিভাজন উৎপাদনকে দ্রুততর ও সাশ্রয়ী করে তোলে।শ্রমিকের কাজ সীমিত হয়ে দাঁড়ায় যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির মাঝে, যা শেষমেশ যন্ত্র দিয়ে আরও ভালোভাবে করা সম্ভব হয়ে ওঠে।
এইভাবে একের পর এক শিল্প শাখা যন্ত্র, স্টিম ও কারখানাব্যবস্থার অধীনতায় চলে আসে—যেমনটা ইতিপূর্বে সুতা ও তাঁত শিল্পে ঘটেছিল।একই সঙ্গে এই শিল্পগুলো বড় মূলধনীদের দখলে চলে যায় এবং শ্রমিকরা তাদের শেষ স্বাধীনতার চিহ্নটুকুও হারায়।ধীরে ধীরে কেবল আসল ‘ম্যানুফ্যাকচার’ বা উৎপাদন ব্যবস্থা নয়, হস্তশিল্পও চলে আসে কারখানার আওতায়।
বড় মূলধনী শ্রেণি ক্রমশ ছোট ছোট কারিগর ও কারুশিল্পীদের স্থান দখল করে নেয় বিশাল কর্মশালা স্থাপনের মাধ্যমে—যা ব্যয় সাশ্রয়ী এবং শ্রমবিভাজনকে আরও জটিলভাবে বাস্তবায়ন করে।
এইভাবে আমরা এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছি যেখানে সভ্য দেশগুলোর প্রায় সব ধরনের শ্রমই এখন কারখানাভিত্তিক।এবং প্রায় সব কাজেই হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচার পরিত্যক্ত হয়েছে।এইপ্রক্রিয়াপুরাতনমধ্যবিত্তশ্রেণিকে, বিশেষতছোটছোটহস্তশিল্পীদের, ব্যাপক ভাবেধ্বংসকরেছে।এটি শ্রমিক শ্রেণির অবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছে এবং এর ফলে গড়ে উঠেছে দুটি নতুন শ্রেণি, যারা ধীরে ধীরে সকল পুরাতন শ্রেণিকে গ্রাস করছে।এই দুটি শ্রেণি হলোঃ
(১) বড় মূলধনীর শ্রেণি, যারা সকল সভ্য দেশে প্রায় একচেটিয়া মালিক হয়ে উঠেছে জীবনের উপকরণ এবং যেসব যন্ত্র ও উপকরণ (যেমনঃ যন্ত্রপাতি, কারখানা) দরকার এসব উৎপাদনের, সেগুলোর।এই শ্রেণিই হলো বুর্জোয়া শ্রেণি বা বুর্জোয়াজি।
(২) সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব একটি শ্রেণি, যাদের বেঁচে থাকার জন্য তাদের শ্রম বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে বিক্রি করতে হয়, যাতে তারা বিনিময়ে জীবনের উপকরণ পায়।এই শ্রেণিই হলো প্রলেতারিয়েত শ্রেণি বা প্রলেতারিয়ানস।
৫। প্রলেতারিয়েতরা বুর্জোয়ার কাছে যে শ্রম বিক্রি করে, তা কী শর্তে বিক্রি করে?
-শ্রম, অন্যান্য পণ্যের মতোই, একটি বাণিজ্যিক পণ্য। সুতরাং, এর মূল্য নির্ধারিত হয় সেই একই অর্থনৈতিক নীতিমালার ভিত্তিতে, যা অন্য সকল পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বৃহৎ শিল্পব্যবস্থা অথবা অবাধ প্রতিযোগিতার পরিস্থিতিতে—যা কার্যত একই ফলাফল সৃষ্টি করে—পণ্যের গড় মূল্য নির্ধারিত হয় সেই পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় ব্যয়ের সমতুল্যে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, শ্রমের মূল্যও নির্ধারিত হয় শ্রম উৎপাদনের ব্যয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু শ্রম উৎপাদনের ব্যয় বলতে বোঝানো হয় এমন পরিমাণ জীবিকা ও উপকরণ, যা একজন শ্রমিককে শ্রমশক্তি ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট এবং একই সঙ্গে গোটা শ্রমজীবী শ্রেণিকে প্রজনন ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, শ্রমিক তার শ্রমের বিনিময়ে যা পায়, তা কেবলমাত্র জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট—তার বেশি নয়। শ্রমের মূল্য, বা মজুরি, এই ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহের মানদণ্ডেই স্থির থাকে।
তবে বাস্তবতায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভিন্নতা অনুসারে এই মজুরি কখনো কিছুটা বাড়ে, আবার কখনো কমে। ব্যবসার ভালো সময়ে শ্রমিক তুলনামূলকভাবে বেশি মজুরি পেতে পারে, আর মন্দাবেলায় তা হ্রাস পায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, দীর্ঘমেয়াদে, শ্রমিক গড় হিসেবে তার ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহের চাহিদার অতিরিক্ত কিছুই পায় না—ঠিক যেমনভাবে পুঁজিপতি তার পণ্যের প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের বাইরে স্থায়ীভাবে লাভ বা ক্ষতির মুখোমুখি হয় না। এই মজুরি নির্ধারণের অর্থনৈতিক আইন বিশেষত তখনই সবচেয়ে কঠোরভাবে প্রয়োগযোগ্য হয়ে ওঠে, যখন বৃহৎ শিল্পব্যবস্থা সমাজের সমস্ত উৎপাদন খাতকে ধীরে ধীরে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে শুরু করে।
৬। শিল্পবিপ্লবের পূর্বে শ্রমজীবী শ্রেণির প্রকৃতি কেমন ছিল?
-সমাজের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমজীবী শ্রেণির অবস্থান ও ভূমিকার রূপান্তর ঘটেছে প্রতিনিয়ত। ভিন্ন ভিন্ন যুগে এবং ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই শ্রেণি নিজেকে আবিষ্কার করেছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে—কখনো দাস, কখনো সেরফ, আবার কখনো ক্ষুদ্র উৎপাদক হিসেবে।
প্রাচীন যুগে শ্রমজীবীরা ছিল মূলত দাস, যারা ছিল ব্যক্তি সম্পত্তির অংশ। গ্রীস ও রোমের দাসপ্রথা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই রীতির ধারা এখনো কিছু পশ্চাৎপদ সমাজে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলেও অতীতে টিকে ছিল। দাসরা সম্পূর্ণরূপে তাদের প্রভুদের অধীন ছিল এবং তাদের শ্রমের বিনিময়ে তারা কোনো ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা সামাজিক মর্যাদা লাভ করত না।
মধ্যযুগে, এই দাসপ্রথা ধীরে ধীরে রূপ নেয় সেরফ ব্যবস্থায়। তখনকার ইউরোপীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজে শ্রমজীবীরা ভূমির সঙ্গে আবদ্ধ সেরফে পরিণত হয়। তারা ছিল জমির মালিক বা অভিজাতদের কর্দমভূক্ত, যারা জমি চাষ করত এবং তার বিনিময়ে অতি সামান্য জীবিকা ও আশ্রয়ের অধিকার পেত। আজও হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং রাশিয়ার কিছু অংশে এই ব্যবস্থার চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে।
শিল্পবিপ্লবের আগ পর্যন্ত শহরাঞ্চলে শ্রমজীবী শ্রেণি ছিল মূলত হস্তশিল্পী ও ‘জার্নিম্যান’ (journeymen)। এরা ক্ষুদ্র মালিকানাধীন কারখানা বা দোকানে কাজ করত এবং সাধারণত একজন কারিগরের অধীনে থেকে পেশাগত দক্ষতা অর্জন করত। তারা এক ধরনের আধা-স্বাধীন কর্মী ছিল, যাদের নির্দিষ্ট মজুরি বা আয় থাকত না, বরং কাজের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত।
পরবর্তীতে যখন ‘ম্যানুফ্যাকচার’ বা বৃহৎ হস্তশিল্প ভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন এই ‘জার্নিম্যান’-রাই পরিণত হয় ম্যানুফ্যাকচারিং শ্রমিকে। এ পর্যায়ে তারা ক্ষুদ্র পুঁজির মালিকদের পরিবর্তে বৃহৎ পুঁজিপতিদের অধীনে শ্রম প্রদান করতে থাকে। এই রূপান্তরের মধ্য দিয়েই আধুনিক প্রলেতারিয়েত শ্রেণির ভিত্তি তৈরি হতে থাকে, যা শিল্পবিপ্লবের পূর্ণ বিকাশের মধ্য দিয়ে একটি সংগঠিত ও বৃহৎ শ্রমজীবী শ্রেণিতে পরিণত হয়।
৭। প্রলেতারিয়ানরা কিভাবে দাসদের থেকে আলাদা?
-দাসত্ব ও প্রলেতারিয়ান অবস্থার মধ্যে রয়েছে এক মৌলিক পার্থক্য। দাস একবারেই বিক্রি হয়—চূড়ান্তভাবে এবং স্থায়ীভাবে—একজন প্রভুর মালিকানায়। অপরদিকে, প্রলেতারিয়ান প্রতিদিন, এমনকি প্রতি ঘণ্টায়, নিজের শ্রম শক্তিকে বারবার বিক্রি করতে বাধ্য হয়, কারণ তার কাছে পুঁজি নেই—শুধু শ্রমই তার পণ্য।
একজন দাস যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো প্রভুর মালিকানাধীন, সেই প্রভু তার জীবনধারণের ন্যূনতম নিশ্চয়তা প্রদান করে, অন্তত তার স্বার্থে। দাস দুর্দশাগ্রস্ত হলেও তার বেঁচে থাকার একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি থাকে, কারণ প্রভুর অর্থনৈতিক কল্যাণ সেই দাসের টিকে থাকার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অপরদিকে, একজন প্রলেতারিয়ানের শ্রম কেবল তখনই কেনা হয়, যখন কোনো পুঁজিপতির তার প্রয়োজন হয়। ফলে তার জীবনের কোনো স্থায়ী নিরাপত্তা নেই—সে নিছক বাজারে বিক্রয়ের যোগ্য একটি মানবসম্পদ মাত্র।
দাস প্রতিযোগিতার বাইরে থাকে। তার অবস্থান স্থির, নির্ধারিত। কিন্তু প্রলেতারিয়ান প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার মধ্যে অবস্থান করে—অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে, মেশিনের সঙ্গে, বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে। এই প্রতিযোগিতা তাকে এক অস্থির ও অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়।
সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে দাস সমাজে নিছক একটি 'সম্পত্তি' হিসেবে বিবেচিত হতো, একজন পূর্ণাঙ্গ নাগরিক বা ব্যক্তি হিসেবে নয়। অথচ প্রলেতারিয়ান একটি 'উচ্চতর' সামাজিক কাঠামোর অংশ হলেও, বাস্তবে তার জীবনদশা অনেক সময়ই একজন দাসের চেয়ে দুর্বিষহ হতে পারে। তার স্বাধীনতা কেবল কাগজে-কলমে, কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সে বুর্জোয়ার আধিপত্যেই বন্দী।
আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো—দাস মুক্ত হয় যখন সে কেবল দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হওয়ার মাধ্যমে প্রলেতারিয়ান শ্রেণিতে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রলেতারিয়ানের মুক্তি আরও গভীরতর—তাকে শুধু নিজের দারিদ্র্য বা নির্ভরতাকে অস্বীকার করলেই চলবে না, তাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণি ও প্রতিযোগিতার গোটা কাঠামোকেই বিলুপ্ত করতে হবে।
৮। প্রলেতারিয়ানরা সেরফদের থেকে কিভাবে আলাদা?
সেরফ বা ভূমিদাস মূলত জমির সঙ্গে যুক্ত এক রূপের শ্রমজীবী, যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান দাসের চেয়ে কিছুটা উন্নত। সেরফ জমির মালিকের অধীনে থেকে তার জমি চাষ করত এবং বিনিময়ে ফসলের একটি অংশ কিংবা শ্রমসেবা প্রদান করত। সে জমির কিছু ব্যবহারিক অধিকার উপভোগ করত এবং সাধারণত সেই ভূমিতে তার বসবাস ও জীবিকা নিশ্চিত থাকত।
প্রলেতারিয়ান কিন্তু এমন নয়। সে কাজ করে এমন একটি উৎপাদন ব্যবস্থায়, যেখানে উৎপাদনের সব উপকরণই অন্য কারো মালিকানায়। সে কেবল নিজের শ্রম বিক্রি করে এবং তার বিনিময়ে সামান্য মজুরি পায়। এখানে জমির মালিকানার কোনো অংশীদারিত্ব নেই, নেই কোনো টেকসই নিরাপত্তা বা সামাজিক বন্ধন।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, সেরফের অবস্থা কিছু ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। তার জীবিকা, সীমিত হলেও, অন্তত নির্ভরযোগ্য। প্রলেতারিয়ানের জীবনে সেই নিশ্চয়তা অনুপস্থিত। তার স্থায়ী কর্মসংস্থান নেই, নেই জমি, ঘর কিংবা উৎপাদনের অন্য কোনো নিয়ন্ত্রণ।
সেরফ প্রতিযোগিতার বাইরে থাকে। সে নির্দিষ্ট জমিতে নির্দিষ্ট কর প্রদান করে টিকে থাকে। প্রলেতারিয়ান এর সম্পূর্ণ বিপরীত—তার বেঁচে থাকাটাই নির্ভর করে শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ওপর।
সেরফ তিনটি উপায়ে মুক্তি লাভ করতে পারে:
১. শহরে পালিয়ে গিয়ে সে হস্তশিল্পী বা শহুরে শ্রমিক হয়ে উঠতে পারে;২. প্রভুকে কর বা শ্রম না দিয়ে নগদ অর্থ প্রদান করে মুক্ত প্রজায় রূপান্তরিত হতে পারে;৩. কিংবা প্রভুকে উৎখাত করে নিজেই জমির মালিক হতে পারে।
উপরোক্ত প্রতিটি পথেই সে পরিণত হয় এক প্রকার ‘ক্ষুদ্র মালিক’-এবং সেই অনুযায়ী প্রতিযোগিতার অংশে পরিণত হয়। অন্যদিকে, প্রলেতারিয়ানের মুক্তি একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। সে মুক্ত হয় তখনই, যখন সে প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণিভিত্তিক সামাজিক কাঠামোকেই বিলুপ্ত করে দেয়।
৯। প্রলেতারিয়ানরা হস্তশিল্পীদের থেকে কীভাবে আলাদা?
-প্রলেতারিয়ানদের সঙ্গে তথাকথিত হস্তশিল্পীদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে—এটি শুধু পেশাগত নয়, বরং শ্রেণিগত এবং মনস্তাত্ত্বিকও। হস্তশিল্পী, বিশেষ করে যিনি আঠারো শতকে সর্বত্র বিদ্যমান ছিলেন এবং এখনও কোথাও কোথাও টিকে আছেন, তাঁকে সর্বোচ্চ মাত্রায় একজন 'সাময়িক' প্রলেতারিয়ান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাঁর লক্ষ্য প্রলেতারিয়ানদের মতো নিছক শ্রম বিক্রি করে টিকে থাকা নয়; বরং নিজের পুঁজি জমিয়ে ভবিষ্যতে অন্য শ্রমিকদের শোষণকারী বুর্জোয়া শ্রেণিতে প্রবেশ করাই তাঁর আকাঙ্ক্ষিত অবস্থা।
এই হস্তশিল্পী সাধারণত তখনই তার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হন, যখন তারা একটি গিল্ড বা কারুশিল্প সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত থাকেন, যেখানে প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং কারখানাভিত্তিক উৎপাদনের আধিপত্য এখনো শুরু হয়নি। এই অবস্থা তাদের স্বাধীনতা ও সীমিত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সুযোগ দেয়।
কিন্তু একবার যখন উৎপাদনে কারখানা-পদ্ধতির প্রবেশ ঘটে, আর বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন এই হস্তশিল্পী নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেন না। পুঁজির দখল, উৎপাদন দক্ষতা এবং বাজার কাঠামোর প্রতিযোগিতায় তিনি ক্রমশ পিছিয়ে পড়েন এবং এক সময় তিনিও প্রলেতারিয়ানের সারিতে এসে পড়েন—নিজের শ্রম বিক্রির বাইরে আর কোনো বিকল্প তাঁর হাতে থাকে না।
সুতরাং, হস্তশিল্পীর ভবিষ্যৎ মূলত তিনটি পথে গড়ে উঠতে পারে:
১। তিনি সফলভাবে পুঁজি সঞ্চয় করে একজন ক্ষুদ্র বুর্জোয়ায় পরিণত হন—এটি একটি সম্ভাব্য, তবে সীমিত পথ।
২। তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তরণ ঘটান—বিশেষত উচ্চ দক্ষতা বা কৌশল থাকলে।
৩। অথবা—এটাই সবচেয়ে সাধারণ ও আধুনিক বাস্তবতা—তীব্র প্রতিযোগিতার চাপে পড়ে তিনি প্রলেতারিয়ানে পরিণত হন, একজন বেতননির্ভর শ্রমজীবীতে রূপান্তরিত হন।
এই শেষ পর্যায়ে এসে তিনি যদি সচেতন হন এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেন, তবে তাঁর সামনে খুলে যায় মুক্তির নতুন দ্বার—তিনি কমিউনিস্ট বা প্রলেতারিয়ান আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এই শোষণমূলক কাঠামোর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে পারেন। এই সংগ্রাম তখন আর শুধু তার ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য নয়, বরং গোটা প্রলেতারিয়ান শ্রেণির মুক্তির অংশ হয়ে ওঠে।
১০। প্রলেতারিয়ানরা 'ম্যানুফ্যাকচারিং' শ্রমিকদের থেকে কীভাবে আলাদা?
-'ম্যানুফ্যাকচারিং' যুগের শ্রমিকরা—যাদের আমরা ষোড়শ থেকে আঠারো শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে দেখতে পাই—মূলত একটি ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন পুঁজির প্রাথমিক স্তরে অন্তর্ভুক্ত শ্রমিক, যাঁদের জীবন ছিল আধা-স্বাধীন এবং যাঁরা নিজেদের উৎপাদন উপকরণের ওপর আংশিকভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারতেন।
এই শ্রমিকদের অধিকাংশেরই ছিল নিজস্ব তাঁত, পরিবারের ব্যবহৃত সুতা কাঁটার চাকা, এমনকি অবসরে নিজ চাহিদা মেটানোর মতো ছোট একটি জমির মালিকানাও। তাঁরা কেবলমাত্র শ্রম বিক্রেতা ছিলেন না; তারা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র উৎপাদকও। পুঁজি তখনও তাঁদের কাছ থেকে পুরোপুরি শ্রমের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়নি।
অন্যদিকে, আধুনিক প্রলেতারিয়ান—বিশেষ করে শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের শহরভিত্তিক শ্রমজীবী—সম্পূর্ণরূপে নিজের উৎপাদনের উপকরণ হারিয়ে ফেলেছে। তাঁর না আছে জমি, না তাঁত, না সুতা কাঁটার চাকা, এমনকি অনেক সময় মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও থাকে ভাড়া করা। প্রলেতারিয়ান এখন কেবলমাত্র নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করেই বেঁচে থাকে, এবং তা করতে হয় প্রতিনিয়ত একটি প্রতিকূল প্রতিযোগিতার বাজারে।
'ম্যানুফ্যাকচারিং' যুগের শ্রমিকদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল—তাঁদের সঙ্গে মালিক বা নিয়োগকারীর সম্পর্ক অনেকাংশেই পিতৃতান্ত্রিক ছিল। এটি কখনো বন্ধুত্বপূর্ণ, কখনো করুণানির্ভর হলেও অন্তত কিছুটা মানবিক ছিল। শ্রমিকরা গ্রামে থাকতেন, একই মালিকের অধীনে কাজ করতেন বছরের পর বছর, ফলে একধরনের সামাজিক বন্ধন তৈরি হতো।
প্রলেতারিয়ানদের ক্ষেত্রে এই চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আধুনিক প্রলেতারিয়ান মূলত শহরবাসী, তাঁরা হয়তো বারবার মালিক পরিবর্তন করেন, অথবা এক মালিকের অধীনে কাজ করলেও তার সঙ্গে সম্পর্কটি একান্তই অর্থনৈতিক—ঠান্ডা, চুক্তিভিত্তিক এবং অবসান-সক্ষম। এখানে কোনো পিতৃতান্ত্রিকতা নেই; আছে কেবল শ্রমের বিনিময়ে নির্ধারিত মজুরি।
বৃহৎ শিল্প ব্যবস্থা যখন ধীরে ধীরে 'ম্যানুফ্যাকচারিং' প্রক্রিয়াকে গ্রাস করে নেয়, তখনই ঘটে এই রূপান্তর। প্রথাগত হস্তশিল্পীরা হারান নিজেদের পুঁজি, ছোটখাটো উপকরণ এবং স্বাধীনতা। ধীরে ধীরে তাঁরা রূপান্তরিত হন প্রলেতারিয়ানে—একজন নির্ভরশীল, নিরুপায়, বেতননির্ভর শ্রমজীবীতে।
এই রূপান্তর কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিকও। এটি মানবজীবনের ভেতরে গভীরতর নিঃসঙ্গতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। যেখানে এক সময় একজন শ্রমিক নিজেকে আংশিক মালিক ভাবতে পারতেন, সেখানে আজকের প্রলেতারিয়ান কেবল নিজের শ্রম বিক্রি করেই জীবনধারণ করেন—নিজের শ্রমের উৎপাদন কীভাবে ব্যবহৃত হবে, সে বিষয়ে তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
এভাবে, শিল্পায়নের বিকাশ শুধু একটি উৎপাদন প্রক্রিয়ার রূপান্তর নয়; এটি একটি শ্রেণির ভেতরের আত্মপরিচয়, জীবনের দর্শন এবং সমাজের কাঠামো বদলে দেয়।
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা: আসিফ নজরুল
- পুরুষের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: এক নীরব বাস্তবতা ও অস্বীকৃত সংকট
- আশুগঞ্জে এনসিপি কমিটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়েই তোলপাড়
- শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী দশ শেয়ার: ১৬ জুলাইয়ের আলোচিত গেইনারদের বিশ্লেষণ
- দেশের বাজারে আজকের সোনার ভরি মূল্য কত
- ১৩ জুলাই শেয়ার দর কমেছে যে ১০টি শেয়ারের
- মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যায় রিমান্ডে মুখ খুলছে আসামিরা, উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য
- বার্নেবি হোয়াইট-স্পানারের ‘Partition’: একটি পরিশীলিত পাঠপ্রতিক্রিয়া
- আজ কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন
- ছাত্রদলের উপর 'মব' চাপানোর পেছনে শিবিরের হাত: কেন্দ্রীয় নেতার অভিযোগ
- মাদারীপুর যেতে না পেরে থানায় আশ্রয় নিলেন এনসিপি নেতারা
- মিটফোর্ড খুন: চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মশাল মিছিল
- এনসিপির সংবাদ সম্মেলন: ‘আওয়ামী লীগ জঙ্গি কায়দায় হত্যাচেষ্টা চালিয়েছে’
- সমুদ্রের অতল গভীরে চীনের অভিযাত্রা: এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার অদৃশ্য রূপ ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
- ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদাম: ইরানে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তির নিখুঁত ছকের এক নারী মুখ
- শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ পর্বের প্রথমাংশ: কমিউনিজমের নীতিমালা (১-১০)
- ‘কিছু দলের আবেগী কর্মসূচি ফ্যাসিবাদকে ডাকে’—সালাহউদ্দিনের হুঁশিয়ারি
- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ‘মিস্টার অসহায়’ বললেন জামায়াত নেতা
- "ইসরায়েলি হামলা ‘অগ্রহণযোগ্য’—কঠোর বার্তা দিলেন এরদোয়ান"
- "কারাগারে ১১ মাস, এবার আদালতে নিজের অবস্থান জানালেন দীপু মনি"
- বাড়ির রান্না: পারিবারিক ঐক্য, স্বাস্থ্য ও ঐতিহ্য রক্ষার চাবিকাঠি
- "সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষার দাবিতে ঢাকায় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিক্ষোভ"
- "নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না: মির্জা ফখরুল"
- চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতা নতুন স্তরে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে: ঢাকার কর্মকর্তা
- “হামলা করেও আমাদের পদযাত্রা থামাতে পারেনি”—নাহিদ ইসলাম
- গোপালগঞ্জের সহিংসতা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশংসা করলেন আসিফ মাহমুদ
- "পরাজয় এড়াতে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে একটি ইসলামি দল"
- সেপ্টেম্বরে ট্রাম্পের পাকিস্তান সফর!
- চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি, পেয়েছি মবোক্রেসি: সালাহউদ্দিন আহমদ
- ডেভিল রানীর নির্দেশেই গোপালগঞ্জে রক্তপাত: সোহেল তাজ
- বাংলাদেশে শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনায় বিপজ্জনক মাত্রায় বিষাক্ত ধাতুর উপস্থিতি
- মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডে গুজবের নেপথ্যে জামায়াত, ক্ষমা চাওয়ার দাবি মুরাদের
- বন্ড মার্কেটে স্থবিরতা, সিকিউরিটির মূল্যে পরিবর্তন নেই!
- সাবধানতা ও বিচক্ষণতা জরুরি, বাজারে ফিরে এসেছে অনিশ্চয়তা
- লাল নিশানে ১০ শেয়ার: লাভে নয়, ক্ষতিতেই মুখ ঢাকলো বিনিয়োগকারীরা
- ১০টি শেয়ার দিল ৫%+ রিটার্ন, বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি
- গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির সুযোগ রুখতে দায়িত্বশীল কর্মসূচির আহ্বান বিএনপির
- যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় নাগরিক শিশু পর্নোগ্রাফির অভিযোগে গ্রেপ্তার
- ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে অশান্তি সৃষ্টির অভিযোগ বিএনপির
- যে কারণে আজ বন্ধ দুই ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন
- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা: আসিফ নজরুল
- পুরুষের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: এক নীরব বাস্তবতা ও অস্বীকৃত সংকট
- আশুগঞ্জে এনসিপি কমিটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়েই তোলপাড়
- শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী দশ শেয়ার: ১৬ জুলাইয়ের আলোচিত গেইনারদের বিশ্লেষণ
- দেশের বাজারে আজকের সোনার ভরি মূল্য কত
- ১৩ জুলাই শেয়ার দর কমেছে যে ১০টি শেয়ারের
- মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যায় রিমান্ডে মুখ খুলছে আসামিরা, উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য
- বার্নেবি হোয়াইট-স্পানারের ‘Partition’: একটি পরিশীলিত পাঠপ্রতিক্রিয়া
- আজ কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন
- ছাত্রদলের উপর 'মব' চাপানোর পেছনে শিবিরের হাত: কেন্দ্রীয় নেতার অভিযোগ
- মাদারীপুর যেতে না পেরে থানায় আশ্রয় নিলেন এনসিপি নেতারা
- মিটফোর্ড খুন: চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মশাল মিছিল
- এনসিপির সংবাদ সম্মেলন: ‘আওয়ামী লীগ জঙ্গি কায়দায় হত্যাচেষ্টা চালিয়েছে’
- সমুদ্রের অতল গভীরে চীনের অভিযাত্রা: এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার অদৃশ্য রূপ ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
- ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদাম: ইরানে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তির নিখুঁত ছকের এক নারী মুখ