মতামত
নেপালের গণঅভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈধতার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক

সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক গণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো দুর্বল হলে জনগণই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে পারে। প্রথমে শ্রীলঙ্কা, পরে বাংলাদেশ এবং সবশেষে নেপাল—তিন দেশেই জনবিস্ফোরণ ঘটল। তিন ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেল ক্ষমতার কেন্দ্র, রাজনৈতিক নেতাদের সম্পত্তি ও বাসভবন জনগণের আক্রমণের মুখে পড়েছে। মূল অভিযোগ ঘুরপাক খাচ্ছে দুর্নীতি, দমন–পীড়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকে ঘিরে। শ্রীলঙ্কায় তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিল, বাংলাদেশ ও নেপালে ছাত্র–যুবকরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এ অভিজ্ঞতাগুলো প্রমাণ করে যে যুবসমাজ যখন সামনে আসে, তখন আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি অস্তিত্ববাদী প্রশ্নে রূপ নেয়—রাষ্ট্র কার জন্য?
নেপালের অভ্যুত্থান একটি বিশেষ শিক্ষা দেয়। সেখানে সংসদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিল এবং সরকার গণভোট ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। তবু জনরোষে ভেসে যায়। আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল দুর্নীতি, এবং ক্ষোভের শিকার হয়েছে সরকার ও বিরোধী—উভয় শিবির। অর্থাৎ এটি শুধু regime change নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাস। রাজনৈতিক বিজ্ঞানে একে বলা হয় anti-establishment mobilization। এখানে আমরা Lipset-এর legitimacy theory প্রয়োগ করতে পারি। জনগণ যখন দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারায়, তখন সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তার বৈধতা নষ্ট হয়। বৈধতা হারানো সরকার কাগজে কলমে টিকে থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৃতপ্রায় হয়ে যায়।
বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত সমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিএনপি আশা করছে তারা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আপাতত রাজনীতির বাইরে থাকলেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতিহাস বলে, সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি থেকে বাদ রাখা যায় না। Samuel Huntington-এর Political Order in Changing Societies এ প্রসঙ্গেই সতর্ক করেন—ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করলে ভবিষ্যতে আবার সহিংস বিস্ফোরণ ঘটে। অতএব, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদি গণতান্ত্রিক পথে তা সম্ভব না হয়, তবে সহিংসতার মাধ্যমে ফেরার চেষ্টা করবে—এমন সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বাংলাদেশের আরেক বাস্তবতা হলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ব্লকের উত্থান। এখানে মওদুদপন্থী দল থেকে শুরু করে কট্টরপন্থী খিলাফতবাদী গোষ্ঠী পর্যন্ত সক্রিয়। তবে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হলো জামায়াতে ইসলামি। সংগঠন, অর্থ, রাজনৈতিক ভিত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতায় তারা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। এখনই হয়তো তাদের জাতীয় ক্ষমতা দখলের সামর্থ্য নেই, কিন্তু আগামী কয়েক বছরে শক্তি বহুগুণে বাড়তে পারে। তখন প্রশ্ন থাকবে—তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সম্মান করবে, নাকি Charles Tilly-এর contentious politics তত্ত্বের মতো বিপ্লবী পথে হাঁটবে? নেপাল–স্টাইলে বিপ্লবী পথে হেঁটেও তারা বিস্ময় তৈরি করবে না।
বর্তমানে বিএনপি–বিরোধীরা সফলভাবে জনগণের মনে প্রতিষ্ঠা করেছে যে বিএনপি একটি দুর্নীতিবাজ দল। এখানে কার্যকর হয়েছে labeling theory। যখন কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির লেবেল একবার বসে যায়, তখন তা সত্য বা মিথ্যা যাই হোক না কেন, সামাজিক বাস্তবতায় প্রভাব বিস্তার করে। সরকারে গেলে এই ধারণা আরও তীব্র হতে পারে, কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্বল। এই প্রেক্ষাপটে আগামী সরকারকে দুটি অস্তিত্বমূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতিতে ফিরতে চাইবে। এখানে power transition theory প্রযোজ্য—প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি দীর্ঘমেয়াদে পুনঃপ্রবেশের চেষ্টা করে এবং সেটি স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থী চাপ ইসলামি রাষ্ট্র প্রকল্পকে আরও শক্তিশালী করবে। এ প্রেক্ষাপটে social movement theory-এর radical flank effect ব্যাখ্যা করে কীভাবে মাঝারি ইসলামপন্থীরা ধীরে ধীরে চরমপন্থীদের দিকে ঝুঁকতে পারে।
এই দুই চাপে দুর্বল সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। নেপাল আমাদের শিক্ষা দেয় যে দুর্নীতি, বৈধতা সংকট এবং জনগণের আস্থা হারানো একটি গণতান্ত্রিক সরকারকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। বাংলাদেশও এখন এক অস্বাভাবিক সময়ে দাঁড়িয়ে। বিএনপি যদি ভাবে সরকার গঠন করলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তবে তা হবে ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি। প্রশ্ন হলো—বিএনপি কি এই দ্বৈত চাপে (আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ও ইসলামপন্থী উত্থান) টিকে থাকার মতো রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিচ্ছে? নাকি আমরা আবারও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক চক্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে অস্থিরতা শেষে সামরিক শাসনই হয়ে ওঠে শেষ অবলম্বন? বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন এক সন্ধিক্ষণে। আর এখানেই মূল প্রশ্ন—আমরা কি নেপালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেব?
বিএনপি ও সংস্কারের রাজনীতি: ম্যান্ডেট, কূটচাল ও টেকসই বৈধতার পরীক্ষায় বাংলাদেশ

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
বিএনপির অনেক নেতা–কর্মী মনে করছেন জামাত, সরকার ও এনসিপি মিলে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তিন ধরনের দল আছে, A, B ও C। A বড় দল, এই গ্রুপে আছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। B মাঝারি দল, এই গ্রুপে আছে জামাত ও জাতীয় পার্টি। C হলো বাকি দল—যেমন এনসিপি, এবি পার্টি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ও অন্যান্য বামপন্থি দল। সাম্প্রতিক সময়ে যে সার্ভেগুলো হয়েছে তাতে যদিও দেখা যাচ্ছে জামাতের অবস্থান আওয়ামী লীগের থেকে ভালো, তবু আওয়ামী লীগ যদি ভয়হীন পরিবেশে নিজের মতামত দিতে পারে, নিঃসন্দেহে তাদের অবস্থান জামাতের থেকে বেশি হবে। যাই হোক, সেই বিতর্কে না যাই। এই শক্তির মাত্রা মাথায় রেখেই বিএনপি গুড ফেইথে রাজনৈতিক ঐকমতের আলোচনায় অংশ নিয়েছে, অন্তত বিএনপি তাই মনে করে বলে আমার মনে হয়েছে। এবং আমরা দেখেছি, জুলাই সনদ ও ঘোষণা নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এক ধরনের ঐকমতে এসেছে, যদিও এনসিপি তার বাইরে থেকেছে।
বাস্তবতা হলো, দেড় বছর ধরে সরকারের এই পরীক্ষামূলক সংস্কারে বিএনপি অংশ নিয়েছে মূলত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরার আশায়। ঠিক এই প্রত্যাশাকেই বিএনপির দুর্বলতা ভেবে জামাত, এনসিপি ও নব্য এলিটরা দরকষাকষি করেছে, বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপে এমন ধারণাই পাওয়া যায়। কিন্তু এই দরকষাকষির সীমানা কোথায়? সীমানা ছিল, নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র না করা, নির্বাচন না পেছানো এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন না করা। বিএনপি বারবার বলেছে, সংবিধান সংস্কার হবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। যে কোনো সভ্য দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করেন। অনির্বাচিত কোনো সরকার, তা যেভাবেই আসুক, এই অধিকার রাখে না। জোর করে করা যায়, কিন্তু জোর কেটে গেলে সেই সংস্কার টেকে না, তা যতই মহৎ হোক। জনগণের ম্যান্ডেট অপরিহার্য, আর সেই ম্যান্ডেট পাওয়ার পথ হলো নির্বাচন।এখন যে সব সংস্কার প্রস্তাব উঠছে, সেগুলোর প্রতিটিতে হ্যাঁ–না ভোটে জনমত নেওয়া একদিকে কষ্টসাধ্য, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ। প্রশ্ন কীভাবে ফ্রেম হবে, তথ্য কে দেবে, প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ থাকবে, সবকিছুই বিতর্কিত হতে পারে। এমন অবস্থায়, যেখানে আওয়ামী লীগ–সমর্থক ভোটাররা এই সংস্কারে তেমন সমর্থন দেবেন না, সেখানে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ ছিল বাকিদের সমর্থন নিশ্চিত করা, খানিকটা ছাড় দিয়ে হলেও যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যান্ডেট দাঁড়ায়। নিঃসন্দেহে জামাত, বিএনপি, এনসিপি ও বামপন্থি দলগুলো মিলে এমন একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হতে পারত, যা এই ধরনের সাংবিধানিক পরিবর্তনকে জনগণের ম্যান্ডেটের বৈধতা দিত। কিন্তু সেই পথে না হেঁটে সংস্কার কমিশন যে পথে হাঁটলেন, তা রাজনৈতিক ভুল বলেই মনে হতে পারে। এর ফলে হয়তো তারা বিএনপির সমর্থন হারানোর পথে।
আরও স্পষ্ট করে বলি, বাংলাদেশের বৈধতার কেন্দ্র A গ্রুপে। B–C গ্রুপ চাপ দিতে পারে, কিন্তু টেকসই বৈধতা বানাতে পারে না। তাই বিএনপি যদি সনদ থেকে সমর্থন ফিরিয়ে নেয়, জামাত–এনসিপি–সরকার মিলে চেষ্টা করলেও গণভোটে “জনগণের রায়” বলে যা দেখাতে চাইবেন, তা বাস্তবে টেকসই বৈধতা তৈরি করবে না। বিএনপি নব্য এলিট ও বিপ্লবীদের কাছে “সংস্কার–বিরোধী” তকমা পেতেই পারে; কিন্তু গণভোটের হার–জিতের ক্ষেত্রে সেই ফ্রেমিং বড় ভূমিকা নাও রাখতে পারে। কারণ, ম্যান্ডেটের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের রাজনীতি, এটি পাশ কাটানো যায় না।
আবার, রাজনৈতিক দল ও সরকারের ভেতরের যে অংশ নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে চায়, তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া ধরে রাখা সম্ভব নয়। আজকের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোনো শক্তিই তা রাজনৈতিক দল, আর্মি কিংবা অন্য কেউ, নির্বাচন ছাড়া সরকার গঠন করে টেকসই থাকতে পারবে না। এর শেষ পরিণতি ভয়াবহ। এই জটিল পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনের উচিত ছিল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখানো, সম্মতি জোগাড় করা, সীমা ঠেলে দেখা নয়। তারা উল্টোটা করেছেন, কতটা বাউন্ডারি পুশ করা যায়, বিএনপিকে কতটা বাঁধা দেওয়া যায়, এটাই যেন পরীক্ষা, অন্তত বিএনপির নেতা কর্মীরা তাই মনে করছেন।
প্রশ্ন এখন স্পষ্ট, এই রাজনৈতিক খেলায় বিএনপি কি পারবে নিজের অবস্থান শক্তভাবে জানাতে, না কি আরও ক্ষতির শিকার হবে? বিএনপি যদি আরও ছাড় দিতে থাকে, তৃণমূল এটাকে ভালোভাবে নেবে না; বরং একে দুর্বলতা হিসেবে পড়বে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও বিএনপির দুর্বলতা নিয়ে মজা নেবে। রাজনীতিতে ইমেজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে বিএনপির দায়িত্ব, রেডলাইন স্পষ্ট করা: নির্বাচন পেছানো যাবে না; সংবিধান–সংস্কার নির্বাচিত সংসদের ম্যান্ডেটে হবে। ইস্যুর ক্রম ঠিক করা: আগে নির্বাচন, তারপর সংসদীয় প্রক্রিয়ায় সংস্কার; প্রয়োজনে সীমিত, নির্দিষ্ট ধারায় গণভোট। এবং জোটের অঙ্ক কংক্রিট করা: বিচারব্যবস্থা, ইসি–রিফর্ম, মৌলিক অধিকার, ৩–৫টি কমন–মিনিমাম বিষয়ে সমঝোতা, বাকিগুলো সংসদে।
শেষ কথা, বিএনপি আজ ভেটো প্লেয়ার। বিএনপি আউট থাকলে গণভোটের রাস্তা বৈধতা আনতে পারবে না; বরং অনিশ্চয়তা বাড়াবে। তাই বিএনপির এখন দরকার পরিষ্কার সিগনাল, এক লাইনের বার্তা: আগে ম্যান্ডেট, পরে সংস্কার, কিন্তু আরও ভালোভাবে। নির্বাচন ছাড়া এই সঙ্কটের টেকসই সমাধান নেই; এবং নির্বাচন–পূর্ব যেকোনো শর্টকাট শেষতক নিজেই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
(আমি শুরু থেকেই নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমি মনে করি না, নির্বাচনের মাধ্যমে দেয়া জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কারও সংবিধান সংস্কারের অধিকার আছে। তাই এই লেখায় আমার অবস্থানগত পক্ষপাত থাকতে পারে।)
রাজনীতি, নির্বাসন ও নৈতিকতা: শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতাকে কোথায় নিচ্ছে

মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকাকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে তিনি ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন সরাসরি নাকচ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “The question of apology does not arise. My government acted to preserve order and stability.” এই বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক মন্তব্য নয়, বরং এটি তাঁর সমগ্র নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন।
শেখ হাসিনার এই বক্তব্য প্রকাশের সময় এবং প্রেক্ষাপট একে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাঁর সরকারের সময় ঘটে যাওয়া দমননীতিকে “brutal and systematic repression” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ দমনে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং নিহতদের প্রায় ৭৮ শতাংশ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ভলকার টার্কের ভাষায়, “Top echelons of the previous government were aware and involved in very serious violations, including enforced disappearances, arbitrary detentions and violent suppression of protests.” এই মন্তব্যগুলো আন্তর্জাতিকভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শেখ হাসিনার সরকারের সময় সংঘটিত ঘটনাগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এই দুই বাস্তবতা এখন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একজন অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত, তিনি এখন ভারতের আশ্রয়ে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। ভারত কি কেবল মানবিক কারণে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে, নাকি এটি বাংলাদেশের ওপর কৌশলগত চাপ প্রয়োগের একটি নতুন পদ্ধতি?
ভারত দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাঁর সময়েই ভারত সীমান্তনিরাপত্তা, ট্রানজিট, নদী ব্যবহার, জ্বালানি বাণিজ্য ও সংযোগনীতিতে বড় ধরনের সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর এই ভারসাম্য ভেঙে যায়। শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লি তাঁকে আশ্রয় দেয় এবং দ্রুত একটি বিশেষ সুরক্ষিত ভবনে তাঁর জন্য রাজনৈতিক সচিবালয় গঠন করে। এই সচিবালয়ের কার্যক্রম এখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু কূটনৈতিক উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে চলছে। সেখানে নিয়মিতভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক হয় এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দিল্লি কি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের ওপর একধরনের নরম রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে চাইছে? বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, তখন দিল্লির উদ্বেগ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত মনে করছে, হাসিনার পতনের ফলে তারা বাংলাদেশের ওপর আগের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। তাই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তারা একদিকে নিজেদের পুরোনো মিত্রকে ধরে রাখছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের ওপর কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে দেওয়া শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটি তাই কেবল তাঁর ব্যক্তিগত মত নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো নির্বাচন বৈধ নয় এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদে তিনি দেশে ফিরবেন না। এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তিনি এখনো নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। তবে এই বক্তব্যের সময়কাল এবং ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ইঙ্গিত করছে যে এটি একটি পরিকল্পিত প্রচারণার অংশ। ভারত হয়তো চায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অবস্থানকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে, যাতে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে একটি নতুন কূটনৈতিক মডেল গড়ে তুলছে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন ইতিমধ্যেই জুলাই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করেছে। সরকার ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি এবং প্রশাসনিক সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসি বাংলাদেশকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করছে।
এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার ক্ষমা অস্বীকারের বক্তব্য তাঁর নৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে। এটি তাঁকে একটি অপ্রায়শ্চিত্ত রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করেছে, যার কাছে মানবিক সংবেদনশীলতা ক্ষমতার চেয়ে ছোট হয়ে গেছে। ভারত এই অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে কিনা, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন। যদি সত্যিই দিল্লি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়ে কূটনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার নীতিগত রাজনীতির জন্য একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করেছে, জনগণের ইচ্ছাশক্তি যেকোনো কূটনৈতিক চাপে বেশি শক্তিশালী। শেখ হাসিনার ক্ষমা অস্বীকৃতি ও ভারতের কৌশলগত দ্বৈততা হয়তো সাময়িক প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ন্যায়, গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ।
দক্ষিণ এশিয়ার সামনে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। কোনো রাষ্ট্র বা নেতা যদি জনগণের আস্থা হারায়, তবে তাকে আশ্রয় বা সমর্থন দিয়ে কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখা কখনো স্থায়ী হয় না। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার ও ভারতের বর্তমান ভূমিকা সেই সত্যটিকেই আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
অভিভাবকতন্ত্রের প্রলোভন: জেনারেল ভূঁইয়ার বয়ান ও গণতন্ত্রের ঘড়ি থামানোর বিপদ

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখছেন ধারাবাহিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী পোস্ট, যার শিরোনাম “আগামী পাঁচ বছরে আমরা কোথায় যাচ্ছি?” এর পঞ্চম অংশে তিনি আলোকপাত করেছেন “বিএনপি ক্ষমতায় এলে সম্ভাব্য চিত্র” বিষয়ে। অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে মনোযোগ দাবি করে। তবে তাঁর লেখার রাজনৈতিক ফ্রেমিং ও বিশ্লেষণের অন্তর্নিহিত ধারা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে, বিশেষ করে যখন সেই বয়ানে নির্বাচিত রাজনীতিকদের “সমস্যা” এবং অ-নির্বাচিত এলিট বা উপদেষ্টাদের “সমাধান” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
এই ফ্রেমটি প্রথমেই একটি মৌলিক অস্বস্তি তৈরি করে, কারণ এটি প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কার্যকারিতাকে একমাত্র গুণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যেন গণতন্ত্রের মূল যুক্তি, অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে ম্যান্ডেট অর্জন, অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং তার জায়গা নেয় “যোগ্য” অ-নির্বাচিত অভিভাবকদের শাসন। এটি একটি বিপজ্জনক স্লিপারি স্লোপ, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পরিবর্তে অভিভাবকতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া হয়। ইতিহাস বলছে, একবার যদি এই পথে যাত্রা শুরু হয়, নির্বাচনী রাজনীতির প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়।
জেনারেল ভূঁইয়ার লেখায় একটি স্পষ্ট কৌশল দেখা যায়, সেটি হলো ভয়কে রাজনৈতিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা। তিনি ভারতীয় চাপ, অর্থনৈতিক সংকট, পুলিশের অকার্যকারিতা, রাস্তার সহিংসতা ইত্যাদি উদাহরণ টেনে এনে বলেছেন যে এসব কারণেই হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় বাড়াতে হবে বা “বিশেষ ব্যবস্থা” নিতে হতে পারে। এই ভয়নির্ভর বয়ান জনমনে এমন ধারণা তৈরি করে যে নির্বাচন অনিশ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিলম্বই নিরাপদ পথ। ফলত একটি “ইলেকশন-অপশনাল” মানসিকতা জন্ম নেয়, যেখানে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ঐচ্ছিক হয়ে ওঠে। এটি গণতন্ত্রের শিকড় ক্ষয়ে দেওয়ার এক নীরব উপায়।
যখন তিনি লেখেন “রিফর্ম আগে, নির্বাচন পরে”, সেটি আসলে এক বিপরীত রাজনৈতিক সিকোয়েন্সের প্রচলন। টেকসই গণতন্ত্রে সংস্কারের বৈধতা আসে নির্বাচনের ম্যান্ডেট থেকে, কিন্তু তিনি উল্টো বলছেন নির্বাচনের আগেই সংস্কার হোক। বাস্তবে এর অর্থ দাঁড়ায় জনগণের ম্যান্ডেটহীন শক্তির হাতে রাজনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া। “রিফর্ম-ফার্স্ট” চিন্তাধারা অচিরেই “ইলেকশন-লেটার” হয়ে যায়, আর পিছিয়ে দেওয়া ভোট খুব কম ক্ষেত্রেই ফিরে আসে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসই তার প্রমাণ।
আরও উদ্বেগজনক হলো, জেনারেল ভূঁইয়া তাঁর লেখায় নিরাপত্তা কাঠামোকে এক ধরনের “নিরপেক্ষ ম্যানেজার” হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পুলিশকে “অলস ঘোড়া” আখ্যা দিয়ে সেনাকে মাঠে রাখার বিষয়টি তিনি নিছক ম্যানেজমেন্ট ইস্যু হিসেবে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি বেসামরিক জবাবদিহির প্রশ্নকে আড়াল করে এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ডি-ফ্যাক্টো রাজনৈতিক রেফারিতে রূপান্তরিত করে। গণতন্ত্রে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কখনোই রাজনীতির ভারসাম্যরক্ষাকারী হতে পারে না, কারণ তাতে নির্বাচিত নেতৃত্বের জবাবদিহি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সরে যায় অদৃশ্য ব্যবস্থাপক মহলের হাতে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জেনারেল ভূঁইয়া সম্ভাব্য বিএনপি সরকারের প্রতি আগেভাগেই অবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন। তাঁর পূর্বাভাসে দেখা যায়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি বাড়বে, ভারতীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, রাস্তায় সহিংসতা হবে। এই ধরনের পূর্বাভাস আসলে রাজনৈতিক আগাম অবমূল্যায়ন, যা একটি বিপজ্জনক বার্তা দেয় যে “ভুল দল” জিতলে সেটিকে “ম্যানেজ” করা ন্যায্য। এতে নির্বাচনী গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত, অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল, শর্তাধীন হয়ে পড়ে।
তাঁর বয়ানে নাগরিকরা নায়ক নয়, বরং “ঝুঁকি”। সমাধান খোঁজা হয় এলিট মহলের ভেতরে, “যোগ্য উপদেষ্টা” বা “সমঝোতার সরকার”-এর মধ্যে। এটি একধরনের ক্লাসিক এলিট সাবস্টিটিউশন, যেখানে জনসম্মতি সরিয়ে পেছনের দরজার চুক্তি সামনে আনা হয়। এতে রাজনৈতিক দল, ভোটার ও নীতির স্বাভাবিক সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে; আস্থা কমে, অংশগ্রহণও হ্রাস পায়। ফলত গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিক কাঠামোয় সীমিত থেকে যায়।
আরেকটি বিষয় হলো, তাঁর লেখায় বারবার “বহির্দেশের ভেটো”, বিশেষ করে ভারতের প্রভাব, একটি অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়। এতে ইঙ্গিত মেলে যে নীতি-প্রসঙ্গগুলোতে বাইরের “রেড লাইন” অতিক্রম করা যায় না। এটি আসলে সার্বভৌম ভোটের অস্বীকৃতি, যেখানে জনমতকে আগে থেকেই সঙ্কুচিত বৃত্তে বন্দি করে ক্ষমতাবান এলিটরা সিদ্ধান্ত নেন কী সম্ভব আর কী নয়।
সব মিলিয়ে, জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়ার লেখার অন্তর্নিহিত বার্তা হলো ভয়নির্ভরতা, “রিফর্ম-ফার্স্ট” সিকোয়েন্স, এলিট ও টেকনোক্র্যাটিক সমাধান, এবং নিরাপত্তা কাঠামোর রাজনৈতিক ভূমিকার স্বাভাবিকীকরণ। এগুলো মিলে এক নতুন প্রকারের অভিভাবকতন্ত্রের ধারণা তৈরি করে, যেখানে জনগণ নয়, “দক্ষ ব্যবস্থাপক”-ই রাজনীতির নিয়ামক।
কিন্তু রাষ্ট্র কোনো ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প নয়, এটি জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন। প্রজাতন্ত্র স্থিতি পায় ব্যালটের ঘড়িতে, যে ঘড়ির কাঁটা কারও ইচ্ছেমতো থামানো যায় না। নির্বাচনের সময়, গতি বা ফলাফল নিয়ে ভয় দেখানোর পরিবর্তে আমাদের দায়িত্ব হলো সেই ঘড়িটিকে সচল রাখা, যাতে জনগণই হয় ক্ষমতার একমাত্র উৎস।
জেনারেল ভূঁইয়ার প্রস্তাবিত “প্রাগম্যাটিক” পথটি যতই বাস্তবসম্মত মনে হোক, তার ভেতরে নিহিত আছে গণতন্ত্রের স্থবিরতার বীজ। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই স্থবিরতা থেকে মুক্ত থাকা, ব্যালটের ঘড়িকে চালু রাখা, এবং সব রাজনৈতিক শক্তিকে সেই সময়ের অধীন আনতে সক্ষম হওয়া। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণের ভোটই এই প্রজাতন্ত্রের প্রাণ, আর সেটিকে স্থগিত রাখা মানেই জাতির হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেওয়া।
তারেক জিয়ার কেন দেশে ফেরা কেন জরুরি?

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে একধরনের আত্মতুষ্টিতে ছিল যে তারা সহজেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। এই আত্মতুষ্টি তাদের রাজনৈতিক কৌশলকে দুর্বল করেছে। রাজনীতি বিজ্ঞানে একে বলা হয় “Overconfidence Trap”—যেখানে দল মনে করে জনসমর্থন এতটাই শক্ত যে সাংগঠনিক দুর্বলতা তাদের ক্ষতি করবে না। বাস্তবে দেখা গেল, তৃণমূলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল, আর এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিএনপি ৪ হাজারেরও বেশি নেতাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়। যদিও এটিকে “accountability politics”-এর উদাহরণ বলা যায়, তবে একই সঙ্গে এটি দলের ভেতরের অস্থিরতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকেও সামনে এনেছে। অন্যদিকে মাঠে যেহেতু “মাইনাস বিএনপি” প্রোজেক্ট চলমান, সেই প্রেক্ষিতে বিএনপি-বিরোধী শিবির বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচারণা বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে নিতে থাকে। মানুষের মনে এক ধরনের ধারণা তৈরি করে যে বিএনপির নেতারা দুর্নীতিবাজ, চোর এবং অসৎ।
ডাকসু নির্বাচনের পর বিএনপির হয়তো বোধোদয় হয়েছে যে জামাতকে তারা যতটা দুর্বল ভেবেছিল, তারা ততটা দুর্বল নয়। জামাত সাংগঠনিকভাবে গুছানো, পরিকল্পনামূলক এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল যদিও পরাজিত হয়েছে, মাত্র চার সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়েও তারা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিবির যেমন তাদের নিজস্ব সাংগঠনিক সক্ষমতা ও জামাতের সহায়তা কাজে লাগিয়েছে এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকেই ডাকসু নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে। Michels-এর Iron Law of Oligarchy এর সাথে যারা পরিচিত তাড়া জানেন যে সংগঠন টিকে থাকতে হলে নেতৃত্ব ও কাঠামোগত শৃঙ্খলা জরুরি। জামাত সেই শৃঙ্খলা ধরে রেখেছে। অন্যদিকে ছাত্রদল এক ধরনের সমন্বয়হীনতার মুখোমুখি হয়েছিল এবং মাত্র চার সপ্তাহের প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। ছাত্রদলের নির্বাচনী সাফল্যের পেছনে দলের কোনো বিশেষ অবদান নয়, বরং ছাত্রদলের কর্মীদের ব্যক্তিগত পরিশ্রমই বড় কারণ ছিল। কিন্তু আমরা ভালো করেই জানি, নির্বাচনের মতো ঘটনায় শুধু ব্যক্তিগত বা গ্রুপভিত্তিক পরিশ্রম যথেষ্ট নয়, এখানে দরকার পড়ে সাংগঠনিক সক্ষমতা।
ডাকসুর এই পরাজয়ে বিএনপির মধ্যে একটি উপলব্ধি তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়—নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ জামাত। আর এই প্রতিপক্ষের সাংগঠনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা মোকাবেলা করার মতো প্রস্তুতি বিএনপি নিতে পারেনি। কেন পারেনি? এর অন্যতম কারণ হলো, বিএনপি মূলত একটি জনভিত্তিক দল, সংগঠনভিত্তিক দল নয়। এখানেই আসল টুইস্ট। জামাত যেমন নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করেছে, পাশাপাশি বিএনপির জনভিত্তিকে দুর্বল করতে গুছানো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে। বিএনপি বিরোধী ব্লক মানুষের মনে বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ, চোর বা টেম্পু-স্ট্যান্ড পার্টি হিসেবে উপস্থাপন করতে তুলনামূলকভাবে সফল হয়েছে।
তাহলে বাকি থাকে সংগঠন। আপাতদৃষ্টিতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে অনেকে সহানুভূতির চোখে দেখত—ভাবত, আওয়ামী লীগের দমন-নিপীড়নের কারণে বিএনপি দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আর এই সহানুভূতির সুযোগ নেই। এখন বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা মানুষ নিপীড়নের ফল হিসেবে নয়, বরং organizational incompetence হিসেবে দেখছে। এটি একধরনের legitimacy crisis—যেখানে মানুষ দলকে অযোগ্য হিসেবে দেখা শুরু করে। আর যদি এই ধারণা স্থায়ী হয়ে যায়, তবে মানুষ বিএনপিকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার উপযুক্ত দল হিসেবে বিবেচনা করবে না। এই অনাস্থা ভবিষ্যতের নির্বাচনে বিএনপির জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে। ডাকসু নির্বাচন দেখিয়েছে যে শুধু আবেগ নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। Samuel Huntington-এর মতে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে হলে institutionalization of politics প্রয়োজন। বিএনপি তার রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছে না।
বিএনপির এই সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য দলের প্রধান নেতাকে মাঠে নেমে আসতে হবে, কর্মীদের মাঝে অবস্থান নিতে হবে। নিঃসন্দেহে তিনি প্রবাসে থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর দলকে একত্রিত করার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তখন তাঁর পক্ষে মানুষের সহানুভূতি ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সহানুভূতি আগের মতো নেই। ডাকসু নির্বাচন বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চরম মানসিক চাপ তৈরি করেছে।
ডাকসু নিয়ে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের নীরবতা কি কোনো বিশেষ বার্তা বহন করছে? এই নীরবতার কারণ কী? দলের ভেতরে কি কোনো অভিমান তৈরি হচ্ছে যা অবশিষ্ট সংগঠনকেও অকার্যকর করে দিচ্ছে? অথবা দলের ভেতরে কি কোনো সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে? এই প্রশ্নগুলো এখন মানুষকে ভাবাচ্ছে। আর এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য মানুষ যখন নেতৃত্বের উপস্থিতি দেখতে চাইবে, তখন তা কেবল ফেসবুক পোস্ট বা ভিডিও বক্তৃতার মাধ্যমে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার শারীরিক উপস্থিতি—মাঠে যাওয়া, শহরের গলিতে গলিতে যাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া, কৃষকের সাথে হাত মেলানো, মসজিদে নামাজ পড়া, পূজার মণ্ডপে গিয়ে শুভেচ্ছা জানানো। এক কথায় একে বলে “proximity effect”। এর ফলে জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাজনৈতিক বৈধতা বাড়ায়। কৃষকের সাথে হাত মেলানো, ক্যাম্পাসে যাওয়া, পূজার মণ্ডপে যাওয়া—এসব কেবল প্রতীকী কাজ নয়, বরং রাজনৈতিক বৈধতা পুনর্গঠনের হাতিয়ার।
বিএনপি যেহেতু এক নেতা-ভিত্তিক দল, সেই নেতার দেশে ফেরা দেরি হলে তা আসলে বিএনপির রাজনৈতিক দুর্বলতাকেই স্পষ্ট করে। তারেক জিয়া হলেন বিএনপির “charismatic authority” (Max Weber)। যদি দীর্ঘদিন তিনি মাঠে অনুপস্থিত থাকেন, তবে দলের ভেতরে গেটকিপার তৈরি করে যারা মূলত সংগঠন ভেতরে বিভক্ত করে ফেলে। এই বিভক্তি শেষ পর্যন্ত charismatic authority কে চ্যালেঞ্জ এর মুখে ফেলে। বাস্তবতা হল, বিএনপি ভুল করবে যদি তারা ভাবে—সিভিল সোসাইটি, ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বা সাধারণ মানুষ অবিরামভাবে শুধু জামাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন দিয়ে যাবে। বিএনপি একমাত্র বিকল্প নয় ক্ষমতার রাজনীতিতে।
এই সত্য উপলব্ধি করেই তারেক জিয়ার দেশে আসা, দেশের মাটিতে সেজদা করা এখন বিএনপির জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি এই পথে হাঁটবে?
উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতি: জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সমীকরণ

মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
ঢাকার ব্যস্ত সড়কে মেট্রোরেল ছুটে যায় দ্রুতগতিতে। হাজারো মানুষের কর্মজীবন বদলে দিচ্ছে প্রতিদিন। অনেকে হয়তো জানেন না, এই আধুনিক ব্যবস্থার পেছনে সবচেয়ে বড় সহায়তা এসেছে দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপান থেকে। আবার কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, সেটিও জাপানের বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তার ফসল। বলা চলে, বাংলাদেশের প্রতিটি উন্নয়ন অধ্যায়ের পেছনে একবার তাকালে দেখা যাবে—জাপানের নিঃশব্দ অথচ দৃঢ় উপস্থিতি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন জাপান দ্রুত এগিয়ে আসে। মাত্র এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক টোকিও সফর দুই দেশের বন্ধুত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে সেতু, রাস্তা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—প্রতিটি খাতেই জাপানের সহায়তা বাংলাদেশের জন্য ছিল জীবনদায়ী। আস্থা, সহানুভূতি ও উন্নয়ন সহযোগিতার এই ভিত্তি আজও দুই দেশের সম্পর্কে এক অটুট বন্ধনের প্রতীক।
অতীতের সেই আস্থার উপর দাঁড়িয়ে সম্পর্কের চরিত্র আজ বদলে গেছে। বাংলাদেশ আর শুধু সহায়তার গ্রহীতা নয়; এখন এটি জাপানের কৌশলগত অংশীদার। বিশেষ করে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিশা এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস “৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি”র যে ধারণা দিয়েছেন, তাতে বহুমুখী সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তার কূটনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকায় জাপান শীর্ষে উঠে এসেছে—কারণ জাপান শুধু উন্নয়ন সহযোগী নয়, ভবিষ্যতের বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের জন্য এক নির্ভরযোগ্য মিত্র।
২০২৫ সালের মে মাসে ড. ইউনূসের টোকিও সফর এই সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনা করে। প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে বৈঠকে জাপান শুধু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে স্বাগত জানায়নি, বরং ১.০৬৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও অনুদান সহায়তা ঘোষণা করেছে। নতুন রেলপথ, জলবায়ু সহনশীলতা এবং শিক্ষাবৃত্তির জন্য এই অর্থ ব্যয় হবে। একই সঙ্গে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে—যার মধ্যে বিনিয়োগবান্ধব One Stop Service, ডিজিটাল নিরাপত্তা, জাপানি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন কারখানা স্থাপন এবং দক্ষ কর্মী উন্নয়ন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল একটি Economic Partnership Agreement (EPA)। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হবে, তখন শুল্ক সুবিধা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে। EPA হলে সেই সুবিধা বজায় থাকবে, রপ্তানি বৈচিত্র্য ঘটবে এবং বাংলাদেশ জাপানি বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে পারবে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক সুযোগ, যাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটবে।
তবে জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিস্তৃত হচ্ছে নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক কৌশলগত সহযোগিতায়। জাপান প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে টহল নৌযান সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্যও হয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে জাপান বাংলাদেশকে শুধু উন্নয়ন সহযোগী নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবেও দেখতে শুরু করেছে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন এই অংশীদারিত্বের আরেকটি বড় দিক। আগামী পাঁচ বছরে অন্তত এক লক্ষ দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী জাপানে যাবে—নার্সিং, কেয়ারগিভিং, আইটি, মেকাট্রনিক্সসহ বিভিন্ন খাতে। এতে একদিকে বাংলাদেশের তরুণরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও জ্ঞান-প্রবাহ উভয় দেশকেই সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় জাপানি বৃত্তি এবং যৌথ কর্মসূচি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
তবে সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। বাংলাদেশের প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বাধা। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধি জাপানি আস্থাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশকে সতর্কভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের মাঝে জাপানের সাথে সম্পর্ক গভীর করতে গেলে দক্ষ কূটনীতির প্রয়োজন হবে।
অন্যদিকে, সুযোগও সীমাহীন। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, তৃতীয় টার্মিনাল—এসব মেগা প্রকল্প বাংলাদেশকে আঞ্চলিক লজিস্টিক্স হাবে পরিণত করবে। EPA কার্যকর হলে রপ্তানি বাজার বহুমুখী হবে। জাপানের সবুজ প্রযুক্তি ও জলবায়ু সহায়তা বাংলাদেশের জন্য টেকসই উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ কর্মী প্রেরণ দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্ক আজ একটি উইন–উইন অংশীদারিত্ব। অতীতের আস্থার ভিত্তি, বর্তমানের কৌশলগত সাযুজ্য এবং ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনা—সবকিছু মিলিয়ে এ সম্পর্ক শুধু দুই দেশের জনগণের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য এটি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং একটি মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যতের পথ। আর জাপানের জন্য বাংলাদেশ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির এক নির্ভরযোগ্য মিত্র।
শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের সামনে এক অমীমাংসিত সংকট
গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতনের এক বছর পরে শেখ হাসিনা কি আওয়ামী লীগের ভেতরে তার উত্তরাধিকারীর হাতে দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা আপাতত বাংলাদেশে কঠিন, কারণ যারা ন্যারেটিভ তৈরি করেন তাঁরা এখানে এক অঘোষিত এমবারগো চালু করেছেন। ফলে এ নিয়ে আলোচনা যুক্তির তুলনায় আবেগময় বিরোধিতার মুখে বেশি পড়ে। আমি এই আবেগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করা এবং জুলাই–আগস্ট মাসে নাগরিকদের ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে আবেগকে সম্মান জানিয়েই আমি এই আলোচনায় প্রবেশ করছি, কারণ একাডেমিক হিসেবে আমার দায়িত্ব সময়ের বিরুদ্ধে গেলেও নিজের চিন্তা প্রকাশ করা। সব চিন্তাই যে সঠিক হবে তা নয়, কিন্তু অন্তত চিন্তাটা প্রকাশ করা জরুরি, যাতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে জটিল রাজনৈতিক ইস্যুগুলো বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি হয়।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। একটানা চুয়াল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি দল পরিচালনা করেছেন, একেবারে কঠোর হাতে। দলের মধ্যে তার বিকল্প খোঁজার চেষ্টা হয়নি বললেই চলে। তাই ‘সাকসেশন প্ল্যান’ নিয়ে কোনো প্রকাশ্য আলোচনা হয়নি; যা হয়েছে তা অনেকটাই বন্ধ দরজার আড়ালে। আওয়ামী লীগের দেশি–বিদেশি মিত্ররাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন, কিন্তু শেখ হাসিনা নীরব থেকেছেন। কেন নীরব থেকেছেন তা তিনি নিজেই ভালো জানেন।২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। প্রথম সারির নেতারা হয় গ্রেফতার হয়েছেন, নয়তো পালিয়েছেন। দ্বিতীয় সারির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তৃতীয় ও চতুর্থ সারির অনেক নেতা এখন স্থানীয়ভাবে বিএনপি ও জামায়াতের নিরাপত্তার ছায়ায় রয়েছেন—যদিও কেউ প্রকাশ্যে তা স্বীকার করবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝেন এমনরা জানেন বাস্তবতা।
আওয়ামী লীগের পতনকে কেবল রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং আওয়ামীপন্থী সামাজিক শ্রেণি-জোটের ভেঙে পড়া হিসেবেও দেখা যায়। দলটি মধ্যবিত্তের সমর্থন হারিয়েছে, ছাত্রলীগ অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে, রাজনীতির জন্য প্রয়োজনীয় শ্রেণি-ভিত্তিক সমর্থনের অনেকটাই ক্ষয় হয়েছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও প্যাট্রোনেজ রাজনীতি দলটির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারের প্রশ্নকে আরও জটিল করে তুলছে।
শেখ হাসিনা অনুপস্থিত থাকায় দলীয় তৃণমূল কোথা থেকে নির্দেশনা পাবে, তার কোনো স্পষ্ট প্রোটোকল আওয়ামী লীগের ছিল না। ফলে গত এক বছরে দলের কমান্ড কাঠামো কার্যত ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে যেসব নেতা–মন্ত্রীদের কারণে আওয়ামী লীগের এই পরিণতি, তাদের হাতে আছে বিপুল অর্থ, যা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত। অথচ জুলাই–আগস্টের আন্দোলন কিংবা ২০১৪ সালের পর থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার ঘটনাগুলো দল কখনো আত্মসমালোচনার চোখে দেখেনি। বরং ষড়যন্ত্রতত্ত্বকেন্দ্রিক ন্যারেটিভই তৈরি করেছে। এতে সাময়িকভাবে হার্ডকোর সমর্থকেরা সন্তুষ্ট হলেও প্রকৃত লাভবান হচ্ছেন সেই নেতারা, যারা মূলত দলের পতনের জন্য দায়ী। ফলে অর্থ ও ষড়যন্ত্রের জোরে তাদের প্রভাব এখনও টিকে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো মাঠের আওয়ামী লীগ ভেঙে পড়েছে, নেতৃত্ব শুন্য।
ওবায়দুল কাদের যদি মনে করেন তিনি ভবিষ্যতে এসে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন, তবে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তার রাজনীতি শেষ। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কাছে অন্য কোনো নেতার গ্রহণযোগ্যতা নেই। অথচ শেখ হাসিনার পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত কোনো নেতা আর রাজনীতিতে ফেরেন না—এটা প্রায় নিয়মের মতো। তাছাড়া তার বয়সও হয়েছে। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার সময় মানুষ তাঁকে পিতৃহারা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে পালানোর পর তিনি আর সেই কন্যা নন, বরং গণতন্ত্র ধ্বংসকারী ও নাগরিক হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এক পরাজিত প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা “শোকাহত কন্যা” থেকে “অধিকৃত একনায়ক” হয়ে উঠলেন, এই ফ্রেমিং থেকে কোনো নেতা বেরোতে পারেন না। ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাস।
এই দুর্বলতার সুযোগ যেমন আওয়ামী লীগের ভেতরের অনেকে নিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক খেলোয়াড়ও নিয়েছেন। এর মানে হলো সময় যত যাবে শেখ হাসিনার ওপর চাপ বাড়বে উত্তরাধিকারীর হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কে হবেন সেই উত্তরাধিকারী? কোন মডেলে হবে নেতৃত্বের হস্তান্তর? তাঁরা কি আসলেই নেতৃত্ব দিতে পারবেন? আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকারের এই অমীমাংসিত প্রশ্নই হবে শেখ হাসিনার জীবনের শেষ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।পাকিস্তানের ভুট্টো পরিবার বা শ্রীলঙ্কার বন্দারনায়েক পরিবার উত্তরাধিকার নির্বাচনে কী করেছিল তা আমরা নিবিড়ভাবে দেখতে পারি। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কীভাবে কাজ করে তা খানিকটা বোঝা যাবে। তবে এই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের জন্য ভারতের কংগ্রেস মডেল প্রাসঙ্গিক। বিজেপির কাছে পরাজয়ের পর বিলুপ্তির মুখে থাকা কংগ্রেসকে রাহুল গান্ধী–প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যৌথ নেতৃত্বে গুছিয়ে তোলে। সফল হয়নি, কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখেছে এবং মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা কি এই মডেল অনুসরণ করবেন? আমার মনে হয়, তিনি একক কারো হাতে ক্ষমতা দেবেন না। জয় ও পুতুল—দু’জনকেই সামনে আনবেন। প্রশ্ন হলো, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির ভূমিকা কী হবে?
আওয়ামী লীগের রাজনীতি বোঝেন এমন অনেককেই আমি এই প্রশ্ন করেছি। আমার যতটুকু বোঝা, তাতে মনে হয় পুতুল এখন সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বগুণ জয়ের থেকেও বেশি। দিল্লিতে দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কাজকর্ম ম্যানেজ করা—সবই তিনি করছেন। অন্যদিকে সজীব ওয়াজেদ মার্কিন নাগরিক। তিনি দলের মুখপাত্র হিসেবে থাকলেও মাঠের রাজনীতিতে কতটা নামবেন, তা অনিশ্চিত। তবে রাজনীতিতে তিনিও সক্রিয়।এটাই শেখ পরিবারের বাঁচা–মরার লড়াই। জিততে পারলে নেতৃত্ব শেখ পরিবারের হাতেই থাকবে, হারলে দল ভেঙে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হবে। বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগকে এখনও পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছে মুজিবের রক্ত। যেমন বিএনপিকে এক রেখেছে জিয়ার রক্ত। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি “leader–centered” পার্টি, যেখানে প্রতিষ্ঠান দুর্বল। ফলে নেতৃত্বের প্রশ্ন উঠলেই পুরো সংগঠন অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আর সে কারণেই নেতৃত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতার রক্তের ভূমিকা মুখ্য হয়ে ওঠে।
অনেকেই ভেবেছিলেন ৫ আগস্ট এই সূত্র মুছে দেবে, কিন্তু অভ্যুত্থানের পর বিচারের ব্যর্থতা ও অভ্যুত্থান-নেতাদের ক্রমাগত রাজনৈতিক ভুল মুজিবের রক্তের উত্তরাধিকারকে আরও মূল্যবান করে তুলেছে। অন্যদিকে যারা Elite Succession Theory-এর সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন ক্ষমতাচ্যুত শাসকরা সাধারণত উত্তরাধিকার প্রশ্নে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করেন। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব জয়–পুতুল–রাদওয়ান এই ত্রিমাত্রিক পরিবারের হাতে রাখা হবে, যাতে দলীয় নিয়ন্ত্রণ শেখ পরিবারের বাইরে না যায়।
সেই প্রেক্ষিতে বলা যায়, আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন এখন তিন কেন্দ্র ঘিরে। দিল্লিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ভার্জিনিয়ায় প্রচারণা সামলাচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ, আর কলকাতায় শক্তি ও অর্থের সমন্বয় করছেন আসাদুজ্জামান খান কামাল, এ.এফ.এম. বাহাউদ্দিন নাসিম ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। অন্তত বিবিসির খবর তাই বলে। ফলে দেখা যাচ্ছে—‘ব্রেইন’ দিল্লিতে, প্রচারণা ভার্জিনিয়ায়, আর ‘মাসল ও মানি’ কলকাতায়।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কি পারবে এই নতুন নেতৃত্ব নিয়ে রাজনীতিতে ফিরে আসতে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ বিষয়টি এখনও বিকাশমান। আওয়ামী লীগের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হবে, ঠিক যে মুহূর্তে তারা ফেরত আসার চেষ্টা করবে, সে মুহূর্তে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি সবাই এক হয়ে যাবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতায়। আগামী দশ বছর এই বিরোধিতা টিকে গেলে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনীতি করা কঠিন হবে, তবে অসম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ সরকার যদি সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয় এবং বিরোধী দল যদি হিংসাত্মক, অগণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তবে আওয়ামী লীগ খুব সহজেই নিজের জন্য রাজনৈতিক স্পেস খুঁজে নেবে। আপাতত মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ সরকার সুশাসন দিতে যথেষ্ট বেগ পাবে ও বিরোধী দল গঠনমূলক রাজনীতিতে তেমন ভূমিকা রাখবে না বরং ধ্বংসাত্মক রাজনীতির দিকে এগবে। আপাতত আমরা এমন কোন লক্ষণ দেখছি না যা আর বাইরে কোন ভবিষ্যৎ এর ধারনা দিচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতেই বলা যায়, আওয়ামীলীগ এর রাজনীতির রুম রাজনীতির আপনা নিয়মেই তৈরি হবে হয়তো।
আওয়ামী লীগের বয়স এখন ৭৬ বছর। মুক্তিযুদ্ধের পর এই প্রথম দল এত বড় সংকটে পড়েছে। প্রশ্ন হলো, জয়–পুতুল মডেল কি দলকে ঘুরে দাঁড় করাতে পারবে? শেখ পরিবার কি আবার নিজেদের রাজনৈতিক দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে? না কি দলটির এই নেতৃত্ব মডেল ব্যর্থ হলে মিশরের নাসেরবাদী পার্টির মতো ক্ষমতাচ্যুতির পর ভেঙে পড়বে?
পিনাকি গং-এর কৌশলগত প্রচারণা: বিএনপির বিভাজন ও ডানপন্থার উত্থান

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে পিনাকি ও তার সহযোগীদের প্রচারণা এক নতুন ধরনের কৌশলগত বাস্তবতা তৈরি করেছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। উদ্দেশ্য একটাই—আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আবেগ উত্তেজিত করে তাদের আবারও ন্যারেটিভ স্পেসে সক্রিয় করা। এই প্রচেষ্টার আরেকটি লক্ষ্য হলো বিএনপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের ভয় দেখানো: “দেখো, আওয়ামী লীগ আবার ফিরতে চলেছে।” তবে বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের আর মাঠ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু তাদের “জুজু” দেখাতে কোনো ক্ষতি নেই; বরং সেটি কৌশলগতভাবে কাজে দেয়। এই প্রচারণার পেছনে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা আছে—বিএনপির ট্রানজিশনাল গণতন্ত্রে ফেরার চেষ্টা দুর্বল করে দেওয়া।
এই কৌশলের একটি দিক হলো পুরোনো আওয়ামী লীগ বনাম জামায়াত বিতর্ককে নতুন করে সামনে আনা। কারণ এই ইস্যুতে বিএনপির সাধারণ কর্মীরা স্বভাবতই আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান নেবে। তখন তারা তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে আরও কঠোর বক্তব্য ও অবস্থান আশা করবে। যদি নেতৃত্ব এই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে সেই ফাঁক কাজে লাগিয়ে পিনাকি গং তাদের বর্তমান কৌশল চালিয়ে যাবে—বিএনপির নেতৃত্বকে ভারতপন্থী বা আওয়ামী লীগসহানুভূতিশীল বলে অভিযুক্ত করবে। তারা ইতোমধ্যেই এই প্রচারণা চালাচ্ছে, যাতে বিএনপির সাধারণ সমর্থকদের বিভ্রান্ত করা যায় এবং তাদের মধ্যে অবিশ্বাস ও বিভাজন তৈরি হয়।
পিনাকি গং ভালোভাবেই জানে যে বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবল। এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে তারা আবারও রাজনীতিতে একটি নতুন ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে চাইছে। সেটি হলো—আওয়ামী লীগ বনাম জামায়াত দ্বন্দ্ব। এই কৌশল কার্যকর হলে বিএনপির সাধারণ কর্মীরা একদিকে হতাশ হবে, অন্যদিকে নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
এই প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, বিএনপির সাধারণ সমর্থক ও নেতৃত্বের মধ্যে অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধপক্ষ বনাম বিরোধী পক্ষের বিতর্ককে ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগকে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করা। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক উইংকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং জনপরিসরে সক্রিয়ভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে দাঁড় করানো। এর ফলে বিএনপিকে সীমিত অনলাইন সক্ষমতা নিয়ে দুই ফ্রন্টে লড়াই করতে হবে—একদিকে আওয়ামী লীগের প্রচলিত বয়ান, অন্যদিকে পিনাকি গং-এর বিভাজনমূলক প্রচারণা।
সবশেষে বলা যায়, এই ধরনের কৌশলগত প্রচারণার সবচেয়ে বড় উপকারভোগী হবে জামায়াত-শিবির এবং মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন চরম ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলো। কারণ তারা একইসঙ্গে বিএনপিকে দুর্বল করতে পারবে এবং নিজেদের আদর্শিক অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রোপাগান্ডা নতুন কিছু নয়, কিন্তু পিনাকি গং-এর প্রচারণা একটি সুপরিকল্পিত কৌশল, যা শুধু একটি দলকে নয়, বরং পুরো গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াকেই দুর্বল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত। বিএনপিকে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে—কেবল আওয়ামী লীগ নয়, এখন তাদের লড়াই একটি নতুন শক্তির বিরুদ্ধেও, যারা বিভাজন ও অবিশ্বাসকে হাতিয়ার করে ডানপন্থার পক্ষে মাঠ প্রস্তুত করছে।
প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বাংলাদেশে রাজনীতির বিপদসংকেত

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ফেনোমেনন হলো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। একাধিক রাজনৈতিক বর্গ ও অ্যাক্টর রাজনীতিকে মাঠের বাইরে সরিয়ে এনে নিজেদের ড্রয়িংরুমে সীমাবদ্ধ করেছেন। ঢাকার বিদেশি দূতাবাসগুলো এই প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে—অনেক রাজনৈতিক নেতা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দূতাবাসে সময় কাটাচ্ছেন, ছক কষছেন, দাবার গুটির মতো চাল দিচ্ছেন। এই মুহূর্তে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের প্রধান শিকার জাতীয় পার্টি। প্রশ্ন হলো, এর পরবর্তী টার্গেট কে হবে? কারা চাইছে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে অস্থিতিশীল করে ছোট ছোট দলগুলোর এক অস্থায়ী কোয়ালিশনকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে? এবং শেষ পর্যন্ত এই কোয়ালিশন কার স্বার্থ রক্ষা করবে?
জাতীয় পার্টির প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো মায়া–মমতা নেই। আমি মনে করি না এই দলের কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক দর্শন বা নীতি আছে। বরং দলটির নেতৃত্ব দীর্ঘ সময় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাবেই নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কারণেই জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অভিযোগ তুলেছে যে জাতীয় পার্টি মূলত একটি ফ্যাসিস্ট সহযোগী শক্তি। সন্দেহ নেই, বিগত ১৫ বছরে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনো শেখ হাসিনার ভয়ে সরকারের সুযোগ–সুবিধা ভোগ করেছে।
তবুও এখানে একটি সম্ভাব্য পথ ছিল: সরকারের অন্যায় ও স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে যারা সহযোগী ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার হতো। সেই পথে না গিয়ে, অভ্যুত্থানের এক বছর পরে পুরো দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে—কোন স্বার্থে? কোন দূতাবাস বা জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তা এই নিষেধাজ্ঞার দাবিকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছেন? কেন বাংলাদেশকে ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করতে তারা এত আগ্রহী? এটি কি কেবল তৃতীয় বিশ্বের এক দেশে রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট চালানোর রোমাঞ্চ, যা কিছু তরুণ কূটনীতিকের জীবনের সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার হয়ে দাঁড়িয়েছে?
কিন্তু প্রশ্ন এখানে শেষ হয় না। আমাদের ছোট ছোট দলগুলোর নেতারাই বা কেন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আস্থা না রেখে এই প্রকার আন্তর্জাতিক পরীক্ষার সহযোগী হচ্ছেন? তারা কি উপলব্ধি করছেন না, নিষেধাজ্ঞা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এই ধারাবাহিকতা কাকে শক্তিশালী করবে আর কাকে দুর্বল করবে? কে প্রকৃত উপকারভোগী হবে, আর এই প্রক্রিয়ার ফলাফল আগামী নির্বাচনে কীভাবে প্রতিফলিত হবে?
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা বিশ্বাস করেন—যদি তারা যথেষ্ট আবেগ এবং জুলাই চেতনার প্রতীক ব্যবহার করেন, তবে জনগণ তাদের কার্যক্রমে সমর্থন দেবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না যে, তাদের স্কেপ রুট ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। তারা যে পথে হাঁটছেন, সেটি জনআস্থার নয়, বরং ক্ষমতার শর্টকাটের পথ। আর যদি নির্বাচন বিলম্বিত হয়, তবে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বেন তারাই—এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা। কারণ জনগণ শেষ পর্যন্ত যে শক্তির ওপর ভরসা করে, তা হলো গণতন্ত্র ও জনগণের অংশগ্রহণ, কোনো দূতাবাসের রাত্রিকালীন ছক নয়।
জাতীয় পার্টি হোক বা অন্য কোনো দল—রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিষিদ্ধ করার সংস্কৃতি আসলে দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হয়তো কিছু সময়ের জন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, কিন্তু তা কখনো স্থায়ী সমাধান দেয় না। আজ জাতীয় পার্টি টার্গেট, কাল অন্য কেউ হতে পারে। এই বাস্তবতাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার একমাত্র পথ হলো রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, আইনের শাসন ও জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ।
শেখ মুজিব: দেবতা, ভিলেন নাকি রাজনৈতিক ট্রাজেডির নায়ক?

ড. বাতেন মোহাম্মদ
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
শেখ মুজিবুর রহমান দেবতা ছিলেন না। আধুনিক বিশ্বের কোনো জাতীয়তাবাদী নেতাই দেবতা নন। তারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে জন্ম নেন না; বরং জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন তারা হয়ে ওঠেন সেই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় ভরসা, নেতৃত্বের প্রতীক এবং সম্মিলিত চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। মুজিবও ছিলেন তেমন এক নেতা, যিনি এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, ঠিক যেমন বিশ্ব ইতিহাসে বহু জাতি তাদের মুক্তির মুহূর্তে একজন মুখপাত্র খুঁজে পেয়েছে।
পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্রব্যবস্থা শুরু হয় মূলত আমেরিকার হাত ধরে। যে আমেরিকার স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন, তাকেও ইতিহাস সমালোচনার মুখে ফেলেছে। তিনি ছিলেন একজন দাস-মালিক, বহু দাসকে অমানবিকভাবে ব্যবহার করতেন। আজকের নৈতিক মানদণ্ডে তাকালে ওয়াশিংটনের চরিত্রের অন্ধকার দিক স্পষ্ট হয়, কিন্তু তবুও তাঁকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ তাঁর নেতৃত্বেই মানব ইতিহাস প্রথমবার দেখেছিল, মানুষ নিজের গোত্রীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে এক নতুন জাতীয় সত্ত্বা গড়ে তুলতে পারে এবং নিজের শাসনের অধিকার অর্জন করতে পারে।
শেখ মুজিবও ছিলেন এক সাধারণ মানুষের মতো, যার মধ্যে ছিল লোভ, তোষামোদে প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা, আত্মীয়তাবাদী দুর্বলতা, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি সুযোগ পেলে নিজেও ভুল করার সম্ভাবনা। কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল এক অসাধারণ ক্ষমতা, সাধারণ মানুষের মন পড়তে পারার এবং তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে কয়েকটি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর শব্দে প্রকাশ করার দক্ষতা। তাঁর উচ্চারণ "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" হয়ে উঠেছিল কোটি বাঙালির হৃদয়ের অনুবাদ।
১৯৭১ সালের মুজিব কোনো ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন কোটি মুক্তিকামী মানুষের সম্মিলিত সত্তা। এই মানুষগুলোর মধ্যে ছিলেন মসজিদের ইমাম, সৎ ও সদালাপী শিক্ষক, আবার ছিলেন কিছু ঠগ, দুর্নীতিবাজ ও সুযোগসন্ধানীও। এই বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিলেন মুজিব। একাত্তরের মুজিব ইতিহাসে এক কালেকটিভ আইডেন্টিটি, একাত্মবোধের প্রতিচ্ছবি। আপনি তাঁকে স্বীকার করুন বা না করুন, এই ঐতিহাসিক সত্য পরিবর্তন হবে না।
তবে ১৯৭২ সালেই জাতি দেখল মুজিবের প্রথম মৃত্যু। একাত্তরের মুক্তির সম্মিলিত সত্তার মুজিব ধীরে ধীরে রূপ নিলেন ব্যক্তি মুজিবে, প্রধানমন্ত্রী মুজিবে। ক্ষমতার কেন্দ্রে এসে তাঁর মধ্যে দেখা দিল স্বজনপ্রীতি, অদূরদর্শিতা, পরিকল্পনাহীনতা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা। ইতিহাস তাঁকে এই জায়গায় সাধারণ মানের এক শাসক হিসেবেই চিহ্নিত করবে হয়তো। তবুও তিনি ছিলেন আলাদা এক বিষয়ে, মানুষকে ভালোবাসা, বিশ্বাস করা এবং সহজেই বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার জাদুকরী ক্ষমতায়। কিন্তু এই বিশ্বাসই অনেক সময় তাঁকে অস্থির ও সিদ্ধান্তহীন করে তুলত, যা শেষ পর্যন্ত অরাজকতা ও অসন্তোষের জন্ম দেয়। এই পরিস্থিতিতে অনেকের কাছে মুজিব হয়ে উঠলেন অগ্রগতির পথে বাধা। ইতিহাসে এরকম উদাহরণ বিরল নয়, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, জিম্বাবুয়ের মুগাবে কিংবা মুজিব, সবাই যেন স্বাধীনতার নায়ক থেকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে বাধার প্রতীক হয়ে ওঠেন। প্রশ্ন থাকে, তাঁরা কি আসলেই ভিলেন, নাকি রাজনৈতিক ট্রাজেডির শিকার নায়ক।
১৯৭৫ সালের আগস্টে মুজিবের দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটল। এবার তাঁর মৃত্যু এল ঘাতকের গুলিতে, যা তাঁর দেহকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করল। যাঁদের কাছে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাঁদের অনেকে এই হত্যার মুহূর্তে নির্বাক হয়ে গেলেন। কেউ হতবাক হয়ে, কেউ আবার দুঃশাসন থেকে মুক্তির আশা নিয়ে। কিন্তু এই মৃত্যু তাঁর সব রাজনৈতিক ভুলকে একরকম রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দিল। এরপর শুরু হল ইতিহাসকে পুনর্লিখনের প্রয়াস, একটি প্রকল্প যা তাঁকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মুজিব বারবার ফিরে এলেন, কারণ প্রকৃত মুক্তির স্বাদ জাতি কোনোদিনই পুরোপুরি পায়নি।
মুজিবের তৃতীয় মৃত্যু সম্ভবত ঘটেছে গত পনের বছরে। এবার তাঁকে খুন করা হয়নি গুলিতে, বরং তিলে তিলে রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভের ভেতরেই তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। মুক্তির সম্মিলিত সত্তার মুজিবকে মূর্তির মুজিবে রূপান্তরিত করা হয়েছে। রাষ্ট্র তাঁকে দেবতা বানিয়েছে, যেখানে তাঁর নাম ব্যবহার করে অন্যায়, নিপীড়ন, লুটপাট সবই বৈধতা পেয়েছে। মানুষের আবেগের মুজিব যখন মূর্তির মুজিব হয়ে গেলেন, তখনই তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় মৃত্যু বরণ করলেন।
তাহলে কি শেখ মুজিব সত্যিই মারা গেছেন? ইতিহাস বলছে, তিনি তিনবার মরেছেন, প্রথমবার ব্যক্তি মুজিব হয়ে, দ্বিতীয়বার ঘাতকের গুলিতে, এবং তৃতীয়বার দেবতা বানানোর প্রকল্পে। কিন্তু এসব মৃত্যুই সাময়িক। কারণ বাংলাদেশ যতদিন বিশ্ব মানচিত্রে থাকবে, ততদিন শেখ মুজিব থাকবেন। কখনো নায়ক হয়ে, কখনো বিতর্কিত নেতা হয়ে, আবার কখনো প্রতীক হয়ে। তিনি ফিনিক্সের মতো বারবার ফিরে আসবেন।
আমরা আসলে সবাই শেখ মুজিব। আমাদের ভেতরের সক্ষমতা, লোভ, দুর্বলতা, স্বপ্ন এবং সীমাবদ্ধতা মিলিয়েই শেখ মুজিবের প্রতিচ্ছবি। আমরাই তাঁকে বারবার হত্যা করেছি, আবার আমরাই তাঁকে পুনর্জীবিত করব আমাদের ভেতরে। শেখ মুজিব দেবতা ছিলেন না, ভিলেনও নন। তাঁকে দেবতা বানানো মানেই তাঁর মৃত্যু ঘটানো। আবার ভিলেন বানানোর চেষ্টা করলে তিনি নতুন রূপে ফিরে আসবেন। তাঁকে দেখতে হবে এক সাধারণ বাঙালি হিসেবে, যার মধ্যে যেমন অতিমানবীয় নেতৃত্বের ক্ষমতা আছে, তেমনি আছে মানবিক দুর্বলতা। এই মানবিক মুজিবকেই ইতিহাসে পড়তে হবে, মুক্তির মহানায়ক হিসেবে, যিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সর্বাপেক্ষা বড় প্রতীক।
শ্রদ্ধা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
পাঠকের মতামত:
- একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট? জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কঠিন দ্বিধায় অন্তর্বর্তী সরকার
- ফখরুলের অভিযোগ: অন্তর্বর্তী সরকার আস্থার সেতু ভেঙে দিয়েছে
- শেষ হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ
- অনন্য মামুনের পোস্টে ঢালিউডে তামান্না ভাটিয়ার সম্ভাব্য আগমন
- নিজ দেশে ইসরায়েলিদের বিক্ষোভ
- ডা. জাকির নায়েক ঢাকায় আসছেন, ভারতের দাবি হস্তান্তরের
- রক্তদান শুধু মানবসেবা নয়, এটি এক মহৎ ইবাদত
- জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে ড. গালিবের সতর্কবার্তা
- পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ফের উত্তেজনায় ট্রাম্প ও ইরান
- জান্নাত-জাহান্নামের রহস্য উন্মোচন কুরআনের আলোকে
- তুরস্ক-কাতারের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে নতুন শান্তির বার্তা
- দেশের ২১ জেলায় ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস
- স্বাক্ষরের পরে বিপক্ষে অবস্থান জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপিকে কঠোর বার্তা হাসনাত আবদুল্লাহর
- দীর্ঘ বৈঠকের পর যুদ্ধবিরতি চালিয়ে যেতে সম্মত পাকিস্তান ও আফগানিস্তান
- সৌদি আরবে ওমরাহ ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর নতুন নিয়ম
- সামরিক শাসন থেকে সংসদীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশে গণভোটের অতীত জানা-অজানা
- শয়তানের আক্রমণ থেকে বাঁচুন রাতে ঘুমানোর আগে যে দোয়া পড়তেন নবীজি (সা.)
- ঘুমের ওষুধ নয় অনিদ্রা দূর করবে আপনার রান্নাঘরের ৬ খাবার
- ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধান অঞ্চলের নামাজের সময়সূচি
- সামরিক প্রস্তুতি লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসন মোকাবিলায় প্রেসিডেন্টের কঠোর নির্দেশ
- শাপলা কলি দিয়ে ইসি বুঝিয়েছে আমরা শিশুদের দল: সামান্তা
- রেকর্ড বৃদ্ধি পরদিনই দরপতন শুক্রবার থেকে কার্যকর হবে নতুন স্বর্ণের মূল্য
- অধ্যাপক ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুমোদন পেল নতুন মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ
- আমরা কীভাবে কী করব, বুঝতে পারছি না: আসিফ নজরুল
- ৩০ অক্টোবর ডিএসই লেনদেনের সারসংক্ষেপ
- ৩০ অক্টোবরের ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ লুজার তালিকা প্রকাশ
- ৩০ অক্টোবরের ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- এনসিপি সমন্বয়কের হুঁশিয়ারি গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি হলে দায়ভার প্রধান উপদেষ্টার
- উন্মোচিত হল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সত্যতা
- এক শতাব্দী পর সৈকতে ভেসে এলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বোতলবন্দি চিঠি
- ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ একপাক্ষিক ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা: মির্জা ফখরুল
- বিটিআরসি'র নতুন নিয়ম ১৬ ডিসেম্বর থেকে: আপনার ফোন বৈধ কিনা, জেনে নিন প্রক্রিয়া
- কর্মসংস্থানকে কেন্দ্রে রেখে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্য তারেক রহমানের
- গণভোটের দাবিতে নির্বাচন কমিশনের কাছে ৮ দলের ৫ দফা দাবি নিয়ে বিক্ষোভ
- বাংলাদেশি টাকার আজকের বিনিময় হার প্রকাশিত
- ওয়ান ব্যাংক পিএলসি-এর Q3 ২০২৫ আর্থিক ফলাফল প্রকাশ
- ফ্রিজে ঘন ঘন বরফ জমছে? স্থায়ী সমাধান দেবে ৩টি সহজ টিপস
- ফ্রিজে ঘন ঘন বরফ জমছে? স্থায়ী সমাধান দেবে ৩টি সহজ টিপস
- RELIANCINS-এর Q3 ২০২৫ আর্থিক ফলাফল প্রকাশ
- উচ্চ রক্তচাপই স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়: জীবন রক্ষায় প্রতিরোধের উপায়গুলি জেনে নিন
- GSP ফাইন্যান্স এর Q3 আর্থিক ফলাফল প্রকাশ
- রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স এর Q3 আর্থিক ফলাফল প্রকাশ
- পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে কি বিশ্ব? ট্রাম্পের নির্দেশে বাড়ছে উদ্বেগ
- মেঘনা ইন্স্যুরেন্স এর Q3 আর্থিক ফলাফল প্রকাশ
- পূবালী ব্যাংকের Q3 আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ
- ট্রাম্প-শি আলোচনা সম্পন্ন: বৈঠকের পর কী বড় সিদ্ধান্ত এলো?
- IFIC ব্যাংকের Q3 আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ
- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এশিয়া সফরের মধ্যেই প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন বাহিনীর নতুন হামলা
- বাণিজ্য উত্তেজনার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ঐতিহাসিক চুক্তি
- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য সুখবর!
- রাজনীতি, নির্বাসন ও নৈতিকতা: শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতাকে কোথায় নিচ্ছে
- ছবি, ভিডিও আর ভয়ের ব্যবসা: অনলাইনে হানিট্র্যাপের অন্ধকার দুনিয়া
- IFIC ব্যাংকের Q3 আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ
- পূবালী ব্যাংকের Q3 আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ
- ইতিহাসের পাতায় আজ: ৩০ অক্টোবর - বিজয়, বিপ্লব আর বেদনার দিন
- ২৮ অক্টোবরের ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- ২৯ অক্টোবর ডিএসই লেনদেনের সারসংক্ষেপ
- ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থা’ প্রভাবে ৫ দিন দেশজুড়ে বৃষ্টির পূর্বাভাস
- রাসুল (সা.) কেন অন্যের পাপকাজ প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন?
- আজকের বাজারের সেরা এবং খারাপ পারফরমার: লাভের সম্ভাবনা কোথায়?
- রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স এর Q3 আর্থিক ফলাফল প্রকাশ
- ২৮ অক্টোবর ডিএসই লেনদেনের সারসংক্ষেপ
- ২৭ অক্টোবরের ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- মেট্রোরেল দুর্ঘটনায় বাবা হারানো: দুই শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে স্ত্রীর আকুল আবেদন
- GSP ফাইন্যান্স এর Q3 আর্থিক ফলাফল প্রকাশ





