ইতিহাস ও দর্শন

বার্লিন সম্মেলন ১৮৮৪–৮৫: আফ্রিকা বিভাজনের রাজনীতি, অর্থনীতি ও উত্তরাধিকার

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ অক্টোবর ০১ ১৩:২৩:৫০
বার্লিন সম্মেলন ১৮৮৪–৮৫: আফ্রিকা বিভাজনের রাজনীতি, অর্থনীতি ও উত্তরাধিকার

১৮৮৪-৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলন ছিল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশ বিভাজনের নিয়ম-কানুন নির্ধারণের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহাসিক সভা। এটি তথাকথিত “Scramble for Africa” বা আফ্রিকা নিয়ে দখলদারিত্বের হুড়োহুড়ির আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। এই গবেষণামূলক প্রবন্ধে বার্লিন সম্মেলনের পটভূমি ও কারণ, এতে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের উদ্দেশ্য, গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা, আফ্রিকার ভূখণ্ডের সীমারেখা ও মানচিত্রে সংঘটিত পরিবর্তন, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদে আফ্রিকার সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিতে প্রভাব, আফ্রিকান জনগণের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ, এবং সম্মেলনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও ঐতিহাসিক মূল্যায়ন আলোচনা করা হয়েছে।

সম্মেলনের পটভূমি ও কারণ

উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর দৃষ্টি আফ্রিকার বিপুল সম্পদ-সম্ভাবনার ওপর পড়ে। শিল্পবিপ্লবোত্তর ইউরোপে কাঁচামালের চাহিদা বাড়ছিল এবং আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন রবার, খনিজ, হাতির দাঁত, তুলা ইত্যাদি শিল্পোৎপাদনের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, আফ্রিকার বাজারকে ইউরোপীয় নির্মিত পণ্যের জন্য নতুন ক্রয়বাজার হিসেবে দেখা হচ্ছিল, যা ইউরোপের অর্থনৈতিক প্রাধান্য আরও সুসংহত করতে পারে। ফলে আফ্রিকা অধিকার করার অর্থনৈতিক আগ্রহ ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাড়িত করে। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে, ইউরোপীয় জাতিগুলোর মধ্যে উপনিবেশ স্থাপনে একপ্রকার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল; প্রতিটি শক্তি চাইছিল অন্যদের আগে আফ্রিকার ভূখণ্ড দখল করে প্রভাব বিস্তার করতে। বিশেষত ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে আফ্রিকার বিভিন্ন অংশ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়, এবং একইসঙ্গে জার্মানির মতো সদ্য ঐক্যবদ্ধ শক্তিও উপনিবেশ লাভে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই প্রতিযোগিতা ও পারস্পরিক সন্দেহ-ঈর্ষা আফ্রিকা নিয়ে বড় ধরনের ইউরোপীয় সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছিল।

বার্লিন সম্মেলনের প্রত্যক্ষ কারণগুলোর একটি ছিল কঙ্গো নদীবিধৌত অঞ্চল নিয়ে বিরোধ। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড ১৮৭০-এর দশক থেকেই মধ্য আফ্রিকায় বিশেষত কঙ্গো অঞ্চলে ব্যক্তিগত উপনিবেশ স্থাপনের প্রচেষ্টায় ছিলেন। লিওপল্ড ১৮৭৬ সালে কথিত মানবতাবাদী উদ্দেশ্যে International African Association প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিখ্যাত অভিযাত্রী হেনরি মর্টন স্ট্যানলিকে আফ্রিকায় পাঠান। স্ট্যানলি ১৮৭৯-১৮৮৪ সময়কালে কঙ্গো অববাহিকায় অসংখ্য চুক্তি করে বিশাল এলাকা লিওপল্ডের সংগঠনের নামে কব্জা করেন। ফরাসি গোয়েন্দারা লিওপল্ডের এই পরিকল্পনার কথা টের পেয়ে নিজেদেরও মধ্য আফ্রিকায় তৎপরতা বাড়ায়; ফরাসি গবেষক পিয়ের দ্য ব্রাজা কঙ্গো অববাহিকায় গিয়ে ব্রাজাভিল স্থাপন করে ফ্রান্সের পতাকা উড়িয়েছিলেন ১৮৮১ সালে। একইসময়ে পর্তুগালও আফ্রিকায় তার প্রাচীন প্রভাব ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয় এবং ব্রিটেনের সাথে একটি চুক্তি করে যাতে লিওপল্ডের সংগঠনটি আটলান্টিক মহাসাগরে পৌঁছুতে না পারে। এভাবে কঙ্গো অঞ্চলে বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও পর্তুগালের স্বার্থসংঘাত ইউরোপীয় পরিমণ্ডলে আলোড়ন তোলে।

১৮৮২-৮৩ সালের দিকে উত্তর আফ্রিকাতেও উত্তেজনা বাড়ছিল; ব্রিটেন সুয়েজ খাল ও মিশর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলে, যা ফ্রান্স ও জার্মানিকে ক্ষুব্ধ করে এবং তারা বিকল্প উপনিবেশের দিকে নজর দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় “আফ্রিকার জন্য হুড়োহুড়ি” সত্যিকারের রূপ নিতে শুরু করে ইউরোপের নানা দেশ প্রচণ্ড গতিতে আফ্রিকায় অভিযান চালিয়ে পতাকা গাড়া শুরু করে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে জার্মান চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক সিদ্ধান্ত নেন সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নিয়ে এক সম্মেলনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আফ্রিকা বিভাজনের নীতিমালা প্রণয়ন করবেন। লিয়োপল্ডের উদ্যোগ এবং পর্তুগালের আহ্বানে ব্রিটিশ সমর্থন নিয়ে, বিসমার্ক ১৫ নভেম্বর ১৮৮৪ তারিখে বার্লিনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডাকেন যাতে ইউরোপের প্রধান ১৩টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণ করে।

ছবি:বার্লিন সম্মেলন

সংক্ষেপে, ইউরোপের বর্ধিত ভৌত ও অর্থনৈতিক লালসা, প্রতিযোগিতামূলক সাম্রাজ্যবাদ এবং কঙ্গো ও অন্যান্য অঞ্চলে সৃষ্ট সঙ্কটই বার্লিন সম্মেলন আয়োজনের প্রধান কারণ ছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, পুরো প্রক্রিয়ায় আফ্রিকার কোনো দেশ বা নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি আফ্রিকার ভাগ্য নির্ধারণে আফ্রিকানদের সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল।

অংশগ্রহণকারী দেশসমূহ ও তাদের উদ্দেশ্য

বার্লিন সম্মেলনে ইউরোপের তেরটি রাষ্ট্র এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র মিলে মোট ১৪টি দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেনএদের মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রেট ব্রিটেন ও পর্তুগাল ইতোমধ্যেই আফ্রিকার বৃহৎ অংশে উপনিবেশ কায়েম করেছিল এবং তারাই ছিল প্রধান স্বার্থধারী শক্তিবেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড নিজের ব্যক্তিগত সংগঠন “International Congo Society” এর মাধ্যমে কঙ্গো অধিকার করার স্বীকৃতি চাইছিলেন, তাই তিনিও তার দূত প্রেরণ করেনইতালি সদ্য জাতিরাষ্ট্র হিসেবে একত্রিত হয়ে আফ্রিকায় সাম্রাজ্য স্থাপনের আশায় সম্মেলনে অংশ নেয়। এছাড়া স্পেন তার ছোটোখাটো উপনিবেশগত স্বার্থ (উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান ইকুয়েটরিয়াল গিনি অঞ্চল) রক্ষার্থে যোগ দেয়।

অন্য অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, রাশিয়া, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন-নরওয়ে (তখন একীভূত), উসমানীয় তুর্কি সাম্রাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য; তবে এদের কেউই আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনে বিশেষ সফল হয়নি বা আগ্রহী ছিল নাপ্রকৃতপক্ষে এই সাতটি রাষ্ট্র কোনো আফ্রিকীয় ভূখণ্ড নিয়ে শেষপর্যন্ত বাড়ি ফিরতে পারেনিযুক্তরাষ্ট্র নিজেই বার্লিন চুক্তির সিদ্ধান্তসমূহ মেনে চলার অধিকার সংরক্ষণ করেছিল এবং সম্মেলনের সমাপ্ত চুক্তিতে শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষরও করেনি, কারণ ঐ সময়ে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা বাড়ছিল।

প্রতিটি শক্তিরই নিজস্ব উদ্দেশ্য ও অভিলাষ ছিল। ব্রিটেন চেয়েছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে (কায়রো থেকে কেপটাউন) এক বিস্তৃত উপনিবেশী করিডোর এবং সুয়েজ খাল ও ভারতে যাওয়ার পথ সুরক্ষিত রাখতফ্রান্স পশ্চিম আফ্রিকা থেকে মধ্য আফ্রিকা হয়ে পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত সম্রাজ্য গড়ার উদ্দেশ্যে সক্রিয় ছিল এবং ব্রিটিশদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজ অবস্থান মজবুত করতে চাইছিলজার্মানি বাইসমার্কের অধীনে ইউরোপে প্রভাবশালী হলেও উপনিবেশিক দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছিল; তাই জার্মানি চেয়েছিল আফ্রিকায় নতুন অধিকার লাভের মাধ্যমে “নতুন সাম্রাজ্য” গড়ে তুলতে এবং ইউরোপীয় ভারসাম্য বজায় রাখতেপর্তুগাল তার পুরনো আফ্রিকীয় উপনিবেশ অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিক রক্ষা ও সম্প্রসারণের ফিকিরে ছিল এবং চেষ্টা করছিল আটলান্টিক থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত (পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব উপকূল) একটি পর্তুগিজ করিডোর তৈরি করতেবেলজিয়াম/লিওপল্ড মূলত ব্যক্তিগত লোভে কঙ্গোর বিশাল সম্পদ (বিশেষত রবার ও হাতির দাঁত) হাতাতে চাইছিলেন, তবে ভান ধরেছিলেন আফ্রিকাকে “সভ্য করে তোলা” ও দাসব্যবসা নির্মূলের মহান লক্ষ্য তাঁর আছেইতালি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের একটি উপনিবেশ চেয়েছিল যাতে তারা বৃহৎ শক্তির কাতারে সামিল হতে পারে; ইতালি লক্ষ্যস্থির করেছিল আফ্রিকার শিং বলে পরিচিত পূর্বাঞ্চল (বর্তমান ইথিওপিয়া/সোমালিয়া অঞ্চল), যদিও সেখানে তাদের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সীমিত সাফল্য পায়। স্পেন তুলনামূলক দুর্বল উপনিবেশবাদী শক্তি হিসেবে কিছু ছোট উপকূলীয় এলাকা (যেমন স্প্যানিশ গিনি, পশ্চিম সাহারার অংশ) ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ইত্যাদি আফ্রিকায় বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি; তারা মূলত কূটনৈতিক উপস্থাপনার অংশ হিসেবে বা তথ্য পাওয়ার জন্য সম্মেলনে অংশ নেয়। উল্লেখ্য, কোনো আফ্রিকান নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধানকে এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এমনকি দ্বীপ Zanzibar-এর সুলতান অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছিল

সার্বিকভাবে, বার্লিন সম্মেলনে যে চৌদ্দটি রাষ্ট্র উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে মাত্র অর্ধেকের আফ্রিকায় বাস্তব উপনিবেশগত স্বার্থ ছিল বা পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়বাকিরা সভায় থাকলেও আফ্রিকা বিভাজনের শেষ ফলাফলে তাদের তেমন ভূমিকা ছিল না। প্রধান চার উপনিবেশবাদী শক্তি এবং রাজা লিওপল্ডের সক্রিয় তৎপরতাই বাস্তবে আফ্রিকা মানচিত্রের ভাগ্য নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে।

সম্মেলনের মূল সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা

বার্লিন সম্মেলনের পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৫ তারিখে General Act of the Berlin Conference নামে একটি চূড়ান্ত দলিল স্বাক্ষরিত হয়। এতে ৩৮টি ধারা বা ক্লজের মাধ্যমে আফ্রিকা উপনিবেশ স্থাপনে যৌথভাবে মেনে চলার নিয়মাবলি নির্ধারণ করা হয়েছিলসম্মেলনের প্রধান সিদ্ধান্ত ও নীতিমালাসমূহের সারমর্ম নিচে উপস্থাপিত হলো:

দাসব্যবসা নিষিদ্ধকরণ: ইউরোপীয় শক্তিগুলি ঘোষণা করে যে তারা আফ্রিকা ও ইসলামি শাসকদের দ্বারা পরিচালিত দাসব্যবসা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করবে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের অধীন অঞ্চলে দাস বাণিজ্য নিষিদ্ধকরণে সম্মত হয় এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করে। (উল্লেখ্য, এটি অনেকটাই নৈতিক বৈধতা অর্জনের প্রচেষ্টা ছিল বলে মন্তব্য করেছেন সমকালীন লেখক জোসেফ কনরাড।)

কঙ্গো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ও মুক্ত বাণিজ্য: সম্মেলনে লিওপল্ডের International Congo Society কর্তৃক অধিকৃত কঙ্গো নদীবেসিনের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের দাবীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়এর ফলে ওই এলাকায় “কঙ্গো ফ্রি স্টেট” প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয় (যদিও মজার বিষয় হলো, “Congo Free State” নামটি সম্মেলনের নথিতে সরাসরি ছিল না, বরং সম্মেলন শেষে লিওপল্ড নিজেই ১ আগস্ট ১৮৮৫ থেকে নিজেকে কঙ্গো ফ্রি স্টেটের সার্বভৌম শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন)কঙ্গো ও আশপাশের বিশাল এলাকায় সব জাতির জন্য মুক্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করা হয় ১৪টি স্বাক্ষরকারী শক্তি কঙ্গো অববাহিকা, নাইজার নদীর অববাহিকা ও আফ্রিকার হ্রদ অঞ্চলে অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানোর অধিকার পেলবিশেষভাবে, সমগ্র কঙ্গো নদীবিধৌত অঞ্চলকে নিরপেক্ষ এলাকা ঘোষণা করা হয় যেখানে সকল রাষ্ট্র সমানভাবে বাণিজ্য করতে পারবে এবং যুদ্ধকালীনও এ অঞ্চলের নিরপেক্ষতা বজায় থাকবেএই মুক্ত বাণিজ্যের নীতির পেছনে উদ্দেশ্য ছিল যেন কোনো একটি দেশ সম্পূর্ণ একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে এবং সকলের জন্য বাজার উন্মুক্ত থাকে

নৌপরিবহন ও জলপথের স্বাধীনতা: চুক্তিতে নির্ধারিত হয় যে কঙ্গো ও নাইজার নদী সকল রাষ্ট্রের জাহাজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকবেঅর্থাৎ এই বড় নদীগুলোতে কোনো রাষ্ট্র একক নিয়ন্ত্রণ বসাতে পারবে না। আফ্রিকার অভ্যন্তরে যাতায়াত ও বাণিজ্যের পথ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এ জলপথগুলো আন্তর্জাতিক মুক্ত পথ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

নতুন ভূখণ্ড দখলের নিয়ম (প্রভাবক্ষেত্রের স্বীকৃতি ও “কার্যকর দখল” নীতি): সম্মেলনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত ছিল যে ভবিষ্যতে আফ্রিকার উপকূলের কোনো নতুন অংশ দখল বা কোনো অঞ্চলে সংরক্ষণ অধিকার (Protectorate) ঘোষণা করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে অবশ্যই সেই পদক্ষেপের বিষয়ে অন্য সকল স্বাক্ষরকারী শক্তিকে জানান দিতে হবেএভাবে গোপনে উপনিবেশ বানানোর পথ বন্ধ হলো এবং তথ্য বিনিময়ের বাধ্যবাধকতা এলো। তাছাড়া, কেবল নামমাত্র দাবি যথেষ্ট হবে না কার্যকর অধিকারবাকার্যকর দখল” (Principle of Effective Occupation) নিশ্চিত করতে হবেএর অর্থ, কোনো শক্তি আফ্রিকায় নতুন এলাকা দাবী করতে চাইলে তাকে ওই ভূখণ্ডে প্রকৃতপক্ষে প্রশাসন ও শাসন চালু করতে হবে, স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে চুক্তি করতে হবে এবং শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে; কেবল মানচিত্রে দাগ টেনে বা সৈনিক পাঠিয়ে পতাকা গেড়ে এলাকা দখল করা যথেষ্ট নয়এই নীতির মাধ্যমে ইউরোপীয়রা পরস্পরের মধ্যে “কাগুজে উপনিবেশ” স্থাপনের প্রতিযোগিতা এড়াতে চেয়েছিল এবং বিরোধ হলে বিচার করতে পারবে এমন একটি মানদণ্ড পেয়েছিল

প্রভাবক্ষেত্র ও সীমান্ত নির্ধারণ: সম্মেলনে আলোচিত আরেকটি বিষয় ছিল কোন শক্তি আফ্রিকার কোন অঞ্চলে অগ্রাধিকার নিয়ে অধিকার স্থাপনের চেষ্টা করতে পারবে তার প্রাথমিক বিভাজন। ইউরোপীয় শক্তিগুলি আপন নিজ নিজ “স্ফিয়ার অব ইনফ্লুয়েন্স” বা প্রভাবক্ষেত্র চিহ্নিত করে নেয় যার মধ্যে তারা জমি অধিগ্রহণের আইনি অধিকারকরতে পারবে এবং অন্যরা তাতে হস্তক্ষেপ করবে নাযদিও এই সীমারেখাগুলো তখনও অস্পষ্ট ছিল, তথাপি এটি আফ্রিকা মানচিত্র খণ্ডিতভাবে ভাগ করার সূচনা করে। তাছাড়া, চুক্তিতে প্রথমবারের মতো স্বীকার করা হয় যে বিভিন্ন উপনিবেশের সীমারেখা নির্ধারণের সময় স্থানীয় জনগণের কল্যাণের দায়িত্ব উপনিবেশকারীদের উপর বর্তাবে বলা হয় “স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীর নৈতিক ও বস্তুগত কল্যাণ” রক্ষা করতে হবে এবং দাসত্ব সম্পূর্ণ দমন করতে হবেতবে বাস্তবে ইউরোপীয়রা এ ধরণের নীতিগত প্রতিশ্রুতি উপেক্ষাই করেছে, যা পরবর্তীকালে স্পষ্ট হয়েছে

ছবি:বার্লিন সম্মেলন

উপরের সিদ্ধান্তগুলো মিলিয়ে বার্লিন সম্মেলন মূলত আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করেছেফলস্বরূপ, ইউরোপীয় শক্তিগুলো পারস্পরিক সংঘাত এড়িয়ে দ্রুতগতিতে আফ্রিকা দখলের অভিযান শুরু করে, যা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছিল কিন্তু সম্মেলনের পর বহুগুণে তীব্র হয়সম্মেলনের General Act এর ধারা অনুযায়ী মহাদেশজুড়ে মানবিক আচরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিশ্রুতিগুলোর অনেকটাই কথার কথা রয়ে গিয়েছিল এবং ইউরোপীয়দের লক্ষ্য রয়ে যায় নিজেদের মধ্যে আফ্রিকা ভাগ-বাটোয়ারা করা ও অর্থনৈতিক লাভ নিশ্চিত করা

আফ্রিকার সীমারেখা ও রাজনৈতিক মানচিত্রের রূপান্তর

আফ্রিকা মহাদেশের ১৮৮০ সালের (বামে) ও ১৯১৩ সালের (ডানে) মানচিত্রের তুলনামূলক চিত্র উপরে দেখা যাচ্ছে। বার্লিন সম্মেলনের পরবর্তী তিন দশকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের বিস্তার কতটা দ্রুত ও সর্বগ্রাসী ছিল, তা এই মানচিত্র দুটির মাধ্যমে সুস্পষ্ট। ১৮৮০ সালের দিকে আফ্রিকার মাত্র আনুমানিক ১০%-২০% অঞ্চল ইউরোপীয়দের দখলে ছিল, তাও প্রধানত উপকূলীয় অংশগুলোবাকি বিশাল অভ্যন্তরীণ অঞ্চলসমূহ স্থানীয় রাজ্য ও জনগোষ্ঠীর স্বাধীন নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু সম্মেলন সমাপ্তির মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে (১৮৯০ নাগাদ) আফ্রিকার প্রায় ৯০% ভূমিই ইউরোপীয় উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল১৯১৩ সালের মানচিত্রে দেখা যায় সমগ্র আফ্রিকা মাত্র দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছাড়া বাকিটুকু সাতটি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের রঙে বিভক্ত এরা হলো ব্রিটেন (গোলাপি), ফ্রান্স (নীল), জার্মানি (বেগুনি), বেলজিয়াম (কমলা), ইতালি (সবুজ), পর্তুগাল (বাদামি) এবং স্পেন (হালকা বেগুনি)

ছবি:ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের রঙে বিভক্ত আফ্রিকা

বার্লিন সম্মেলনের সময় সরাসরি পুরো আফ্রিকার মানচিত্র কলম দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হয়নি ঠিকই, তবে সম্মেলনের নিয়মকানুন অনুসরণ করে পরের বছরগুলোতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও যুদ্ধের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা আফ্রিকার ভূখণ্ড নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয়। লাইবেরিয়া ছিল একটি বিশেষ ক্ষেত্র এটি আমেরিকান প্রভাবাধীন স্বাধীন কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হওয়ায় অন্যরা এটিকে উপনিবেশ বানানোর চেষ্টা করেনি এবং সম্মেলন পরবর্তী ভাগে লাইবেরিয়া স্বতন্ত্রই থাকেঅপরদিকে ইথিওপিয়া (তৎকালীন আবিসিনিয়া) ইউরোপীয়দের দ্বারা সম্পূর্ণ উপনিবেশীকরণ এড়িয়ে যায়; ইতালি দেশটি দখলের চেষ্টা করলে ১৮৯৬ সালে আদুয়া’র যুদ্ধে ইথিওপিয় বাহিনী ইতালিকে পরাজিত করে, যা আফ্রিকার জনগণের জন্য উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের একটি বিরল বিজয় হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেফলে ১৯১৪ সালের পূর্বে শুধু লাইবেরিয়া ও ইথিওপিয়াস্বাধীন ছিল, আর বাকি সমস্ত আফ্রিকা ইউরোপীয়দের অধীন আসে

বার্লিন সম্মেলনের ফলশ্রুতিতে ইউরোপীয়রা আফ্রিকার মানচিত্র নতুন করে আঁকতে বসে। ঐতিহ্যগত স্থানীয় রাজ্য বা জাতিগোষ্ঠীর সীমানা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শাসন সুবিধার্থে সোজা রেখা দিয়ে মানচিত্র ভাগ করা হয় ইউরোপের ড্রইং রুমে বসেসাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী Lord Salisbury১৯০৬ সালে আফ্রিকার সীমানা আঁকায় ইউরোপীয়দের এই অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রসঙ্গে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন: “আমরা ইউরোপীয়রা এমন মানচিত্রে রেখা টেনেছি যেখানে কোনও শ্বেতকায় মানু্ষের পা আগে পড়েনি; আমরা পরস্পরকে পাহাড়-নদী-বন উপহার দিয়েছি, যদিও বাস্তবে সেই পাহাড়-নদী কোথায় আছে তা আমরা জানতামই না”

ফলস্বরূপ, একই জাতিগত বা ভাষাগত জনগোষ্ঠীকে কেটে দুই-তিনটি উপনিবেশে ভাগ করে ফেলা হয়েছে, আবার বহু ভিন্ন ও ঐতিহাসিকভাবেশত্রুভাবাপন্নজনগোষ্ঠীকে একত্রে জোরপূর্বক একই উপনিবেশের অধীনে রাখা হয়েছেউদাহরণসরূপ, সোমালি জাতির মানুষদের পাঁচটি ভিন্ন উপনিবেশ/সীমান্তের মধ্যে ভাগ করা হয় (ব্রিটিশ, ইতালীয়, ফরাসি সোমালিল্যান্ড, ইথিওপিয়া ও কেনিয়া); আবার নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন ইত্যাদিতে ইউরোপীয়রাসীমারেখা এমনভাবেএঁকেছেযা অনেক জাতিকে কৃত্রিমভাবে পৃথক করেছে বা জোর করে একত্র করেছে।

ইউরোপীয় বিভাজনের একটি বড় প্রভাব ছিল যে আফ্রিকার প্রথাগত চলাচল ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। নতুন সীমান্তের কারণে অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের দৈনন্দিন যাতায়াত, বাণিজ্য ও যাযাবর জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারেনি; যেসব নৃগোষ্ঠী একসময়ে মুক্তভাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চারণ ও বসবাস করত, কৃত্রিম সীমানার বেড়াজালে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়েসীমান্তরেখা দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে নিকটাত্মীয় জাতিগুলোও আলাদা উপনিবেশের অধিবাসী হয়ে গেল যেমন আফ্রিকার শিংয়ে আফার জাতি ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া ও জিবুতিতে বিভক্ত, নাইজেরিয়া-ক্যামেরুন সীমান্তে বহু জাতি দ্বিখণ্ডিত, ইত্যাদিএ ধরণের বিভাজন স্থানীয় সংহতি ও পরিচয়বোধে আঘাত হানে এবং এক রাষ্ট্রের ভিতরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বৈরিতা জন্মানোর মঞ্চ তৈরি হয়

বার্লিন সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে যে সীমারেখা টানা হয়েছিল তা মূলত কঙ্গো অববাহিকা ও কেন্দ্রীয় আফ্রিকার কিছু অংশ সীমাবদ্ধ ছিলঅধিকাংশ সীমানা বাস্তবে নির্ধারিত হয়েছে সম্মেলনের পরবর্তী ২০-৩০ বছরে বিভিন্ন ইউরোপীয় চুক্তি, আলোচনা ও যুদ্ধের মাধ্যমেবিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর তাদের আফ্রিকীয় অধিকারগুলো বিজয়ী শক্তিদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করা হয় এবং তখন আধুনিক আফ্রিকার মানচিত্রের কাছাকাছি সীমারেখা চূড়ান্ত হয়উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির উপনিবেশগুলো ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম প্রভৃতির কাছে ম্যান্ডেট হিসেবে হস্তান্তরিত হয়; উত্তর আফ্রিকায় ওসমানীয়দের শেষ অংশ লিবিয়া ইতালি দখল করে (১৯১২), মরক্কো ফ্রান্স ও স্পেন ভাগ করে নেয় (১৯১২)মোটকথা, ১৯০০ সালের শুরুতে আফ্রিকা মহাদেশ প্রায় সম্পূর্ণই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের politically মানচিত্রে রূপান্তরিত হয়, যা মাত্র ২০ বছর আগেও কল্পনাতীত ছিল।

এই বিভাজনের দীর্ঘস্থায়ী কুপ্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ইউরোপীয়দের কাঠামোবিহীন সীমানাগুলো স্থানীয় জাতিগত ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী যুগে বহু অঞ্চলে গুরুতর জাতিগত সংঘাত দেখা দিয়েছেউদাহরণ হিসেবে, রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডির মতো দেশে উপনিবেশকদের তৈরি কৃত্রিম পরিচয় বিভাজন (টুৎসি ও হুতু শ্রেণীকরণ) স্বাধীনতার পর ভয়াবহ গণহত্যার রূপ নিয়েছে ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডার গণহত্যার শিকড় উপনিবেশিক বিভাজনে প্রোথিত ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা ও আফ্রিকার সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতিতে প্রভাব

বার্লিন সম্মেলন আফ্রিকায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের স্রোতকে বেগবান করেছিল এবং পরবর্তী প্রায় ৭০ বছর আফ্রিকার অধিকাংশ অঞ্চল ইউরোপীয় শক্তির অধীনে থাকে। এই ঔপনিবেশিক শাসন আফ্রিকার সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে আমূল পরিবর্তিত করে ফেলে।

অর্থনৈতিক প্রভাব: ইউরোপীয় শাসকরা আফ্রিকার অর্থনীতিকে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী ঢেলে সাজায়। উপনিবেশগুলোকে মূলত কাঁচামালের যোগানদার ও প্রস্তুত পণ্যের বাজার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিলআফ্রিকার উর্বর ভূমিতে স্থানীয় খাদ্যশস্যের পরিবর্তে ইউরোপীয় মিলের চাহিদামত নগদ ফসল (cash crop) চাষে বাধ্য করা হয় যেমন কোটন, কফি, কাকাও, রাবার, চা, ইত্যাদি যা ইউরোপে রফতানি করা হতো। স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও কারুশিল্প ইউরোপীয় পণ্যের আগমনে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি, অনেক ক্ষেত্রে উপনিবেশিক সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই স্থানীয় শিল্প ধ্বংস করে দেয় যাতে আফ্রিকা ইউরোপের শিল্পপণ্যের বাজার হয়। ইউরোপীয়রা আফ্রিকায় রেলপথ, সড়ক, বন্দর নির্মাণ করেছিল বটে, কিন্তু এসব অবকাঠামো তৈরি হয়েছিল মূলত খনিজ সম্পদ ও কৃষিপণ্য দ্রুত সমুদ্রবন্দরে পৌঁছানোর স্বার্থে, আফ্রিকার নিজস্ব উন্নয়নের জন্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, কঙ্গো ফ্রি স্টেটে লিওপল্ডের শাসনের অধীনে রাবার ও হাতির দাঁতের লোভে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর চরম অত্যাচার হয়; লক্ষাধিক মানুষকে রাবার সংগ্রহের কোটা পূরণে ব্যর্থ হলেই নির্মম নির্যাতন ও হাত-পা কর্তনের শিকার হতে হয়েছিলএইভাবে উপনিবেশিক অর্থনীতি আফ্রিকার সম্পদ ইউরোপে প্রবাহিত করে, অথচ আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে তেমন বিনিয়োগ করা হয়নি ফলস্বরূপ স্বাধীনতার পর বহু দেশ দারিদ্র্য ও একপাক্ষিক অর্থনীতি (কেবল একটি-দুইটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল) নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব: ঔপনিবেশিক শাসন আফ্রিকার সামাজিক কাঠামো ও সংস্কৃতিতে গভীর অভিঘাত আনে। ইউরোপীয়রা বহু স্থানে “divide and rule” নীতি প্রয়োগ করে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু একটি জাতিগোষ্ঠী বা গোত্রকে প্রশাসনে সুযোগ দিয়ে অন্যদের বঞ্চিত করে রাখে, যাতে স্থানীয় ঐক্য ভঙ্গ হয় এবং উপনিবেশ শাসন সহজ হয়এই কল বিভাজনের রাজনীতি আফ্রিকান সমাজে বিদ্যমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভেদকে গভীরতর করে তোলে এবং ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস ও বৈরিতা বাড়িয়ে দেয়, যা অনেক জায়গায় আজও রয়ে গেছেউপনিবেশবাদীরা প্রথাগত সমাজব্যবস্থা ও নেতৃত্ব কাঠামো ভেঙে দিয়ে নিজেরা শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়; অনেক রাজ্য বা প্রধানদের ক্ষমতাচ্যুত বা কেবল নামমাত্র রেখে বাস্তব ক্ষমতা ইউরোপীয় প্রশাসকরা গ্রহণ করে। আফ্রিকার প্রথাগত আইন ও সামাজিক রীতিনীতি উপেক্ষিত হয় এবং ইউরোপীয় আইন ও বিচারব্যবস্থা বলপূর্বক প্রয়োগ করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক ছিল।

সংস্কৃতিকভাবে, ইউরোপীয় মিশনারি ও শিক্ষা ব্যবস্থা আফ্রিকায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। খ্রিস্টান মিশনারিরা বহু আফ্রিকানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন এবং ইউরোপীয় মূল্যবোধ ও জীবনধারা প্রচার করেন, যাকে বলা হত “সভ্যতার মিশন” (civilizing mission)এর ফলে আফ্রিকার অনেক পুরনো ধর্মবিশ্বাস ও প্রথা অবমূল্যায়িত বা বিলুপ্ত হয় এবং ধর্মান্তর ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসকরা ইউরোপীয় ভাষাকে (যেমন ইংরেজি, ফরাসি, পর্তুগিজ) প্রশাসন ও শিক্ষার মাধ্যম করে তোলেন; বহু আফ্রিকান শিশু মিশন স্কুল বা সরকারী স্কুলে ইউরোপীয় ভাষা ও ইতিহাস শিখে বড় হতে থাকে, যার ফলে তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির চর্চা কমে যায়। অবশ্য এর ইতিবাচক দিকও কিছু ছিল এই পশ্চিমী শিক্ষিত শ্রেণিই পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বে আসে তবে সামগ্রিকভাবে এটি ঐতিহ্য থেকে এক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে।

ঔপনিবেশিক শাসনের সামাজিক অন্যায়ের আরেকটি দিক ছিল শ্রম শোষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। আফ্রিকায় জোরপূর্বক শ্রম (Forced labor) প্রথা চালু করা হয় অনেক উপনিবেশে গ্রামবাসীদের ওপর কোটা ধার্য করে রাস্তা, রেল, খনিতে কাজ করানো হতো নামমাত্র বা কোনো মজুরি ছাড়াই। ইউরোপীয়দের বর্ণবৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি কারণে আফ্রিকানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হত; উপনিবেশগুলোতে শ্বেতাঙ্গদের জন্য আলাদা উন্নত সুযোগসুবিধা, আর আফ্রিকানদের জন্য নিন্মমানের ব্যবস্থা রাখা হত (যেমন আলাদা বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা)। এই বর্ণবাদী শাসন দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কিছু অঞ্চলে পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় (উদাঃ- এপার্টহাইড)।

রাজনৈতিক প্রভাব: ঔপনিবেশিক ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে আফ্রিকার নিজস্ব শাসনক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং স্থানীয় রাজনৈতিক বিকাশ প্রায় স্থবির হয়ে যায়। ইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠী আফ্রিকায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার বা গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ দেয়নি; পরিবর্তে নিযুক্ত গভর্নর, কমিশনার বা উপনিবেশিক সেনাবাহিনীর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শাসন চলে। স্থানীয় রাজারা অনেকে ব্রিটিশদের প্রভাব বলয়ে “চুক্তিভিত্তিক অধীনতা” (protectorate) স্বীকার করেন অথবা প্রতিরোধ করলে উৎখাত হন। দীর্ঘকাল ধরে আফ্রিকানরা নিজেদের দেশে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত থাকে, যা তাদের মধ্যে শাসনতন্ত্র গড়ার অভিজ্ঞতার অভাব সৃষ্টি করে। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতার দাবী জোরালো হয়, তখনও নতুন রাষ্ট্রগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো ছিল ঔপনিবেশিকদের তৈরি যা ছিল স্থানীয় পরিস্থিতির সাথে অনেকাংশেই বেমানান ও কেন্দ্রীভূত একপাক্ষিক শাসনের অভ্যাসে অভ্যস্ত। এর ফলে স্বাধীনতা-উত্তর আফ্রিকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবাধ ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বৈরশাসনের বীজ রয়ে যায়।

সার্বিকভাবে, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা আফ্রিকার সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনীতি প্রত্যেকটি স্তরেই গভীর পরিবর্তন নিয়ে আসে। অনেক ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন ছিল ধ্বংসাত্মক ও শোষণমূলক। আফ্রিকার সম্পদ লুন্ঠিত হয়েছে, সংস্কৃতি ও প্রতিরোধ দমন করা হয়েছে ইউরোপের মুনাফার স্বার্থে আফ্রিকানদের শ্রম ও ভূমি নিঃশেষিত হয়েছে এবং তাদের প্রথাগত জীবনযাত্রা, সামাজিক বন্ধন ছিন্নভিন্ন হয়েছেঅবশ্য কিছু ইতিবাচক উপাদান (যেমন আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তির সাথে পরিচয়, বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সংযোগ) উপনিবেশবাদের মাধ্যমে এসেছে বলেও কেউ কেউ উল্লেখ করেন, কিন্তু ঐসব উপাদানও চাপিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য ক্ষতির সাথে মিশ্রিত ছিল। উপনিবেশিক শাসন আফ্রিকায় আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে দিলেও সেই ভিত্তি ছিল অনেকাংশেই কৃত্রিম এবং বেদনার্ত অভিজ্ঞতায় নির্মিত, যা ভবিষ্যতে বহুমাত্রিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে

আফ্রিকার জনগণের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ আন্দোলন

আফ্রিকার জনগণ প্রথম থেকেই ইউরোপীয় আগ্রাসন ও শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। এই প্রতিরোধ কখনো ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, কখনো বা কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের মাধ্যমে। উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক পর্যায়ে বহু আফ্রিকান শাসক ও জনগোষ্ঠী নিজেদের মাতৃভূমি রক্ষায় অস্ত্র তুলে নেয়।

উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম আফ্রিকায় ম্যান্ডিঙ্গো সাম্রাজ্যের নেতাসামরি তুরে (Samory Touré)ফরাসি উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন; তাঁর প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী ফরাসিদের অগ্রগতি অনেক বছর আটকে রাখে যদিও শেষমেশ ১৮৯৮ সালে তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু জাতি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৮৭৯ সালে যুদ্ধে যায় ইতিহাসখ্যাত ইসান্ডলওয়ানা যুদ্ধের শুরুতে জুলুরা ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাস্ত করলেও পরবর্তীতে উন্নত আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। পূর্ব আফ্রিকায় মহদি বিদ্রোহ (১৮৮১-১৮৯৮) সুদানে ঘটেছিল; মহদি নেতা মুহাম্মদ আহমদ’র অনুসারীরা খর্তুমে ব্রিটিশদের হারিয়ে একটি স্বাধীন ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৮৫ সালে, যা প্রায় ১৩ বছর টিকে ছিলতবে ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ-মিশরীয় বাহিনী অবশেষে এই মহদিআন্দোলন দমন করে সুদান পুনর্দখল করে নেয়

উপনিবেশ স্থাপনের পরেও বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ জারি থাকে। জার্মান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় (বর্তমান নামিবিয়া) ১৯০৪ সালে হেরেরো ও নামা জনগোষ্ঠী অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিপ্লব করে। শুরুতে তারা কিছু সাফল্য পেলেও জার্মান সেনাবাহিনী অবশেষে অত্যন্ত নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। Waterberg-এর যুদ্ধে হেরেরো যোদ্ধাদের পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ করা হয় এবং জার্মানরা অন্তত ৬৫,০০০ হেরেরো (যা তাদের মোট জনসংখ্যার ৮০%!) ও ১০,০০০ নামা জনগণকে পরিকল্পিতভাবে মরুভূমিতে তাড়া করে এনে হত্যা করে বা ক্যাম্পে আটকে রেখে অমানবিক পরিস্থিতিতে মৃত্যু ঘটায় এটিকে ইতিহাসবিদরা উনবিংশ শতকের শেষের দিকে সংঘটিত প্রথম গণহত্যার উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেনএকইসময়ে জার্মান পূর্ব আফ্রিকায় (বর্তমান তানজানিয়া) ১৯০৫-০৭ সালের মাজি মাজি বিদ্রোহ ঘটে, যেখানে স্থানীয় জনগণ জার্মানদের বাধ্যতামূলক তুলা চাষ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মাজি মাজি বিদ্রোহী যোদ্ধারা প্রথমদিকে সফল হলেও জার্মান বাহিনী শেষপর্যন্ত হিংস্র দমননীতি গ্রহণ করে এবং প্রায় দুই বছর ধরে এই গণজাগরণ ধাপে ধাপে গুঁড়িয়ে দেয়মাজি মাজি আন্দোলনের পরবর্তী প্রতিশোধ হিসেবে দুর্ভিক্ষসহ আনুমানিক ২-৩ লাখ তানজানিয়ান নিহত হন।

তুলনামূলকভাবে আশাব্যঞ্জক উদাহরণ হল ইথিওপিয়া, যা উল্লেখিত আদুয়া যুদ্ধে ইতালিকে পরাভূত করে অনেকটা গর্বিত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে। ইথিওপিয়া উপনিবেশ হতে তো এড়িয়েছেই, উপরন্তু তাদের এই বিজয় আফ্রিকার অন্যান্য দেশে প্রেরণা যোগায় যে ইউরোপীয়দের অজেয় নয়আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাইবেরিয়া ছিল, যেটি মূলত আমেরিকান সমর্থনপুষ্ট হওয়ায় ইউরোপীয়রা তাকে ছুঁতে সাহস করেনি এবং আফ্রিকান শাসকদের হাতে শাসিত হতে থাকে।

সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিরোধের রূপও ছিল। অনেক আফ্রিকান শাসক কূটনৈতিকভাবে ইউরোপীয়দের প্রভাব খাটো করার চেষ্টা করেন উদাহরণ হিসেবে আশান্তি সাম্রাজ্যের রাজারা প্রথমে চুক্তি ও আলোচনার মাধ্যমে ব্রিটিশদের প্রভাব সীমিত রাখতে চান, যদিও শেষমেশ যুদ্ধ এড়াতে পারেননি। কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক প্রভাবে বিরোধিতা হয় উদাহরণস্বরূপ, আলজেরিয়ায় সূফি দরবেশদের নেতৃত্বে ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ বিদ্রোহ চলে (আব্দ আল-খাদিরের আন্দোলন ইত্যাদি)। পূর্ব আফ্রিকায় কঙ্গো এবং কেনিয়ায় অনেকে কর না দিয়ে, খ্রিস্টান মিশনারিদের শর্ত মেনে না নিয়ে, বা ইউরোপীয়দের নির্দেশ উপেক্ষা করে নীরব প্রতিরোধ গড়েছেন। তবে উপনিবেশবাদীরা প্রায় সবসময়ই এধরনের প্রতিবাদ কঠোরভাবে দমন করেছে।

একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিরোধগুলোর বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় ইউরোপীয়দের শ্রেষ্ঠতর অস্ত্রশস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ ও কৌশলের ফলেইউরোপীয়রা অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান (যেমন ম্যাক্সিম গান) এবং স্থল ও নৌবাহিনীর সমন্বিত শক্তি নিয়ে আফ্রিকান যোদ্ধাদের বিপরীতে নেমেছিল, যাদের অনেকেরই ছিল প্রচলিত হাতিয়ার বা সীমিত আগ্নেয়াস্ত্র। তদুপরি ইউরোপীয় শক্তিরা মাঝে মাঝে পারস্পরিক বিরোধ থাকলেও আফ্রিকানদের বিদ্রোহ দমনে সমর্থন জোগাত (যেমন কোনো বিদ্রোহী নেতা এক শক্তির বিরুদ্ধে লড়লে অন্য উপনিবেশবাদী শক্তিও তাকে শত্রুই ভাবত)। তাই সামরিকভাবে আফ্রিকানদের অধিকাংশ আন্দোলন পরাভূত হয়। তবে এই সংগ্রামগুলো আফ্রিকান জনগণের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে রাখে এবং অনেক বীর ব্যক্তি ও ঘটনার কিংবদন্তি সৃষ্টির মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় শক্তিগুলো দুর্বল হলে আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলি নবউদ্যমে দৃশ্যপটে আসে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও প্রাক্তন সৈনিকদের নেতৃত্বে ১৯৫০-৬০ দশকে সারা আফ্রিকাজুড়ে স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম দানা বাঁধে। ঘানা, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, কেনিয়া, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা ইত্যাদি দেশে ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় (কোথাও শান্তিপূর্ণভাবে, কোথাও সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে) ইউরোপীয়দের বিতাড়ন করা হয়। ১৯৫০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে বেশিরভাগ আফ্রিকান দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এভাবে আফ্রিকান জনগণের দীর্ঘ প্রতিরোধ ও সংগ্রাম অবশেষে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভাঙতে সক্ষম হয়। তবে উপনিবেশবাদ-বিরোধী সেই সফলতা অর্জনের পরও ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষতচিহ্ন ও বিভেদের বিষবৃক্ষ অনেক সমাজে রয়ে গেছে, যা স্বাধীনতা-উত্তর আফ্রিকায় নতুন চ্যালেঞ্জের জন্ম দেয়।

বার্লিন সম্মেলনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

বার্লিন সম্মেলনের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা যে কৃত্রিম সীমানা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা আফ্রিকায় চাপিয়ে দিয়েছিল, তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল এখনও আফ্রিকার রাজনীতি ও সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। সম্মেলনের সরাসরি পরিণতিতে ১৮৮৫-১৯১৪ সময়কালে আফ্রিকা প্রায় সম্পূর্ণ উপনিবেশে পরিণত হয়; যদিও ইউরোপীয় শক্তিগুলোর পারস্পরিক বড় সংঘাত এ সময় এড়ানো গিয়েছিল, পরোক্ষভাবে এই বিভাজনই পরবর্তীতে কিছু বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সংঘাতের কারণের অন্তর্ভুক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকায় অধিকার নিয়ে প্রতিযোগিতা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বাড়িয়েছিল, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনুষঙ্গগুলোর একটি ছিল (যুদ্ধ ছড়ানোর পর আফ্রিকার মাটিতেও ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোর মাঝে যুদ্ধ হয়)

সবচেয়ে লক্ষণীয় দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হল আফ্রিকার জাতিগত ও রাষ্ট্রিক অস্থিতিশীলতা। ইউরোপীয়রা বিভাজনের সময় স্থানীয় জাতিগত, ভাষিক, ধর্মীয় বৈচিত্র্যের কথা একেবারেই আমলে নেয়নি। ফলস্বরূপ স্বাধীনতার পর আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলো পেয়েছিল এমন এমন সীমান্ত ও জনসংখ্যা কাঠামো, যা প্রায়শই অভ্যন্তরীণ ঐক্য বিনষ্টকারী ছিল। বহু দেশে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে গৃহযুদ্ধ, বিদ্রোহ ও জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয় যেমন নাইজেরিয়ায় ইগবো জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী বিয়াফ্রা যুদ্ধ (১৯৬৭-৭০), সুদানে উত্তর-দক্ষিণ গৃহযুদ্ধ (দ্বিতীয় সুদান যুদ্ধ ১৯৮৩-২০০৫) ইত্যাদি। রুয়ান্ডার ১৯৯৪ সালের গণহত্যা উপনিবেশিক আমলে বেলজিয়ানদের তৈরি জাতিগত বিভেদের রাজনীতির বিষফল হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হয়কঙ্গো সহ মধ্য আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক গৃহযুদ্ধ ও অঞ্চলগত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, যার উৎস উপনিবেশিক কৃত্রিম রাষ্ট্রগঠন ও শোষণজনিত দুর্বল অর্থনীতি

উপনিবেশিক সীমান্তঘটিত আন্তর্জাতিক সংঘাতও আফ্রিকায় অনেক দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইথিওপিয়া-সোমালিয়া বিরোধ (ওগাদেন যুদ্ধ ১৯৭৭-৭৮) সোমালি জাতিগোষ্ঠী বিভক্ত করার উপনিবেশিক সীমানা থেকে উদ্ভূত। ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধ (১৯৯৮-২০০০) উপনিবেশিক যুগে ইতালির টানা সীমান্তের বিতর্কের ফল। মরক্কো ও আলজেরিয়ার মধ্যে ১৯৬৩ সালের সীমান্তযুদ্ধ (ওয়ার্স অফ স্যান্ড) ফরাসি উপনিবেশিক সীমানার অসম্পূর্ণতার জের। প্রায় প্রতিটি আফ্রিকান রাষ্ট্রকেই কোনো না কোনো প্রতিবেশীর সাথে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ মোকাবিলা করতে হয়েছে, যা ঐ উপনিবেশিক সীমানার পৃথককরণের অনিবার্য ফল।

আফ্রিকার স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো একদিকে ইউরোপীয় শাসন থেকে মুক্ত হলেও, ঔপনিবেশিক শোষণের অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার তাদের পিছনে তাড়া করে ফেরে। উপনিবেশিক শাসকরা এমন অর্থনীতি রেখে গিয়েছিল যা কেবল একমুখী কাঁচামাল রপ্তানি আর প্রস্তুত পণ্য আমদানির দুষ্টচক্রে আবদ্ধ। স্বাধীনতার পর বেশিরভাগদেশ এই কাঠামো থেকে বেরোতে পারেনি, ফলে বৈচিত্র্যহীন অর্থনীতি, মূল্যপতন, ঋণের ফাঁদ প্রভৃতি সমস্যা ঘনীভূত হয়। বহির্বিশ্বের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক, যেমন উপনিবেশিক প্রভূদের সাথেই সদ্যস্বাধীন দেশগুলোর বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নির্ভরতা, নব্য-ঔপনিবেশিক (neo-colonial) প্রভাব বজায় রাখেফ্রান্স আফ্রিকার প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে দীর্ঘদিন সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখে (ফ্রান্সাফ্রিক নীতি), ব্রিটেন ও বেলজিয়ামও বিভিন্ন উপায়ে হস্তক্ষেপ করে গেছে এর প্রতিক্রিয়ায় সাম্প্রতিককালে মালি ও বুরকিনা ফাসো’র মত দেশগুলো ফরাসি উপস্থিতির বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নিচ্ছে এবং এটিকে আধুনিক উপনিবেশবাদ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে

ঔপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও আফ্রিকার বহু সমস্যার মূলেআছে। ইউরোপীয়রা যেহেতু শক্তিমান কেন্দ্রীয় শাসন (colonial state) কায়েম করেছিল এবং স্থানীয় স্তরে মানুষের অংশগ্রহণ সীমিত রেখেছিল, স্বাধীনতার পর এই রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্র স্থাপন ও সুসংহতকরণ খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বহু দেশে স্বাধীনতার পরপরই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে উদাহরণস্বরূপ, নাইজেরিয়া ও ঘানাতে স্বাধীনতার দশকের মধ্যেই সেনা অভ্যুত্থান ঘটে এবং সেনাশাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়গবেষকরা যুক্তি দিয়েছেন যে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে একীভূত করে গঠিত কৃত্রিম রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ ঐক্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হওয়ায় এই ধরনের বিভাজন ও অবিশ্বাস মিলিটারি শাসনের জন্ম দেয়ফলত, আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে স্থিতিশীল গণতন্ত্র গড়ে ওঠেনি এবং আজও রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান যা এক অর্থে বার্লিন সম্মেলনে শুরু হওয়া ঔপনিবেশিক পুনর্বিন্যাসের দীর্ঘ ছায়া।

আফ্রিকার উপর উপনিবেশবাদের এই সামগ্রিক প্রভাব সম্পর্কে তানজানিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জুলিয়াস এনায়ারে সুদূরদর্শীভাবে বলেন: “১৮৮৪ সালে বার্লিনে আমাদের মহাদেশকে ভাগ করে কৃত্রিম ‘জাতি’ সৃষ্টি করা হয়েছে, আর আজ আমরা সেই রাষ্ট্রগুলোকে একটি স্থিতিশীল সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে সংগ্রাম করছি… আমরা বিশ্বে সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত (Balkanised) মহাদেশ হওয়ার ঝুঁকিতে আছি।”

এনায়ারের এই উক্তি বার্লিন সম্মেলনের উত্তরাধিকারকে succinctly উপস্থাপন করে আফ্রিকার জনগণকে আজও উপনিবেশিক বৈষম্য ও বিভেদের ফলশ্রুতির সাথে লড়াই করতে হচ্ছে।

সমালোচনা ও ঐতিহাসিকমূল্যায়ন

বার্লিন সম্মেলন এবং এর মাধ্যমে সংঘটিত আফ্রিকার বিভাজনকে ইতিহাসে ঔপনিবেশিক লোভ ও অন্যায়ের চূড়ান্ত প্রকাশ হিসেবে তীব্র সমালোচনা করা হয়। এই সম্মেলনের অন্যতম নিন্দিত দিক হল, পুরো একটি মহাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে যার ভূখণ্ড ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হচ্ছে, সেই আফ্রিকার জনগণের মতামত নেওয়ার কোনো প্রচেষ্টাই হয়নি একটিও আফ্রিকান ব্যক্তি এতে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায়নি। এটি ছিল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের চরম ঔদ্ধত্য ও আত্মম্ভরিতার উদাহরণ, যেখানে তাঁরা মনে করেছিল যে আফ্রিকার জমি ও জনগণ তাদের ইচ্ছামতো ভাগ করে নেওয়ার জিনিস মাত্রআফ্রিকার দৃষ্টিকোণ থেকে বার্লিন সম্মেলনকে তাই অমার্জনীয় ঐতিহাসিক অন্যায় হিসেবে দেখা হয়, যা বহিরাগতরা আফ্রিকানদের “বাড়ির বাইরে রেখে তাদের বাড়ি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া”র সামিল।

সম্মেলনে ইউরোপীয় শক্তিগুলো যে উচ্চ আদর্শ ও মানবিকতার কথা বলেছিল, ইতিহাসপ্রমান করেছে যে সেগুলো বহুাংশে ভণ্ডামি ছিল। দাসব্যবসা নিষিদ্ধ ও আফ্রিকানদের কল্যাণ সুরক্ষার ঘোষণা সত্ত্বেও বাস্তবে ইউরোপীয়রা আফ্রিকায় বৈপ্লবিক শোষণ ও নিপীড়ন চালায় এবং বার্লিন চুক্তির অনেক ধারা তারা নিজরাই লঙ্ঘন করে। যেমন, চুক্তিতে “স্থানীয় জনগণের নৈতিক ও বস্তুগত কল্যাণ” এর কথা বলা হলেও উপনিবেশ শাসকরা আফ্রিকানদের উপর শোষণমূলক কর, শ্রমদাস প্রথা ও অত্যাচার চালিয়েছে এবং কোনো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ বা জবাবদিহিতা মানেনি। “কার্যকর দখল” নীতিও উপেক্ষিত হয়েছে বহুক্ষেত্রে উপকূল দখলের নিয়মের ফাঁক গলে ইউরোপীয়রা আফ্রিকার গভীরে ঢুকে চুক্তি ছাড়াই বিশাল অঞ্চল দাবি করে নেয়। কাজেই, ঐ আন্তর্জাতিক বিধি বাস্তবে কাগুজে থেকে যায় এবং জোর যার মুল্লুক তার নীতি-পদ্ধতিই শাসন করেছে আফ্রিকাকে।

ঐতিহাসিকগণ বার্লিন সম্মেলনের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্নমুখী বিশ্লেষণ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এটি আফ্রিকার উপনিবেশিক বিভাজনের সূচনা বিন্দু ও প্রতীকী মুহূর্ত হিসেবে গণ্য হয়েছেউদাহরণতঃ, ১৯৪৮ সালে প্রখ্যাত আফ্রিকান-আমেরিকান পণ্ডিত W. E. B. Du Bois মন্তব্য করেন যে, আফ্রিকায় দাসব্যবসার পাশাপাশিই আরেকটিঐতিহাসিকঘটনা হল ১৮৭০-এর পর আফ্রিকার বিভাজন, যা বার্লিন সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় এবং যার মূল স্বরূপ হলো আফ্রিকার অর্থনৈতিক শোষণDu Bois-এর এই বক্তব্য উপনিবেশবাদের অর্থনৈতিক ড্রাইভের প্রতি আলোকপাত করে এবং বার্লিন সম্মেলনকে সেই শোষণমূলক সাম্রাজ্যবাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপনকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে।

তবে সাম্প্রতিকসময়েগবেষকরা সতর্ক করেছেন যে বার্লিন সম্মেলনের প্রভাবকে অতিমূল্যায়ন না করতে। ইতিহাসবিদ মার্টিন ক্রেভেন, সি. ই. ক্রো প্রমুখ যুক্তি দিয়েছেন যে আফ্রিকার বিভাজন ছিল একটি প্রক্রিয়া যা সম্মেলনের বাইরেও অনেক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও ঘটনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল শুধু বার্লিনেই সব সীমানা ঠিক হয়নি এবং অনেকে সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো পুরোপুরি কার্যকর করেনিতাঁরা বলেন, বার্লিন সম্মেলনের আইনি দলিলের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত ছিল, তাই এটিকে উপনিবেশায়নের একমাত্র সংকেত ধরে নিলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রকৃত অভিলাষ ও কর্মকাণ্ড আড়ালে থেকে যায়বাস্তবিকই, সম্মেলনে কয়েকটি নীতি ঠিক হলেও পরবর্তীতে শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে সেগুলো এড়িয়ে চলে এবং শক্তির জোরে নিজেরাই সীমানা ঠিক করতে থাকে। তবু, বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের দৃষ্টিতে বার্লিন সম্মেলনের তাৎপর্য এর প্রতীকী ও প্রক্রিয়াগত ভূমিকাতে এটি ইউরোপীয়দের মধ্যে আফ্রিকা ভাগাভাগি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার সংহত প্রচেষ্টা এবং উপনিবেশবাদকে বৈধতা দেওয়ার কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে স্মরণীয়।

আফ্রিকার দিক থেকে, বার্লিন সম্মেলন এবং সামগ্রিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসনকে মূল্যায়ন করা হয় এক বিভীষিকাময় অধ্যায় হিসেবে, যার ক্ষত আজও পুরোপুরি মোছেনি। সাম্প্রতিককালে আফ্রিকান ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীরা ইউরোপের সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রতি ঔপনিবেশিক অপরাধের স্বীকৃতি ও পরিত্রাণের দাবি জানাচ্ছেন২০২৪ সালে বার্লিন সম্মেলনের ১৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে “Dekoloniale Berlin” নামে একটি সম্মেলনে আফ্রিকার প্রতিনিধি ও বিশ্বজোড়া আফ্রিকান বংশোদ্ভূতরা মিলিত হয়ে উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনা করেন এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর নিকট এক ঘোষণাপত্রে ঔপনিবেশিক নিপীড়নের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা, পুনরparation (ক্ষতিপূরণ) ও লুণ্ঠিত সম্পদ ও শিল্পকর্ম ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানানতাদের মতে বার্লিনে ইউরোপের “উচিত অনুচিত না ভেবেই অন্যের ভাগ্য নির্ধারণের ঔদ্ধত্য” বিশ্বের বুকে যে বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, তা পূরণ করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু এর দায় স্বীকার ও ফলশ্রুতিগুলো সামাল দিতে পদক্ষেপ নেওয়া নৈতিক দায়িত্ব

পরিশেষেবলাযায়, ১৮৮৪-৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলন ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের নিষ্ঠুর বাস্তবায়ন, যার মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশকে ভৌগোলিক রেখায় টুকরো করা হয় ইউরোপের ক্ষমতাধরদের স্বার্থে। এটি তৎকালীন ভূরাজনীতিতে ইউরোপীয় সংঘাতগুলোকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করলেও আফ্রিকার জনগণের জন্য নিয়ে আসে পরাধীনতার শৃঙ্খল। উপনিবেশবাদী শাসন আফ্রিকার সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতিকে গভীরভাবে বদলে দিয়েছে, বহুক্ষেত্রে বিধ্বংসী প্রভাবে। স্বাধীনতার প্রাপ্য বেশিরভাগ আফ্রিকান জাতি শেষপর্যন্ত অর্জন করেছে বটে, কিন্তু বার্লিন সম্মেলনে সূচিত বিভাজনের ঐতিহাসিক মাশুল তারা আজও বহন করছে সীমান্ত-বিবাদ, জাতিগত উত্তেজনা, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা ও কাঠামোগত অসমতা ইত্যাদি তারই উদাহরণইতিহাস তাই বার্লিন সম্মেলনকে একদিকে ঔপনিবেশিক যুগের চূড়ান্ত প্রহসন হিসেবে মনে রাখে, অন্যদিকে এটি থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা হল যে বহিরাগত বলপ্রয়োগে চাপিয়ে দেওয়া বিভক্তি ও শাসন দীর্ঘকালীন অসন্তোষ ও অস্থিতিশীলতার বীজ বপন করে। বার্লিন সম্মেলনের প্রতি সমালোচনা ও ধিক্কার জানিয়ে আজ আফ্রিকার মানুষ ও বিশ্ববোধ সম্পন্ন সমাজ সেই ক্ষতির নিরাময়ের পথ খুঁজছে, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার মোকাবিলায় সোচ্চার হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো জাতিগোষ্ঠীকে বাইরের শক্তির লালসার শিকার হতে না হয়।


রহস্যময় পাণ্ডুলিপি কোডেক্স জাইগাস: কেন এটি ‘শয়তানের বাইবেল’ নামে পরিচিত?

২০২৫ সেপ্টেম্বর ৩০ ১৯:১৬:৩২
রহস্যময় পাণ্ডুলিপি কোডেক্স জাইগাস: কেন এটি ‘শয়তানের বাইবেল’ নামে পরিচিত?
AFP via Getty Images

১৬৪৮ সালের জুলাই মাসে, ত্রিশ বছরের যুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে সুইডিশ সৈন্যরা প্রাগ শহর দখল করে নেয় এবং শহরের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদগুলো বাজেয়াপ্ত করে। সেগুলোর মধ্যে ছিল কোডেক্স জাইগাস (Codex Gigas)—ইউরোপীয় মধ্যযুগের বৃহত্তম জীবিত আলোকিত পাণ্ডুলিপি। প্রায় ৩ ফুট উঁচু, দেড় ফুটেরও বেশি চওড়া এবং প্রায় ৯ ইঞ্চি পুরু এই পাণ্ডুলিপির ওজন ছিল প্রায় ১৬৫ পাউন্ড। এর অসাধারণ কারুকার্যের জন্য এটি একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি।

তবে শুধুমাত্র এর বিশাল আকারের জন্যই এর এত খ্যাতি নয়। বইটির ভেতরে একটি একক পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে শয়তান (সাতান)-এর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি। এই বৈশিষ্ট্যটি শত শত বছর ধরে পাণ্ডুলিপিটিকে আকর্ষণ ও ভয়ের উৎস করে তুলেছে এবং এটি ‘শয়তানের বাইবেল’ (Devil’s Bible) নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

এক খণ্ডে বাঁধা এক লাইব্রেরি

লাতিন ভাষায় ‘দৈত্যাকার বই’ অর্থবহনকারী কোডেক্স জাইগাস বর্তমানে সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সংরক্ষিত আছে। পণ্ডিতরা বিশ্বাস করেন, এটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, অর্থাৎ ১২০৪ থেকে ১২৩০ সালের মধ্যে বোহেমিয়া রাজ্যে (যা এখন চেক প্রজাতন্ত্র) তৈরি করা হয়েছিল।

বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিউ হটন জানান, পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা একটি নোট থেকে জানা যায়, বেটম্যান আর্কাইভের (Bettmann Archive) বেনেক্টাইন মঠ ছিল এর প্রাচীনতম পরিচিত মালিক। ১৮৫৩ সালে এই পাণ্ডুলিপিটি বন্ধক হিসেবে অন্য একটি মঠে দেওয়া হয়েছিল।

এর ৩০০টিরও বেশি জীবিত পাতা প্রায় ১৬০টি বাছুর বা গাধার চামড়া দিয়ে তৈরি, যা মসৃণ ঝিল্লিতে প্রস্তুত করা হয়েছিল। হস্তলিপিবিদ মাইকেল গুল্লিক-এর গবেষণা অনুযায়ী, অভিন্ন হাতের লেখা এবং পোকামাকড়ের বাসা গুঁড়ো করে তৈরি এক ধরনের কালির ব্যবহার প্রমাণ করে এটি একক লেখকের কাজ। সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগারের অনুমান, এই পাণ্ডুলিপিটি শেষ করতে কমপক্ষে ২০ বছর, এমনকি ৩০ বছরও লাগতে পারত।

পাণ্ডুলিপিটি নিজেই একটি পোর্টেবল লাইব্রেরির মতো। এটিতে বাইবেলের পাঠ্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক, চিকিৎসা এবং রেফারেন্সমূলক বিভিন্ন উপাদান যুক্ত করা হয়েছে। এতে প্রথম শতাব্দীর ইতিহাসবিদ ফ্লাভিয়াস জোসেফাস-এর লেখা ‘অ্যান্টিকুইটিজ অফ দ্য জিউস’, সিডোর অফ সেভিলের মধ্যযুগীয় বিশ্বকোষ ‘ইটিমোলজিয়া’ (Etymologiae), কনস্টানটাইন দ্য আফ্রিকানের চিকিৎসা গ্রন্থ, ক্যালেন্ডার, ভূত তাড়ানোর ফর্মুলা এবং বোহেমিয়ার ইতিহাস সম্পর্কিত ‘ক্রোনিকা বোয়েমোরাম’ (Chronica Boemorum)-এর মতো নানা কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

শয়তান: বিশদ বিবরণের মধ্যে রহস্য

শয়তানের প্রতিকৃতিটি কোডেক্স জাইগাস-এর প্রায় মাঝামাঝি অংশে, স্বর্গের শহরটির সমান বড় একটি ছবির উল্টো দিকে দেখা যায়। এই শিংওয়ালা মূর্তিটি পাণ্ডুলিপির উজ্জ্বল চিত্রাঙ্কনের তুলনায় অনুজ্জ্বল রঙে আঁকা এবং এটি প্রায় পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বিস্তৃত। কিছু পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, পরিত্রাণ এবং অভিশাপের মধ্যে পছন্দের কথা মনে করিয়ে দিতে এই চিত্রটি ইচ্ছাকৃতভাবে এখানে রাখা হয়েছিল।

পাণ্ডুলিপিটিকে ঘিরে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। বলা হয়, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার অপরাধে জীবন্ত প্রাচীর দিয়ে গেঁথে ফেলার শাস্তি পাওয়া এক সন্ন্যাসী, এক রাতের মধ্যে মঠের গৌরব বাড়াতে পারে এমন একটি বই তৈরি করার প্রতিজ্ঞা করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় তিনি শয়তানের সাহায্য চান এবং কৃতজ্ঞতা স্বরূপ শয়তানের প্রতিকৃতি এঁকে দেন।

যুদ্ধ ও আগুনের মধ্য দিয়ে যাত্রা

১৫৯৪ সালে রোমান সম্রাট রুডলফ দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটি তার সংগ্রহে যুক্ত করেন। সুইডিশ সৈন্যরা প্রাগ দখলের সময় এটি বাজেয়াপ্ত করে স্টকহোমে নিয়ে যায়। ১৬৯৭ সালে স্টকহোমের রাজকীয় দুর্গে আগুন লাগলে, এটিকে বাঁচাতে একজন উদ্ধারকারী জানালা দিয়ে পাণ্ডুলিপিটি বাইরে ছুঁড়ে মারেন। এতে পাণ্ডুলিপিটি আগুনে বাঁচলেও এর বাঁধাই ছিঁড়ে যায় এবং কিছু পৃষ্ঠা নষ্ট হয়। ১৮৭৮ সালে এটিকে স্টকহোমের নবনির্মিত জাতীয় গ্রন্থাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে এটি আজও সংরক্ষিত আছে। ২০০৭ সালে কোডেক্স জাইগাস ৩৫৯ বছর পর প্রথমবার প্রাগে ফিরে এসেছিল, যা দেখার জন্য রেকর্ড সংখ্যক ভিড় জমেছিল।

কোডেক্স জাইগাস বিশ্বাস, ভয় এবং লোককাহিনীর একটি সেতু হিসেবে টিকে আছে। এটি মধ্যযুগীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও কারুকার্যের এক অসাধারণ উদাহরণ।


ভূতের সঙ্গে যোগাযোগ: ভিক্টোরিয়ান যুগে ব্যবহৃত ৪টি রহস্যময় সরঞ্জাম

২০২৫ সেপ্টেম্বর ৩০ ১৫:৫১:০৪
ভূতের সঙ্গে যোগাযোগ: ভিক্টোরিয়ান যুগে ব্যবহৃত ৪টি রহস্যময় সরঞ্জাম
বেটম্যান আর্কাইভ

ভিক্টোরিয়ান যুগে আধ্যাত্মবাদ (Spiritualism) একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ধর্মীয় আন্দোলন ছিল। এর মূল ধারণা ছিল—মানুষের মৃত্যুর পরেও তার আত্মা জীবিত থাকে এবং ‘মিডিয়াম’ বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিরা সেই আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। যদিও লক্ষ্য ছিল মৃতদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা, আজকের দিনে প্রচলিত প্যারানরমাল বা অতিপ্রাকৃত অনুসন্ধানের কৌশলগুলো ভিক্টোরিয়ান যুগের মানুষরা হয়তো চিনতেই পারতেন না।

ইতিহাসবিদ এবং ‘When We Spoke to the Dead’ বইয়ের লেখক ইলিস কার্টার বলেন, “ভূতের সন্ধানের অর্থ তখন কোনো ভুতুড়ে বাড়িতে গিয়ে কী আছে, তা দেখা ছিল না।” তিনি বলেন, মূলত একটি টেবিলের চারপাশে বসে, মিডিয়ামের হাত ধরে ‘সেয়ান্স’ (Séance) বা আত্মার আহ্বান করা হতো।

দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সেই সময়ে—যখন টেলিফোন বা টেলিগ্রাফের মাধ্যমে দূরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করাও অলৌকিক বলে মনে হতো—ভিক্টোরিয়ানরা মৃতদের কাছে পৌঁছানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতির প্রতিও আগ্রহী ছিলেন। এর মধ্যে ছিল স্পিরিট বোর্ড, ট্রাম্পেট, টেবিল এবং ম্যানিফেস্টেশন ক্যাবিনেটের মতো নানা সরঞ্জাম।

১. টেবিল (Table Tipping)

ভিক্টোরিয়ান যুগের আধ্যাত্মবাদের প্রথম দিকে, মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য টেবিলই ছিল সবচেয়ে সাধারণ সরঞ্জাম। মিডিয়াম এবং সেয়ান্সের অংশগ্রহণকারীরা একটি ছোট বা মাঝারি আকারের টেবিলের চারপাশে বসতেন এবং এর উপর হাত রাখতেন। এরপর টেবিলটি নড়তে শুরু করলে বুঝতে পারা যেত যে আত্মা উপস্থিত হয়েছে। এই অনুশীলনটি টেবিল টিপিং বা টেবিল টার্নিং নামে পরিচিত ছিল।

গেটি ইমেজেস: ১৯০০ সালের এক সিয়ান্সে একটি টেবিলকে নিজের মতো নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে।

ইলিস কার্টার বলেন, টেবিল নড়াচড়ার মাধ্যমে আত্মা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিত। ১৮৫০-এর দশকে এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছিল। যদিও ১৮৫৩ সালে বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে উপসংহারে এসেছিলেন যে টেবিলের চারপাশে বসা লোকেরাই আসলে অবচেতনভাবে এটিকে নাড়াতেন। তবে এই বিতর্ক সত্ত্বেও, টেবিল টিপিং ২০ শতকের শুরু পর্যন্ত আত্মা ডাকার প্রধান পদ্ধতি ছিল।

২. স্পিরিট বোর্ড (Spirit Boards)

প্রাথমিকভাবে, মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে শব্দ করে তাদের উপস্থিতি জানানোর জন্য বলা হতো—যেমন টেবিলে একবার শব্দ করলে ‘হ্যাঁ’ বা দুবার শব্দ করলে ‘না’। কার্টার বলেন, এই পদ্ধতিটি ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ এবং ক্লান্তিকর।

স্পিরিট বোর্ডগুলো দেখতে বোর্ড গেমের মতো হলেও তাতে বর্ণমালার ২৬টি অক্ষর, শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা এবং “হ্যাঁ,” “না” ও “বিদায়” শব্দগুলো প্রদর্শিত হতো। (গেটি ইমেজেস)

এরপর আসে স্পিরিট বোর্ড বা ‘উইচ বোর্ড’। এটি দেখতে বোর্ড গেমের মতো হলেও এতে বর্ণমালার ২৬টি অক্ষর, ০ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা এবং ‘হ্যাঁ’, ‘না’ ও ‘বিদায়’ শব্দগুলো লেখা থাকত। এতে একটি প্ল্যানচেট বা হৃদপিণ্ডের আকারের কাঠের টুকরা থাকত, যা স্পর্শ করে অংশগ্রহণকারীরা আত্মাকে দিয়ে বার্তা লেখাতেন। সবচেয়ে বিখ্যাত স্পিরিট বোর্ডের নাম হলো উইজা বোর্ড, যা ১৮৯১ সালে প্যাটেন্ট করা হয়।

৩. স্পিরিট ট্রাম্পেট (Spirit Trumpets)

১৯ শতকের শেষের দিকে স্পিরিট ট্রাম্পেট বা সেয়ান্স ট্রাম্পেট নামের সরু টিনের, অ্যালুমিনিয়ামের বা কার্ডবোর্ডের শঙ্কুগুলো ‘সেয়ান্স রুমের সবচেয়ে জনপ্রিয় সরঞ্জাম’ হয়ে ওঠে। ‘The Victorian Book of the Dead’ বইয়ের লেখক ক্রিস উডইয়ার্ড বলেন, এই ট্রাম্পেটগুলো টেবিলের মাঝখানে রাখা হতো এবং বিশ্বাস করা হতো যে এটি আত্মার জগত থেকে আসা ফিসফিস, কুকুরের ডাক বা বাতাসের মতো শব্দগুলিকে বড় করে তুলবে। অনেক সময় মিডিয়ামরা এই ট্রাম্পেট মুখে ধরতেন, যাতে আত্মা সরাসরি এর মাধ্যমে কথা বলতে পারে। এর ফলে স্পিরিট বোর্ডের চেয়ে দ্রুত এবং বিস্তারিত বার্তা পাওয়া যেত।

আলামি স্টক ফটো: ১৯২৯ সালের এক সিয়ান্সে আত্মার ট্রাম্পেট পড়ে যাওয়ার মুহূর্তের ছবি।

৪. ম্যানিফেস্টেশন ক্যাবিনেট (Manifestation Cabinets)

আত্মার আহ্বানের সময় মিডিয়ামরা সাধারণত সবার সামনে থাকলেও, কিছু মিডিয়াম একটি আসবাবপত্র ব্যবহার করতেন, যা ম্যানিফেস্টেশন ক্যাবিনেট বা স্পিরিট ক্যাবিনেট নামে পরিচিত। এটি প্রায়শই ভারী মখমলের পর্দা দিয়ে আবৃত একটি কাঠের আলমারির মতো হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল ‘আধ্যাত্মিক শক্তিকে আকর্ষণ ও সংরক্ষণ করা’।

গেটি ইমেজেস (গাডো): ১৮৯৪ সালে সিনসিনাটি ও নিউইয়র্কে মঞ্চস্থ হ্যারি কেলারের বিজ্ঞাপন— Perplexing Cabinet Mysteries নামের ওই শোতে কেলার আত্মাদের “আহ্বান” করতে ব্যবহৃত করেছিলেন একটি বিশেষ ম্যানিফেস্টেশন ক্যাবিনেট।

১৮৫০ এর দশকে উইলিয়াম এবং ইরা ডেভেনপোর্ট নামের দুই ভাই এর ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলেন। মিডিয়াম হাতে-পায়ে বাঁধা অবস্থায় ক্যাবিনেটের ভেতরে বসতেন, যাতে প্রমাণ হয় যে বাইরে যা আসছে তা আত্মার জগৎ থেকে আসছে। এরপর পর্দা ভেদ করে ভাসমান মুখ বা পুরো শরীরের প্রতিচ্ছবি (অ্যাপারিশন) বেরিয়ে আসত।


বিস্কুটের টিন দিয়ে তৈরি টিভি, প্রথম যে মানুষটিকে দেখা গিয়েছিল পর্দায়

২০২৫ সেপ্টেম্বর ৩০ ১৫:৩৭:১৮
বিস্কুটের টিন দিয়ে তৈরি টিভি, প্রথম যে মানুষটিকে দেখা গিয়েছিল পর্দায়
ছবি: সংগৃহীত

আজ থেকে এক শতাব্দী আগে, ১৯২৫ সালের ২ অক্টোবর, স্কটিশ উদ্ভাবক জন লগি বেয়ার্ড (John Logie Baird) সফলভাবে মানুষের মুখের একটি শনাক্তযোগ্য চলমান ছবি প্রেরণ করতে সক্ষম হন। বেয়ার্ডের প্রথম সেই পরীক্ষার মূল তারকা ছিলেন উইলিয়াম টেইন্টন নামের এক তরুণ অফিস সহকারী। ঘটনাটির চল্লিশ বছর পর উইলিয়াম টেইন্টন বিবিসি’কে সেই নাটকীয় মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছিলেন।

একাকী উদ্ভাবক ও ব্যর্থতার শুরু

১৮৫০ এর দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা টেলিভিশন আবিষ্কারের চেষ্টা করে আসছিলেন। কিন্তু এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তি—যিনি সাইকেলের বাতি, ভাঙাচোরা কাঠ ও বিস্কুটের টিনের মতো বাতিল জিনিস ব্যবহার করে তার যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিলেন। যাজকের পুত্র বেয়ার্ড প্রায় সারা জীবনই অসুস্থতায় ভুগেছেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চিকিৎসাগত কারণে অনুপযুক্ত ঘোষিত হন।

এর আগে বেয়ার্ড কৃত্রিম হীরা তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন, যার ফলে একবার গ্লাসগোর বিদ্যুৎ সংযোগের একটি অংশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া, তার তৈরি ঘরোয়া পাইলস নিরাময়ের এক ভয়াবহ ওষুধ এতটাই বিপজ্জনক ছিল যে ভবিষ্যৎ টেলিভিশন উপস্থাপকরা হয়তো বলতেন, “বাড়িতে এটি চেষ্টা করবেন না!”

ভাঙাচোরা সরঞ্জাম ও ঐতিহাসিক সাফল্য

বিভিন্ন ব্যর্থতার পরও বেয়ার্ড বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিলেন। মোজা ও সাবানের ব্যবসা থেকে পাওয়া পুঁজি দিয়ে তিনি ১৯২৩ সালে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে হেস্টিংসে একটি সাধারণ জায়গা ভাড়া নেন। সেখানে একটি পুরানো চায়ের বাক্সকে ইঞ্জিন দিয়ে লাগিয়ে, ভাঙাচোরা সরঞ্জাম দিয়ে তিনি তার টেলিভিশন পরীক্ষা শুরু করেন। বেয়ার্ডের এই সিস্টেমে একটি বড় ডিস্ক দ্রুত গতিতে ঘুরত, যা ফটোডিটেক্টর ও তীব্র আলো ব্যবহার করে ছবিকে লাইন বাই লাইন স্ক্যান করত। এরপর এই সংকেতগুলো প্রেরণ করে চলমান ছবি তৈরি করা হতো।

হেস্টিংসে একবার বৈদ্যুতিক শক খেয়ে বেয়ার্ড লন্ডনের সোহোর ২২ ফ্রিথ স্ট্রিটে তার নতুন ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন। তার যান্ত্রিক ডিভাইসটি এতটাই তীব্র তাপ নির্গত করত যে মানুষের পক্ষে সেখানে দীর্ঘক্ষণ থাকা কঠিন ছিল। ফলে তিনি প্রাথমিকভাবে ‘স্টুকি বিল’ নামে একটি পুতুলকে ব্যবহার করতেন।

প্রথম টেলিভিশন তারকার আগমন

১৯২৫ সালের ২ অক্টোবর ৩৭ বছর বয়সী বেয়ার্ড তার পরীক্ষার জন্য উইলিয়াম টেইন্টনকে বেছে নেন, যিনি তার ল্যাবরেটরির নিচেই অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। উইলিয়াম টেইন্টন বিবিসিকে জানিয়েছিলেন:

“মি. বেয়ার্ড দৌড়ে এলেন, উত্তেজনায় টইটম্বুর। প্রায় টেনে নিয়ে গেলেন আমাকে তার ছোট ল্যাবরেটরিতে। তিনি এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। তিনি প্রায় আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন যত দ্রুত সম্ভব দোতলায়।”

যন্ত্রপাতির বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে টেইন্টন প্রথমে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বেয়ার্ড তাকে ট্রান্সমিটারের সামনে বসিয়ে দেন। টেইন্টন অনুভব করেন আলোর তীব্র তাপ, তবে বেয়ার্ড তাকে আশ্বাস দেন যে চিন্তার কিছু নেই। বেয়ার্ড রিসিভিং প্রান্তে চলে যান। টেইন্টন তাপে থাকতে না পেরে সরে গেলে বেয়ার্ড দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলেন: “আমি আপনাকে দেখেছি, উইলিয়াম, আমি আপনাকে দেখেছি। আমি অবশেষে টেলিভিশন পেয়েছি, প্রথম সত্যিকারের টেলিভিশন ছবি!”

টেইন্টন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে সেই সময়ে খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। তিনি বেয়ার্ডকে বলেছিলেন, “মি. বেয়ার্ড, আমি এটিকে খুব একটা ভালো মনে করছি না। এটি খুবই স্থূল।” জবাবে বেয়ার্ড বলেছিলেন, “এটি কেবল শুরু। আপনি দেখবেন এটি দেশজুড়ে, এমনকি সারা বিশ্বে সব বাড়িতে পৌঁছে যাবে।”

বেয়ার্ডের এই আবিষ্কারের পাঁচ বছর পর, ১৯৩১ সালে, টেইন্টন টেলিভিশনে ফিরে এসেছিলেন সেই নাটকীয় মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করতে। যদিও বেয়ার্ডের যান্ত্রিক পদ্ধতি পরবর্তীতে উন্নত প্রযুক্তির কাছে পিছিয়ে পড়ে, তবুও তিনিই টেলিভিশনের পথপ্রদর্শক।

সূত্র: বিবিসি


রেনেসাঁর দর্শন ও দিশা: গ্রিক-রোমান জ্ঞান, মুসলিম দার্শনিকদের ভূমিকা ও আধুনিকতার উন্মেষ

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ সেপ্টেম্বর ২০ ১৬:৪১:২৩
রেনেসাঁর দর্শন ও দিশা: গ্রিক-রোমান জ্ঞান, মুসলিম দার্শনিকদের ভূমিকা ও আধুনিকতার উন্মেষ

রেনেসাঁ (ইংরেজিতে Renaissance) ছিল ইউরোপের ইতিহাসে ১৪শ থেকে ১৭শ শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাল, যা মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক যুগের সূচনা করে। “Renaissance” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো “পুনর্জন্ম” – এই সময়ে ইউরোপে প্রাচীন গ্রিক-রোমান জ্ঞান ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটে বলেই এমন নামকরণ। রেনেসাঁ ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে চতুর্দশ শতকের শেষদিকে শুরু হয় এবং পরবর্তী দুই-তিন শতকে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে, যা ইউরোপকে মধ্যযুগের অন্ধকার যুগ থেকে বের করে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। নিচে রেনেসাঁ সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হলো।

রেনেসাঁ কী ও কেন: সংজ্ঞা, সময়কাল ও উৎপত্তিস্থল

রেনেসাঁ বলতে ইউরোপের ইতিহাসে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণের সেই যুগকে বোঝায়, যা চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এটি ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে শুরু হয়ে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয় বলে ধারণা করা হয়। অনেক ইতিহাসবিদের মতে অঞ্চলের ভেদে এই সময়সীমা কিছুটা আগে-পরে হতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে এটি ১৫শ ও ১৬শ শতককে অন্তর্ভুক্ত করে এবং মধ্যযুগ শেষে নতুন যুগের সূচনা করে। রেনেসাঁর সূতিকাগার ছিল ইতালি, বিশেষ করে ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্র; সেখান থেকে এর ভাবধারা ধীরে ধীরে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে।

এই সময়ে ইউরোপে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়: ইতালির নগর-রাষ্ট্রগুলোতে বাণিজ্য ও পৃষ্ঠপোষকতার সমৃদ্ধ পরিবেশ, প্রাচীন রোমান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের উপস্থিতি এবং শহরকেন্দ্রিক মুক্ত চিন্তার প্রসার ইত্যাদি কারণেই ফ্লোরেন্স ও আশপাশের অঞ্চলে জ্ঞান-সংস্কৃতির এই “পুনর্জন্ম” সম্ভব হয়েছিল। মধ্যযুগের অন্ত্যজ পর্যায়ে আসে মহামারী ব্ল্যাক ডেথ (১৩৪৭–১৩৫০) ও শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অবসান, যার ফলে ইতালির মানুষের মানসিকতায় বদল আসে এবং জীবন ও মানবসম্পর্কিত বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহ বাড়ে। এসব সামাজিক পটভূমি রেনেসাঁর বিকাশে সহায়ক ছিল।

রেনেসাঁ শব্দটি প্রথম চালু হয় ১৫৫০ সালে জর্জিও ভাসারির লেখায় rinascita (ইতালীয় ভাষায় “পুনর্জন্ম”) রূপে, যদিও একটি ঐতিহাসিক কাল হিসেবে “Renaissance” পরিভাষাটি জনপ্রিয়তা পায় ঊনবিংশ শতকে ইতিহাসবিদ জ্যাকব বার্কহার্ট-এর লেখনীর মাধ্যমে। “পুনর্জাগরণ” বলতে মূলত ইউরোপের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান বিদ্যা, শিল্প ও দর্শনের চর্চা নতুন করে শুরু হয় এবং মধ্যযুগের স্থবিরতা কাটিয়ে সংস্কৃতিক্ষেত্রে জাগরণ ঘটে। রেনেসাঁ চিন্তাবিদগণ পূর্ববর্তী মধ্যযুগকে “অন্ধকার যুগ” বা জ্ঞান-সংস্কৃতির অধঃপতনের যুগ হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং তারা তাদের সমাজকে নতুন করে উজ্জীবিত করতে প্রাচীন যুগের জ্ঞান-দর্শনকে পুনরায় গুরুত্ব দেন। তাই রেনেসাঁর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাচীন ক্লাসিকাল সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রতি তীব্র আগ্রহ এবং সেগুলোর নবব্যাখ্যা ও সম্প্রসারণ। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসের “মানুষই সকল কিছুর মানদণ্ড” এই মানবকেন্দ্রিক ধারণাকে রেনেসাঁ মানবতাবাদীরা তাদের দর্শনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন।

রেনেসাঁর সূত্রপাত কেন ইতালিতে ও সেই সময়ে হলো?

ইতিহাসবিদরা এর কয়েকটি কারণ নির্দেশ করেছেন।

প্রথমত,ক্রুসেড যুদ্ধ এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ইউরোপীয়রা প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত বহু পান্ডুলিপি ও ধারণা ফিরে পায়। বিশেষ করে ১৪৫৩ সালে অটোমান তুর্কিরা কনস্টান্টিনোপল (বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী) দখল করার পর অনেক গ্রিক পণ্ডিত ও শিল্পী মূল্যবান গ্রন্থপত্রসহ পালিয়ে ইতালি আসে এবং সেগুলো নিয়ে আসেন। একইসময়ে মুসলিম শাসিত স্পেন (আন্দালুস) ও সিসিলির মতো স্থানে খ্রিস্টান ও মুসলিমদের সংঘাত ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান চলছিল; স্পেনে খ্রিস্টান পুনর্দখলের সময়ও বহু জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি ইতালির ফ্লোরেন্স, পাদুয়া প্রভৃতি শহরে আশ্রয় নেন। এসব ঘটনার ফলে ইতালিতে প্রাচীন গ্রিক-রোমান জ্ঞানচর্চার নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি হয়, যা পুনর্জাগরণকে ত্বরান্বিত করে।

দ্বিতীয়ত,ইতালির শহরগুলো (ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলান, রোম ইত্যাদি) মধ্যযুগের শেষদিকে বাণিজ্য ও শিল্পে উন্নত, ধনী নগর-রাষ্ট্র ছিল এবং সেখানে বণিক ও ক্ষমতাবান পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল প্রবল। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লোরেন্সের মেডিচি পরিবার চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও শিক্ষাবিস্তারে অসাধারণ পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, যা রেনেসাঁর বিকাশে বড় ভূমিকা পালন করে।

তৃতীয়ত,ইতালির রাজনীতিতে তখন ফিউডাল শাসন দুর্বল হয়ে স্বাধীন নগর-প্রজাতন্ত্র ও বণিকতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। এর ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা নতুন চিন্তাধারার উন্মেষে সহায়ক হয়।

প্রাচীন গ্রিক দর্শনের পুনর্জাগরণ

রেনেসাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান দর্শন ও জ্ঞানকে পুনরাবিষ্কার ও আত্মস্থ করা। মধ্যযুগে ইউরোপে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা মূলত ক্যাথলিক চার্চের তত্ত্বাধীনে ছিল এবং চিন্তাধারা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। প্রাচীন কবিতা-সাহিত্য বা ইতিহাসের তুলনায় তত্ত্বগত দর্শন ও ধর্মতত্ত্বই বেশি গুরুত্ব পেত। কিন্তু রেনেসাঁ যুগের পণ্ডিতরা প্রাচীন গ্রিস ও রোমের শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনকে নতুন উদ্যমে অধ্যয়ন করতে শুরু করেন এবং সেখান থেকে মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের বীজ খুঁজে পান।

বিশেষ করে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারার পুনর্জাগরণ ঘটে এ সময়ে। রেনেসাঁ শিল্পী রাফায়েলের বিখ্যাত ফ্রেস্কো দ্য স্কুল অব অ্যাথেন্স (১৫০৯–১৫১১) এই পুনর্জাগরণকে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলে। চিত্রকর্মের কেন্দ্রে লাল পোশাকে প্লেটো ও নীল পোশাকে অ্যারিস্টটল তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় মগ্ন, আর তাদের চারপাশে সক্রেটিসসহ প্রাচীন দার্শনিকদের অবয়ব। এটি দেখায়, রেনেসাঁ যুগে ইউরোপের বিদ্বজ্জনেরা প্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডারকে কিভাবে পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

গ্রিক দর্শনের মধ্যে মানবকেন্দ্রিকতা ও যুক্তিবাদের যে বীজ ছিল, রেনেসাঁ সেই বীজকে বিকশিত করে। প্লেটোর আদর্শবাদ ও ন্যায়ের ধারণা, অ্যারিস্টটলের বাস্তববাদ ও যুক্তিবিদ্যা এবং সক্রেটিসের অনুসন্ধানী প্রশ্নপদ্ধতি – এসবই রেনেসাঁ চিন্তাবিদদের অনুপ্রাণিত করে নতুন দর্শন ও বিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বিশেষ করে মানবতাবাদ (Humanism) নামে যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন রেনেসাঁয় জন্ম নেয়, তার শিকড় প্রাচীন রোমক লেখক সিসেরোর humanitas ধারণা এবং গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসের উক্তি “মানুষই সকল কিছুর মানদণ্ড”-এ নিহিত ছিল

রেনেসাঁ মানবতাবাদীরা ল্যাটিন ও গ্রিক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, বিশেষ করে সাহিত্য, ইতিহাস ও বক্তৃতাশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ ইউরোপের সন্ন্যাসী পুথিঘর থেকে খুঁজে বের করতে থাকেন এবং সেগুলো অধ্যয়ন করে নতুন জ্ঞান অর্জন করেন। ১৩৯৬ সালে ফ্লোরেন্সের কোলুচ্চিও সালুতাতি বাইজান্টিয়াম থেকে মনীষী ম্যানুয়েল ক্রাইসোলোরাসকে আমন্ত্রণ জানান গ্রিক ভাষা ও সাহিত্য পড়ানোর জন্য। এটিকে গ্রিক ভাষা-শিক্ষা ও গ্রন্থচর্চার পুনর্জীবনের সূচনা বিন্দু ধরা হয়।

ক্রাইসোলোরাস ও তাঁর শিষ্যদের প্রচেষ্টায় ফ্লোরেন্সে গ্রিক ভাষায় দক্ষ পণ্ডিতশ্রেণি তৈরি হয়। তারা প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের লেখনীকে সরাসরি মূল গ্রিক ভাষা থেকে অনুবাদ ও বিশ্লেষণ শুরু করেন। উদাহরণস্বরূপ, মেডিচি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় মার্সিলিও ফিচিনো প্রায় ১৪৬২–১৪৬৯ সালের মধ্যে প্লেটোর সমগ্র রচনা ল্যাটিনে অনুবাদ করেন, যার ফলে প্লেটোর চিন্তা আবার ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে।

গ্রিক দর্শনের পুনর্জাগরণের ফলে রেনেসাঁ যুগের চিন্তাধারায় বড় পরিবর্তন আসে। মধ্যযুগে যদিও অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা আংশিকভাবে পরিচিত ছিল (বিশেষত থোমাস একুইনাসের মাধ্যমে), প্লেটোনিক দর্শন প্রায় বিস্মৃত ছিল। রেনেসাঁয় প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র, ন্যায়বোধ ও সৌন্দর্যচিন্তা নতুন করে আলোচিত হয়; এর প্রভাব শিল্পকলায় নৈতিক ও নান্দনিক আদর্শের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়।

অন্যদিকে, অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শন ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা – যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা – রেনেসাঁয় নতুন মাত্রায় বিকশিত হয়। এর পেছনে কারণ ছিল গ্রিক পাণ্ডুলিপি সরাসরি পড়ার সুযোগ তৈরি হওয়া, এবং পূর্ববর্তী আরবি-লাতিন অনুবাদের সীমাবদ্ধতা সংশোধন করে বিশুদ্ধ জ্ঞান আহরণ করা।

ইতিহাসবিদ চার্লস হোমার হ্যাসকিন্স উল্লেখ করেন, ইউরোপে আসলে তিনবার প্রাচীন জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ঘটেছে – ক্যারোলিঞ্জীয় পুনর্জাগরণ (৮ম–৯ম শতক), অটোনীয় পুনর্জাগরণ (১০ম শতক), এবং দ্বাদশ শতকের পুনর্জাগরণ। দ্বাদশ শতকের পুনর্জাগরণ মূলত দর্শন ও বিজ্ঞানকেন্দ্রিক ছিল, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিরূপ সৃষ্টি এবং গ্রিক ও আরবি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ অনুবাদ। তবে ষোড়শ শতকের রেনেসাঁয় জোর পড়ে সাহিত্য, ইতিহাস ও শিল্পে, যা মানবিকবিদ্যার (humanities) পুনর্জন্ম ঘটায়।

প্রাচীন গ্রিক দর্শনের পুনর্জাগরণ রেনেসাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি স্থাপন করে। ইউরোপের পণ্ডিতরা এসব প্রাচীন গ্রন্থ নতুন করে অধ্যয়ন করে উপলব্ধি করেন যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যুক্তিসংগতভাবে গঠিত, এবং তা মানুষের বুদ্ধি দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ফলে মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞানচর্চা (empiricism) গুরুত্ব লাভ করে এবং বিজ্ঞান, সাহিত্য ও দর্শনে নবচর্চার জোয়ার শুরু হয়।

মুসলিম দার্শনিক ও অনুবাদকদের অবদান

মধ্যযুগে যখন ইউরোপে প্রাচীন গ্রিক জ্ঞান অনেকাংশে বিস্মৃত ছিল, তখন ইসলামি সভ্যতা সেই জ্ঞানের রক্ষক ও সম্প্রসারক হিসাবে কাজ করেছিল। সপ্তম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে আরব ও পারস্যের দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা গ্রিক দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র ও বিজ্ঞানের বহু গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন এবং সেগুলোর ওপর মৌলিক ভাষ্য রচনা করেন। এই জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিকাশের কাজ মূলত আব্বাসীয় শাসনামলে সম্পন্ন হয়।

৮৩২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত বায়তুল হিকমা বা House of Wisdom, যেখানে হাজার হাজার গ্রিক ও প্রাচ্য পাণ্ডুলিপি অনূদিত ও আলোচিত হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্রন্থ থেকে শুরু করে অ্যারিস্টটলের দর্শন পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ গ্রন্থ সিরিয়াক ও আরবিতে অনূদিত হয়। মুসলিম পণ্ডিতরা শুধু অনুবাদ করেননি, বরং ব্যাখ্যা, টীকা এবং সমালোচনার মাধ্যমে জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন।

মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে আল-ফারাবি, ইবন সিনা (লাতিনে Avicenna) এবং ইবন রুশদ (লাতিনে Averroes) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আল-ফারাবি (মৃত্যু ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার ওপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর এহসাউল উলুম (বিজ্ঞানের শ্রেণিবিন্যাস) পরবর্তীতে লাতিনে অনূদিত হয়ে ইউরোপের জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোতে প্রভাব ফেলে।

ইবন সিনা (৯৮০–১০৩৭) প্রাচীন গ্রিক দর্শনের সাথে নিজস্ব চিন্তা মিলিয়ে ইসলামি দর্শনকে উচ্চতায় নিয়ে যান। তাঁর কিতাব আল-শিফা এবং কানুন ফি-ত্বিব্ব (চিকিৎসাশাস্ত্র) গ্রন্থ লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাঁর সত্তা ও মহীয়ান অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণা পশ্চিমা স্কল্যাস্টিক দর্শনকে আলোড়িত করে।

ইবন রুশদ (১১২৬–১১৯৮) ছিলেন অ্যারিস্টটলের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার। তিনি অ্যারিস্টটলের দর্শনের এমন ব্যাখ্যা দেন, যা খ্রিস্টীয় ইউরোপে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। থোমাস একুইনাস সহ বহু ইউরোপীয় দার্শনিক তাকে সম্মানসূচক উপাধি দেন “The Commentator” বা “মহাভাষ্যকার”। ইবন রুশদ যুক্তি ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে লিখতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর এই চিন্তা পরবর্তীতে ইউরোপীয় রাজনৈতিক দর্শন ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মধ্যযুগে ইউরোপে গ্রিক জ্ঞান প্রবেশের একটি প্রধান পথ ছিল মুসলিম স্পেন (আন্দালুস) ও সিসিলি। ক্রুসেড ও রিকনকিস্টার সময়ে খ্রিস্টানরা মুসলিম বিশ্বের উন্নত সভ্যতার সংস্পর্শে আসে এবং সেখানে সংরক্ষিত গ্রিক-রোমান জ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়।

১১শ থেকে ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে স্পেনের টলেডো ও সিসিলিতে ব্যাপক অনুবাদ আন্দোলন গড়ে ওঠে। টলেডো অনুবাদ বিদ্যালয়ে জেরার্ড অব ক্রেমোনা ও মাইকেল স্কট-এর মতো অনুবাদকরা সক্রিয় ছিলেন। তারা হিপোক্রেটিস, গ্যালেন, প্টোলেমি, অ্যারিস্টটল, ইবন সিনা ও ইবন রুশদের গ্রন্থ লাতিনে অনুবাদ করেন। এর মাধ্যমে ইউরোপে গ্রিক ও ইসলামি জ্ঞান সমানভাবে প্রবাহিত হয়।

ক্রুসেড থেকে ফেরা ইউরোপীয়রা ইসলামি অঞ্চল থেকে বহু গ্রিক ও রোমান পাণ্ডুলিপি নিয়ে আসে। ইউক্লিডের জ্যামিতি, টলেমির জ্যোতির্বিদ্যা বা অ্যারিস্টটলের দর্শন – এগুলো প্রথমে আরবি অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপীয়দের হাতে আসে, পরে লাতিনে অনূদিত হয়। মুসলিম পণ্ডিতরা প্রাচীন গ্রিক জ্ঞানের সেতুবন্ধ রচনা করেছিলেন। যদি তারা জ্ঞান সংরক্ষণ ও অনুবাদ না করতেন, ইউরোপীয় রেনেসাঁ এভাবে বিকশিত হতো না। ইতিহাসবিদ জর্জ মাকদিসি এমনকি মন্তব্য করেছেন, রেনেসাঁ মানবতাবাদের কিছু বৈশিষ্ট্য মধ্যযুগের ইসলামি বিশ্ব থেকে উৎসারিত। উদাহরণস্বরূপ, শুদ্ধ ভাষার প্রতি আকর্ষণ এবং বক্তৃতাশাস্ত্রের কৌশল (ars dictaminis) – যা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অতএব, ইউরোপের রেনেসাঁর ভেতরে মুসলিম সভ্যতার অবদান ছিল এক অদৃশ্য কিন্তু অপরিহার্য শক্তি, যদিও ইতিহাসে তা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়েছে।

নবজাগরণে মধ্যযুগের “অন্ধকার” দূরীকরণ ও আধুনিক চিন্তাধারার উন্মেষ

মধ্যযুগকে প্রায়শ “অন্ধকার যুগ” বলা হয়, কারণ সে সময় ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধে এক ধরনের স্থবিরতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি বিরাজ করছিল। অবশ্য আধুনিক ঐতিহাসিকরা মধ্যযুগকে সম্পূর্ণ অন্ধকার হিসাবে দেখতে নারাজ, তবু নবজাগরণের সাথে তুলনা করলে এটা স্পষ্ট যে রেনেসাঁ মানবমনের এক মুক্তির যুগ ছিল। এই যুগে ইউরোপের চিন্তাধারায় যে পরিবর্তন আসে তা প্রধানত চারটি ধারায় দেখা যায়: মানবতাবাদ, বিজ্ঞানচর্চায় যুক্তিবাদ ও পরীক্ষা, ধর্মীয় কর্তৃত্বের সমালোচনা এবং মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন। এর ফলে মধ্যযুগের ধর্মকেন্দ্রিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যানধারণা থেকে সরে এসে আধুনিক বিশ্বদৃষ্টির জন্ম হয়।

প্রথমত, মানবতাবাদ:রেনেসাঁর মানবতাবাদীরা বিশ্বাস করতেন মানুষ নিজের যুক্তি ও সক্ষমতার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন ও সমাজ উন্নয়ন সম্ভব। তারা ভাবতেন মধ্যযুগে যেভাবে প্রত্যেক বিষয়ে চার্চের নির্দেশ মেনে চলা হয়েছে, তা সংস্কার করা দরকার। ফলস্বরূপ, পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ক্যাথলিক চার্চের কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে। ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্বের পরিবর্তে মানবিক বিদ্যার চর্চা শুরু হয়, যার পরিণতিতে মার্টিন লুথার প্রভৃতি সংস্কারক গির্জার বিরোধিতা করে আলাদা মতবাদ প্রচার করেন। অ্যাবারনেথি লিখেছেন, মানবতাবাদ এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছিল যেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় আন্দোলন ও উপদল জন্ম নিতে পারে … মার্টিন লুথার ক্যাথলিক চার্চের সংস্কারের কথা জোর দিয়ে বলেন এবং পাপমোচনের নামে জিন্দা বিক্রি, নেপোটিজম ইত্যাদি দূর করার দাবি তোলেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৫১৭ সালে লুথার প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, যা চার্চের হাজার বছরের একক প্রভাব ভেঙে বহু মতের সহাবস্থানের সুযোগ করে দেয়। নবজাগরণের মানবতাবাদীরা ধর্মকে পুরোপুরি অস্বীকার না করেও, ধর্মীয় বিষয়ে ব্যক্তিগত বোঝাপড়া ও পবিত্র গ্রন্থের নিজস্ব解釈কে গুরুত্ব দেন। যেমন, গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র (১৪৫০-এর দিকে উদ্ভাবিত) দ্বারা বাইবেলের অনুবাদ ও ছাপানোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নিজ ভাষায় বাইবেল পড়ার সুযোগ পায়। এর ফলে জনগণ চার্চের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজেরাই ধর্মগ্রন্থের কথা ভাবতে শুরু করে – যার ফল একদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ, অন্যদিকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও যুক্তিনির্ভর আলোচনা। এটি মধ্যযুগের অন্ধ আনুগত্যের যুগের অবসান ঘটায় এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের বীজ বপন করে।

দ্বিতীয়ত, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চায় বিপ্লব:রেনেসাঁর আগে জ্ঞান অর্জনের উপায় ছিল পুরাতন গ্রন্থ ও কর্তৃপক্ষ নির্ভর; যেমন অ্যারিস্টটল যা বলেছেন বা বাইবেল যা বলেছে তাই শাশ্বত সত্য বলে মেনে নেওয়া হতো। কিন্তু রেনেসাঁর অগ্রণী বিজ্ঞানীরা এই মানসিকতা বদলাতে শুরু করেন। তারা প্রকৃতিকে বোঝার জন্য পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নির্ভর পদ্ধতি গ্রহণ করেন, যা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তি। ইতিহাসবিদদের মতে, এসময় থেকেই বৈজ্ঞানিক চিন্তা ধর্মীয় চিন্তা থেকে আলাদা হতে থাকে – বিজ্ঞান ও ধর্মকে আলাদা জ্ঞানক্ষেত্র হিসেবে দেখা শুরু হয়। উদাহরণ হিসেবে, ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই উন্নত দূরবীন আবিষ্কার করে চাঁদ-গ্রহ পর্যবেক্ষণ করেন ও ভূ-কেন্দ্রিক তত্ত্ব খণ্ডন করে সূর্য-কেন্দ্রিক তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করেন। তাঁর এসব কার্যক্রম ক্যাথলিক চার্চ ভালোভাবে নেয়নি; গ্যালিলিওকে ধর্মধ্বজাধারীরা জাদুবিদ্যা ও ধর্মবিরোধিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং শেষ জীবনে গৃহবন্দি করে রাখে। তবু জ্ঞানের গতিধারা আর থেমে থাকেনি। ১৫৪৩ সালে পোল্যান্ডের নিকোলাস কপার্নিকাস সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের মতবাদ প্রকাশ করেন, যা মধ্যযুগীয় জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। গ্যালিলিও ও কেপলারের কাজ পরবর্তীতে নিউটনের মহাকর্ষ-তত্ত্ব প্রবর্তনের পথ প্রশস্ত করে। এভাবে নবজাগরণের বিজ্ঞানচর্চা মধ্যযুগের চিন্তাকে উল্টে দিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের বুনিয়াদ গড়ে দেয়।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অঙ্কিত “ভিত্রুভিয়ান ম্যান” (প্রায় ১৪৯০) চিত্রটি নবজাগরণে শিল্প ও বিজ্ঞানের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। এই অঙ্কনে মানবদেহের আদর্শ অনুপাত ও জ্যামিতিক সৌন্দর্য প্রদর্শিত হয়েছে, যা রেনেসাঁর মানবতাবাদী ও বৈজ্ঞানিক চেতনার পরিচায়ক। মানুষ যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এবং জ্ঞানার্জনের মানদণ্ড হতে পারে – ভিত্রুভিয়ান ম্যান সেই ধারণাকেই প্রকাশ করে।

তৃতীয়ত, যুক্তিবাদ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা:রেনেসাঁর আগে পশ্চিমা সমাজের জ্ঞানতত্ত্ব প্রধানত আনুগত্য ও ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর ছিল; কিন্তু এই সময়ে দার্শনিকরা গ্রিকদের মতোই জ্ঞানার্জনের জন্য যুক্তি (reason) এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার ওপর জোর দিতে থাকেন। ষোড়শ শতকে ফ্রান্সিস বেকন “জ্ঞান মানে ক্ষমতা” এই মন্ত্রে বিজ্ঞানকে পর্যবেক্ষণ-নির্ভর করার প্রস্তাব দেন এবং Inductive পদ্ধতির গুরুত্ব আরোপ করেন। একই সময়ে ইংল্যান্ডে টমাস হোবস এবং পরবর্তীতে জন লক যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের দর্শন বিকশিত করেন, যেগুলো আলোকায়নযুগে (Enlightenment) আরও বিকশিত হয়। নবজাগরণে এসব বীজ প্রথম বপন হয়েছিল। এমনকি চিত্রকলাতেও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্বের নিখুঁত চিত্রায়ন (perspective প্রযুক্তির মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা আঁকা) শুরু হয়। আর সাহিত্য-নাটকে (যেমন শেক্সপিয়র) মানবচরিত্রের বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ দেখা যায়, যা মধ্যযুগের নৈতিক উপকথা থেকে আলাদা। এভাবে রেনেসাঁ যুক্তি ও বাস্তব অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের প্রধান উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

চতুর্থত, রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তায় পরিবর্তন:রেনেসাঁর আগে ইউরোপে রাজনৈতিক ধারণা ছিল ঈশ্বর কর্তৃক রাজাদের অধিকারপ্রাপ্তি (Divine Right) ও সামন্ততান্ত্রিক আনুগত্যকেন্দ্রিক। রেনেসাঁ এই ধারণায় চ্যালেঞ্জ আনে – বিশেষত ইতালির নগর-রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ম বা সম্রাটের কর্তৃত্ব থেকে সরে গিয়ে নাগরিক স্বাধীনতা ও প্রজাতান্ত্রিক চিন্তার উদ্ভব হয়েছিল। ১৪৯৪ সালের পূর্বে ইতালিতে একাধিক ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র ও ডিউক-কর্তৃত্বাধীন রাজ্য ছিল, যেখানে বণিক ও সাধারণ মানুষ তুলনামূলক স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রশাসনে অংশ নিতে পারছিলেন। ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্র তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য সুপরিচিত ছিল এবং লরেঞ্জো দ্য মেডিচির শাসনামলে সেখানে কূটনীতি, শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে তত্ত্বচর্চা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৫১৩ সালে নিকোলো মাকিয়াভেলি “দ্য প্রিন্স” গ্রন্থে বাস্তববাদী রাজনৈতিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন – তিনি দেখান কীভাবে রাজনীতিকে নীতিশাস্ত্র থেকে আলাদা করে বাস্তব ক্ষমতার যুক্তি অনুযায়ী চালাতে হয়। মাকিয়াভেলির এই রাষ্ট্রচিন্তা মধ্যযুগীয় নৈতিক রাজনীতির ধারণার বিচ্যুতি ঘটায় এবং আধুনিক রাজনীতি-বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে।

রেনেসাঁকূটনীতিরও জন্ম দেয় – আগে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে দূত প্রেরণের চল এত ব্যাপক ছিল না, কিন্তু ইতালির রাজ্যগুলো পরস্পরের সাথে আচরণে একটি কূটনৈতিক প্রথা প্রবর্তন করে যা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্র চুক্তি, দূতাবাস স্থাপন ইত্যাদি রেনেসাঁর অবদান। এছাড়া এই সময়েই আধুনিক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা (ঋণ, বিনিয়োগ, ডবল-এন্ট্রি হিসাববিদ্যা) বিকাশ লাভ করে, যা অর্থনীতি ও বাণিজ্যে বিপ্লব আনে।

উপরে বর্ণিত পরিবর্তনগুলোর সমষ্টিগত ফলাফল হল, রেনেসাঁ ইউরোপকে আধুনিক যুগের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা, রাজনীতি সবক্ষেত্রে নবচেতনার যে সূচনা হয়, তা পরবর্তীকালে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের আলোকপ্রাপ্তির যুগ (Enlightenment) এবং শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করে। ঐতিহাসিক অ্যাবারনেথি বলেন, “নবজাগরণ প্রাচীন বিশ্ব থেকে আধুনিক যুগে পরিবর্তনের সময়; এটি আলোকিত যুগের জন্মের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর প্রস্তুত করে দেয়।” নবজাগরণের অর্জনসমূহ – যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি, দর্শনে মানবকেন্দ্রিকতা, শিল্পে বাস্তববাদ, বাণিজ্যে নতুন পথ – এসবের স্থায়ী প্রভাব ইউরোপীয় সমাজে থেকে যায় এবং আজকের বহু মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠান সেই রেনেসাঁরই উত্তরাধিকার।

তবে এটা উল্লেখযোগ্য যে এই রেনেসাঁর বা নবজাগরণ ইউরোপের জন্য যতই আশীর্বাদ হয়ে আসুক না কেন, এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও বিশ্বমঞ্চে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, রেনেসাঁর কৌতূহল ও অভিযানস্পৃহা ইউরোপীয়দেরকে নতুন ভূমি অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করে – কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার (১৪৯২) ও ম্যাগেলানের পৃথিবীপরিক্রমা (১৫১৯-১৫২২) এর মতো অভিযাত্রা মানবজ্ঞান বাড়ায় বটে, কিন্তু এর সাথে সাথে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ ও দাসব্যবসার যুগও শুরু হয়। ইউরোপীয়রা আমেরিকার আদিবাসীদের উপর রোগ ও শোষণের দুর্বিষহ বোঝা চাপিয়ে দেয়, আফ্রিকা থেকে দাস আমদানি শুরু করে – যাকে “ট্র্যান্স-অ্যাটলান্টিক স্লেভ ট্রেড” বলা হয়। অবশ্য এসব ঐতিহাসিক ঘটনা নবজাগরণী মানবতাবাদের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নবজাগরণ ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্পে উন্নত করে তুললেও বিশ্ব ইতিহাসে উপনিবেশবাদী শক্তির উত্থানও দ্রুততর করে। এই জটিলতাসমূহ সত্ত্বেও, নবজাগরণকে সাধারণত ইতিবাচক আলোকেই দেখা হয় – কারণ এটি মানবসভ্যতার চিন্তার জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করে।

প্রধান উৎস সমূহ:

Abernethy, S. (2016). How the Renaissance changed the world. Medievalists.net. https://www.medievalists.net/2016/04/how-the-renaissance-changed-the-world/

Burckhardt, J. (1990). The civilization of the Renaissance in Italy (S. G. C. Middlemore, Trans.). Penguin Classics. (Original work published 1860)

Encyclopaedia Britannica. (n.d.). Renaissance. In Encyclopaedia Britannica. Retrieved September 20, 2025, from https://www.britannica.com/topic/Renaissance

Haskins, C. H. (1927). The Renaissance of the twelfth century. Harvard University Press.

Jarus, O., & Szalay, J. (2023, March 29). The Renaissance: The ‘rebirth’ of science & culture. Live Science. https://www.livescience.com/55230-renaissance.html

Makdisi, G. (1990). The rise of colleges: Institutions of learning in Islam and the West. Edinburgh University Press.

Stanford Encyclopedia of Philosophy. (2018, September 24). Al-Farabi. In E. N. Zalta (Ed.), The Stanford Encyclopedia of Philosophy (Fall 2018 Edition). https://plato.stanford.edu/entries/al-farabi/

Stanford Encyclopedia of Philosophy. (2018, February 8). Ibn Rushd (Averroes). In E. N. Zalta (Ed.), The Stanford Encyclopedia of Philosophy (Spring 2018 Edition). https://plato.stanford.edu/entries/averroes/

Stanford Encyclopedia of Philosophy. (2018, January 15). Avicenna (Ibn Sina). In E. N. Zalta (Ed.), The Stanford Encyclopedia of Philosophy (Spring 2018 Edition). https://plato.stanford.edu/entries/avicenna/


অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস: উত্থান, পতন ও সভ্যতা–বিজ্ঞানে অবদান

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৭ ১২:১৮:১১
অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস: উত্থান, পতন ও সভ্যতা–বিজ্ঞানে অবদান

অটোমান সাম্রাজ্য (Ottoman Empire) বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও প্রভাবশালী সাম্রাজ্য হিসেবে বিবেচিত। আনুমানিক ১২৯৯ সালে তুর্কি নেতা ওসমান গাজী এই সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং এটি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রায় ছয় শতকেরও বেশি সময় ধরে বিস্তার লাভ করে । ১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীতে অটোমানরা রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং ১৯২২ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের আবির্ভাবের মাধ্যমে এই সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে । অটোমান সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিমের সংযোগস্থলে অবস্থান করে, বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং ইসলামী সভ্যতা ও বিশ্ব সংস্কৃতিতে অনন্য অবদান রেখেছে।

অটোমান সাম্রাজ্যের সূচনা

অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজী (Osman) ছিলেন আনাতোলিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি তুর্কি গোত্রের প্রধান। ১৩শ শতাব্দীর শেষ দিকে সেলজুক তুর্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওসমান তাঁর স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে তোলেন। আনাতোলিয়ায় সেই সময় মঙ্গোল আক্রমণে সেলজুক সালতানাত ভেঙে যায় এবং অসংখ্য ছোট ছোট তুর্কি স্বাধীন রাষ্ট্র (বেইলিক) গড়ে উঠে। ওসমানের পিতা এরতুউরুল পূর্বে সোগুত অঞ্চলে ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যা ওসমানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রধানত্বে রূপ নেয়। ওসমান গাজীর অনুসারীরা নিজেদেরকে ইসলামের ধারক ঘাজি (ধর্মযোদ্ধা) হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং পার্শ্ববর্তী ক্রমশ দুর্বল বিজান্তীয় (বাইজেন্টাইন) শহরগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। ১৩০২ সালে বাইজেন্টাইনের বিরুদ্ধে বাফিয়াসের যুদ্ধে ওসমানের বিজয় তাঁর রাষ্ট্রের উত্থানে ভূমিকা রাখে। সুলতান ওসমান আনুমানিক ১২৯৯ সালে তাঁর ক্ষুদ্র ভূখণ্ডকে স্বাধীন ঘোষণা করেন বলে অটোমান ঐতিহাসিকেরা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বর্ষ ধরা হয় ১২৯৯ সাল। শুরুতে রাজধানী ছিল সোগুত; পরবর্তীতে ওসমানের পুত্র অর্হান ১৩২৬ সালে উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহর বুরসা জয় করে সেখানে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। অর্হানের শাসনামলে অটোমানরা সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলে এবং পাশ্বর্বতী বাইজেন্টাইন অঞ্চলসমূহ অধিকারে আনতে থাকে। ওসমানের নাতি সুলতান মুরাদ (১৩৬২–১৩৮৯) অটোমান রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি মজবুত করেন এবং তাঁর শাসনামলে বলকান অঞ্চলে অটোমানদের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। ১৩৬১ সালে (কিছু মতান্তরে ১৩৬৯) এডির্ন (প্রাচীন এড্রিয়ানোপল) বিজয়ের মাধ্যমে ইউরোপের মাটিতে অটোমানদের স্থায়ী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৮৯ সালের কোসোভোর যুদ্ধে সার্বীয় শক্তির পতন ঘটে, যার ফলে বলকানে অটোমান প্রসার আরও বেগবান হয়। এই প্রাথমিক বিজয়গুলো অটোমানদের একটি ছোট প্রধান্য থেকে এক বৃহৎ সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করে।

ছবি:অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজী

বিকাশ ও বিস্তার

অটোমান সাম্রাজ্য ১৪৫৩ সালের পর একটি বিশ্ব সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। ১৪০২ সালে তৈমুর লঙের সাথে অঙ্কারার যুদ্ধে পরাজয়ের পর সাময়িক বিরতি এলেও সুলতান প্রথম মেহমেদের ঐক্যস্থাপনের মাধ্যমে অটোমানরা পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ (মেহমেদ দ্য কনকুইরর) কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের মাধ্যমে এক হাজার বছরেরও প্রাচীন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান। ঐতিহাসিক এই বিজয়ের ফলে কনস্টান্টিনোপল (অধুনা ইস্তাম্বুল) অটোমানদের রাজধানীতে রূপান্তরিত হয় এবং অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ১৬শ শতকে অটোমানরা তাদের সর্বোচ্চ সম্প্রসারণে পৌঁছে। বিশেষ করে সুলতান সেলিম I ১৫১৪ সালে চালদিরানের যুদ্ধে পারস্যের সাফাভীয় শাহ ইসমাইলকে পরাজিত করে পূর্ব সীমান্ত বিস্তৃত করেন এবং ১৫১৬-১৫১৭ সালে মিশর ও সিরিয়া জয় করে মমলুক সালতানাতের পতন ঘটান। এই অভিযানের ফলে পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ সম্পূর্ণ আরব ভূমি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এবং অটোমান সুলতানেরা মুসলিম বিশ্বের খেলাফতের দাবিদার হন।

মানচিত্রে ১৩০০ থেকে ১৬৮৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং অধিকৃত অঞ্চল

১৬শ শতকের মাঝামাঝি সুলতান সুলেইমান মহান (সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট, শাসনকাল ১৫২০–১৫৬৬) অটোমান সাম্রাজ্যকে তার চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান। সুলেইমান ইউরোপের হৃদপিণ্ড পর্যন্ত সাম্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারণ করেন; তার সময়ে হাঙ্গেরি বিজিত হয় এবং অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা নগরীর দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত অটোমানরা পৌঁছে যায়। তাঁর শাসনামলে সাম্রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল (বলকান ও গ্রিসসহ), মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ইরাক-সিরিয়া-প্যালেস্টাইন-আরব উপদ্বীপ এবং উত্তর আফ্রিকায় আলজেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অটোমান নৌবহর ভূমধ্যসাগরে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে নৌ-অধিনায়ক খাইরুদ্দিন বারবারোসার নেতৃত্বে উত্তর আফ্রিকার উপকূলীয় শহরগুলো অটোমান নিয়ন্ত্রণে আসে। সাম্রাজ্য তিন মহাদেশে (ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা) বিস্তৃত হয়ে প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের বিরাট ভূখণ্ড জুড়ে শাসন করছিল। নিচের মানচিত্রে ১৩০০ থেকে ১৬৮৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং অধিকৃত অঞ্চলের পর্যায়ক্রম দেখানো হয়েছে। এই মানচিত্রে গোলাপি রঙে দেখানো প্রারম্ভিক অটোমান এলাকা (প্রায় ১৩০০ সালে), সবুজ, হলুদ, কমলা ইত্যাদি রঙে বিভিন্ন সুলতানের শাসনামলে অধিগৃহীত অঞ্চল এবং নীল রঙে ১৬৬৩-১৬৮৩ সময়ের শেষ দিকের প্রসারিত ভূখণ্ড চিহ্নিত আছে।

ছবি:সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট, শাসনকাল ১৫২০–১৫৬৬

অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটে ১৭শ শতকের শেষে। ১৬৮৩ সালে দ্বিতীয় ভিয়েনা অবরোধের পূর্ব মুহূর্তে সাম্রাজ্য ভিয়েনার দক্ষিণ পর্যন্ত পৌঁছেছিল এবং দক্ষিন-পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া মাইনর, পূর্ব ইউরোপের ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া, পুরো লেভান্ত, মিশর ও উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা এর অধীনে ছিল। তবে ১৬৮৩ সালের ভিয়েনার যুদ্ধে অটোমানদের পরাজয় ইউরোপের কেন্দ্রাভিমুখী অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়। এরপর ১৬৯৯ সালের কারলোওয়িৎজ চুক্তির মাধ্যমে হাঙ্গেরিসহ মধ্য ইউরোপের বড় অংশ অস্ট্রিয়া ও তার মিত্রদের হাতে চলে যায়। তবুও বলকান অঞ্চল ও আনাতোলিয়ায় অটোমান আধিপত্য আরও এক শতাব্দী স্থায়ী ছিল। সামগ্রিকভাবে, অটোমান সাম্রাজ্যের বিকাশ পর্বে ধারাবাহিক যুদ্ধ ও বিজয়ের মাধ্যমে একটি ক্ষুদ্র সীমান্ত রাষ্ট্র থেকে বিশাল বহুধর্মী-বহুজাতিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।

পতন ও এর কারণ

অটোমান সাম্রাজ্যের পতন একটি ধীর ও বহুস্তরিক প্রক্রিয়া ছিল, যার মূলে রাজনৈতিক অদক্ষতা, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, সামাজিক পরিবর্তন ও সামরিক বিপর্যয়—all মিলিতভাবে কাজ করেছিল। ঐতিহ্যগত ধারণায় ১৫৬৬ সালে সুলতান সুলেইমানের মৃত্যুর পর থেকেই সাম্রাজ্য "পতনের পথে" উঠেছে বলে মনে করা হতো, যদিও আধুনিক গবেষণা দেখায় যে ১৮শ শতকের বেশিরভাগ সময়েও অর্থনীতি, সমাজ ও সামরিক শক্তিতে অটোমানরা যথেষ্ট কার্যকর ছিল। তবে ১৭শ শতকের শেষদিকে শুরু হওয়া কয়েকটি বড় পরাজয় অটোমানদের পশ্চাৎমুখী যাত্রা ত্বরান্বিত করে। ১৬৮৩ সালের ভিয়েনা যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর পর পরই কারলোওয়িৎজ (১৬৯৯) ও পাসারোভিৎস (১৭১৮) চুক্তিতে অটোমানরা ইউরোপের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড হারায়। পরবর্তী সময়ে রুশ সাম্রাজ্যের সাথে ধারাবাহিক যুদ্ধে ক্রিমিয়া ও বলকানের আরও এলাকা খোয়া যায় (যেমন ১৭৭৪ সালের কুচুক-কাইনারজা চুক্তিতে ক্রিমিয়া হারানো)।

১৮শ ও ১৯শ শতকে সাম্রাজ্য অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল হতে থাকে। শাসকবর্গের মধ্যে দুর্নীতি ও ক্ষমতার লড়াই, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের শিথিলতা এবং প্রাদেশিক শাসকদের বেপরোয়া আচরণ রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি করে। অটোমান সামরিক ব্যবস্থাও ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছিল; বিশেষ করে নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল গ্রহণে অনীহা (যেমন, জاںনিসারিদের রক্ষণশীল মনোভাব) সামরিক দক্ষতাকে ক্ষুণ্ণ করে। অর্থনৈতিক দিকে, ইউরোপীয় জাতিগুলো যখন শিল্পবিপ্লবের সুফল পাচ্ছিল, অটোমান অর্থনীতি তখনও কৃষি ও প্রাচীন পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ইউরোপীয়দের সঙ্গে অসম বাণিজ্য চুক্তি (ক্যাপিচুলেশন) ও ঋণগ্রস্ততা অটোমান অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। সাম্রাজ্যের প্রধান বাণিজ্য পথগুলোও ১৬শ শতক থেকে পরিবর্তিত হয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপীয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, ফলে রাজস্ব কমে যায়।

১৯শ শতকের বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল সাম্রাজ্যের বহুজাতিক কাঠামোর ভাঙন। ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উত্থানের প্রভাব অটোমান অধীন জাতিগুলোর মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। গ্রিক, সার্ব, বুলগারিয়ান, আরব প্রভৃতি জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বাধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ফলশ্রুতিতে গ্রিস (১৮২১) ও সার্বিয়া সহ বলকান অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠতে থাকে। অটোমান শাসকরা সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কার চালু করেন, যাকে তানজিমাত (Tanzimat, ১৮৩৯-১৮৭৬) বলা হয়। তানজিমাত ফরমানসমূহ শাসনব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, আইন ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এবং সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার প্রদানের কথা বলেছিল। এসব উদ্যোগ সাময়িক স্থিতিশীলতা আনলেও, অটোমান শাসনমহলে রক্ষণশীল ও উদারপন্থীদের দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক মন্দা ও ঋণের বোঝা আরো বাড়তে থাকে। ১৮৭৬ সালে প্রথম সংবিধান চালু হলেও তা দুবছরের মধ্যেই স্থগিত হয় এবং সুলতান দ্বিতীয় আব্দুলহামিদ একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৮০ ও ১৮৯০-এর দশকে অটোমান সাম্রাজ্যকে ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমে ক্রমশ "ইউরোপের অসুস্থ মানুষ" বলে অভিহিত করা হতে থাকে – যা ইঙ্গিত দেয় যে সাম্রাজ্যটি তখন রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, অর্থনৈতিকভাবে নিঃশেষিত ও অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত ছিল। অবশেষে ১৯০৮ সালে তরুণ তুর্কি বিপ্লবের মাধ্যমে সাংবিধানিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সাম্রাজ্য রক্ষা করার এটি ছিল অন্তিম প্রচেষ্টা। ১৯১২-১৩ সালের বলকান যুদ্ধে অটোমানরা ইউরোপের বাকি অঞ্চলগুলো (মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি) হারায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে অটোমানরা জার্মানির পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ চলাকালে আরব উপত্যকায় শরিফ হোসেইনের নেতৃত্বে আরব বিদ্রোহ ঘটে এবং একই সময়ে অটোমান প্রশাসন আর্মেনিয়ান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নৃশংস নিধন চালায়। বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ১৯১৮ সালে মিত্রশক্তি কনস্টান্টিনোপলসহ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করে এবং সেভ্রের চুক্তি (১৯২০) অনুসারে অটোমান সাম্রাজ্যকে অংশ-বিভাগ করার পরিকল্পনা হয়। তবে তুর্কি জাতীয়তাবাদী নেতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুর্কিরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯২২ সালে অটোমান সুলতানতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। ১৯২৩ সালে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের ছয়শত বছরের শাসনের অবসান ঘটে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে সামগ্রিকভাবে যেসব কারণ কাজ করেছে সেগুলো হলো: যুগোপযোগী সংস্কার করতে ব্যর্থ হওয়া দুর্বল শাসনব্যবস্থা, প্রযুক্তি ও সামরিক কৌশলে পশ্চাৎপদতা, বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত অর্থনীতি, অভ্যন্তরীণ জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির চাপ।

ইসলাম বিকাশে অটোমানদের অবদান

অটোমান শাসকগণ নিজেদের ইসলামের ধারক ও বাহক হিসেবে উপস্থাপন করতেন এবং সাম্রাজ্যের প্রশাসন ও সংস্কৃতিতে ইসলামী আদর্শ গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। বিশেষ করে ১৫১৭ সালে সুলতান সেলিম I মিশর জয় করার পর অটোমানরা খেলাফতের মর্যাদা দাবি করে নেন এবং সেলিম আনুষ্ঠানিকভাবে “খলীফা” উপাধি গ্রহণ করেন। তাই অটোমান সুলতানেরা রাজনৈতিক শাসকের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সুন্নী ইসলাম ছিল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম এবং তারা Hanafi মাজহাব বা বিধান অনুসরণ করতো। ইসলামী আইন (শরিয়া) প্রশাসনের ভিত্তি ছিল, যদিও সুলতানগণ প্রয়োজন অনুযায়ী কানুন নামে নিজেদের আইনও জারি করতেন যেটি শরিয়ার সম্পূরক হিসেবে কাজ করতো। সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তাব্যক্তি ছিলেন “শায়খুল ইসলাম”, যিনি ধর্মীয় বিধান (ফতোয়া) প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। অটোমান শাসনব্যবস্থায় উলেমা বা আলেমসমাজ (ইসলামী পণ্ডিতবর্গ) প্রশাসনিক শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এবং বিচার বিভাগসহ নানাক্ষেত্রে তারা কর্তৃত্ব পালন করতেন।

অটোমানরা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাঁরা সর্বত্র অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন, যেগুলো কেবল ইবাদতের স্থানই ছিল না বরং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করত। উদাহরণস্বরূপ, সুলতান বাইয়েজিদ প্রথম ১৩৯৬-১৪০০ সালে অটোমানদের প্রথম রাজধানী বুরসা শহরে “উলু জামে” (বৃহৎ মসজিদ) নির্মাণ করেন যা ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মসজিদ এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। পরে ইস্তান্বুল বিজয়ের (১৪৫৩) পর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ শহরে বহু মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন, যার মধ্যে ফাতিহ মসজিদ কমপ্লেক্স (১৪৭০ সালে সম্পন্ন) উল্লেখযোগ্য; এই কমপ্লেক্সে মসজিদের সাথে একাধিক উচ্চতর মাদ্রাসা, হাসপাতাল ও লাইব্রেরি অন্তর্ভুক্ত ছিল যা কুলিয়ে নামে পরিচিত। অটোমানদের সময়কালে মাদ্রাসাগুলোতে কোরআন ও হাদিসের পাশাপাশি দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত ও ইতিহাসের পাঠও অন্তর্ভুক্ত থাকত এবং মেধাবী আলেম তৈরিতে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মাদ্রাসাগুলোর ব্যয় ভার বহন করার জন্য “ওয়াক্‌ফ” (ধর্মীয় সম্পত্তি বা ট্রাস্ট) ব্যবস্থা চালু ছিল, যার মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা সম্পত্তি দান করে শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করতেন। এই ওয়াক্‌ফ প্রথার ফলে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্ররাও বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষা ও সামাজিক উন্নতির সুযোগ পেত।

ধর্মীয় নীতির ক্ষেত্রে অটোমানরা শরিয়তকে ভিত্তি মানলেও তারা সাম্রাজ্যের অমুসলিম প্রজাদের প্রতি তুলনামূলক সহনশীল নীতি গ্রহণ করে। অটোমান সাম্রাজ্যে “মিল্লাত” পদ্ধতি চালু ছিল, যার আওতায় খ্রিস্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়গুলোকে নিজস্ব ধর্মীয় নেতৃত্বের অধীনে কিছু স্বায়ত্তশাসন দেয়া হত। তবে অমুসলিম প্রজাদেরকে ঐতিহ্যগত জিজিয়া কর প্রদান করতে হত এবং তারা কিছু ক্ষেত্রে ইসলামি আইনের অধীনেও বিচার পেতেন। অন্যদিকে মুসলমান প্রজাদের জন্য জাকাত ও ওয়াক্‌ফের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। অটোমান সুলতানরা বহু সুফি দরবেশ ও ধর্মীয় সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন; বিশেষ করে বড় বড় সূফি খানকাহ (যেমন কোণ্যা শহরে মেভলভী দরবেশদের কেন্দ্র এবং বектаশি তরিকার খানকাহ) প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণে শাসকদের ভূমিকা ছিল। সামগ্রিকভাবে, অটোমানরা পবিত্র নগরীগুলোর অভিভাবক হিসেবে ইসলাম প্রচার ও রক্ষণা-বেক্ষণে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। মক্কা ও মদিনার পবিত্র মসজিদগুলোর দেখভাল, হজযাত্রীদের নিরাপত্তা এবং মদিনায় নবীর রওজা সংরক্ষণে অটোমান সুলতানরা বিশেষ পদক্ষেপ নিতেন। ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ, ইসলামী শিক্ষার প্রসার ও খেলাফতের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অটোমানরা বিশ্ব ইসলামকে একীভূত ও শক্তিশালী রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

সভ্যতার বিকাশে অবদান

অটোমান সাম্রাজ্য তার দীর্ঘ শাসনামলে শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য, নগর উন্নয়ন এবং সমগ্র সংস্কৃতির বিকাশে অসামান্য অবদান রেখেছে। অটোমান সংস্কৃতি ছিল পারস্য, আরব, তুর্কি ও বাইজেন্টাইন ঐতিহ্যের মিশ্রণে গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। তারা পূর্ববর্তী ইসলামী শিল্পধারাকে আত্মসাত করে নিজস্ব স্বকীয় রূপ দিয়েছিল এবং ইউরোপীয় প্রভাবকেও আংশিকভাবে গ্রহণ করেছিল।

স্থাপত্যকলায় অবদান: অটোমান স্থাপত্য বিশ্বসভ্যতার এক মূল্যবান অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এই স্থাপত্যশৈলী মূলত সেলজুক তুর্ক ও বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের সমন্বয়ে বিকশিত হয়েছে। অটোমানরা গম্বুজ-ভিত্তিক কেন্দ্রীয় নকশার মসজিদ নির্মাণে পারদর্শিতা অর্জন করে, যা আগের সেলজুক স্থাপত্যের সম্প্রসারিত রূপ। ইস্তান্বুলের আয়া সোফিয়া গির্জা (যা পরবর্তী সময়ে মসজিদে রূপান্তরিত হয়) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অটোমান স্থাপত্যে বিশাল গম্বুজ ও চারপাশে অর্ধ-গম্বুজ ব্যবহারের রীতি গড়ে ওঠে। ১৫শ শতাব্দী থেকে ১৬শ শতাব্দীতে অটোমানরা অসংখ্য দর্শনীয় মসজিদ ও ধর্মীয় কমপ্লেক্স তৈরি করেছে, যেগুলো এখনও ইস্তান্বুলসহ প্রাক্তন অটোমান এলাকা সমূহের আকাশরেখা সুবাসিত করে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইস্তান্বুলের ফাতিহ কমপ্লেক্স (১৪৬৩–৭০), বায়েজিদ মসজিদ (১৪৯১), সেলিম মসজিদ (১৫২২) এবং সুলতান সুলেইমানের নামে নির্মিত সুদৃশ্য সুলеймานিয়া কমপ্লেক্স (১৫৫০-এর দশক) উল্লেখযোগ্য। এই সকল স্থাপত্যকর্মের নকশায় বৈচিত্র্য থাকলেও প্রতিটিতে গভীর সুষম বিন্যাস, প্রশস্ত গম্বুজ আর নান্দনিক অলংকরণের সমন্বয় দেখা যায়। অটোমান রাজধানী ইস্তান্বুল ছাড়াও এডির্নে, বুরসা, দামেস্ক, কায়রো, আলজিয়ার্স, সারায়েভো, সোভিয়া প্রভৃতি শহরে অটোমান স্থাপত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে, যা এই সাম্রাজ্যের স্থাপত্যকীর্তির ভৌগোলিক পরিসরকে চিহ্নিত করে।

অটোমান সাম্রাজ্যের ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠত্ব সর্বাধিক প্রকাশ পায় মহান স্থপতি মিমার সিনান (১৪৮৯–১৫৮৮ খ্রি) এর সৃষ্টিকর্মে। সিনান অটোমান দরবারের প্রধান স্থপতি হিসেবে প্রায় অর্ধশতাব্দী কাজ করেন এবং ৩০০-এর বেশি স্থাপনা ডিজাইন করেন। তাঁর নকশাকৃত ইস্তান্বুলের শাহজাদা মসজিদ (১৫৪৮) ও সুবিখ্যাত সুলеймানিয়া মসজিদ (১৫৫৭) এবং এডির্নের.selimiye মসজিদ (১৫৭৫) অটোমান স্থাপত্যকলার শিখর হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে এডির্নের সেলিমিয়া মসজিদকে সিনানের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে অভিহিত করা হয়, যেখানে তিনি সুবৃহৎ গম্বুজকে এমন দক্ষতার সাথে স্থাপন করেছেন যে সমগ্র অভ্যন্তরীণ স্থানে এক অনন্য ঐকতান সৃষ্টি হয়েছে। অটোমান স্থাপত্যের আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল কুলিয়ে ব্যবস্থা – একটি মসজিদকেন্দ্রিক কমপ্লেক্স, যার সাথে বিদ্যালয় (মাদ্রাসা), ভোজনশালা (ইমারত), হাসপাতাল (দারুশ্‌শিফা), গণস্নানাগার (হামাম) এবং দরিদ্রখানা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাক। এই ব্যবস্থা ইসলামিক শহুরে জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সেবা প্রদান করত। অটোমান নির্মাতারা স্থাপত্যে জৌলুসের পাশাপাশি কার্যকারিতার দিকেও জোর দিয়েছিলেন, যা তাদের নির্মিত সেতু, সড়ক, সরাইখানা ও জলসরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়। ইস্তান্বুলে সুয়েমানিয়া কমপ্লেক্সের অংশ হিসেবে একটি হাসপাতাল ও চারটি উচ্চতর মাদ্রাসা ছিল, যা তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করে।

শিল্পকলা ও কারুশিল্প: অটোমান আমলের চিত্রকলা, মিনিয়েচার (অণুচিত্র) শিল্প একটি অনন্য স্তরে উন্নীত হয়। পারস্যের মিনিয়েচার ধারার প্রভাব নিয়ে অটোমান দরবারে নিজস্ব চিত্রশৈলী গড়ে ওঠে। অটোমান মিনিয়েচার চিত্রকররা (প্রায়ই "নক্‌কাশ" নামে পরিচিত) ইতিহাস, সাহিত্য ও রাজকীয় উদযাপন বিষয়ক পান্ডুলিপি অলংকরণে পারদর্শিতা দেখান। উদাহরণস্বরূপ, ১৫৮০-এর দশকে দরবারী চিত্রশিল্পী নক্‌কাশ ওসমান বহু ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি চিত্রায়িত করেন, যাতে সমসাময়িক অটোমান সমাজের জীবনধারা ও ঘটনাবলী চিত্রিত হয়েছে। তাছাড়া, টাইল ও সিরামিক শিল্পে অটোমানরা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। ইজনিক শহরের সিরামিক কারখানাগুলো থেকে উৎপাদিত নীল-সাদা নকশার টাইলস ও বাসনপত্র ১৬শ শতকে উৎকৃষ্ট শৈলী ও গুণমানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এই ইজনিক টাইলস ইস্তান্বুলের সুলতান আহমেদ (নীল মসজিদ) সহ বহু অটোমান স্থাপনায় প্রাচীর অলংকরণে ব্যবহৃত হয়েছে। অটোমানরা শিল্পকলায় সুক্ষ্ম অলংকরণ ও নকশার প্রতি বিশেষ ঝোঁক দেখিয়েছে – তা টেক্সটাইল হোক বা ধাতুশিল্প। অটোমান বুননকলা (বিশেষ করে মখমল ও কার্পেট) এবং সূক্ষ্ম কাজ করা হাতিয়ার ও অলংকারাদি (ফলক, তরবারি, রত্নখচিত পাগড়ির কেশট etc.) দক্ষ কারিগরদের হস্তশিল্পের উৎকর্ষতার নিদর্শন বহন করে। সাহিত্য ও শিক্ষা: অটোমান আমলের সাহিত্যও বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও সাহিত্যিক ভাষা ছিল অটোমান তুর্কি, যেটি আরবি-ফারসি-বাহুল্যপূর্ণ এক ধরনের তুর্কি ভাষা। আদালত ও উচ্চশিক্ষায় তুর্কি ভাষা প্রচলিত থাকলেও কবিতা ও সুফিবাদের ভাষা হিসেবে ফারসি দীর্ঘকাল Preferred ছিল। অটোমান দরবারে "দিভান সাহিত্য" নামে পরিচিত এক ধরণের উচ্চশ্রেণির কবিতা বিকশিত হয়, যেখানে ভাজহাঁস (গযল), কাসিদা প্রভৃতি কবিতার ফর্মে প্রেম, দর্শন ও নৈতিকতা ব্যক্ত করা হত। বিখ্যাত অটোমান কবিদের মধ্যে শেখি, বিজেন্তীয় বংশোদ্ভূত মাহদি এবং পরবর্তীতে বাকী ও ফুযুলীর নাম উল্লেখযোগ্য, যাঁরা তুর্কি ও ফারসি উভয় ভাষায় কবিতা রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া ঐতিহাসিক লেখনিতে অটোমানরা বেশ অগ্রগামী ছিল – বিভিন্ন সুলতানের শাসনকাল এবং যুদ্ধ-বিজয়ের বর্ণনা দিয়ে বহু ইতিহাসগ্রন্থ রচিত হয়। সুলতানি দরবারের নিজস্ব ইতিহাসবিদ (শেহনামেচি) নিয়োগ দেয়া হত, যাঁরা শাসকদের গুণকীর্তন ও ঘটনার লিপিবদ্ধ করতেন। অটোমান সাম্রাজ্যে মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব ১৭২৬ সালে (ইব্রাহিম মাতেফেরিকার উদ্যোগে) শিক্ষাবিস্তার ও জ্ঞানচর্চায় নতুন দ্বার উন্মোচন করে। ধীরে ধীরে ছাপাখানায় ধর্মীয় গ্রন্থসহ নানা বিষয়ের বই প্রকাশিত হতে থাকে, যা জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিস্তারে সহায়তা করে।

সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক জীবন: সাংস্কৃতিক পরিসরে অটোমানরা একটি অনন্য সঙ্গীত ঐতিহ্য সৃষ্টি করে, যা আজকের তুরস্কের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূল ভিত্তি। অটোমান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মূলত দরবারকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়; এতে পারস্য ও আরব সঙ্গীতের প্রভাব ছিল, তবে নিজস্ব ধ্রুপদী ধারা (মাকাম) ও বাদ্যযন্ত্র (তানবূর, নেওয়, কানূন ইত্যাদি) গড়ে ওঠে। দরবারের বাহিরেও সুফি দরবেশদের সংগীত (উদাহরণ: মেভলভীদের সামা নৃত্য সংগীত) গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। অটোমান সামরিক ব্যান্ড বা মেহতর বিশ্বের প্রাচীনতম সংগঠিত সামরিক সঙ্গীত দল হিসেবে পরিচিত, যার জাঁকজমকপূর্ণ নজরকাড়া বাদ্য পরিবেশনা ইউরোপেও দারুণ প্রভাব ফেলে। মোৎসার্ট এবং বেটোফেনের মত অনেক ইউরোপীয় সুরকার অটোমান তুর্কি ব্যান্ডের সুর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের সিম্ফনিতে তথাকথিত "টর্কিশ মার্চ" সুর যুক্ত করেন। সামাজিক জীবনে অটোমানদের নিজস্ব রীতিনীতি ও আচার-সংস্কার গড়ে ওঠে – যেমন তুর্কি কফি পান এবং কফি হাউস সংস্কৃতি, যা অটোমানরা জনপ্রিয় করে তোলে এবং যা আজ বিশ্বজুড়ে প্রসারিত।

সামগ্রিকভাবে অটোমান সাম্রাজ্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির জগতে বহুমুখী অবদান রেখেছে। তাদের শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যকীর্তি শুধু ইসলামী জগতেই নয়, ইউরোপ-এশিয়ার শিল্পকলাতেও ছাপ ফেলেছে। বহু জাতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে অটোমানরা এক বৈচিত্র্যময় অথচ ঐক্যবদ্ধ সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, যার নিদর্শন আজও ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান।

জ্ঞান ও বিজ্ঞানে অটোমানদের অবদান

অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকরা সামরিক বিজয়ের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেও নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। পূর্ববর্তী ইসলামি সোনালি যুগের জ্ঞানতাত্ত্বিক ঐতিহ্য তারা বজায় রেখেছিলেন এবং একই সাথে নতুন নতুন জ্ঞানও সঞ্চারিত করেছিলেন। অটোমান সুলতানরা তাঁদের রাজধানী ও প্রধান নগরীগুলোতে গ্রন্থাগার স্থাপন ও পাণ্ডুলিপি অনুবাদে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। উদাহরণস্বরূপ, কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমির লেখা একটি প্রকাণ্ড ভূগোল গ্রন্থ তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করার নির্দেশ দেন এবং তা অটোমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে অন্তর্ভুক্ত করেন। আবার তাশকোঁপ্রুজাদে আহমদ ও আলী কুশজি (সমরখন্দের এক প্রতিভাবান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ) এর মত পণ্ডিতেরা অটোমান দরবারে যোগ দিয়ে জ্যোতির্বিদ্যা ও গাণিতিক চর্চায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও খগোলবিদ্যায় অটোমানদের একটি বিশেষ কীর্তি হলো ইস্তান্বুলের পর্যবেক্ষণাগার। সুলতান তৃতীয় মুরাদের আমলে বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাকিউদ্দিন মোহাম্মদ (তাকি আল-দীন) ১৫৭৭ সালে কনস্টান্টিনোপলে এক বৃহৎ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক মানমন্দির স্থাপন করেন। ইউরোপে সমসাময়িক টাইকো ব্রাহের মানমন্দিরের সাথে তুলনীয় এই পর্যবেক্ষণাগারে তাকিউদ্দিন অতি উন্নত যন্ত্রপাতি (বৃহদাকার armillary sphere, অত্যাধুনিক নক্ষত্রঘড়ি প্রভৃতি) স্থাপন করেন এবং গ্রহ-নক্ষত্রের নিখুঁত পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। ১৫৭৭ সালের ধূমকেতু আবির্ভাবের ফলে সুলতানের নির্দেশে তিনি এর শুভাশুভ ফল গণনা করেন এবং এটিকে পারস্য জয়ের সুখসূচক নিদর্শন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: এই ধূমকেতুর পরই প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং কিছু প্রভাবশালী আলেম এই মানমন্দিরে জ্যোতিষবিদ্যার চর্চাকে শরিয়তবিরোধী আখ্যা দিয়ে এর বিরোধিতা করেন। ফলশ্রুতিতে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই (১৫৮০ সালে) রাজকীয় আদেশে এই মানমন্দিরটি ধ্বংস করা হয়। তবু এই ক্ষণস্থায়ী প্রচেষ্টাটি অটোমানদের বৈজ্ঞানিক উদ্দীপনার পরিচায়ক। নিচের চিত্রে ১৬শ শতকের ইস্তান্বুল মানমন্দিরে অটোমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কার্যক্রমের একটি দৃষ্টান্তমূলক দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে। ঐতিহাসিক এই মিনিয়েচার চিত্রে দেখা যায়, অটোমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি (টেলিস্কোপ সদৃশ দূরবীন, অস্ত্রলাভ ইত্যাদি) ব্যবহার করে আকাশ পর্যবেক্ষণে রত এবং জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গণনা ও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে অটোমান সাম্রাজ্য ইসলামী চিকিৎসা ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল এবং তাতে নিজস্ব অবদানও রেখেছিল। ১৫শ শতাব্দীতে য়িলদিরিম বায়েজিদের সময়ে বুরসা ও এডির্নেতে হাসপাতালে (দারুশ্‌শিফা) মানসিক রোগের সঙ্গীত ও সুগন্ধ দ্বারা চিকিৎসা practiced হত বলে জানা যায়। এছাড়া ১৫শ শতাব্দীর শেষ দিকে চিকিৎসক শেরাফ্‌এদ্দিন সাবুনকুওগ্লু একটি চিত্রসহ সার্জারি-বিষয়ক বিশ্বকোষ রচনা করেন, যা সমগ্র ইসলামী জগতে মধ্যযুগের শেষ বড় চিকিৎসা বিশ্বকোষ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি সার্জারি সম্পর্কিত বহু যন্ত্রের নকশা দেন এবং তাঁর পুস্তকে অস্ত্রোপচারের পদ্ধতিসমূহ চিত্রায়িত করেন। অটোমানদের অবদানে কিছু নতুন সার্জিক্যাল যন্ত্রের উদ্ভাবনও হয়েছে – যেমন নানা আকারের শল্যচিমটা (forceps), ক্যাথেটার, ছুরি-কাঁচি (scalpel) ইত্যাদি শল্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। তবে এই দাবিগুলোর কিছু আধুনিক গবেষণায় অতিরঞ্জিত বলেও মনে করা হয়, তারপরও এটা স্পষ্ট যে অটোমান চিকিৎসাবিদ্যা পূর্বসূরীদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে এবং হাসপাতাল ও চিকিৎসাশাস্ত্রকে পৃষ্ঠপোষণা দিয়েছে।

অটোমান বিজ্ঞানীরা প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতেও আগ্রহ দেখান। ১৫৮০-এর দশকে তাকি আল-দীন তাঁর লেখায় প্রথম বাষ্পচালিত যন্ত্রের (স্টীম টারবাইন ভিত্তিক steam jack) উল্লেখ করেন এবং ১৫৫১ সালে মিশরে এক প্রকারের বাষ্পচালিত রোটারি থালা আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়। যদিও এই উদ্ভাবনগুলি তৎকালীন সমাজে তেমন প্রভাব ফেলেনি, তবু এগুলো প্রযুক্তিগত চেতনার স্বাক্ষর বহন করে। অটোমান সামরিক প্রযুক্তি ১৫শ শতকেই ইউরোপকে চমকে দেয় – ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল অভিযানে তারা বিশালকায় কামান (“তোপ”) ব্যবহার করে দুর্গের প্রাচীর ভেদ করেছিল, যা সেই যুগের বৃহত্তম কামানগুলোর অন্যতম বলে ধরা হয়। ১৮শ শতকে এসে অটোমানরা ইউরোপীয় প্রযুক্তি সরাসরি গ্রহণে মনোযোগ দেয় – কামরা ও বারুদের কারখানা স্থাপন, সামরিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৭২৬ সালে ইব্রাহিম মুতেফেররিকা নামক এক পণ্ডিত প্রথম আরবি হরফের মুদ্রণযন্ত্র ইস্তান্বুলে প্রতিষ্ঠার অনুমতি পান, যদিও শুরুতে ধর্মীয় আলেমদের আপত্তির মুখে তাকে কিছুটা গোপনে ছাপাখানা চালাতে হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯শ শতকে মহম্মদ আলী পাশার শাসনামলে অটোমান মিশরে শিল্পবিপ্লবের ন্যায় আধুনিক কলকারখানা গড়ে তোলার চেষ্টাও হয় – সেখানে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মাধ্যমে লোহা-ইস্পাত, টেক্সটাইল ও কাগজ কারখানা চালু করা হয়েছিল। অর্থনীতির ইতিহাসবিদ জাঁ বাতু মন্তব্য করেছেন যে মিশরে সে সময় এমন অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল যেখানে সম্ভবত পেট্রোলিয়ামকেও জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারের চিন্তা উদয় হচ্ছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পরিসরটি স্বভাবতই ইসলামী জগতের স্বর্ণযুগের তুলনায় কিছুটা কম উজ্জ্বল হতে পারে, কিন্তু তার পরেও তারা জ্ঞান সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অটোমানরা পূর্ববর্তী গ্রিক ও আরবি গ্রন্থসমূহ তুর্কি ও ফারসিতে অনুবাদ করে ব্যাপক পাঠকের নাগালে নিয়ে আসে। ইস্তান্বুল, বুরসা, এডির্নে প্রভৃতি শিক্ষা কেন্দ্রে সুউচ্চ কাফেলার (মাদ্রাসা) মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জ্ঞানচর্চা অব্যাহত থাকে। অটোমান সাম্রাজ্য যেহেতু তিন মহাদেশব্যাপী বিস্তৃত ছিল, তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রভাবসমূহকে একত্রিত করার সুযোগ পায়। এভাবেই অটোমান পরিমণ্ডলে জ্ঞানের এক সমৃদ্ধ ধারাবাহিকতা বজায় ছিল, যা পরবর্তীতে আধুনিক তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান আন্দোলনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।


মাহাথির মোহাম্মদ ও মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক রূপান্তর: নীতি, সংস্কার ও উত্তরাধিকার

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ আগস্ট ২৪ ২৩:৪১:৪৮
মাহাথির মোহাম্মদ ও মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক রূপান্তর: নীতি, সংস্কার ও উত্তরাধিকার

বিশ শতকের শেষভাগে মালয়েশিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক রূপান্তরের কৃতিত্ব প্রায়ই মাহাথির মোহাম্মদের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সাহসী নীতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তিনি ১৯৮১ থেকে ২০০৩ এবং পরে আবার ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম ২২ বছরের শাসনামলে মাহাথির মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণ ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। একটি পণ্যনির্ভর পশ্চাৎপদ অর্থনীতি থেকে এটিকে রূপান্তরিত করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে গতিশীল উদীয়মান শিল্প অর্থনীতির একটিতে।

তিনি জাতীয় উন্নয়নের জন্য উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি হাতে নেন। এর মধ্যে ছিল Look East Policy, Vision 2020 এবং বিশাল অবকাঠামোগত প্রকল্পসমূহ। তিনি প্রচলিত ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে দ্বিধা করেননি। ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটে আইএমএফ-এর সহায়তা প্রত্যাখ্যান এবং পুঁজি নিয়ন্ত্রণ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি এর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মাহাথির মূলধারার অর্থনীতিতে ইসলামী নীতিমালা যেমন ইসলামী ব্যাংকিং ও সুকুক বন্ড সংযুক্ত করেন। উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেন এবং রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত উদ্যোগ তৈরি করেন উন্নয়নের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।

আশির দশকের শুরু: শিল্পায়ন উদ্যোগ ও “লুক ইস্ট” নীতি

১৯৮১ সালে মাহাথির ক্ষমতায় আসার সময় মালয়েশিয়া তীব্র বাজেট ঘাটতি এবং রাবার, টিন ও পাম তেল রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির চাপে ভুগছিল। শিল্পায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে তিনি একটি বৃহৎ শিল্পায়ন কর্মসূচি হাতে নেন এবং ১৯৮২ সালে প্রবর্তন করেন “Look East Policy”। এর উদ্দেশ্য ছিল জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মনৈতিকতা ও শিল্প দক্ষতাকে অনুসরণ করা।

এই নীতির আওতায় হাজার হাজার মালয়েশিয়ান শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীকে জাপানে পাঠানো হয় এবং জাপানি বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয় মালয়েশিয়ায়। আশা করা হয়েছিল যে পূর্ব এশীয় দক্ষতা ও শৃঙ্খলা মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে স্থানান্তরিত হবে। লুক ইস্ট নীতির ৪০তম বার্ষিকীতে মাহাথির উল্লেখ করেন যে ১৯৮২ সালের পর থেকে ২৬,০০০-এরও বেশি মালয়েশিয়ান জাপানে পড়াশোনা করেছে এবং প্রায় ১,৫০০ জাপানি কোম্পানি মালয়েশিয়ায় কার্যক্রম চালাচ্ছে, যেখানে চার লক্ষাধিক মানুষ কর্মরত।

এই নীতি প্রাথমিকভাবে মালয়েশিয়ার কৌশলগত ঝোঁককে পশ্চিমা নির্ভরতা থেকে সরিয়ে পূর্ব এশীয় মডেলের দিকে নিয়ে যায়। এতে যেমন অর্থনৈতিক বাস্তববাদ প্রতিফলিত হয়, তেমনি উন্নয়নে অধিক জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের জন্য মাহাথিরের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও স্পষ্ট হয়।

মাহাথিরের প্রথম দিককার বছরগুলোতে জাতীয় শিল্প অগ্রদূত তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মালয়েশিয়ার প্রথম জাতীয় গাড়ি কোম্পানি Proton (মিতসুবিশির প্রযুক্তিগত সহায়তায়), যার লক্ষ্য ছিল দেশীয় অটোমোবাইল শিল্প গড়ে তোলা। ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো ভারী শিল্পগুলোকে উৎসাহিত করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত Heavy Industries Corporation of Malaysia (HICOM) এর মাধ্যমে, যা প্রায়ই স্বল্পসুদে জাপানি ঋণ ব্যবহার করে যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হতো।

এই পদক্ষেপগুলোর লক্ষ্য ছিল দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করা এবং শিল্পপণ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো। রাজনৈতিকভাবে এর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল: আধুনিক শিল্পে বুমিপুত্রা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং জাতীয় গর্বের প্রতীক তৈরি করা (যেমন মালয়েশিয়ায় তৈরি গাড়ি), যা জাতিগত অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে সহায়ক হতো। তবে এই রাষ্ট্রনেতৃত্বাধীন শিল্পায়ন উদ্যোগ ব্যয়বহুল ছিল এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতাও দেখা দেয়। যেমন, Perwaja Steel প্রকল্প পরবর্তীতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। তবুও, এই নীতি মালয়েশিয়ার শিল্প অর্থনীতির প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করে।

অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগের উত্থান (মধ্য আশির দশক–নব্বইয়ের দশক)

মধ্য আশির দশকে বৈশ্বিক মন্দা এবং পণ্যের দামের পতন মালয়েশিয়াকে কঠোরভাবে আঘাত করে। ১৯৮৫ সালে দেশটি মন্দার কবলে পড়ে। এই পরিস্থিতি মাহাথিরকে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে। ১৯৮৬ সালের পর তাঁর সরকার রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ থেকে বাজারমুখী নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। অর্থমন্ত্রী দাইম যায়নুদ্দিনের নেতৃত্বে সরকার কৃচ্ছ্রসাধন, নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণের মতো পদক্ষেপ নেয়।

এর আগেই ১৯৮৩ সালে মাহাথির “Malaysia Incorporated” ধারণা উত্থাপন করেছিলেন, যেখানে সরকার ও বেসরকারি ব্যবসাকে উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে কল্পনা করা হয়। নব্বইয়ের দশকে এই ধারণা গতি পায়। অনেক সরকারি দপ্তর করপোরেট রূপে রূপান্তরিত হয় বা বেসরকারীকরণ করা হয়। Telekom Malaysia, Tenaga Nasional, এমনকি Malaysia Airlines-কেও আংশিক বা সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দক্ষতা বাড়ানো, সরকারের আর্থিক বোঝা হ্রাস করা এবং একই সঙ্গে মালয় উদ্যোক্তাদের একটি করপোরেট শ্রেণি তৈরি করা।

মাহাথিরের অবসর গ্রহণের সময় ২০০৩ সালে দেখা যায়, ১৯৮১ সালের তুলনায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়ে ৯০৬-এ দাঁড়িয়েছে এবং বাজার মূলধন ৫৫ বিলিয়ন রিঙ্গিত থেকে বেড়ে ৬৪০ বিলিয়ন রিঙ্গিতে পৌঁছেছে। এটি প্রমাণ করে তাঁর শাসনামলে বেসরকারি খাত কতটা সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণও ছিল এই নীতির আরেকটি মূল লক্ষ্য। ১৯৮৬ সালে সরকার Promotion of Investments Act চালু করে, যেখানে রপ্তানিমুখী উৎপাদনকারীদের জন্য কর প্রণোদনা দেওয়া হয় এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করা বুমিপুত্রা মালিকানার কিছু শর্ত শিথিল করা হয়। এর ফলে উচ্চমূল্যের রপ্তানিমুখী শিল্প, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়।

সময়ও ছিল অনুকূল। ১৯৮৫ সালের Plaza Accord-এর পর জাপানি ইয়েনের মান বাড়তে শুরু করে। ফলে অনেক জাপানি কোম্পানি (পরে কোরিয়ান ও তাইওয়ানিজ কোম্পানিও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উৎপাদন স্থানান্তর করতে থাকে। মালয়েশিয়ার নতুন উদার বিনিয়োগ পরিবেশ এই ঢেউয়ের প্রধান সুবিধাভোগীতে পরিণত হয়। ফলে মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলে সেমিকন্ডাক্টর, ইলেকট্রনিক্স ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার প্রসার ঘটে। পূর্ব এশিয়া থেকে মূলধন ও প্রযুক্তির প্রবাহ মালয়েশিয়াকে নব্বইয়ের দশকে এক দশকব্যাপী উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও কাঠামোগত রূপান্তরের পথে এগিয়ে দেয়। ফলে নব্বইয়ের শুরুর দিকেই মালয়েশিয়া এক প্রধান ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়।

রাজনৈতিকভাবে এ নীতি ছিল মাহাথিরের এক বাস্তববাদী রূপান্তর। পূর্বের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি এটি ছিল Vision 2020-এর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বৈদেশিক মূলধন ও বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াস। নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়া নিয়মিতভাবে ৮–১০ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এবং কৃষি ও খনিজের বাইরেও অর্থনীতিকে দৃঢ়ভাবে বহুমুখীকরণ করে। মাহাথির নিজেও বলেছিলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়া বিশ্বের শীর্ষ ২০ বাণিজ্যিক দেশের একটিতে পরিণত হয়।

প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় মালয়েশিয়া বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে নিজেদের শর্তে একীভূত হতে সক্ষম হয়েছিল। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বাগত জানালেও সরকার-সংযুক্ত কোম্পানি ও নীতির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করা হয়েছিল। এর ফলে প্রবৃদ্ধির সুফল মালয়েশিয়ার জনগণ ভোগ করতে পেরেছিল।

ভিশন ২০২০ ও উচ্চাভিলাষী আধুনিকায়ন কর্মসূচি

১৯৯১ সালে আত্মবিশ্বাসের জোয়ারে ভেসে মাহাথির ঘোষণা করেন Vision 2020। এটি ছিল এক সাহসী জাতীয় কর্মসূচি, যার লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়াকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তর করা। এই দীর্ঘমেয়াদি ভিশন শুধু অর্থনীতি নয়, আরও বিস্তৃত একটি কাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে নয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল একটি বৈজ্ঞানিক ও প্রগতিশীল সমাজ গঠন থেকে শুরু করে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করা পর্যন্ত।

অর্থনৈতিকভাবে ভিশন ২০২০ প্রতি বছর প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ওপর জোর দেয়। রাজনৈতিকভাবে এর উদ্দেশ্য ছিল জাতিগত ভেদাভেদ অতিক্রম করে সকল মালয়েশিয়ানকে সমৃদ্ধি ও আধুনিকতার যৌথ লক্ষ্যের চারপাশে ঐক্যবদ্ধ করা। এটি New Economic Policy (১৯৭০–১৯৯০)-এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে প্রণীত হয়েছিল। NEP মূলত দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পদের পুনর্বিন্যাসে গুরুত্ব দিয়েছিল। আর Vision 2020 সেই ধাপ অতিক্রম করে এক সমন্বিত আধুনিক উন্নয়ন কৌশল প্রস্তাব করে। একই বছর মাহাথির National Development Policy চালু করেন, যা NEP-এর উত্তরসূরি হলেও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণে বেশি জোর দেয়।

নব্বইয়ের দশকের অর্থনৈতিক বুম ও অবকাঠামো উন্নয়ন

নব্বইয়ের দশকের প্রথম ও মধ্যভাগে মালয়েশিয়া এক অর্থনৈতিক বুমের সাক্ষী হয়। এই সময় মাহাথির সরকার দেশকে আধুনিকায়নের জন্য বিশাল অবকাঠামো ও নগর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। মহাসড়ক, আকাশচুম্বী ভবন, বিমানবন্দর, এমনকি নতুন শহরও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় গড়ে ওঠে।

একটি ঐতিহাসিক প্রকল্প ছিল North–South Expressway। এটি ৮৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়ক, যা থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করে। ১৯৯৪ সালে এটি সম্পন্ন হয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সংযোগ বৃদ্ধি পায়। রাজধানী কুয়ালালামপুরের আকাশরেখা পাল্টে যায় Petronas Twin Towers নির্মাণের মাধ্যমে। ৪৫২ মিটার উচ্চতার এই ভবন দুটি ১৯৯৮ সালে সম্পন্ন হলে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনে পরিণত হয়। এতে জাতীয় তেল কোম্পানি পেট্রোনাসের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়। এটি মালয়েশিয়ার আধুনিক আকাঙ্ক্ষা ও দ্রুত উন্নয়নের প্রতীক হয়ে ওঠে।

সরকার নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর KLIA নির্মাণ করে। এটি ১৯৯৮ সালে চালু হয় এবং দ্রুতই বিশ্বমানের বিমানকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। এর পাশাপাশি নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় নতুন প্রশাসনিক রাজধানী Putrajaya-এর নির্মাণ। ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৯ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সেখানে স্থানান্তরিত হয়। পরে এটিকে ফেডারেল টেরিটরি ঘোষণা করা হয়। সুপরিকল্পিত এই শহরে বিশাল সরকারি ভবন, আধুনিক অবকাঠামো, বাগান ও স্মার্ট প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি মাহাথিরের কল্পিত আধুনিক ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিফলন।

আরেকটি দূরদর্শী প্রকল্প ছিল Multimedia Super Corridor (MSC)। ১৯৯৬ সালে চালু হওয়া এই উচ্চপ্রযুক্তি অঞ্চল কুয়ালালামপুর থেকে নতুন বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল সাইবারজায়া শহর। MSC-কে মালয়েশিয়ার “সিলিকন ভ্যালি” হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল প্রযুক্তি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প গড়ে তোলা। মাহাথির নিজেই বৈশ্বিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা প্যানেলও গঠন করেন। ২০০০ সালের মধ্যে বিল গেটসের মতো প্রযুক্তি বিশ্বনেতারা MSC-কে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রযুক্তি উদ্যোগ হিসেবে আখ্যা দেন।

কুয়ালালামপুরে অবস্থিত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, যা ১৯৯৮ সালে সম্পন্ন হয়, সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন হিসেবে খ্যাতি পায়। মাহাথির মোহাম্মদের উন্নয়ন নীতির অধীনে এগুলো শুধু আকাশচুম্বী স্থাপত্যই নয়, বরং মালয়েশিয়ার দ্রুত আধুনিকায়নের গর্বিত প্রতীক হয়ে ওঠে।

নব্বইয়ের দশকে মাহাথির সরকারের রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে শুধু এই টুইন টাওয়ারই নয়, নতুন মহাসড়ক, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং নতুন প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রাজায়া নির্মাণ করা হয়। এসব বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প মালয়েশিয়ার আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং বিশ্বমঞ্চে দেশটির সক্ষমতা তুলে ধরে।

এই প্রকল্পগুলো ছিল ব্যয়বহুল এবং অনেক সময় সমালোচিতও হয়েছে। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এগুলো মালয়েশিয়ার ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোকে উন্নত করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির ভিত্তি স্থাপন করেছে। এসব অবদানের জন্য মাহাথির “বাপা পেমোডেনান” বা “Father of Modernisation” উপাধি অর্জন করেন।

এ ধরনের বৃহৎ রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন আধুনিকীকরণের পেছনে দুটি প্রধান যুক্তি ছিল। অর্থনৈতিকভাবে মাহাথির বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বমানের অবকাঠামো ও প্রতীকী প্রকল্প বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে এবং মালয়েশিয়াকে নবশিল্পায়িত দেশের কাতারে উন্নীত করবে। সত্যিই, ২০০৩ সালের মধ্যে মালয়েশিয়া বিশ্বের ১৭তম বৃহত্তম বাণিজ্যিক জাতিতে পরিণত হয় এবং প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ও সেবা খাত গড়ে তোলে।

ইসলামী অর্থনীতি ও নীতিমালার সংযুক্তি

পশ্চিমা ধাঁচের শিল্প আধুনিকায়নের পাশাপাশি মাহাথিরের মালয়েশিয়া ধীরে ধীরে ইসলামী অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে। এতে দেশের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাস্তবতা প্রতিফলিত হয় এবং মাহাথিরের আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র গড়ার ধারণাও প্রকাশ পায়। আশির দশকে মাহাথিরের সরকার ইসলামীকরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল জনগণের চাহিদা পূরণ করা, একই সঙ্গে ইসলামী বিরোধী দলের প্রভাবও হ্রাস করা। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মালয়েশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক Bank Islam Malaysia Berhad। মাহাথির এটিকে আখ্যা দেন “একটি বৃহত্তর ইসলামী অর্থনীতির প্রথম ধাপ” হিসেবে। এর পরের বছর চালু হয় দেশের প্রথম তাকাফুল বা ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠান, যা শরীয়াহ-সম্মত আর্থিক সেবা প্রদান শুরু করে। এই প্রাথমিক উদ্যোগগুলো মালয়েশিয়াকে আধুনিক ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম অগ্রদূত করে তোলে।

নব্বইয়ের দশক জুড়ে সরকার প্রচলিত ব্যবস্থার পাশাপাশি ইসলামী আর্থিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে থাকে। ১৯৯০ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জিত হয়, যখন Shell MDS বিশ্বের প্রথম সুকুক বা ইসলামী বন্ড মালয়েশিয়ায় ইস্যু করে। এতে ১২৫ মিলিয়ন রিঙ্গিত সংগ্রহ করা হয় এবং শরীয়াহ-সম্মত মূলধনবাজারের নতুন পথ উন্মুক্ত হয়। নব্বইয়ের শেষভাগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ কমিশনে বিশেষ শরীয়াহ উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়, যাতে ইসলামী ব্যাংকিং ও মূলধন বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একই সময়ে ইসলামী আন্তঃব্যাংক অর্থবাজার চালু করা হয়, যাতে ইসলামী ব্যাংকগুলো তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে পারে। মাহাথির এসব উদ্যোগকে সমর্থন করেন, কারণ এগুলো তাঁর কল্পিত অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল ইসলামী রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ইসলাম উন্নয়নের অন্তরায় নয়। মুসলমানরা আধুনিক কাঠামোর মধ্যেও সফল হতে পারে এবং তিনি নীতির মাধ্যমে তা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।

ইসলামী অর্থনীতি সম্প্রসারণের রাজনৈতিক যুক্তি ছিল বহুমুখী। একদিকে এটি মুসলিম নাগরিকদের ধর্মীয়-অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করে। তারা যাতে বিশ্বাস অনুযায়ী ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ করতে পারে, সে সুযোগ তৈরি হ। অন্যদিকে মালয়েশিয়াকে একটি বৈশ্বিক ইসলামী আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করত, যা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মূলধন আকর্ষণ করত।

এই কৌশলের দীর্ঘমেয়াদি সুফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে মালয়েশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুকুক ইস্যুকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। একই সঙ্গে দেশটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ইসলামী ব্যাংকিং খাত গড়ে তোলে। বর্তমানে মালয়েশিয়ার প্রায় ৪৫ শতাংশ অর্থায়ন ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হয়। দেশটি ধারাবাহিকভাবে ইসলামী অর্থনীতি উন্নয়ন সূচকে শীর্ষে থাকে।

১৯৯৭–৯৮ এশিয়ান আর্থিক সংকট: আইএমএফকে অস্বীকার করে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। এটি ছিল এশিয়ান আর্থিক সংকট। ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন আঞ্চলিক মুদ্রার অস্থিরতা দেখা দেয়, মালয়েশিয়াও প্রতিবেশী দেশগুলোর মতোই গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রিঙ্গিতের মান দ্রুত পতন ঘটে, শেয়ারবাজার প্রায় অর্ধেক ধসে পড়ে এবং বিপুল মূলধন দেশ থেকে বেরিয়ে যায়। ১৯৯৮ সালের শুরুর দিকে মালয়েশিয়ার জিডিপি প্রবলভাবে সংকুচিত হচ্ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অত্যন্ত কমে গিয়েছিল।

অনেক পর্যবেক্ষক ধারণা করেছিলেন মালয়েশিয়াও থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আইএমএফের সহায়তা চাইবে এবং কঠোর মিতব্যয়ী নীতি গ্রহণ করবে। সত্যিই, প্রথমদিকে উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে সরকার সুদের হার বৃদ্ধি ও সরকারি ব্যয় কমানোর মতো আইএমএফ-ধাঁচের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মাহাথির ক্রমশ এসব পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। তিনি মনে করছিলেন এগুলো মন্দাকে আরও গভীর করছে এবং দেশের অর্থনৈতিক নীতির নিয়ন্ত্রণ বিদেশি ঋণদাতাদের হাতে চলে যাচ্ছে।

১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি মাহাথির নাটকীয়ভাবে আনোয়ারকে সরিয়ে দেন এবং একেবারে ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মালয়েশিয়া আইএমএফের সহায়তা নেবে না, বরং নিজস্বভাবে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে।

১৯৯৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া রিঙ্গিতের বিনিময় হার মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৩.৮০ নির্ধারণ করে এবং বিদেশে রিঙ্গিত লেনদেন নিষিদ্ধ করে। এর ফলে জল্পনাকারীদের মূলধন পালানোর পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগের ওপর এক বছরের জন্য উত্তোলন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় (পরে তা উত্তোলনের ওপর কর ধার্য করে পরিবর্তন করা হয়)। একই সময়ে আইএমএফের নির্দেশনার বিপরীতে সুদের হার কমানো হয়, যাতে ব্যাংক ঋণ বাড়াতে পারে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হয়। মাহাথির স্পষ্ট করে বলেন যে আইএমএফের সহায়তা প্রত্যাখ্যান করার মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক নীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং কঠোর মিতব্যয়ী পদক্ষেপ এড়ানো। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আইএমএফ-নির্ধারিত নীতির কারণে মন্দা আরও গভীর হয়েছে এবং সেখানে ব্যাপক বেকারত্ব ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়া সেই পথ এড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।

মাহাথিরের এই নীতি শুরুতে সমালোচিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ফিরবে না। কিন্তু বাস্তবে দ্রুত স্থিতিশীলতা আসে। নির্ধারিত বিনিময় হার রিঙ্গিতের পতন থামিয়ে দেয়। ব্যবসার জন্য নিশ্চয়তা তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে সহজ করার দিকে মনোযোগ দিতে পারে। মূলধনের দেশত্যাগ বন্ধ হওয়ায় রিজার্ভ রক্ষা পায় এবং নতুন করে জল্পনামূলক আক্রমণ প্রতিরোধ হয়।

১৯৯৮ সালে অর্থনীতি ৭.৪ শতাংশ সংকুচিত হলেও ১৯৯৯ সালে প্রবৃদ্ধি ফিরে আসে ৬.১ শতাংশে। তা-ও আইএমএফ ঋণ ছাড়াই। এই সাফল্য মাহাথিরের অবস্থানকে অনেকের চোখে বৈধতা দেয়। পরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করে যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অস্থায়ী পুঁজি নিয়ন্ত্রণ বৈধ নীতি হতে পারে। পল ক্রুগম্যানের মতো অর্থনীতিবিদও মন্তব্য করেন যে মালয়েশিয়ার বিকল্প প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিকে গভীর ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে এবং তা পরে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তুলনায় ইন্দোনেশিয়ার আইএমএফ কর্মসূচি এতটাই কঠোর ছিল যে ১৯৯৮ সালে অর্থনীতি ১৩ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে প্রেসিডেন্ট সুহার্তোকে ক্ষমতাচ্যুত করে। মালয়েশিয়া আইএমএফের শর্ত এড়িয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় থেকেও রক্ষা পায়।

রাজনৈতিকভাবে সংকট শুরুর ১৪ মাস পর পুঁজি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা নেতৃত্বের এক দৃঢ় প্রকাশ ছিল। এটি মন্ত্রিসভার প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আনোয়ার ইব্রাহিমকে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করা, যিনি এসব নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। বিতর্ক সত্ত্বেও ফলাফল স্পষ্ট ছিল। মালয়েশিয়া অধিকাংশ প্রতিবেশীর তুলনায় দ্রুত সংকট থেকে বেরিয়ে আসে। কোনো আইএমএফ ঋণ বা শর্ত ছাড়াই এবং মৌলিক শিল্প অক্ষত রেখেই। এই ঘটনাই স্পষ্টভাবে তুলে ধরে মাহাথির ফর্মুলা। বৈশ্বিক প্রচলিত নীতিকে অগ্রাহ্য করার সাহস এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক সংহতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

বেসরকারীকরণ ও রাষ্ট্র-সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান: রাষ্ট্র ও বাজারের মধ্যে ভারসাম্য

মাহাথিরের অর্থনৈতিক কৌশলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনা ও বেসরকারি খাতের দক্ষতার বাস্তবসম্মত সমন্বয়। এর প্রতিফলন ঘটে তাঁর বেসরকারীকরণ কর্মসূচি এবং রাষ্ট্র-সংযুক্ত কোম্পানি বা GLC (Government-Linked Companies) গঠনের মাধ্যমে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়ায় টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, মহাসড়ক থেকে শুরু করে এয়ারলাইন্স পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ করা হয়।

সরকারের দাবি ছিল যে “বেসরকারি খাত-নির্ভর প্রবৃদ্ধি” সেবার মান উন্নত করবে এবং সরকারি আর্থিক বোঝা হ্রাস করবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারীকরণ মানে এই নয় যে রাষ্ট্র পুরোপুরি ব্যবসা থেকে সরে গেছে। বরং প্রায়ই দেখা গেছে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে করপোরেট রূপ দেওয়া হয়েছে, আংশিক শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়েছে, কিন্তু সরকার বা বুমিপুত্রা ট্রাস্ট সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধরে রেখেছে। এর ফলে রাষ্ট্র-সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্থান ঘটে, যেখানে সরকার হয় শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বা রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করত।

Petronas (তেল), Tenaga Nasional (বিদ্যুৎ), Telekom Malaysia এবং POS Malaysia-এর মতো কোম্পানিগুলো করপোরেট কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তবে এসব খাতে সরকার প্রধান অংশীদার বা নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়ে যায়। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সার্বভৌম সম্পদ তহবিল Khazanah Nasional, যা এসব বিনিয়োগ সরকারের পক্ষে পরিচালনা করে।

বেসরকারীকরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল অদক্ষ ও লোকসানী সরকারি সংস্থাগুলোকে বাজারের শৃঙ্খলার আওতায় আনা। এর ফলে উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল। পাশাপাশি বিক্রির অর্থ দিয়ে সরকারের ঋণ কমানো সম্ভব হবে, যা আশির দশকে জিডিপির শতভাগেরও বেশি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মাহাথিরের সংস্কারের পর বাজেট ঘাটতি হ্রাস পায় এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সরকার উদ্বৃত্ত বাজেট চালাতে সক্ষম হয়। বেসরকারি খাতের জিডিপিতে অংশও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

রাজনৈতিকভাবে বেসরকারীকরণ ছিল একটি কৌশল। এর মাধ্যমে New Economic Policy-এর লক্ষ্য অর্থাৎ বুমিপুত্রা ব্যবসায়ী শ্রেণি গড়ে তোলা সম্ভব হয়। অনেক বেসরকারীকৃত চুক্তি বা লাইসেন্স শাসক দলের ঘনিষ্ঠ মালয় ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়। এতে রাজনীতি ও ব্যবসা গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। মহাসড়ক নির্মাণ ছিল এর একটি উদাহরণ। বেসরকারি ঠিকাদাররা দীর্ঘমেয়াদি ও লাভজনক টোল চুক্তি পেত, প্রয়োজনে সরকারি সাহায্যও পেত। এর ফলে এক শ্রেণির “কর্পোরেট মালয়” ব্যবসায়ী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা সরকারি সুবিধার মাধ্যমে উপকৃত হতো। সমালোচকরা একে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বলে অভিহিত করেন। অর্থনীতিবিদ জোমো কে এস মন্তব্য করেছিলেন যে মাহাথির আমলে অনেক সময় “privatization” আসলে “piratization” ছিল। জনগণের সম্পদ সস্তায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হতো এবং সংকটকালে রাষ্ট্র উচ্চমূল্যে আবার তা কিনে নিত।

তবুও মাহাথিরের বেসরকারীকরণ ও রাষ্ট্র-সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান কৌশলের সামগ্রিক প্রভাব মূলত ইতিবাচক ছিল। এর ফলে মালয়েশিয়ায় আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, দক্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সম্প্রসারিত পরিবহন অবকাঠামো গড়ে ওঠে। Petronas-এর মতো কিছু প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং সরকারকে বিপুল রাজস্ব প্রদান করে।

Malaysia Incorporated নীতি, যা সরকার ও ব্যবসার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা তৈরি করেছিল, জাপানের keiretsu মডেলের অনুকরণে গড়ে তোলা হয়। এর ফলে বৃহৎ প্রকল্পে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়। যদিও এতে স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং দুর্নীতি দেখা দেয়, তবুও সরকারকে জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে বেসরকারি খাতকে কাজে লাগানোর সুযোগ দেয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় মালয়েশিয়া একটি তুলনামূলক ভালো ভারসাম্য অর্জন করে। ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির চেয়ে এটি বেশি বাজারভিত্তিক, আর ফিলিপাইনের মতো ল্যাসে-ফেয়ার মডেলের চেয়ে বেশি রাষ্ট্র-সমন্বিত। এই মধ্যপন্থা মালয়েশিয়াকে অবকাঠামোতে কম বিনিয়োগের সমস্যা থেকে রক্ষা করে এবং একই সঙ্গে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অদক্ষতাও এড়াতে সাহায্য করে। এটিই মাহাথির যুগে টেকসই প্রবৃদ্ধির অন্যতম মূল রহস্য।

দ্বিতীয় মেয়াদ (২০১৮–২০২০): সংস্কার, কৃচ্ছ্রসাধন ও যৌথ সমৃদ্ধি

৯২ বছর বয়সে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসেন মাহাথির। এতে তিনি মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনায় আবারও প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পান। তবে প্রেক্ষাপট ছিল একেবারেই ভিন্ন। এ সময় তিনি একটি মধ্যম আয়ের এবং বহুমুখীকৃত অর্থনীতি উত্তরাধিকারসূত্রে পান, যা নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। সরকারি ঋণ ছিল এক ট্রিলিয়ন রিঙ্গিতেরও বেশি (দায়সহ)। পাশাপাশি ছিল 1MDB দুর্নীতির কেলেঙ্কারির প্রভাব এবং প্রবৃদ্ধি শ্লথ হওয়া ও বৈষম্যের উদ্বেগ।

একটি সংস্কারবাদী জোট Pakatan Harapan নেতৃত্ব দিয়ে মাহাথির দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলকে পরাজিত করে। ক্ষমতায় এসে তিনি প্রথমেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের দিকে মনোযোগ দেন। 1MDB কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু করেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এর মাধ্যমে তিনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে Council of Eminent Persons গঠন করেন।

দ্বিতীয় দফায় মাহাথির ব্যয়সংকোচন ও অগ্রাধিকারের ওপর জোর দেন। এটি ছিল নব্বইয়ের দশকের তাঁর বিলাসী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর প্রায় বিপরীত। তিনি যুক্তি দেন অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো জরুরি। তাই পূর্ববর্তী সরকারের শুরু করা একাধিক মেগা প্রকল্প বাতিল বা পুনর্বিবেচনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়ালালামপুর–সিঙ্গাপুর হাই-স্পিড রেল প্রকল্প বাতিল করা হয়। মাহাথির যুক্তি দেন এটি “লাভজনক নয়, আমাদের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে, কিন্তু এর থেকে আয় হবে না।” আরেকটি বড় প্রকল্প, চীন-সমর্থিত ইস্ট কোস্ট রেল লিংক, স্থগিত করে পরে কম খরচে পুনঃআলোচনা করা হয়।

দেশীয়ভাবে সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে বহুল সমালোচিত GST (Goods and Services Tax) বাতিল করে। এর পরিবর্তে চালু করা হয় সহজতর সেলস ট্যাক্স। যদিও এতে সরকারি আয় স্বল্পমেয়াদে হ্রাস পায়, তবুও এটি জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয় এবং ভোগ ব্যয় বাড়াতে সহায়ক হয়।

যৌথ সমৃদ্ধি ভিশন ২০৩০

মাহাথিরের সংক্ষিপ্ত দ্বিতীয় মেয়াদের অন্যতম প্রধান উদ্যোগ ছিল ২০১৯ সালের শেষ দিকে Shared Prosperity Vision 2030 (SPV 2030) চালু করা। স্বীকার করা হয়েছিল যে Vision 2020-এর উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জিত হয়নি, বিশেষ করে সমবণ্টনের ক্ষেত্রে। তাই নতুন এই রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে সকল মালয়েশিয়ানকে একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনমান প্রদান এবং দেশটিকে আবারও “নতুন এশিয়ান টাইগার” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, আয় ও সম্পদের বৈষম্য হ্রাস এবং নতুন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্র চিহ্নিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। উদ্বোধনী ভাষণে মাহাথির বলেন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে “ক্যানসারের মতো অঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে” দূর করতে হবে।

SPV 2030 মূলত অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও সুশাসন সংস্কারকে একত্রিত করে। এতে অতীতের অতিরিক্ততা ও বৈষম্য থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়। এটি ছিল মাহাথিরের বিদায়ী ভিশন যাতে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে সমৃদ্ধি সৃষ্টি করেছিলেন তা টেকসই হবে এবং আরও সমভাবে বণ্টিত হবে।

২০২০ সালের মার্চে রাজনৈতিক পুনর্গঠন এবং একই সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারির সূচনার কারণে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ সংক্ষিপ্ত হয়। মাত্র ২১ মাসে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ফলাফল অর্জিত না হলেও এটি প্রমাণ করে স্বল্প সময়ে পরিবর্তন আনা কতটা কঠিন। তবে প্রতীকীভাবে তাঁর প্রত্যাবর্তন উন্নয়ন দর্শনের স্থায়ী প্রভাবকে তুলে ধরে। তিনি মালয়েশিয়াকে আর্থিক শৃঙ্খলা ও নৈতিক নেতৃত্বের দিকে পুনরায় মনোযোগী করেন। তাঁর মতে, উত্তরসূরীরা যে শৃঙ্খলাবদ্ধ উন্নয়নের পথ থেকে সরে গিয়েছিল তা সংশোধন করার চেষ্টা করেন তিনি।

মাহাথির মোহাম্মদের মোট ২৪ বছরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া এক অসাধারণ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। একটি স্বল্প আয়ের পণ্য রপ্তানিকারক দেশ থেকে এটি পরিণত হয় এক বহুমুখী, উচ্চ-মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে। ১৯৮০ সালে মাথাপিছু জিডিপি যেখানে প্রায় ১,৮০০ ডলার ছিল, তা ২০০০ সালের শুরুর দিকে ৯,০০০ ডলারেরও বেশি হয়ে যায়। দারিদ্র্যের হার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। শতাব্দীর শুরুতে মালয়েশিয়া শুধু রাবার ও পাম তেল নয়, মাইক্রোচিপ ও গাড়িও উৎপাদন করছিল। জনগণ উন্নত দেশের মানসম্মত অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে। মাহাথিরের শাসনামল মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভূদৃশ্যকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে। এজন্য তিনি উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে খ্যাতি পান। দেশীয়ভাবে তিনি “Father of Modernisation” নামে পরিচিত হন। গুরুত্বপূর্ণ হলো, মাহাথির সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও কখনো কখনো কর্তৃত্ববাদী পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, তবে এই স্থিতিশীলতাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছিল।মাহাথির মোহাম্মদের অধীনে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক রূপান্তরের রহস্য ছিল দূরদর্শী পরিকল্পনা, রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ ও অভিযোজিত বাস্তববাদের সমন্বয়ে। তিনি একদিকে বৃহৎ ধারণা যেমন জাতীয় ভিশন, অবকাঠামো বিনিয়োগ ও সামাজিক প্রকৌশলকে কাজে লাগিয়েছেন, অন্যদিকে নীতিতে নমনীয়তা দেখিয়ে কখনো রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, কখনো বাজারমুখী সংস্কার গ্রহণ করেছেন। প্রয়োজনে প্রচলিত বৈশ্বিক নীতি ভেঙে গিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি আমন্ত্রণ করেছেন।

এই দ্বৈত কৌশল—একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ও বৈশ্বিক, প্রচলিত ও অপ্রচলিত—মালয়েশিয়ার অনন্য প্রেক্ষাপটে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং দেশটি একদিকে উৎপাদনশীল শিল্পশক্তি, অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতির বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

আজ মাহাথির যখন ২০২৫ সালে শতবর্ষে পা রাখছেন, সমালোচকরাও স্বীকার করেন যে তিনি মালয়েশিয়াকে রূপান্তরিত, আধুনিকায়িত, শিল্পায়িত এবং শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত করেছেন। তাঁর উত্তরাধিকার জটিল হলেও এটি নিঃসন্দেহে এক মূল্যবান পাঠ, যেখানে অর্থনৈতিক কৌশল ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির সমন্বয়ে জাতি গঠনের দিশা খুঁজে পাওয়া যায়।


আলবার্ট আইনস্টাইনের শেষ মুহূর্ত: এক ছবিতে ধরা পড়ল এক যুগের অবসান

২০২৫ আগস্ট ২০ ১১:০৫:১১
আলবার্ট আইনস্টাইনের শেষ মুহূর্ত: এক ছবিতে ধরা পড়ল এক যুগের অবসান
ছবি: চ্যটজিপিটি

বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে নেমে আসে শোকের ছায়া। ২০শ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানীর জীবনাবসানের খবর প্রথমে পৌঁছায় সংবাদকর্মীদের কাছে, এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সবচেয়ে প্রতীকী হয়ে ওঠে একটি ছবি তার অগোছালো ডেস্কের ছবি, যা ধারণ করেছিলেন লাইফ ম্যাগাজিনের আলোকচিত্রী রালফ মরস।

শেষ ছবির গল্প

১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল, আইনস্টাইন প্রিন্সটন হাসপাতালে মারা যান। খবর শোনামাত্র রালফ মরস ৯০ মাইল দূর থেকে ছুটে আসেন। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছাতেই তিনি দেখেন সেখানে উপচে পড়া ভিড় সাংবাদিক, আলোকচিত্রী ও অসংখ্য মানুষ। মরস পরে বলেছিলেন, “সেখানে কেবল বিশৃঙ্খলা। তাই আমি ছুটলাম ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজে, যেখানে আইনস্টাইন কাজ করতেন।”

পথিমধ্যে তিনি কিনে নেন এক কেস স্কচ হুইস্কি। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট মানুষকে রাজি করানোর হাতিয়ার হিসেবে। মরস জানতেন, নগদ অর্থে মানুষ সবসময় সাহায্য নাও করতে পারে, কিন্তু একটি বোতল মদ অনেক দরজা খুলে দিতে পারে। তার অনুমান সত্যি প্রমাণিত হয়। ভবনের তত্ত্বাবধায়ককে একটি বোতল দিয়ে তিনি আইনস্টাইনের অফিসের দরজা খুলিয়ে নেন।

ভেতরে প্রবেশ করেই মরস ক্যামেরায় বন্দি করেন আইনস্টাইনের ডেস্ক। টেবিলে তখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র, নথি ও অসমাপ্ত কাজ যেন জানান দিচ্ছিল মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও তিনি ছিলেন কর্মমগ্ন। সেই ছবিই হয়ে ওঠে বিজ্ঞানীর শেষ প্রতীকী দলিল। কারণ আইনস্টাইনের দেহ দ্রুত দাহ করা হয়, ফলে মৃত্যুর পর তার কোনো ছবি তোলা সম্ভব হয়নি।

রোগ যন্ত্রণার মাঝেও অবিরাম কাজ

আইনস্টাইনের মৃত্যুর কারণ ছিল অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম ফেটে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। এটি বহু বছর ধরে তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। ১৯৪৮ সালে অস্ত্রোপচার করা হয়, যখন তার পেটে আঙুরফলের মতো বড় ফোলা ধরা পড়ে।

তার চিকিৎসার ইতিহাসে জানা যায়, তিনি বারবার তীব্র ব্যথায় আক্রান্ত হতেন, যা টানা ২-৩ দিন স্থায়ী হতো এবং প্রায়ই বমির সঙ্গে ফিরে আসত। এমন আক্রমণ প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস পরপর দেখা দিত। শারীরিক এই কষ্ট তাকে দুর্বল করলেও থামাতে পারেনি।

১৯৫০-এর দশকেও তিনি প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন। মৃত্যুর দিনেও তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন এক অসমাপ্ত খসড়া ইসরায়েলের সপ্তম স্বাধীনতা দিবসে প্রচারিত হওয়ার জন্য লেখা বক্তৃতা। কিন্তু সেটি আর শেষ করা হয়নি। সেই খসড়াই রয়ে যায় তার জীবনের শেষ লিখিত দলিল।

অবদান রাখার দর্শন

আইনস্টাইনের জীবনদর্শন ছিল স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, “সফল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো না, বরং মূল্যবান মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো।”

১৯১৫ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ এবং ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার জয় করার পরও তিনি বিশ্রাম নেননি। বরং পরবর্তী চার দশক তিনি বিজ্ঞানের ভুবনে অবদান রেখে গেছেন। নিজস্ব অর্জনে থেমে না থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে।

এখানেই তার দর্শনের অনন্যতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু দেওয়ার আছে হোক তা গবেষণা, শিল্পকর্ম, কিংবা পরিবারের প্রতি ভালোবাসা। মানুষের প্রকৃত জীবন কেবল ভোগ করার জন্য নয়, বরং সৃষ্টিশীল অবদান রাখার জন্য।

শেষ মুহূর্তের দর্শন: “আমি আমার কাজ করেছি”

মৃত্যুর ঠিক আগে চিকিৎসকরা তাকে আরেকটি অস্ত্রোপচারের প্রস্তাব দেন। এটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত। আইনস্টাইন শান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তার উত্তর ছিল, “আমি আমার কাজ সম্পন্ন করেছি। এখন চলে যাওয়ার সময়। আমি সেটি করব মর্যাদার সঙ্গে।”

এই বাক্যেই যেন প্রতিফলিত হয় তার সমগ্র জীবনের দর্শন। তিনি জানতেন, তার কাজের প্রকৃত মূল্যায়ন ভবিষ্যৎ করবে। নিজের কাজ নিয়ে রায় দেওয়া তার দায়িত্ব নয়। দায়িত্ব কেবল সৃষ্টি করা, নিজের সর্বোচ্চ দেওয়া।


"Black Skin, White Masks": উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও মানসিক মুক্তির গভীর পাঠ

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ আগস্ট ১২ ১৫:৪৬:০৬
"Black Skin, White Masks": উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও মানসিক মুক্তির গভীর পাঠ

"Black Skin, White Masks" ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষাপটে মার্টিনিকে জন্মানো মনোচিকিৎসক ও দার্শনিক ফ্রাঁৎজ ফানোঁর আত্মজৈবনিক ধাঁচের সমালোচনামূলক রচনা (প্রথম প্রকাশ ১৯৫২)। এই গ্রন্থে ফানোঁ দেখিয়েছেন কীভাবে ঔপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদ মানবমনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয়ের নির্মাণ ও বিকৃতি ঘটে। ফানোঁ মনোবিশ্লেষণ তত্ত্বের সাহায্যে উপনিবেশবাদী সমাজে কৃষ্ণাঙ্গদের নির্ভরতাবোধ ও হীনমন্যতার অনুভূতিগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, একজন কৃষ্ণাঙ্গ যতই শ্বেতাঙ্গদের মতো শিক্ষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করুক না কেন, উপনিবেশবাদীরা তাকে অবশ্যম্ভাবীভাবে নীচু চোখেই দেখবে এই মানসিকতা উপনিবেশিক সমাজে কৃষ্ণাঙ্গদের নীচু অবস্থানে আবদ্ধ রাখার একটি কৌশল। Black Skin, White Masks বা “কালো চামড়া, সাদা মুখোশ” শিরোনামটি ইঙ্গিত দেয় যে কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গ মুখোশ পরছে অর্থাৎ উপনিবেশকারীর ভাষা, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি গ্রহণ করছে শুধুমাত্র মানবিক মর্যাদা পাওয়ার আশায়, যেখানে বর্ণবাদী সমাজ তাদের মানবিকত্ব থেকেই বঞ্চিত করে । বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে পরিচয়, ভাষা, ঔপনিবেশিক ক্ষমতা, মনোবিশ্লেষণ, বর্ণবাদ ও মানসিক মুক্তি ইত্যাদি বিষয় গভীরভাবে আলোচনা করা হয়েছে। প্রকাশের সময় তেমন গুরুত্ব না পেলেও, পরে এই গ্রন্থটি উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের পথিকৃৎ লেখনী হিসেবে স্বীকৃত হয় এবং বিশ্বজুড়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলন, ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রাম ও কৃষ্ণচেতনা আন্দোলনে এর গভীর প্রভাব পড়ে।

পরিচয় ও বর্ণগত পরিচিতি

পরিচয়ের প্রশ্নে ফানোঁ দেখিয়েছেন যে ঔপনিবেশিক শাসনে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে সবসময় শ্বেতাঙ্গের মানদণ্ডে বিচার করা হয়, ফলে তাদের আপন পরিচয় বিকৃত ও বন্দী হয়ে পড়ে। ফানোঁ মন্তব্য করেন যে কৃষ্ণাঙ্গরা “কালোত্বের কারাগারে বন্দী”, আর শ্বেতাঙ্গরা “শ্বেতত্বের কারাগারে” অর্থাৎ বর্ণবাদী কাঠামো প্রত্যেককে তাদের বর্ণের খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখে। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিতে এক কৃষ্ণাঙ্গের পরিচয় তার নিজের দ্বারা নয়, বরং শ্বেতাঙ্গের চোখে নির্ধারিত হয়। একটি প্রসঙ্গগত উদাহরণ হিসেবে ফানোঁ বর্ণনা করেন, এক শ্বেত শিশু তাকে দেখে চিৎকার করে উঠল মা, দেখো একটা কালো মানুষ!” (“Look, a Negro!”) এই বাক্যটি মুহূর্তেই ফানোঁকে অন্যীকৃত (othered) করে দিলো এবং তাকে কেবল গাত্রবর্ণের একটি বস্তুতে পরিণত করলো। এই ঘটনাটি দেখায় যে বর্ণবাদী সমাজে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে সর্বদা শ্বেতাঙ্গের পক্ষপাতদৃষ্টির আয়নায় নিজেকে দেখতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে উপনিবেশাধীন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যে দ্বৈত পরিচয়বোধ সৃষ্টি হয় নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে একরকম, আবার শ্বেতাঙ্গের মাঝে অন্যরকম আচরণ করতে হয়। ফানোঁ লক্ষ্য করেছেন, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ শ্বেতাঙ্গদের সাথে ভিন্নভাবে আচরণ করেন তুলনায় যখন তিনি নিজের কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের মাঝে থাকেন; এই ভিন্নতার মূল কারণ হচ্ছে ঔপনিবেশিক শিক্ষা যা তাকে শিখিয়েছে যে তার কালো পরিচয় নিম্ন মানের। এভাবে বাইরের চাপ ও আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েনে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি নিজের সত্তার সাথেই বিচ্ছিন্ন বোধ করতে শুরু করে।

এই পরিস্থিতিতে ক্রমাগত হেয় প্রতিপন্ন হতে হতে একজন কৃষ্ণাঙ্গ অবচেতনে অনেক সময় বর্ণবাদী ধারণাগুলোকেই সত্যি বলে মেনে নিতে শুরু করে এবং তার মধ্যে একটি হীনমন্যতার বোধ জন্মায়। ফানোঁ দেখিয়েছেন, একজন উচ্চশিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি অনর্গল ফরাসি বললেও শ্বেতাঙ্গরা বিস্ময়ে তাকে আলাদা চোখে দেখে তুমি কত ভালো ফরাসি বলো!” আসলে এর ভেতরে লুকিয়ে থাকে এই ধারণা যে সে কখনোই প্রকৃত “ফরাসি” নয়, কেবল অনুকরণ করছে। অর্থাৎ নিখুঁত শ্বেত মুখোশ পরেও তার কালো চামড়া তাকে সমাজের চোখে সম্পূর্ণ মানুষ হতে দেয় না। কালোত্ব ও শ্বেতত্বের এই দ্বন্দ্বমূলক পরিচয়-সংকট ফানোঁর বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু। উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে ফানোঁ আহ্বান জানান এই আরোপিত পরিচয়ের বেড়াজাল ভেঙে ফেলার জন্য। তিনি লেখেন তাঁর চূড়ান্ত প্রার্থনা: “ওহে আমার দেহ, আমাকে এমন একজন মানুষ করে তোলো যে সদা প্রশ্ন করে যায়!”– অর্থাৎ তিনি চান কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ নিজের পরিচয় নিজে নির্ধারণ করবে, সামাজিক বর্ণবাদী সংজ্ঞার বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রশ্ন তুলে সত্যিকার মুক্ত সত্তা প্রতিষ্ঠা করবে।

ভাষা ও সংস্কৃতি

ভাষা ফানোঁর বিশ্লেষণের একটি মুখ্য বিষয়, যা উপনিবেশিক প্রভুত্বে সংস্কৃতি ও ক্ষমতার বাহক রূপে কার্যকর হয়। ফানোঁ প্রথম অধ্যায়েই ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে লেখেন, “কথা বলা মানে অপরের কাছে পূর্ণভাবে অস্তিত্ব লাভ করা।”

ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে এটির মানে দাঁড়ায় উপনিবেশকারীর ভাষায় কথা বলা মানেই তার সংস্কৃতি ও বিশ্বের অংশ হয়ে যাওয়া। ফানোঁ যুক্তি করেন যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ অ্যান্টিলীয় (ক্যারিবীয়) যদি পারফেক্ট ফরাসি বলতে শেখে, তবে শ্বেতাঙ্গ সমাজ তাকে “আরো সাদা”, অর্থাৎ শ্বেত বিশ্বের চোখে আরও মানবিক বলে মনে করে। এই ধারণাটি বর্ণবাদী বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে যেখানে ফরাসি ভাষা-সংস্কৃতিকে সভ্যতার মানদণ্ড ধরা হয়, আর Afro-Caribbean ক্রেওল ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুচ্ছজ্ঞান করা হয়। ফানোঁ দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের তাঁদের নিজস্ব ক্রেওল ভাষার জন্য লজ্জা পাওয়ানো হত; তাঁদের শেখানো হত যে ঘরোয়া উপভাষা নিম্নমানের, “শুদ্ধ” ফরাসি বলাটাই গৌরবের। তাই উপনিবেশিত কালো মানুষের কাছে ফরাসি ভাষায় দক্ষতা একটি মর্যাদার চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু এতে একটি নিষ্ঠুর বিদ্রূপ লুকিয়ে আছে: একজন কৃষ্ণাঙ্গ যতই নির্ভুল ফরাসি বলুক না কেন, তার কালো ত্বক তাকে শ্বেত সমাজের চোখে ভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করবেই। ফানোঁ এই ঘটনাকে “চামড়াবরণগত হীনতা” (epidermalization of inferiority) বলেছেন যেখানে কালো ত্বক মানেই নিম্নতা, এ ধারণা শ্বেত মানুষের চেতনা ও ভাষায় গেঁথে গেছে। ভাষার প্রসঙ্গে এক ধরনের দ্বৈত সত্তাও তৈরি হয়: একজন কৃষ্ণাঙ্গ নিজের সমাজে যেভাবে কথা বলে, শ্বেতাঙ্গদের সামনে তার চেয়ে ভিন্নভাবে কথা বলতে বাধ্য হয়, কারণ মনের ভেতর জাগরূক থাকে বর্ণবাদী বিচার-বিশ্লেষণ সম্পর্কে উদ্বেগ।

ফানোঁ দেখান যে ভাষা ক্ষমতায়নের হাতিয়ার তো বটেই, তবে তা আত্ম-বিচ্ছিন্নতারও কারণ হতে পারে। একদিকে উপনিবেশকারীর ভাষা শেখা মানে তাদের সাংস্কৃতিক “বিশ্বে” প্রবেশের চাবিকাঠি লাভ করা তিনি লিখেছেন, “যে মানুষ একটি ভাষার মালিক, পরোক্ষভাবে সে ঐ ভাষায় প্রকাশিত সমগ্র জগতেরও অধিকারী।” অন্যদিকে, উপনিবেশকারীর ভাষায় কথা বলার অর্থ বহুসময় নিজের দমানোর প্রক্রিয়াতে শামিল হয়ে পড়া। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা এমন যে, ফরাসি ভাষায় সাবলীল হওয়াটাই যেন উন্নত মানুষের লক্ষণ, আর নিজের দেশের ভাষা-উপভাষা ব্যবহারে লজ্জাবোধ জন্মায় ফলে ভাষার প্রতিটা উচ্চারণ, দৈনন্দিন শব্দচয়ন এমনকি স্বরগত ভঙ্গিতেও উপনিবেশিত ব্যক্তি নিজের অবমূল্যায়নকে বহন করেন। ফানোঁর বর্ণনায় দেখা যায়, ফরাসি ভাষায় “সঠিক” উচ্চারণ রপ্ত করতে গিয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা প্রায়ই বাড়াবাড়ি রকম চেষ্টা করে ফরাসিদের মতো করে ‘র’ উচ্চারণ করতে ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীলন করে। কিন্তু এত কষ্টের পরও বাস্তবতা হল, যখন তারা শ্বেতাঙ্গদের সমাজে কথা বলে, তখনও তাচ্ছিল্য বা অবাক দৃষ্টিতে সম্মুখীন হতে হয়; ভাষায় দক্ষতা তাদের কালো পরিচয়ের কারণে প্রাপ্ত অবমাননা মুছে ফেলতে পারে না। সংক্ষেপে, ফানোঁ ভাষা বিষয়ক আলোচনায় এই বেদনাদায়ক দ্বন্ধ উন্মোচন করেছেন: উপনিবেশিত মানুষকে শেখানো হয় যে উপনিবেশকের মতো কথা বলতে পারলেই সে সম্মান পাবে, কিন্তু বাস্তবে শুধু ভাষাগত দক্ষতা দিয়ে উপনিবেশবাদী সংস্কার কাটিয়ে ওঠা যায় না। সত্যিকার মুক্তি তখনই আসবে যখন ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে ঔপনিবেশিক উৎকৃষ্টতার ভ্রান্ত ধারণাই ভেঙে ফেলা যাবে, যে ধারণা অনুযায়ী উপনিবেশকারীর ভাষা-সংস্কৃতিকেই শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়।

ঔপনিবেশিকতা ও ক্ষমতার কাঠামো

ফানোঁর বিশ্লেষণে ঔপনিবেশিক ক্ষমতার কাঠামোকে সম্পূর্ণতা ও সর্বগ্রাসী রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। তাঁর মতে ঔপনিবেশিকতা এমন একটি প্রকল্প যা মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রতিটি অংশকেই প্রভাবিত ও বিকৃত করে দেয়। এটি কেবল রাজনৈতিক বা শারীরিক দমন নয়, বরং এমন একটি মানসিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য যা উপনিবেশিত ও উপনিবেশকারী উভয়ের সত্তাকেই বিকৃত করে তোলে। ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কীভাবে কাজ করে, ফানোঁ তা উদ্ঘাটন করেছেন শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশকারীরা একটি সম্পূর্ণ মূল্যবোধের ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে যেখানে শ্বেতাঙ্গত্বকে শ্রেষ্ঠ ও কালোত্বকে নিকৃষ্ট বলে স্থাপন করা হয়, এবং এর মাধ্যমে উপনিবেশাধীন জনগণকে অমানবিক করে তোলা হয়। ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান ও সাহিত্য বহুদিন ধরে আফ্রিকান বা কৃষ্ণাঙ্গ লোকদের “বানর ও মানুষের মধ্যবর্তী হারিয়ে যাওয়া কड़ी” হিসেবে চিত্রিত করেছে ফানোঁ এই উদাহরণটি টেনে দেখিয়েছেন যে উপনিবেশবাদীর শাসনমূলক মতাদর্শ আসলে ঘোরতর বর্ণবাদে ভরপুর ছিল। এমন বর্ণবাদী তত্ত্বগুলো অসাম্যের কাঠামোর সপক্ষে কথিত ‘বৈজ্ঞানিক’ যুক্তি জুগিয়েছিল যাতে উপনিবেশকারীরা নিজেদের সভ্যতার বহনকারী হিসেবে এবং উপনিবেশকদের অসহায় অনগ্রসর হিসেবে দেখতে পারে। ফানোঁ ঔপনিবেশিক ক্ষমতার এই প্রপঞ্চ উন্মোচিত করেছেন এবং বলেছেন এটি কোনও সত্যের প্রতিফলন নয় বরং এক ধরনের সহিংসতা। তিনি উল্লেখ করেছেন ঔপনিবেশিক শাসনের সহিংসতারদুটি ধরণরয়েছেপ্রথমত উপনিবেশকের সহিংসতা, যা দেশের মানুষ, মন ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে এবং দেশীয়দের জমি-স্থান দখল করে; এবং দ্বিতীয়ত উপনিবেশাধীনের প্রতিসহিংসতা, যা মর্যাদা, আত্মপরিচয় ও ইতিহাস ফিরে পাওয়ার জন্য তাদের বিদ্রোহ ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়।

ফানোঁ বিশেষভাবে সমালোচনা করেছেন সেই ঔপনিবেশিক মনোবিজ্ঞানকে যা শাসিতদের দুর্দশার জন্য উল্টো তাদেরকেই দোষারোপ করে। চতুর্থ অধ্যায় “উপনিবেশাধীন জনগণের তথাকথিত নির্ভরতা-কমপ্লেক্স” এ ফানোঁ ফরাসি মনোবিজ্ঞানী অক্টাভ মানোনির তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন, যেখানে মানোনি বলেছিলেন উপনিবেশাধীনদের মধ্যে নাকি আগেই থেকে “নির্ভরতাবোধের জটিলতা” ছিল, যা তাদেরকে পরাধীনতা মেনে নিতে প্রস্তুত করেছিল। ফানোঁ তীব্রভাবে এই ধারণা খণ্ডন করেন এবং দেখান যে এতে ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা নিজেদের দোষ এড়ানোর সুযোগ পায় যেন উপনিবেশবাদ না এলেও উপনিবেশাধীনদের মানসিকতার কারণেই শোষণ অনিবার্য ছিলফানোঁ এর বিপরীতে জোর দিয়ে বলেছেন, উপনিবেশাধীন মানুষের মানসিকতায় কোনও নির্ভরতাবোধ বা হীনমন্যতা থাকলে তা ঔপনিবেশিক অত্যাচারের ফল, তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নয়তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইউরোপীয় সমাজই মৌলিকভাবে বর্ণবাদী একটি সমাজ হয় বর্ণবাদী, নয়তো নয়… ইউরোপের কাঠামো বর্ণবাদপূর্ণ” ফলে ইউরোপ যে সমস্ত উপনিবেশ গড়েছিল সেগুলিও অনিবার্যভাবে সেই বর্ণবাদী কাঠামো বহন করেএভাবে ফানোঁ দেখিয়েছেন দোষ উপনিবেশাধীনদের চরিত্রে নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার গভীরে প্রোথিত জাতিগত বিদ্বেষেই সমস্যার মূলে।

এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফানোঁ উপনিবেশিক শাসনের টিকে থাকার পদ্ধতিগুলো আমাদের সামনে স্পষ্ট করেছেন: কেবল বন্দুক বা আইনের জোরে নয়, বরং অত্যাচারিতের মনোজগৎ উপনিবেশ করে রেখেই উপনিবেশবাদ নিজেকে টিকিয়ে রাখে। উপনিবেশকের আধিপত্য উপনিবেশিতের মনে আত্মবিশ্বাসহীনতা ও বিদীর্ণতা সৃষ্টি করে, যা আরও সূক্ষ্ম কিন্তু শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম। ফানোঁর সমালোচনা সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন জীবনেও ঔপনিবেশিক ক্ষমতার সূক্ষ্ম উপস্থিতি লক্ষ্য করে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরও সাবেক উপনিবেশগুলোতে ঔপনিবেশিক যুগের শ্রেণিবিন্যাস ও মানসিক ক্ষত সহজে মুছে যায় না; বরং সেগুলো ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার রূপে রয়ে যায়ফানোঁ মূলত একটি ব্যাপক ও গভীর পরিবর্তনের কথা বলেন সত্যিকারের মুক্তির জন্য কেবল শাসক বদলালেই চলবে না, বরং সেই ঔপনিবেশিক মূল্যবোধকেই সম্পূর্ণভাবে উল্টে দিতে হবে যা শ্বেতাঙ্গকে উচ্চে ও কৃষ্ণাঙ্গকে নীচে স্থাপন করেছিল। তাঁর লেখনী ঔপনিবেশিক ক্ষমতার স্বরূপ উদঘাটন করে বলেছে যে সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জনের পথ রাজনৈতিক বিপ্লবের পাশাপাশি গভীর মানসিক উপনিবেশমুক্তির চেষ্টার মাধ্যমে গিয়েই প্রসারিত হবে।

মনোবিশ্লেষণ ও কৃষ্ণাঙ্গ মানসিকতা

গ্রন্থের মর্মস্থলে রয়েছে বর্ণবাদের (বিশেষত কৃষ্ণবিদ্বেষী বর্ণবাদের) বিশ্লেষণ ও তার বিষাক্ত মানসিক প্রভাবগুলোর অনুসন্ধান। ফানোঁ দেখিয়েছেন কীভাবে বর্ণবাদ একটি শোষিত জনগোষ্ঠীর মনে হীনমন্যতা ও আত্মঅবিশ্বাসের বীজবোনেতাঁরঅন্যতমগুরুত্বপুর্ণবক্তব্যহলবর্ণবাদী সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা কোনও কৃষ্ণাঙ্গই মানসিক ক্ষতি এড়াতে পারে না। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “স্বাভাবিক একটি কালো শিশু, স্বাভাবিক একটি কালো পরিবারে বড় হয়েও, শ্বেত জগতের সামান্য স্পর্শেই অস্বাভাবিক হয়ে পড়বে”অর্থাৎ শিশুকাল থেকে যে-ই কৃষ্ণাঙ্গ একটি পক্ষপাতদুষ্ট শ্বেতাঙ্গ সমাজের মুখোমুখি হয়, তার মনে আঘাত লাগবেই, যদিও সে নিজ পরিবারে একদম স্বাভাবিক পরিবেশে মানুষ হয়ে থাকে। ফানোঁ ব্যাখ্যা করেছেন, অল্প বয়স থেকেই কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা এমন এক সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয় যেখানে বইপত্র, কার্টুন, কমিকস প্রভৃতিতে কালো চরিত্রদের খলনায়ক বা দুষ্কৃতিকারী রূপে দেখানো হয়; “কালো মানেই মন্দ” এই ধারণা তাদের অজান্তেই শিখিয়ে দেওয়া হয়শৈশবের এই মানসিক প্রভাবকে তিনি এক প্রকারের “সমষ্টিগত আঘাত” (collective trauma) বলেন যা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটির মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে, আবার তা গোটা সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতার অংশও হয়ে ওঠেএভাবে বড় হতে হতে অনেকে নিজের অচেতনে ওই নেতিবাচক সংস্কারগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে হীনমন্যতার অনুভূতি: শুধু কালো হওয়ার “দোষে” সারাক্ষণ নিজেকে অধম ও অক্ষম মনে করার মানসিকতা।

ফানোঁর বিবৃত “হীনমন্যতা-গ্রন্থি” (inferiority complex) ধারণাটি তাঁর বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ঘনঘন বর্ণবৈষম্যের মুখোমুখি হয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা নানা প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে কেউ অতিরিক্ত মেধা বা যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করে, কেউবা শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠের চালচলন-ফ্যাশন অবলম্বন করে নিজেকে মানিয়ে নিতে চায় কিন্তু এসব চেষ্টায়ও মনের গভীরে প্রোথিত আত্মসম্মানের অভাব মেটে না। শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ এমন এক ব্যবস্থা যা অত্যাচারিতের হাড়-মজ্জায় নিজের নিম্নতার ধারণা প্রবেশ করিয়ে দেয়। ফানোঁ বর্ণনা করেছেন, একটি কৃষ্ণাঙ্গকে দেখামাত্রই অনেক শ্বেতাঙ্গের মনে একগুচ্ছ অবচেতন অপমানসূচক ধ্যানধারণা কাজ করে (যেমন: “নিগ্রো মানেই অমনোষ্য, অপরাধপ্রবণ, অমেধাবী”), এবং এই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির আত্মছবিকেও ক্রমশ ভারী করে তোলে। এর একটি উদাহরণ সেই “দেখো, একটা কালো মানুষ!” ঘটনাটি যেখানে কালো ব্যক্তিকে কৌতূহল বা ভয়ের বস্তু হিসেবে দেখানো হয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে নয়এরকম অভিজ্ঞতা বারবার হতে থাকলে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি নিজের প্রতিও সন্দেহ করা শুরু করতে পারে: “আমি কি সত্যিই নগণ্য?” এ প্রশ্ন জাগতে পারে। ফানোঁ বর্ণবাদ-বিশ্লেষণে আরও উল্লেখ করেছেন, ইহুদি-বিদ্বেষ ও কৃষ্ণ-বিদ্বেষের তফাৎটি লক্ষ্যণীয়: জঁ-পল সার্ত্রের বিশ্লেষণ টেনে তিনি দেখান যে ইহুদি-বিদ্বেষীরা ইহুদিদের অতিশয় ক্ষমতাবান বলে ভয় পায়, কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে বর্ণবাদীরা ধরে নেয় যে কালো মানুষ অক্ষম ও দুর্বল, তাই তাকে অপমান ও অবজ্ঞা করা যায়এ ধরনের বিদ্বেষ তাচ্ছিল্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকে; প্রতিপাদ্য বিষয় হলো কালো মানুষ নাকি যোগ্যতার দিক থেকে শূন্য। সমাজের সর্বস্তরে এমন বার্তা প্রতিনিয়ত প্রচারিত হলে অনেক কৃষ্ণাঙ্গের মনেও অজান্তে বদ্ধমূল হয়ে যায় যে সে বোধহয় সত্যিই কমবে

তবে ফানোঁ কৃষ্ণাঙ্গদেরকে এই প্রক্রিয়ার নিছক নিষ্ক্রিয় শিকার হিসেবে দেখেন না। তিনি বিশদে আলোচনা করেছেন কীভাবে অনেকে এর প্রতিবাদে নিজেদের মধ্যে গর্ব ও ঐক্যবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি নিগ্রিতুদ (Négritude) আন্দোলনের কথা বলেন যে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন কৃষ্ণাঙ্গদের ঐতিহ্য উদযাপন করে যা কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে নিন্দাবাদের জবাবে গর্বের ধারণা তুলে ধরতে চেয়েছিলফানোঁ যদিও নিগ্রিতুদ ভাবধারার সীমাবদ্ধতার সমালোচনা করেন (কারণ এতে একটি স্থির “কৃষ্ণাঙ্গ সত্তা” ধারণাকে ধারণ করা হয় বলে), তবু তিনি স্বীকার করেন যে এই আন্দোলন কৃষ্ণাঙ্গদের আত্ম-অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে মানসিক স্বস্তি ও প্রতিষেধক কিছুটা হলেও দিয়েছে কালো সুন্দর” এই ঘোষণা আত্মবিশ্বাস জাগাতে সাহায্য করেছেফানোঁর নিজস্ব দৃষ্টিতে, হীনমন্যতার এই গ্রন্থি কাটানোর জন্য প্রয়োজন নিজেদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পুনর্মূল্যায়ন। শ্বেতাঙ্গের বিকৃত দৃষ্টির আয়না ভেঙে ফেলে নিজেদের নতুন করে দেখা জরুরি। যখন একজন কৃষ্ণাঙ্গ উপলব্ধি করবে যে তার হীনমন্যতা আসলে বর্ণবাদের তৈরি একটি মিথ্যা এবং তার দৈন্যের অনুভূতি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উৎপাদিত তখনই সে মুক্তির পথে পা বাড়াতে পারবে। সুতরাং ফানোঁর বর্ণনা বর্ণবাদের প্রভাব সম্পর্কে একদিকে খুবই অন্ধকার ও হতাশাজনক কীভাবে এটা মানুষের মনকে সম্পূর্ণ বিষাক্ত করে দিতে পারে কিন্তু অন্যদিকে আশাবাদী ইঙ্গিতও আছে যে চেতনা ও সংগ্রামের মাধ্যমে এই মানসিক শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব, মুক্তির সম্ভাবনা এখনো জীবিত।

মানসিক মুক্তি

Black Skin, White Masks গ্রন্থের অন্তিম লক্ষ্যে ফানোঁ যে বিষয়ে পৌঁছতে চান তা হল ঔপনিবেশিক অবস্থা থেকে মানসিক মুক্তি অর্জনের সম্ভাবনা। উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের যত মনস্তাত্ত্বিকব্যাধিতিনিশনাক্তকরেছেন, সেসবেরনিরাময়েরপথনিয়েওতিনিভাবেনবইয়েরশেষেফানোঁভবিষ্যতেরদিকেনজররেখেপ্রায়আশাবাদীসুরেলিখেছেনসত্যিকারের মুক্তির জন্য অতীতের শৃঙ্খল থেকে একটা আমূল ছেদ দরকার, ভবিষ্যতকে নতুনভাবে কল্পনা করা দরকার। ফানোঁ জোর দিয়ে বলেছেন যে কৃষ্ণাঙ্গ জনগণকে অত্যাচারের ইতিহাসে আবদ্ধ হয়ে থাকলে চলবে না: “আমরা ইতিহাসের দাস নই… যেকোনো ধরনের ভবিষ্যৎই সম্ভব”এমনকি তিনি দাসত্ব বা উপনিবেশবাদের জন্য ক্ষতিপূরণের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি মনে করেন অতীতের ভুক্তভোগীতার পরিচয়কে আঁকড়ে ধরে থাকাও কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য একধরনের সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করবেএর বদলে ফানোঁ যে নতুন মানবতাবাদের কল্পনা করেন, তা ঔপনিবেশিক দ্বারা আরোপিত কালো/সাদা বিভাজনের ঊর্ধ্বে এক ঐক্যবোধ যেখানে মানুষ নিজের পরিচয় নিজে গড়ে নেবে, পরাধীনতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে। তাঁর বিখ্যাত সমাপনী বাক্য, “ওহে আমার দেহ, আমাকে এমন একজন মানুষ করে তোলো যে সর্বদা প্রশ্ন করে!”, এই চিন্তার সারমর্ম। এখানে “প্রশ্নকারী মানুষ” বলতে তিনি এমন ব্যক্তি বোঝাচ্ছেন যে চিরদিন সমাজের বেঁধে দেয়া পরিচিতি ও নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যে মাথা নিচু করে বংশানুক্রমে পাওয়া দ্বিতীয় শ্রেণির পরিচয় মেনে নেবে না। অবিরাম প্রশ্ন করার এই মানসিকতা নিজেই এক ধরনের মুক্তি বয়ে আনে: এটি সেই বর্ণবাদী আখ্যানকে চূর্ণ করে যে কৃষ্ণাঙ্গদের শ্বেতাঙ্গদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে হবে বা উপনিবেশবাদ তাদের যা পরিচয় দিয়েছে তাই মেনে নিতে হবে।

বাস্তব ক্ষেত্রে, ফানোঁ যে মানসিক মুক্তির কথা বলেন তার মানে হল নিজ শর্তে আত্মসম্মান ও আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করা। বইটি জুড়ে তিনি যে কাজটি করেছেন তা হল প্রতিটি “নীচু মানের” মিথকে খণ্ডন করে আত্মমর্যাদার জমি তৈরী করা। উপসংহারে তিনি জোর দেন এই ব্যাপারে যে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে তার মূল্য শ্বেত পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই; বরং নিজস্ব স্বকীয়তায় সে সম্পূর্ণ মানুষের মর্যাদা দাবি করতে পারে। এর অর্থ নিজের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও দৈহিক সত্তাকে কোনরকম লজ্জা বা আত্মঅবিশ্বাস ছাড়াই আপন করে নেওয়া কালো হওয়া”কে লজ্জার কিছু না ভেবে গর্বের সাথে বহন করা। একই সাথে এর অর্থ অন্যদের মানুষত্বকেও নতুনভাবে দেখা: ফানোঁ এমন একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন যেখানে কাউকেই আর একটি নিছক “বস্তুর” বা গতানুগতিক মূর্ত রূপ হিসেবে দেখা হবে না, প্রতিটি মানুষই তার স্বতন্ত্র পরিচয়ে মর্যাদাপূর্ণ হবে। ফানোঁর মুক্তির ধারণা গভীরভাবে ব্যক্তিগত ও মানসিক, কিন্তু এটি সামাজিক বিপ্লবের সঙ্গেও যুক্ত। তার ইঙ্গিত অনুযায়ী একটি সম্পূর্ণ উলট-পালট প্রায় “উদ্‌ঘাটনমূলক” (apocalyptic) পরিবর্তন ছাড়া বর্ণবাদের পুষ্ট বৃক্ষটিকে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়এটি এমন চিন্তারই পূর্বাভাস, যা তিনি পরবর্তীতে দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বলেন সহিংস বিপ্লব এবং নতুন সমাজ নির্মাণের কথা। তবে কালো চামড়া, সাদা মুখোশ গ্রন্থে মূল জোরটি অভ্যন্তরীণ বিপ্লবের উপর: উপনিবেশের মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত মন গড়ে তোলা। ফানোঁর এই বার্তা পাঠককে রাজনীতিক স্বাধীনতার বাইরেও ভাবতে শেখায় মুক্তি মানে কেবল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নয়, নিজের মন-মানসিকতার স্বাধীনতাও, নিজের পরিচয় ও ভবিষ্যৎ নিজে নির্ধারণ করার স্বাধীনতা। বর্ণবাদের বিষাক্ত উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হয়ে নতুন শৃঙ্খলমুক্ত পরিচয় নির্মাণের যে আহ্বান ফানোঁ জানিয়েছেন, তা নিপীড়িত মানুষের মানসিক সুস্থতা ও অগ্রগতির জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে।

উত্তর-ঔপনিবেশিক অধ্যয়নে প্রভাব

ফ্রাঞ্জ ফ্যাননের Black Skin, White Masks উত্তর-ঔপনিবেশিক অধ্যয়ন এবং সমালোচনামূলক তত্ত্বে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। যদিও ইংরেজিভাষী বিশ্বে এটি ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত বিশেষ পরিচিতি পায়নি, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে এসে এটি উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের পাঠ্যক্রমে অপরিহার্য গ্রন্থে পরিণত হয়। এডওয়ার্ড সাঈদের Orientalism এবং গায়ত্রী স্পিভাকের প্রভাবশালী প্রবন্ধগুলোর পাশাপাশি গবেষক ও শিক্ষার্থীরা ফ্যাননের ঔপনিবেশিক পরিচয় নিয়ে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ অধ্যয়ন করতেন, যা ফ্যাননকে এই ক্ষেত্রের এক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।

বইটি এমন সব ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, যা পরবর্তীকালে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিশ্লেষণে গবেষকদের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, বর্ণবাদের অধীনে উপনিবেশিত মানুষের “বাস্তব অভিজ্ঞতা” বা lived experienceএর ধারণা (যেমন “দেখো, একজন নিগ্রো!” মুহূর্ত) পরবর্তীকালে “Othering” এবং ঔপনিবেশিক কথ্য ভাষায় “অন্য” নির্মাণ বোঝার ক্ষেত্রে এক মূল তাত্ত্বিক রেফারেন্সে পরিণত হয়। ফ্যানন অস্তিত্ববাদী দর্শন ও বর্ণভিত্তিক বিশ্লেষণকে একত্রিত করে যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন, তা পরবর্তীতে “উত্তর-ঔপনিবেশিক অস্তিত্ববাদ” বা critical race phenomenology নামে পরিচিত হয়।

বহু প্রভাবশালী তাত্ত্বিক স্পষ্টভাবে ফ্যাননের কাজের উপর ভিত্তি করে তাদের ধারণা গড়ে তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, হোমি কে. ভাভা ফ্যাননের বিশ্লেষণ ব্যবহার করে “হাইব্রিডিটি” ও “মিমিক্রি” ধারণা বিকাশ করেনযা ব্যাখ্যা করে কিভাবে উপনিবেশিত জনগণ আংশিকভাবে উপনিবেশকের সংস্কৃতি গ্রহণ ও রূপান্তর করে নতুন কিছু সৃষ্টি করে। ভাভার বিখ্যাত প্রবন্ধ Interrogating Identity: Frantz Fanon and the Postcolonial Prerogative উত্তর-সংগঠনবাদী যুগে ফ্যাননকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে। একইভাবে, এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর Culture and Imperialism গ্রন্থে ফ্যাননের ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণকে প্রতিরোধ আন্দোলনের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

বৃহত্তর critical race theory-তে, অভ্যন্তরীণ বর্ণবাদ (internalized racism) এবং বর্ণ ও অস্তিত্বের (ontology) মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে ফ্যাননের কাজ অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়েছে। তাঁর এই ধারণাযে বর্ণবাদ নিপীড়িত মানুষের অস্তিত্বকেও বিকৃত করতে পারেআমেরিকা এবং অন্যান্য প্রেক্ষাপটে বর্ণবাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কিত গবেষণায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

ফ্যাননের প্রভাব তত্ত্বের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন ও সাহিত্য পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বর্ণ, জাতি, অভিবাসন, পরিচয় এবং উপস্থাপনা নিয়ে অসংখ্য আলোচনায় তাঁর লেখাগুলো অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। “সাদা মুখোশ” (white masks) এবং “কালো চামড়া” (black skin)এর প্রাণবন্ত রূপক বহু উপন্যাস, চলচ্চিত্র ও শিল্পকর্মে উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিচয়ের সংকট চিত্রিত করতে ব্যবহৃত হয়েছে।

তদুপরি, ফ্যাননের চিন্তাধারা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অভিযোজ্য প্রমাণিত হয়েছে: গবেষকরা তাঁর বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো ব্যবহার করেছেন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম, নারীবাদী সমালোচনা এবং প্রবাসী অভিজ্ঞতার আলোচনায়। গ্লেন কুলথার্ডের Red Skin, White Masks (২০১৪) এবং হামিদ দাবাশির Brown Skin, White Masks (২০১১) সরাসরি ফ্যাননের শিরোনাম ব্যবহার করে যথাক্রমে উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের অবস্থা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বর্ণগতভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছে। এটি প্রমাণ করে যে নিপীড়ন ও পরিচয় নিয়ে ফ্যাননের মূল ভাবনা ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সার্থকভাবে প্রয়োগযোগ্য।

শিক্ষাগত দর্শনের পরিসরে আজ ফ্যাননকে কৃষ্ণাঙ্গ র‍্যাডিকাল ধারা ও ঔপনিবেশিক বিরোধী চিন্তার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। Stanford Encyclopedia of Philosophyএ উল্লেখ আছে যে, ফ্যাননের ধারণাগুলি ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে সময়, স্থান, ভাষা এবং আত্মপরিচয়ের বিশ্লেষণে গভীরভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

উত্তর-ঔপনিবেশিক অধ্যয়নে তাঁর উত্তরাধিকার সর্বাধিক স্পষ্ট এই সত্যে যে, গবেষকরা এখনও তাঁর লেখায় নতুন অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পান। দশক পেরিয়েও ফ্যাননের প্রশ্ন—“উপনিবেশিত হওয়া মানে কী?”, “কিভাবে বর্ণবাদের চক্র ভাঙা যায়?”—আজও সমানভাবে জরুরি। সুতরাং উত্তর-ঔপনিবেশিক গবেষণার ভুবনে Black Skin, White Masks কেবল ঔপনিবেশিকতার সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিশ্লেষণের কাঠামোই সরবরাহ করেনি, বরং এমন এক প্রজন্মের চিন্তাবিদকে অনুপ্রাণিত করেছে যারা এর ধারণাকে চ্যালেঞ্জ, সম্প্রসারণ ও পুনর্নির্মাণ করে চলেছেন।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধ্বংসের ছায়া থেকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার উত্থান

২০২৫ আগস্ট ০৮ ২২:২৮:৪৬
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধ্বংসের ছায়া থেকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার উত্থান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯–১৯৪৫) ছিল মানব ইতিহাসে সংঘটিত সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক বিধ্বংসী যুদ্ধ, যেখানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক, বিমান থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্রের মতো ধ্বংসাত্মক প্রযুক্তির ব্যবহারের নজির স্থাপিত হয়েছিল । এই যুদ্ধটি ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ হিসেবেও পরিগণিত হয়; এতে আনুমানিক ৭০ থেকে ৮৫ মিলিয়ন (৭ থেকে ৮.৫ কোটি) মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যার অধিকাংশই ছিলেন নিরীহ বেসামরিক জনগণ। অক্ষশক্তি (জার্মানি, ইতালি ও জাপান) এবং মিত্রশক্তি (যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স প্রভৃতি) — এ দুই জোট পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় এবং ছয় বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তির বিজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই মহাযুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়, যা পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

প্রেক্ষাপট: যুদ্ধের পটভূমি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী শক্তিগুলো জার্মানির ওপর যেসব কঠোর শর্ত আরোপ করেছিল এবং পরবর্তীকালে সংঘটিত মহামন্দার কারণে ইউরোপ জুড়ে গভীর অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে জার্মানিতে অ্যাডল্‌ফ হিটলারের নাৎসি মতবাদ, ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ এবং জাপানে সাম্রাজ্যবাদী সামরিকতন্ত্র উদ্দীপিত হয়ে ক্ষমতায় আসে। ১৯৩০-এর দশকে একের পর এক আগ্রাসী পদক্ষেপ বিশ্বকে আবার যুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, জাপান ১৯৩১ সালে মাঞ্চুরিয়া দখল করে এবং ১৯৩৭ সালে চীনের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু করে; স্পেনের গৃহযুদ্ধে (১৯৩৬–৩৯) ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো পরোক্ষভাবে লড়াইয়ের ময়দান পায়; আর নাৎসি জার্মানিঅস্ট্রিয়া ও সুডেটল্যান্ড অধিগ্রহণের মাধ্যমে ইউরোপে তাদের বিস্তারবাদী নীতি জোরদার করে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স শুরুতে হিটলারের এসব আগ্রাসন মোকাবিলায় তুষ্টিকরণ নীতি অনুসরণ করলেও ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করার পর আর উদাসীন থাকতে পারেনি। ফলস্বরূপ, ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে; এই ঘোষণার মাধ্যমে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে।

ছবি:নাৎসি বাহিনীর সাথে অ্যাডল্‌ফ হিটলার

মূল ঘটনাপ্রবাহ (১৯৩৯–১৯৪৫)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছয় বছরে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া জুড়ে অসংখ্য সামরিক অভিযান ও গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। সংক্ষিপ্তভাবে বছরের ক্রমানুসারে প্রধান ঘটনাগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

১৯৩৯: সেপ্টেম্বরে নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অল্পদিনের মধ্যেই পোল্যান্ড জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ইউরোপব্যাপী মহাসংঘাতের সূচনা হয়।

১৯৪০: জার্মানি পশ্চিম ইউরোপে ঝড় তোলা অভিযান চালায়। এপ্রিল-মে মাসে ডেনমার্ক ও নরওয়ে দখলের পর মে-জুনে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস হয়ে ফ্রান্সকে পরাস্ত করে জুনের মাঝামাঝিতে প্যারিস অধিকার করে। ফ্রান্স পতনের পর ব্রিটেন এককভাবে নাৎসি হামলার মোকাবিলা করতে থাকে; একই বছরের শেষভাগে অনুষ্ঠিত “ব্যাটল অফ ব্রিটেন” চলাকালে রয়েল এয়ার ফোর্স জার্মান লুফওয়াফের ভয়াবহ বিমান আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।

১৯৪১: নাৎসি জার্মানি ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়নে আকস্মিক আক্রমণ (অপারেশন বার্বারোসা) শুরু করে, যার মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপে বিশাল এক নতুন যুদ্ধফ্রন্ট খুলে যায়। অন্যদিকে, একই বছরের ৭ ডিসেম্বর জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই নৌঘাঁটি পার্ল হারবারসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটিশ ও মার্কিন স্থাপনাগুলিতে আকস্মিক আক্রমণ চালায়। যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং যুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই বৈশ্বিক রূপ লাভ করে।

১৯৪২: বছরের প্রথমার্ধে অক্ষশক্তি তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখলেও বছরের মাঝামাঝি থেকে যুদ্ধের মোড় ঘুরতে শুরু করে। জুন ১৯৪২-এ মার্কিন নৌবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরে মিডওয়ে দ্বীপের যুদ্ধে জাপানের নৌ-বহরকে পরাজিত করে, যা জাপানের আগ্রাসন থামিয়ে দেয়। ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে একই সময়ে নাৎসি বাহিনী স্টালিনগ্রাদ অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে, যদিও বছরের শেষে এসে সেখানে তাদের অগ্রগতি থেমে যায় এবং মিত্রশক্তির প্রতিরোধ জোরদার হতে শুরু করে।

১৯৪৩: এই বছরটিতে মিত্রশক্তি বিভিন্ন ফ্রন্টে পাল্টা আক্রমণে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারিতে স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধ সমাপ্ত হয় মিত্রশক্তির বিজয়ের মাধ্যমে – এই ভয়াবহ সংঘর্ষে সোভিয়েত লালফৌজ নাৎসি বাহিনীর অগ্রযাত্রা সম্পূর্ণরূপে থামিয়ে দেয়। মে মাসে উত্তর আফ্রিকায় জার্মানি-ইতালির যৌথ বাহিনী পরাজিত হয় এবং মিত্রশক্তি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল নিরাপদ করে। জুলাই মাসে মিত্র বাহিনী ইতালির সিসিলি দ্বীপে অবতরণ করে এবং সেপ্টেম্বরে ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার আত্মসমর্পণ করে (ইতালি এরপর মিত্রশক্তির পক্ষে যোগ দেয়)। একই সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে ক্রমাগত নাৎসিদের পিছু হটতে বাধ্য করতে থাকে এবং প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র বাহিনী দ্বীপে দ্বীপে জাপানিদের পরাস্ত করে অগ্রসর হয়।

১৯৪৪: মিত্রশক্তি সর্বাত্মক আক্রমণের মাধ্যমে জয়ের পথে অগ্রসর হতে থাকে। ৬ জুন মিত্র বাহিনী ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে ঐতিহাসিক ডি-ডে অবতরণ পরিচালনা করে এবং পশ্চিম ইউরোপ মুক্ত করার অভিযান শুরু করে। পূর্বদিকে সোভিয়েত সেনারা নাৎসিদের থেকে নিজেদের হারানো ভূখণ্ড ফিরে পেতে থাকেন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো নাৎসি কবল থেকে মুক্ত হতে থাকে। একইসময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনী জাপানের নৌশক্তিকে কার্যত ধ্বংস করে দেয় এবং একের পর এক কৌশলগত দ্বীপ দখলে নিয়ে জাপানের মূল ভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হয়। বছরের শেষ নাগাদ অক্ষশক্তি প্রায় প্রতিটি ফ্রন্টে রক্ষণাত্মক অবস্থানে সংকুচিত হয়ে পড়ে।

১৯৪৫: যুদ্ধের শেষ অধ্যায়ে মিত্রশক্তি সক্রিয়ভাবে অক্ষশক্তির হৃদপিণ্ডে আঘাত হানে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে পশ্চিম দিক থেকে ব্রিটিশ-আমেরিকান ও পূর্ব দিক থেকে সোভিয়েত বাহিনী জার্মান ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। ৩০ এপ্রিল নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার আত্মহত্যা করেন; তার পরপরই ৮ মে নাৎসি জার্মানি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে এবং ইউরোপে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এদিকে প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু জাপান এখনও আত্মসমর্পণে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে আগস্ট ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে হিরোশিমা (৬ আগস্ট) ও নাগাসাকিতে (৯ আগস্ট) দুটো পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ৮ আগস্ট মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে। এই যুগপৎ আঘাতে জাপানীয় সরকার সম্পূর্ণ বিচলিত হয়ে পড়ে এবং ১৫ আগস্ট ১৯৪৫ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু ঐতিহাসিক ছবি।

যুদ্ধের ফলাফল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি বিশ্বের জন্য গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। যুদ্ধশেষে বিশ্ব মানচিত্র পুনর্সংগঠিত হয় এবং ক্ষমতার ভারসাম্য ও সমাজের বিন্যাস নতুনভাবে রূপ পায়। নিচে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি ও প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো।

রাজনৈতিক ফলাফল

দুটি পরাশক্তির উত্থান ও শীতল যুদ্ধ:দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি বিশ্ব রাজনীতি ও ক্ষমতার কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। যুদ্ধ-পূর্ব পৃথিবীতে ইউরোপের একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বৈশ্বিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করলেও, যুদ্ধের পরে সেই পুরনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের স্থান পূরণে আবির্ভূত হয় দুটি নতুন পরাশক্তি — গণতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।

একসময়ের মিত্র এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতাদর্শ দ্রুত বৈরিতার জন্ম দেয়। এর ফলে পৃথিবী প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে শীতল যুদ্ধের মাধ্যমে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লকে বিভক্ত থাকে — একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক জোট এবং অন্যদিকে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন পূর্ব ব্লক। এই সময়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সোভিয়েত প্রভাবাধীন কমিউনিস্ট শাসনে চলে যায়, আর পশ্চিম ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সহযোগিতায় একত্রিত হয়। নাৎসি জার্মানির দখলীকৃত ভূখণ্ড বিভাজনের ফলে জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয় — পূর্ব জার্মানি (সোভিয়েত প্রভাবাধীন) ও পশ্চিম জার্মানি (মার্কিন প্রভাবাধীন)।

শীতল যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য ছিল সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়িয়ে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, গুপ্তচরবৃত্তি, মহাকাশ প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনা। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট এবং ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত-নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ চুক্তি গঠিত হওয়ায় পৃথিবী দুটি শক্তিশালী সামরিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভাজন কয়েক দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা বজায় রাখে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করে।

জাতিসংঘের সৃষ্টি: বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বৈশ্বিক শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ (United Nations) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংলাপ, সহযোগিতা ও সংঘর্ষ প্রতিরোধের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ শুরু করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী আসন বিজয়ী পরাশক্তিগুলো – যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীন – নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়, যা তাদেরকে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ভেটোসহ বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে।

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী দেশগুলোকে (যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম) অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার অধিকাংশ উপনিবেশে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হয় এবং যুদ্ধশেষের মাত্র দুই দশকের মধ্যে ভারত (১৯৪৭), ইন্দোনেশিয়া (১৯৪৫), পাকিস্তান (১৯৪৭), মায়ানমার/বার্মা (১৯৪৮), সিলন/শ্রীলংকা (১৯৪৮), ঘানা (১৯৫৭), আলজেরিয়া (১৯৬২) ইত্যাদি বহু নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয়। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে এসব দেশের উদয়কে ডিকলোনাইজেশন (পূর্ব উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা লাভ) প্রক্রিয়া বলা হয়, যা বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপের শতাব্দীপ্রাচীন প্রাধান্যের অবসান ঘটায়।

অর্থনৈতিক ফলাফল

যুদ্ধধ্বস্ত অর্থনীতি ও মার্কিন আধিপত্য: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপ ও এশিয়ার প্রায় সমস্ত বড় অর্থনীতিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে যায়। যুদ্ধশেষে জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে কলকারখানা ও অবকাঠামো বিধ্বস্ত হওয়ায় খাদ্য ও জ্বালানির মারাত্মক সংকট দেখা দেয়; ১৯৪৫-৪৬ সালের শীতকালে এসব অঞ্চলে অনেক মানুষকেই অনাহার ও দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছিল। এর বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে দূরে থাকায় এবং যুদ্ধ অর্থনীতির জোয়ারে সক্রিয় থাকায় আমেরিকা অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যায়। ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অর্থনৈতিক শক্তি এবং শিল্পোৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।

ইউরোপ পুনর্গঠন ও মার্শাল পরিকল্পনা : যুদ্ধের পর ধ্বংসপ্রায় পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতি পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্র উদার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালে চালু করা মার্শাল পরিকল্পনার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা ও বিনিয়োগ দেয়, যার ফলে এসব দেশ দ্রুত শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এই সহযোগিতার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালির মতো দেশগুলো ১৯৫০-এর দশকে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে মিত্রশক্তি একই সময়ে ব্রেটন উডস সম্মেলনের (১৯৪৪) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করে, যাতে যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনে আর্থিক কাঠামো ও সহযোগিতা নিশ্চিত হয়।পশ্চিম ইউরোপ আমেরিকার সাহায্যে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালেও পূর্ব ইউরোপ সোভিয়েত প্রভাবক্ষেত্রে থাকায় সেখানকার পুনর্গঠন হয় ভিন্ন আদর্শে ও তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে।

জাপানের পুনর্জাগরণ: প্রশান্ত মহাসাগরে পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে সাময়িকভাবে দখলে নিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক-اقتصادی সংস্কার কার্যকর করে। মার্কিন সহায়তায় যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান তার শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থনীতিকে সচল করে তোলে। ১৯৫০-৬০ দশকে জাপান দ্বিগুণ তালে শিল্পোৎপাদন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটিয়ে একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে জাপান বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রনিকস, গাড়ি নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে নেতৃস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে আসে, যা যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক মিরাকলের একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সামাজিক ফলাফল

মানবিক বিপর্যয় ও গণহত্যার ক্ষত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মানবিক মূল্য ছিল অবর্ণনীয়। আনুমানিক ৭ থেকে ৮.৫ কোটি মানুষ এই যুদ্ধে নিহত হন, যার মধ্যে অর্ধের বেশি ছিলেন সাধারণ নিষ্পাপ নাগরিক। নাৎসি জার্মানির শাসনামলে সংঘটিত হলোকাস্ট মানব ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যার উদাহরণ – প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে নাৎসি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে, পাশাপাশি রোমানীয়, পোলীয়, রুশ ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী, যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধেও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। যুদ্ধশেষে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে (উদাহরণ: নুরেমবার্গ বিচার, টোকিও বিচার) নাৎসি ও জাপানি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার অনুষ্ঠিত হয়। এসব বিচার মানব ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দকেও জবাবদিহি করতে হবে।

নাৎসি জার্মানির শাসনামলে সংঘটিত-নির্মম হলোকাস্ট এর একটি ভয়াবহ চিত্র।

উদ্বাস্তু সংকট ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তন: যুদ্ধের ফলস্বরূপ কোটি কোটি মানুষ গৃহহীন ও وطنছাড়া হয়ে পড়ে। ইউরোপের নানা সীমান্ত পরিবর্তন, জাতিগত সংঘাত ও প্রতিশোধের মাশুল হিসেবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে যুদ্ধের পর প্রায় ১ থেকে ২ কোটি মানুষকে তাদের জন্মভূমি থেকে বাধ্যতামূলকভাবে উৎখাত করা হয় – এর মধ্যে নৌৎসিজের অধীনস্থ পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব প্রুশিয়া ইত্যাদি অঞ্চল থেকে জার্মান বংশোদ্ভুত জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক জার্মানিতে পাঠানো এবং পূর্ব পোল্যান্ড থেকে লক্ষাধিক পোলিশকে নিজ দেশ ছাড়তে বাধ্য করা উল্লেখযোগ্য। একই সাথে যুদ্ধকালীন নির্যাতন থেকে বেঁচে যাওয়া ইউরোপীয় ইহুদিরা নিজ নিজ জন্মভূমিতে নিরাপত্তাহীন বোধ করায় বহু ইহুদি শরণার্থী মধ্যপ্রাচ্যের প্যালেস্টাইনে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এর প্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে, যা পরে আরব-ইসরায়েল সংঘাতের সূত্রপাত করে। বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধোত্তর সময়ে প্রচুর জনগোষ্ঠী নিজ দেশে বা দেশের বাইরে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়, যা আধুনিক বিশ্বের জনসংখ্যাগত বিন্যাসকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে।

নারীর ভূমিকা ও সামাজিক পরিবর্তন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশের নারীসমাজ সমগ্রভাবে কর্মক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। পুরুষরা সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ায় মহিলা কর্মীরা কারখানা, পরিবহন, চিকিৎসাসেবা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রসমূহে বিপুল সংখ্যায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যা আগে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের অধিকারভুক্ত কর্মক্ষেত্র ছিল। এই পরিস্থিতি নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় এবং যুদ্ধোত্তর বিশ্বে বিভিন্ন দেশে নারীর অধিকার আন্দোলন ও সমাজে নারীর অবস্থান উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ বহু দেশে যুদ্ধের পরপরই কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায় এবং নারীরা ভোটাধিকারের মতো রাজনৈতিক অধিকারের জন্যও জোরালো দাবি ওঠাতে শুরু করে। যুদ্ধের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক সম্প্রদায় মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করে; ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভায় সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়, যাতে বিশ্বের সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার আদর্শ স্থাপন করা হয়। এছাড়া যুদ্ধরত পক্ষগুলোর আচরণবিধি উন্নত করার উদ্দেশ্যে জেনেভা কনভেনশনসমূহ ১৯৪৯ সালে পুনর্বিবেচনা ও সম্প্রসারিত হয়। বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামাজিক অভিঘাত মানবসমাজকে শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দিয়ে গেছে।

পরিশেষে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার এক ক্রান্তিকালের সূচনা করে। এই যুদ্ধের ফলে একদিকে জাতিসমূহ তাদের সমষ্টিগত নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে, অন্যদিকে নবস্বাধীন দেশগুলোর উত্থান বিশ্বরাজনীতিতে উপনিবেশ-উত্তর যুগের সূচনা করে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যেমন পরমাণু শক্তির আবিষ্কার নতুন দ্বন্দ্ব ও ভীতির সৃষ্টি করেছে, তেমনি মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও যুদ্ধ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। নতুন শক্তির ভারসাম্য, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, সামরিক জোট বিন্যাস ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যবস্থা পুনর্নিমাণ হয়, যা আধুনিক বিশ্বের গতিধারা নির্ধারণে মৌলিক ভূমিকা রেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা মানবজাতিকে একদিকে বিধ্বংসী যুদ্ধের মাশুল এবং অপরদিকে বৈশ্বিক সহযোগিতার মূল্য দুটোই শিখিয়েছে, যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পথনির্ধারণে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

পাঠকের মতামত: