রান্নাঘর হারালে ভাঙে পরিবার: যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত ও বাংলাদেশের সতর্কবার্তা

বাড়ির রান্না: পারিবারিক ঐক্য, স্বাস্থ্য ও ঐতিহ্য রক্ষার চাবিকাঠি

জীবনযাপন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৭ ১৭:০৫:৪৩
বাড়ির রান্না: পারিবারিক ঐক্য, স্বাস্থ্য ও ঐতিহ্য রক্ষার চাবিকাঠি
ঘরের খাবারে শুধু পেট নয়, ভরে ওঠে হৃদয়ও। ছবি: AI

সংগঠিত সমাজ ও সুস্থ পরিবারের ভিত্তি গড়ে উঠে গৃহকেন্দ্রিক কার্যকলাপে। সম্প্রতি আমেরিকার পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, সময়ের সাথে সাথে সেখানে বিবাহিত দম্পতির গৃহস্থের ভাগ কমে যাচ্ছে । ১৯৭০ সালে মোট পরিবারের ৭১% অংশ ছিল বিবাহিত দম্পতির, যা ২০২২ সালে মাত্র ৪৭%। একই সময়ে “অনাম (nonfamily)” পরিবারের অংশ ১৯৭০-এর ১৯% থেকে ২০২২ সালে ৩৬%-এ উঠেছে। অর্থাৎ অনেক মানুষ একা বসবাস বা একক অভিভাবক পরিবার গঠন করছে। ডিভোর্সের হারও আমেরিকায় বেশি; সাম্প্রতিক তথ্যে প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ২.৪ জন ডিভোর্স করেছে। এই পরিবর্তনগুলো একদিকে ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রকাশ করলেও, পরিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি করে।

গবেষণা বলছে, পরিবারের সবার মিলিত রান্না ও মিলিত খাওয়ার চর্চা পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের বন্ধন জোরদার করে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, “পারিবারিক রান্না ও মিলিত আহার” মানসিক সংযোজন বাড়ায়, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করে। নিয়মিত পরিবারের সকল সদস্য একসঙ্গে বসে খেলে খাদ্যগুণ ভালো হয় এবং অসুস্থ অভ্যাস কমে যায়। বিপরীতে, বাড়ির বাইরে খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়লে পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং স্থুলকায়ীতা, ডায়াবেটিস-কার্ডিওভাসকুলার রোগসহ দীর্ঘমেয়াদী অসুখের ঝুঁকি বাড়ে। এই সব তথ্য থেকে বোঝা যায়, কেবল ঘরের বেডরুম থাকলেই পরিবার হয় না; রান্নাঘর থাকা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থা ও ঝুঁকি

বাংলাদেশ এখন দ্রুত নগরায়ন ও ডিজিটাল জীবনে ঢুকে পড়ছে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সুবিধা বৃদ্ধির ফলে শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে অনলাইন খাবার অর্ডার করার অভ্যাস বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এক গবেষণায় উল্লেখ আছে যে কোভিড মহামারীর সময়ে অনেকেই খাদ্য সরবরাহ অ্যাপ ব্যবহার করেছে অনলাইন ফুড ডেলিভারি অ্যাপ দিচ্ছে ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ”। ঢাকাসহ বড় শহরে ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড ইত্যাদি জনপ্রিয়, বিশেষ করে ব্যস্ত কর্মজীবীদের মধ্যে।

এদিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত পরিবার কাঠামোয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ২০২২ সালের গৃহ আয়-ব্যয় জরিপ অনুসারে গ্রামীণ এলাকায় গড় পরিবারের সদস্যসংখ্যা ২০১০ সালের ৪.৫৩ থেকে কমে ৪.৩০ হয়েছে। অর্থাৎ যুগের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মিলিত পরিবারের সংখ্যা কমে, নিউক্লিয়ার (পরিবার-শিশুদের নিয়ে পিতা-মাতা) পরিবার বাড়ছে। ঢাকার মতো মহানগরীর জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক চাপ ও শেখা-দেখা উন্নতির কারণে এই ধারা ত্বরান্বিত হয়েছে।

বিবাহবিচ্ছেদও বাংলাদেশে বেড়েছে। সরকারি জরিপে দেখা গেছে ২০২২ সালে দেশে প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ডিভোর্সের হার ১.৪ (২০২১ সালে ০.৭) হয়েছে, যা এক বছরে দ্বিগুণ। এই প্রবণতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান প্রভাবিত করছে। যদিও বাংলাদেশে বিবাহ সংকটকে সামাজিকভাবে যথেষ্ট নেগেটিভ মনে করা হয়, তবুও শিক্ষা, চাকরি ও সচেতনতার কারণে মানুষ কঠিন সম্পর্ক থেকে বের হয়ে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে উৎসাহী হচ্ছে ।

খাদ্য ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকি বাংলাদেশেও স্পষ্ট। গবেষকরা সতর্ক করেছেন, বাইরে তৈরি খাবার অস্বাস্থ্যকর হতে পারে। বিশেষ করে শিশু-কিশোররাই দ্রুত খাবারে বেশি আকৃষ্ট; তারা ফাস্ট ফুড খেলে সাধারণত বেশি ক্যালরি এবং কম পুষ্টি গ্রহণ করে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, রাস্তার ও স্ট্রিট ফুডে জীবাণু এবং দূষণের মাত্রা বেশি; ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বিক্রি হওয়া চটপট, নুডলস ইত্যাদির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অন্ত্র সংক্রমণ, পেটের সমস্যা এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রোগ হতে পারে। পাশাপাশি বাড়ির বাইরে খাবারে ফ্যাট, চিনি, নোনতা বেড়ে যাওয়ার কারণে স্থুলতাও বাড়ছে।

বাংলাদেশেও অস্বাস্থ্যকর বাইরে খাবার খাওয়ার প্রভাব মানসিক এবং অর্থনৈতিকউভয় ধরনের হতে পারে। পরিবার ভেঙে গেলে মানসিক চাপ বাড়ে; আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা খরচ বাড়ে

প্রাত্যহিক অভ্যাস পরিবর্তন: অনেক মধ্যবিত্ত শহরবাসী এখন রেস্তোরাঁ খাওয়ার অভ্যেসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। পরিবারের সবাই মিলে প্রতিদিন বা নিয়মিত রাঁধা খাবার খাওয়ার পরিবর্তে বাইরে বা ডেলিভারি ভরা ফুডে নির্ভর করছে।

ফ্যামিলি টাইম: পরিবারের সকলে একসঙ্গে বসে খাবার গ্রহণ মানসিক সুস্থতাসহ পারস্পরিক বোঝাপড়াকে বাড়ায়। এটি না থাকলে বাবা-মা, সন্তানদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে।

পুষ্টিমানের অবক্ষয়: বাইরে তৈরি খাবারে অধিকাংশ সময়ে তেল, ক্যালরি থাকে বেশি; ফলশ্রুতিতে শিশু ও বয়স্ক উভয়েরই পুষ্টি প্রাপ্তি কমতে পারে।

ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি: আমাদের পূর্বপুরুষরা ভ্রমণে গিয়েও নিজস্ব রান্না ভাত নিয়ে যেতেন। এটি শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি পরিবারিক ঐক্যকে টিকিয়ে রাখত। আজ সেই ঐতিহ্য হারিয়ে গেলে পারিবারিক বন্ধন ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

সুপারিশ ও সমাধান

বাংলাদেশে যদি এই খাওয়ার পরিবর্তিত অভ্যাস অব্যাহত থাকে, তবে আমেরিকার মতো পারিবারিক বিচ্ছেদের ঝুঁকি রয়েছে। তবে এটি প্রতিহত করা সম্ভব। গবেষণায় বিশেষ করে নির্দেশ আছে, পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে রান্না ও খেতে বসার অভ্যাস বৃদ্ধি করতে হবে। এতে খাদ্যবস্তুর পুষ্টিমান ভালো থাকে এবং পারস্পরিক আলাপচারিতা গড়ে ওঠে।

পরিবারে মিলিতভাবে রাঁধুন: প্রতিদিন বা সপ্তাহে অন্তত কয়েকবার পরিবারের সবাই মিলে রান্না ও খাবার সময় নির্ধারণ করুন। যৌথ আহার পারিবারিক ঐক্য ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সচেতন পুষ্টি: বাইরে খাবারের চেয়ে বাড়িতে রান্না করা খাবার পুষ্টিগুণে নির্ভরযোগ্য। অভিজ্ঞদের মতে, “ঘরে তৈরি খাবার” সাধারণত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়। তাই ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড কম খেয়ে শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডাল ইত্যাদি বাড়িতে রান্না করুন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা: পরিবার-পরিজনকে বাইরে খাবারের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে শিক্ষা দিন। বিশেষ করে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে হেলথি ডায়েটের সচেতনতা বৃদ্ধি করুন।

পশুপালন ও কৃষি: বাড়িতে পেঁয়াজ, রসুন কিংবা একটি হাঁস/মুরগি পালন করে, চাষ-বাগান করে নিজস্ব খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে গৃহপালিত পশুপালন বাড়ালে বাড়ির বাইরে খাবারের ওপর নির্ভরতা কমে।

সামাজিক মাধ্যমের দায়িত্ব: ফেসবুক, ইউটিউব বা টেলিভিশনে হঠাৎ ফ্যাশন বা বিখ্যাত খাবার তেমন প্রভাব ফেলছে, এর বদলে পরিবার ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক বার্তা প্রচার করা উচিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় রান্নার সঠিক পদ্ধতি, পুষ্টি ও পরিবার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণা চালান।

জনজীবনে ভোগবাদী সংস্কৃতি আর প্রযুক্তির বেড়ে চলা প্রভাব এড়ানো কঠিন, তবে সচেতনভাবে নিজেকে ও পরিবারের জন্য সুস্থ খাদ্যাভ্যাস গড়তে পারি। আমাদের পূর্বপুরুষরা বার্তা দিয়েছেন যে বাড়ির রান্না পরিবারের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে। আমেরিকান উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশি পরিবারগুলিকেও বাড়িতে রান্নাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এর ফলে পারিবারিক ঐক্য টিকে থাকবে, মানসিক-শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ সুদৃঢ় হবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ