বিশেষ প্রতিবেদন

নিষেধাজ্ঞার ছাই থেকে ফিনিক্সের উত্থান: ইরানের সামরিক বিপ্লব

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৬ ১৭:৪৬:১৭
নিষেধাজ্ঞার ছাই থেকে ফিনিক্সের উত্থান: ইরানের সামরিক বিপ্লব

একটি দৃশ্য কল্পনা করুন। তেলআবিব কিংবা রিয়াদের কোনো এক ডিফেন্স কমান্ড সেন্টারে বসে আছেন অভিজ্ঞ এক জেনারেল। হঠাৎ বেজে ওঠে সাইরেন। রাডারে ধরা পড়ে শত শত মিসাইল ধেয়ে আসছে—তাদের মধ্যে অনেকেই শব্দের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি গতিতে ছুটছে। এগুলো নির্দিষ্ট পথে চলা সাধারণ ব্যালিস্টিক মিসাইল নয়; এরা বায়ুমণ্ডলের মধ্যে গতিপথ পাল্টাতে সক্ষম। মাত্র ৭–১২ মিনিটের মধ্যে এগুলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে। এসব মিসাইলকে বিশ্বের উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলোও ঠিকমতো শনাক্ত করতে পারছে না। এটি সায়েন্স ফিকশন নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতার কেন্দ্রে রয়েছে যে দেশটি, সেটি হচ্ছে ইরান—একটি নিষেধাজ্ঞাবিধ্বস্ত, অথচ অভূতপূর্বভাবে সামরিকভাবে স্বনির্ভর দেশ।

শুরুটা বিপ্লব আর শত্রুতার গল্প

ইরানের এই সামরিক উত্থানকে বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের সময়ে। মার্কিনপন্থী শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর পতনের মধ্য দিয়ে ইরানে ক্ষমতায় আসে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামি সরকার। বিপ্লবের ফলে ইরান তার এক সময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করে। তেহরানে মার্কিন দূতাবাস জিম্মি সংকটের পরপরই আমেরিকা ইরানের উপর প্রথম দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ হয় যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি এবং অস্ত্র সরবরাহ।

ইরাক যুদ্ধ: অস্তিত্ব সংকট আর আত্মরক্ষার চেতনার জন্ম

ইরানের অস্তিত্বের পরীক্ষা শুরু হয় ১৯৮০ সালে, যখন সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইরাক ইরানে হামলা চালায়। আট বছরব্যাপী এই ভয়ংকর যুদ্ধের সময় ইরান ছিল কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। বিপরীতে, ইরাক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছ থেকে উন্নত অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও স্কাড মিসাইল পায়। ‘ওয়ার অব দ্য সিটিস’ নামে পরিচিত এই পর্বে ইরাক ইরানের জনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে নির্বিচারে মিসাইল নিক্ষেপ করে। ইরান এই মুহূর্তে ছিল প্রায় নিরস্ত্র; এয়ারফোর্স ছিল অকেজো, যন্ত্রাংশের অভাবে মরিচা ধরা, আর প্রতিরোধক্ষমতা ছিল শূন্যের কোঠায়। এই অভিজ্ঞতা ইরানকে দুটো শিক্ষা দেয়: আন্তর্জাতিক আইন দিয়ে আত্মরক্ষা হয় না, আর জাতীয় নিরাপত্তা অর্জনের জন্য স্বনির্ভরতা অপরিহার্য।

মিসাইল স্বপ্ন: শূন্য থেকে শুরু, সাহসিকতার রূপান্তর

যুদ্ধের মাঝেই ইরান শুরু করে নিজেদের মিসাইল তৈরির পরিকল্পনা। উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়া থেকে কিছু স্কাড বি মিসাইল সংগ্রহ করে তারা এগুলোর উপর রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার হাসান তেহরানী মোকাদ্দাম, যিনি আজ ইরানের মিসাইল প্রোগ্রামের জনক হিসেবে পরিচিত। প্রযুক্তি, উপকরণ, জ্ঞান—সব কিছুর অভাব থাকা সত্ত্বেও একদল তরুণ ইরানি ইঞ্জিনিয়ার এই অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজে নেমে পড়ে। উত্তর কোরিয়াও তাদের সহায়তা করে। তেলের বিনিময়ে প্রযুক্তি বিনিময় হয়। এইভাবে জন্ম নেয় ‘শাহাব’ সিরিজের মিসাইল। শাহাব–১ এর পর আসে শাহাব–৩, যার পাল্লা ছিল প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার—এটি ইসরায়েল ও মার্কিন ঘাঁটিকে প্রথমবারের মতো ইরানের মিসাইল রেঞ্জে নিয়ে আসে।

নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ও গোপন প্রযুক্তি সংগ্রহের মেধাবী কৌশল

২০০০-এর দশকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ মিলে ইরানের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাদ দেওয়া হয় (SWIFT), প্রযুক্তিগত পণ্য আমদানিতে কঠিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এমনকি ডুয়েল ইউজ পণ্য, যেমন উন্নত কার্বন ফাইবার বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রসেসরের আমদানিও নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু ইরান এর মোকাবেলায় গড়ে তোলে গোপন শেল কোম্পানি নেটওয়ার্ক। চীন, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপে স্থাপিত এই কোম্পানিগুলো জটিল ট্রান্সফার চেইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি দেশে পাঠাতে সক্ষম হয়।

শিক্ষা ও গবেষণায় বিপ্লব: প্রযুক্তিতে মেধার পুনর্জন্ম

বাইরে থেকে প্রযুক্তি আনা কঠিন হলেও, জ্ঞান অর্জন বন্ধ করা যায় না—এই উপলব্ধি থেকেই ইরান জাতীয়ভাবে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ করে। দেশের সেরা শিক্ষার্থীদের বিদেশে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ইলেকট্রনিক্স ও রোবোটিকস পড়তে পাঠানো হয়। দেশে শরীফ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি ও মালেক আশতার ইউনিভার্সিটিকে পরিণত করা হয় গবেষণার হাব-এ। এর ফলে গড়ে ওঠে একদল স্থানীয় গবেষক ও প্রকৌশলী, যারা শুধু রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সীমাবদ্ধ না থেকে মৌলিক উদ্ভাবনে মনোযোগ দেয়।

আইআরজিসি: সামরিক বাহিনীর গায়ে অর্থনীতির হাড়জোড়া

ইরানের ইসলামিক রেভলুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC) শুধুমাত্র সামরিক বাহিনী নয়, বরং এটি ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম। খাতাম আল-আন্বিয়া নির্মাণ কোম্পানি, টেলিকম খাত, বন্দর, তেল ও গ্যাস খাতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাদের হাত। এই অর্থনৈতিক শক্তি সরাসরি সামরিক গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। ফলে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে তারা নিজেদের অর্থায়নে বড় বড় সামরিক প্রকল্প চালিয়ে যেতে পারে।

অপ্রতিসম যুদ্ধনীতি: দুর্বল থেকে শক্তির বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল

ইরান জানে তারা কখনোই যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের মতো আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, স্টেলথ বোমারু বিমান বা শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী গড়তে পারবে না। তাই তারা বেছে নেয় অপ্রতিসম যুদ্ধনীতি (Asymmetric Warfare)। ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল তাদের বোমারু বিমানের বিকল্প, সস্তা ড্রোন তাদের আকাশ প্রতিরক্ষার প্রতিদ্বন্দ্বী, হিজবুল্লাহ, হুতি ও অন্যান্য শিয়া মিলিশিয়ারা তাদের ভূরাজনৈতিক প্রক্সি, এবং হরমুজ প্রণালীর স্পিড বোট যুদ্ধজাহাজ ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়।

টেকনোলজির বিপ্লব: সলিড ফুয়েল থেকে হাইপারসোনিক যুগে প্রবেশ

ইরান তাদের মিসাইলগুলোতে আগে লিকুইড ফুয়েল ব্যবহার করতো, যা সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ। পরবর্তীতে তারা সলিড ফুয়েল প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করে। সেজিল, ফাতাহ-এর মতো মিসাইল সলিড ফুয়েলভিত্তিক, যা প্রস্তুত অবস্থায় ভূগর্ভে সংরক্ষণ করা যায় এবং দ্রুত উৎক্ষেপণ করা সম্ভব। মিসাইলগুলোতে যুক্ত করা হয়েছে আধুনিক টার্মিনাল গাইডেন্স ও ম্যানুভারেবল রিএন্ট্রি ভেহিকেল, যার ফলে মিসাইল লক্ষ্যবস্তুতে শেষ মুহূর্তে দিক পাল্টাতে সক্ষম।

ফাতাহ যুগ: হাইপারসোনিক কৌশলের উত্থান

২০২৩ সালে ইরান বিশ্বের চমকে দিয়ে ফাতাহ নামক হাইপারসোনিক মিসাইল উন্মোচন করে, যার গতি শব্দের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। এরপর আসে ফাতাহ-২—একটি হাইপারসোনিক গ্লাইড ভেহিকেল। এই প্রযুক্তি এতটাই উন্নত যে বর্তমানে শুধুমাত্র আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের হাতেই এটি রয়েছে। ফাতাহ-২ যেন ইরানের প্রতিরোধশক্তির এক প্রতীক, যা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকেও অকার্যকর করে দিতে পারে।

ড্রোন বিপ্লব: কম খরচে বেশি কার্যকারিতা

শাহেদ–১৩৬ ড্রোনের মাধ্যমে ইরান প্রমাণ করেছে যে যুদ্ধের জন্য শুধুমাত্র ব্যয়বহুল প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই। মাত্র ২০,০০০ ডলারে তৈরি হওয়া এই কামিকাজে ড্রোনগুলো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধেও ব্যবহার করেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণের মাধ্যমে এই ড্রোনগুলো কোটি ডলারের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে অকার্যকর করে তুলছে।

নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য সফল, নাকি বিপরীত?

ইরানের সামরিক উত্থান আমাদের সামনে এক বড় প্যারাডক্স হাজির করে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল তাদের প্রযুক্তিগত ও সামরিক অগ্রগতিকে রুদ্ধ করার জন্য, কিন্তু বাস্তবে এই নিষেধাজ্ঞাই ইরানকে আত্মনির্ভর, উদ্ভাবনী এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক এক সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছে। আজ ইরান কেবল একটি দেশ নয়, বরং একটি কৌশলগত বাস্তবতা—একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি, যারা বলছে: “আমরা পিছিয়ে নেই, আমরা প্রস্তুত।”

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ