মতামত

পুরুষের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: এক নীরব বাস্তবতা ও অস্বীকৃত সংকট

ড. আনিসুর রহমান খান ও ড. রাসেল হোসাইন
ড. আনিসুর রহমান খান ও ড. রাসেল হোসাইন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
২০২৫ জুলাই ১২ ১৬:৩৭:০৬

পারিবারিক সহিংসতা বিশ্বব্যাপী একটি স্থায়ী ও বহুমাত্রিক সামাজিক সংকট। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ এবং একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ব্যক্তি জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। যদিও নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি গত কয়েক দশকে নীতিনির্ধারণী আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে এবং আন্তর্জাতিক-জাতীয় পরিসরে নানা উদ্যোগ ও আইন বাস্তবায়িত হয়েছে, তবুও পারিবারিক সহিংসতার একটি দিক এখনো প্রায় পুরোপুরি উপেক্ষিত, তা হলো পুরুষের প্রতি সহিংসতা।

পারিবারিক নির্যাতন বলতে সাধারণত বোঝানো হয় ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বা দাম্পত্য সম্পর্কে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে শারীরিক, মানসিক, যৌন, আর্থিক বা অন্যান্য ধরনের সহিংস আচরণ। সাধারণভাবে সমাজে এর ধারণা নারীবান্ধব এবং নারীকেন্দ্রিক, ফলে পুরুষও যে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হতে পারে, তা একটি অস্বস্তিকর ও 'অবিশ্বাস্য' ধারণা বলে ধরে নেওয়া হয়। এর ফলে পুরুষ ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা যেমন সমাজে গুরুত্ব পায় না, তেমনি গবেষণা, আইন এবং নীতিনির্ধারণেও তাদের জন্য জায়গা সংকুচিত থেকে যায়।

নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, কোনো নারী পুরুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা করলে তা মূলত প্রতিক্রিয়াশীল, আত্মরক্ষা, প্রতিশোধ কিংবা সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের প্রয়োজনে। এই বর্ণনা হয়তো কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে খাটে, তবে এতে পুরুষ ভুক্তভোগীদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে অসম্পূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়। বহু পুরুষ সহিংসতার শিকার হলেও তা প্রকাশ করতে ভয় পান, অপমানিত বোধ করেন কিংবা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় চুপ থাকেন। অনেক সমাজেই পুরুষ মানেই শক্তিশালী, এই ছকে পুরুষ যদি নির্যাতিত হয়, তা তার 'পুরুষত্ব' নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ফলে নির্যাতিত পুরুষেরা সহানুভূতি তো দূরে থাক, অধিকাংশ সময় নিজ পরিবার, বন্ধুবান্ধব এমনকি প্রশাসনের কাছ থেকেও অনাস্থা ও অপমানের শিকার হন।

পুরুষ নির্যাতনের বাস্তবতা কোনো বিচ্ছিন্ন বা স্থানীয় সমস্যা নয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস অফিস-এর ২০২২–২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার প্রত্যেক তিনজনের মধ্যে একজন পুরুষ। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশটিতে পুরুষদের বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ৭.৭ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত ন্যাশনাল ইনটিমেট পার্টনার অ্যান্ড সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স সার্ভে (NISVS)-এর তথ্য অনুসারে, জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে ৪৪.২ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৭.৩ শতাংশ নারী ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা যৌন, শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।

ভারতেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০০৫–২০০৬ সালে যেখানে প্রতি হাজারে ৭ জন স্বামী স্ত্রীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন, ২০১৫–২০১৬ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রতি হাজারে ২৯ জনে। পাশাপাশি দেখা গেছে, ভারতে পারিবারিক সহিংসতার ফলে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।

বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে যে সব গবেষণা ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, তার প্রায় শতভাগই নারীকেন্দ্রিক। এর ফলে পুরুষ ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা এবং সমস্যা উপেক্ষিত থেকে গেছে। পারিবারিক সহিংসতাকে কেবল নারীর সমস্যা হিসেবে দেখা হয় এবং পুরুষকে সহিংসতার ‘উৎস’ হিসাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই মনোভাব সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একপাক্ষিক ও সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। বর্তমানে দেশে নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রয়েছে বহু ধরনের নারী-কেন্দ্রিক আইন, হেল্পলাইন, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, নারী উন্নয়ন নীতি এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের সহায়তা। অথচ পুরুষের জন্য নেই তেমন কোনো আইনি আশ্রয় বা মনো-সামাজিক সহায়তার ব্যবস্থা।

বাংলাদেশে অনেক পুরুষ এমন অভিযোগ করেছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে নারীরা কখনো কখনো মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিশোধ নেন, যেমন বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ, যৌতুক মামলা, বৈবাহিক ধর্ষণ মামলা কিংবা ভরণপোষণ সংক্রান্ত জটিলতা। এসব মামলা অনেক সময় আইনের অপব্যবহার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ আইনি কাঠামো পুরুষের দিকটি একরকম অদৃশ্য করে রেখেছে।

বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে গবেষণা প্রায় অনুপস্থিত। এর পেছনে রয়েছে সামাজিক অস্বীকৃতি, গবেষণা তহবিলের অভাব এবং একধরনের একচোখা নারীবাদী চাপ। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বেও এই বিষয়টি প্রথমদিকে দমন করা হয়েছে। আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানী সুজান স্টেইনমেটজ যখন ১৯৭০-এর দশকে "ব্যাটার্ড হাজব্যান্ড সিনড্রোম" নিয়ে গবেষণা প্রকাশ করেন, তখন তাঁকে নারীবিদ্বেষী বলে তীব্র সমালোচনা, এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও সহ্য করতে হয়। তাঁর গবেষণায় বলা হয়েছিল, অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রীর সহিংসতা স্বামীর নির্যাতনের চেয়েও তীব্র হতে পারে, এবং পুরুষরা তা লজ্জা বা ভয় থেকে গোপন রাখেন।

বাংলাদেশসহ বহু দেশেই পুরুষ নির্যাতনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। অধিকাংশ আইন নারী ভুক্তভোগীদের জন্য তৈরি এবং পুরুষরা এসব আইনের আওতায় আসেন না বা সুরক্ষা পান না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচারব্যবস্থাও পুরুষ ভুক্তভোগীদের প্রতি প্রয়োজনীয় সহানুভূতি প্রদর্শন করে না। বরং পুলিশে গেলে অনেক সময় পুরুষদের কটাক্ষ, হাসি-ঠাট্টা এমনকি অবিশ্বাসের মুখে পড়তে হয়। ফলে পুরুষেরা সহিংসতা সত্ত্বেও চুপ করে থাকেন। সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে এবং পুরুষতান্ত্রিক গোঁড়ামির কারণে তাঁরা অভিযোগ করতে লজ্জা পান।

এই চুপ করে থাকার কষ্ট অনেক সময় একমাত্রিক চাপ হিসেবে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে পুরুষের আত্মহত্যার হার নারীর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এই প্রবণতা শুধু মানসিক স্বাস্থ্য নয়, পারিবারিক সহিংসতার ছায়াকেও সামনে আনে।

ভারতের প্রখ্যাত পুরুষ অধিকারকর্মী নন্দিনী ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, "যখন নারীরা একে অপরকে সমর্থন করে, তখন বলা হয় 'ক্ষমতায়ন' কিন্তু পুরুষেরা একে অপরকে সমর্থন করলেই সেটা হয়ে যায় 'নারীবিদ্বেষ'।" এই বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য নিরসনের লড়াইটি আসলে দুই লিঙ্গের মানুষের সম্মিলিত মানবিকতার জন্য হওয়া উচিত, কোনো একপক্ষের বিরুদ্ধে নয়।

পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টিকে অবহেলা করলে তা ধীরে ধীরে এক গভীর সামাজিক সংকটে রূপ নিতে পারে। সমাজকে বুঝতে হবে, শুধু নারীরাই নির্যাতনের শিকার হন না, পুরুষরাও হয়। তাই প্রয়োজন লিঙ্গ-নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন গবেষণা, এবং পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট সহায়তা কাঠামো গড়ে তোলা। পুরুষদের নিজেদেরও সাহস করে এগিয়ে আসতে হবে, পৌরুষের ধোঁয়াশা ভেঙে সহিংসতা সম্পর্কে মুখ খুলতে হবে। এ বিষয়ে গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

একটি ন্যায্য, মানবিক ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য পারিবারিক সহিংসতার শিকার সকল পক্ষ, নারী, পুরুষ, শিশু কিংবা প্রবীণ, সবার কথা সমান গুরুত্বে শুনতে হবে। অন্যথায়, সমাজ যেমন একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকবে, তেমনি নীরবে হারিয়ে যাবে অসংখ্য পুরুষের কান্না, যাদের বেদনা কেউ শোনে না।

- ড. আনিসুর রহমান খান, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা এবং প্রফেসর এক্সট্রাঅর্ডিনারিয়াস, ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড হেলথ সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা

-ড. রাসেল হোসাইন, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ