১৯০০ সালের শাসনবিধি: আইন নয়, একটি রাজনৈতিক অস্ত্র

ওমর ফারুক
একটিভিস্ট, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে ১৯০০ সালের ১ মে “পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি” (Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900) জারি করে। এটি কোনো সংসদীয় আইন নয়, বরং একটি প্রশাসনিক নির্দেশ যা অঞ্চলটিকে তথাকথিত 'বিশেষ মর্যাদা' প্রদান করে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইন থেকে কার্যত মুক্ত ঘোষণা করে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত সাংবিধানিক আইন প্রয়োগ অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং এখনো তা প্রশাসনিক বাস্তবতায় কিছুটা বহাল রয়েছে।
বর্তমানে পাহাড়ি নেতৃত্বের একটি অংশ এই শাসনবিধির পূর্ণ প্রয়োগ দাবি করে রাজনৈতিক আন্দোলন চালাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্লেষকরা এটিকে ‘রাজনৈতিক প্রতারণার একটি অস্ত্র’ হিসেবে দেখছেন। কারণ, তারা পুরো শাসনবিধি বাস্তবায়নের পক্ষে নন; বরং যেসব ধারা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে কেবল তা রক্ষায় আগ্রহী। বাকিগুলো, যা তাদের ক্ষমতা বিস্তারে বাধা হতে পারে, সেসব ধারার বিরুদ্ধে তাঁরা সরব। এভাবে এই মৃতপ্রায় আইনকে তারা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।
মহামান্য আদালত এই আইনকে ‘মৃত’ ঘোষণা করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে এখনো কিছু মহল ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ হিসেবে চিত্রায়িত করতে চান। এর মাধ্যমে বাইরের বিশেষ করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিগ্রহণ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বসবাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রথাগত আইন ও রাজার নামের আড়ালে এই এলাকা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা চালু রয়েছে। অথচ এসব ‘রাজা’ ব্রিটিশ আমলে নিযুক্ত বেতনভোগী সার্কেল চিফ ছিলেন—তাঁরা ভূমির মালিক বা কোনোভাবে নির্বাচিত স্থানীয় শাসক ছিলেন না।
এই শাসনবিধি আসলে ব্রিটিশদের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার ছিল। কুকি ও চাকমাদের প্রতিরোধ দমন করতে না পেরে, প্রশাসনিক ক্ষমতা জেলা প্রশাসকদের হাতে রেখে, স্থানীয় নেতাদের সামান্য কিছু সুবিধা দিয়ে ব্রিটিশরা পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তখনকার পাহাড়ি নেতৃত্ব এই আইনের বিরোধিতা করেনি। বরং সুবিধাভোগী ছিলেন, যেমন আজকের দিনে একটি বিশেষ শ্রেণি সেই সুবিধা রক্ষা ও সম্প্রসারণে তৎপর।
স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইন সাংবিধানিকভাবে বৈধতা পায় না। এটি দেশের অভ্যন্তরে বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম উৎস। বহু সচেতন পাহাড়ি নাগরিকও এখন এই আইনের অপব্যবহারে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করেছেন—কিছু এলিট শ্রেণির (বিশেষত চাকমা) নেতৃত্বে, ভিনদেশীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট লোভ-লালসায় তারা সমস্ত পার্বত্যবাসীকে জিম্মি করে ফেলছেন।
বাংলাদেশের সংবিধান একটি একক, অভিন্ন, অবিভাজ্য রাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলে। এখানে কোনো প্রাদেশিক বা ফেডারেল ব্যবস্থার অনুমোদন নেই। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘নন-রেগুলেটেড এরিয়া’ হিসেবে দেখানো সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। যদি এই আইন পুরোমাত্রায় কার্যকর হয়, তাহলে তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের এক-দশমাংশ এবং কৌশলগত গুরুত্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। এটি চট্টগ্রাম বন্দর ও কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। যদি এই অঞ্চল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ব্রিটিশরা যেমন এই অঞ্চলকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল, তেমনি রাডক্লিফ কমিশনের কাছে মুসলিম লীগও আবেদন করেছিল যাতে কৌশলগত কারণে এই অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে থাকে।
আজকের দিনে চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহলের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। রাষ্ট্রবিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনবিধি কার্যকর করা হলে চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি হস্তক্ষেপ কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কিছু আত্মকেন্দ্রিক পাহাড়ি নেতা নিজেরা বিদেশি স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার ঝুঁকি সৃষ্টি করছেন।
অতএব, ১৯০০ সালের হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়াল নিছক একটি প্রশাসনিক আইন নয়; এটি এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রশ্ন। এই বিতর্কিত আইন টিকিয়ে রাখার মানে হলো—একটি স্বাধীন দেশকে আবারও ঔপনিবেশিক কাঠামোয় ফিরিয়ে নেওয়ার অপপ্রয়াস। পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই আইনের অপব্যবহার করছেন, তা কোনোভাবেই জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে নয়।
সরকারের উচিত এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় ঐক্য, সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে আইনটির পুনর্মূল্যায়ন করা। প্রয়োজনে এর বাতিল ঘোষণা করতে হবে। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কল্পিত জাতিসত্তা রক্ষার নামে পুরো জাতির স্বার্থকে বিপন্ন হতে দেওয়া যায় না। পাহাড়ি-বাঙালি সবাই যেন মিলেমিশে বসবাস করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে, এই আইন থেকে জন্ম নেওয়া সকল বৈষম্যমূলক, অগণতান্ত্রিক ও বিচ্ছিন্নতামূলক ধারা দ্রুত জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে বাতিল করা একান্ত প্রয়োজন।
উৎস: বিবিসি বাংলা, আমাদেরসময়.কম, ডেইলি স্টার, উইকিপিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম ও নিজস্ব অনুসন্ধান।
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা: আসিফ নজরুল
- পুরুষের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: এক নীরব বাস্তবতা ও অস্বীকৃত সংকট
- আশুগঞ্জে এনসিপি কমিটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়েই তোলপাড়
- ১২ দিনের যুদ্ধ ও বিশ্বব্যবস্থার বিপর্যয়ের পূর্বাভাস
- ১৩ জুলাই শেয়ার দর কমেছে যে ১০টি শেয়ারের
- প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান কর্মতৎপরতা চাই – ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
- কাফরুলে উঠান বৈঠকে তরুণ ভোটারদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ, আলোচনায় বিএনপির ৩১ দফা
- মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যায় রিমান্ডে মুখ খুলছে আসামিরা, উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য
- ১৯০০ সালের শাসনবিধি: আইন নয়, একটি রাজনৈতিক অস্ত্র
- বাংলাদেশ প্রেসক্লাব বাহরাইনের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
- ফেনীতে বন্যা বিপর্যয়: বিপুল ক্ষয়খতি
- আজ কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন
- মিটফোর্ড খুন: চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মশাল মিছিল
- রূপচর্চায় নারিকেল তেলের ব্যবহার জেনে নিন
- ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও স্মৃতিতে বেঁচে আছেন ‘কৌতুকের রাজা’ দিলদার
- সোহাগ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ঘাতক নান্নু গ্রেফতার
- সমুদ্রের অতল গহ্বরে নাসার গুপ্ত অভিযান: মহাকাশ অনুসন্ধানের নতুন চাবিকাঠি?
- ১৮ পূর্ণ হতেই পর্ন মডেলের সঙ্গে নতুন বিতর্কে লামিন ইয়ামাল
- জুলাই অভ্যুত্থানে নারীর অবদান স্মরণে ঢাবিতে ‘জুলাই ওমেনস ডে’ পালিত
- রাতের ঘুমে তেষ্টা পেলে সতর্ক হোন: সামান্য উপেক্ষা ভবিষ্যতে ডেকে আনতে পারে বড় সমস্যা
- নওগাঁয় মায়ের জন্য বন্ধ নিজের ঘরের দরজা, তালা দিয়ে রুখলেন একমাত্র ছেলে
- মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে নির্বাচনী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ বিএনপির
- ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদাম: ইরানে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তির নিখুঁত ছকের এক নারী মুখ
- ‘গৃহযুদ্ধের পথে দেশ’: জিএম কাদেরের হুঁশিয়ারি
- মেহেরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দম্পতির করুণ মৃত্যু
- নিলামে উঠতে যাচ্ছে মঙ্গলের সেই উল্কাপিণ্ড যা পৃথিবীতে বিরল
- নাচের মেয়ে মন্দিরা এবার বড় পর্দায় নতুন রূপে
- আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশের নজিরবিহীন পদক্ষেপ
- লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়ার নানান কারণ ও প্রতিকার
- যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক জটিলতা কাটাতে বাংলাদেশ সরকারের নতুন উদ্যোগ
- ‘২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দাবি’—বিএনপির স্পষ্ট সংকেত
- ড. আসিফ নজরুলের প্রতিশ্রুতি: জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে দ্রুত ও ন্যায্য
- পুতিন ‘সুন্দর কথা বলেন, সন্ধ্যায় বোমা ফেলেন’: ট্রাম্প
- মালয়েশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রে বেনজীরের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ
- ফেসবুকে ক্ষমা চেয়ে পোস্ট, ঢাবি ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যু ভোরে
- জুলাই আন্দোলনের সাহসী নারীরা আজ নীরব—উৎকণ্ঠা শারমীন মুরশিদের
- পাবনায় যৌতুকের দাবিতে গৃহবধূ সাদিয়ার হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ
- প্রেমিকের হুমকি, স্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ—বিপাকে প্রবাসী
- পাবনা-৩ আসনে জনভিত্তিক প্রার্থী চান বিএনপি মনোনয়নপ্রত্যাশী রাজা
- অভিবাসীদের স্বপ্নপূরণে বাহরাইনের সোনালী অফার
- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা: আসিফ নজরুল
- পুরুষের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: এক নীরব বাস্তবতা ও অস্বীকৃত সংকট
- আশুগঞ্জে এনসিপি কমিটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়েই তোলপাড়
- ১২ দিনের যুদ্ধ ও বিশ্বব্যবস্থার বিপর্যয়ের পূর্বাভাস
- ১৩ জুলাই শেয়ার দর কমেছে যে ১০টি শেয়ারের
- প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান কর্মতৎপরতা চাই – ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
- কাফরুলে উঠান বৈঠকে তরুণ ভোটারদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ, আলোচনায় বিএনপির ৩১ দফা
- মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যায় রিমান্ডে মুখ খুলছে আসামিরা, উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য
- ১৯০০ সালের শাসনবিধি: আইন নয়, একটি রাজনৈতিক অস্ত্র
- বাংলাদেশ প্রেসক্লাব বাহরাইনের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
- ফেনীতে বন্যা বিপর্যয়: বিপুল ক্ষয়খতি
- আজ কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন
- মিটফোর্ড খুন: চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মশাল মিছিল
- রূপচর্চায় নারিকেল তেলের ব্যবহার জেনে নিন
- ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও স্মৃতিতে বেঁচে আছেন ‘কৌতুকের রাজা’ দিলদার