১৯০০ সালের শাসনবিধি: আইন নয়, একটি রাজনৈতিক অস্ত্র

ওমর ফারুক
ওমর ফারুক
একটিভিস্ট, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা
২০২৫ জুলাই ০৯ ১৬:০৮:৪৭
১৯০০ সালের শাসনবিধি: আইন নয়, একটি রাজনৈতিক অস্ত্র

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে ১৯০০ সালের ১ মে “পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি” (Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900) জারি করে। এটি কোনো সংসদীয় আইন নয়, বরং একটি প্রশাসনিক নির্দেশ যা অঞ্চলটিকে তথাকথিত 'বিশেষ মর্যাদা' প্রদান করে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইন থেকে কার্যত মুক্ত ঘোষণা করে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত সাংবিধানিক আইন প্রয়োগ অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং এখনো তা প্রশাসনিক বাস্তবতায় কিছুটা বহাল রয়েছে।

বর্তমানে পাহাড়ি নেতৃত্বের একটি অংশ এই শাসনবিধির পূর্ণ প্রয়োগ দাবি করে রাজনৈতিক আন্দোলন চালাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্লেষকরা এটিকে ‘রাজনৈতিক প্রতারণার একটি অস্ত্র’ হিসেবে দেখছেন। কারণ, তারা পুরো শাসনবিধি বাস্তবায়নের পক্ষে নন; বরং যেসব ধারা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে কেবল তা রক্ষায় আগ্রহী। বাকিগুলো, যা তাদের ক্ষমতা বিস্তারে বাধা হতে পারে, সেসব ধারার বিরুদ্ধে তাঁরা সরব। এভাবে এই মৃতপ্রায় আইনকে তারা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।

মহামান্য আদালত এই আইনকে ‘মৃত’ ঘোষণা করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে এখনো কিছু মহল ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ হিসেবে চিত্রায়িত করতে চান। এর মাধ্যমে বাইরের বিশেষ করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিগ্রহণ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বসবাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রথাগত আইন ও রাজার নামের আড়ালে এই এলাকা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা চালু রয়েছে। অথচ এসব ‘রাজা’ ব্রিটিশ আমলে নিযুক্ত বেতনভোগী সার্কেল চিফ ছিলেন—তাঁরা ভূমির মালিক বা কোনোভাবে নির্বাচিত স্থানীয় শাসক ছিলেন না।

এই শাসনবিধি আসলে ব্রিটিশদের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার ছিল। কুকি ও চাকমাদের প্রতিরোধ দমন করতে না পেরে, প্রশাসনিক ক্ষমতা জেলা প্রশাসকদের হাতে রেখে, স্থানীয় নেতাদের সামান্য কিছু সুবিধা দিয়ে ব্রিটিশরা পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তখনকার পাহাড়ি নেতৃত্ব এই আইনের বিরোধিতা করেনি। বরং সুবিধাভোগী ছিলেন, যেমন আজকের দিনে একটি বিশেষ শ্রেণি সেই সুবিধা রক্ষা ও সম্প্রসারণে তৎপর।

স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইন সাংবিধানিকভাবে বৈধতা পায় না। এটি দেশের অভ্যন্তরে বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম উৎস। বহু সচেতন পাহাড়ি নাগরিকও এখন এই আইনের অপব্যবহারে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করেছেন—কিছু এলিট শ্রেণির (বিশেষত চাকমা) নেতৃত্বে, ভিনদেশীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট লোভ-লালসায় তারা সমস্ত পার্বত্যবাসীকে জিম্মি করে ফেলছেন।

বাংলাদেশের সংবিধান একটি একক, অভিন্ন, অবিভাজ্য রাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলে। এখানে কোনো প্রাদেশিক বা ফেডারেল ব্যবস্থার অনুমোদন নেই। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘নন-রেগুলেটেড এরিয়া’ হিসেবে দেখানো সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। যদি এই আইন পুরোমাত্রায় কার্যকর হয়, তাহলে তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের এক-দশমাংশ এবং কৌশলগত গুরুত্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। এটি চট্টগ্রাম বন্দর ও কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। যদি এই অঞ্চল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ব্রিটিশরা যেমন এই অঞ্চলকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল, তেমনি রাডক্লিফ কমিশনের কাছে মুসলিম লীগও আবেদন করেছিল যাতে কৌশলগত কারণে এই অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে থাকে।

আজকের দিনে চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহলের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। রাষ্ট্রবিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনবিধি কার্যকর করা হলে চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি হস্তক্ষেপ কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কিছু আত্মকেন্দ্রিক পাহাড়ি নেতা নিজেরা বিদেশি স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার ঝুঁকি সৃষ্টি করছেন।

অতএব, ১৯০০ সালের হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়াল নিছক একটি প্রশাসনিক আইন নয়; এটি এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রশ্ন। এই বিতর্কিত আইন টিকিয়ে রাখার মানে হলো—একটি স্বাধীন দেশকে আবারও ঔপনিবেশিক কাঠামোয় ফিরিয়ে নেওয়ার অপপ্রয়াস। পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই আইনের অপব্যবহার করছেন, তা কোনোভাবেই জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে নয়।

সরকারের উচিত এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় ঐক্য, সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে আইনটির পুনর্মূল্যায়ন করা। প্রয়োজনে এর বাতিল ঘোষণা করতে হবে। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কল্পিত জাতিসত্তা রক্ষার নামে পুরো জাতির স্বার্থকে বিপন্ন হতে দেওয়া যায় না। পাহাড়ি-বাঙালি সবাই যেন মিলেমিশে বসবাস করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে, এই আইন থেকে জন্ম নেওয়া সকল বৈষম্যমূলক, অগণতান্ত্রিক ও বিচ্ছিন্নতামূলক ধারা দ্রুত জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে বাতিল করা একান্ত প্রয়োজন।

উৎস: বিবিসি বাংলা, আমাদেরসময়.কম, ডেইলি স্টার, উইকিপিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম ও নিজস্ব অনুসন্ধান।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ