নদী শুধু ভিটে ভাঙেনি, ভেঙেছে প্রজন্মের স্বপ্নও: চরের এক তরুণের জীবনভাঙা বয়ান

সারাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৮ ১৬:২৪:১০
নদী শুধু ভিটে ভাঙেনি, ভেঙেছে প্রজন্মের স্বপ্নও: চরের এক তরুণের জীবনভাঙা বয়ান

নদী যদি শুধু পানি হতো, তাহলে হয়তো এতটা ভয় লাগত না। কিন্তু নদী যখন গিলে খায় জমি, ভিটা, বংশানুক্রমিক স্মৃতি আর জীবনের বিনিয়োগ—তখন সেটি কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, হয়ে ওঠে মানবিক ট্র্যাজেডি। এমনই এক নদীর নাম মেঘনা। আর সেই মেঘনার তীরে দাঁড়িয়ে এক তরুণ তার জীবনের গল্প শোনান—যেখানে ঘর হারানোর যন্ত্রণা গিলে নেয় তার শৈশব, যৌবন এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

ভিটে যেখানে ছিল, নদী এখন সেখানে

হাতিয়ার তমরদ্দি বাজার থেকে এক সময় হেঁটে নদী পর্যন্ত যেতে লাগত প্রায় ঘণ্টাখানেক। কিন্তু বছর ঘুরতে ঘুরতে মেঘনা নিজেই এগিয়ে আসে মানুষের ঘরসংসারের দিকে। কেউ বুঝে ওঠার আগেই নদী গিলে খেতে শুরু করে শত বছরের বসতভিটা।

একজন তরুণ বলেন, “আমাদের বাড়ি ছিল বাজারের কাছেই। কিন্তু বড় হতে হতে দেখলাম, নদীই চলে এসেছে আমাদের দরজার সামনে। বাবা তখন ২০০৫ সালে সুবর্ণচরের লাগোয়া এক নবজাগ্রত চরে এক খণ্ড জমি কিনলেন। সেই জমিতে ২০০৯ সালে আমরা পুরোনো ভিটা ছেড়ে নতুন জীবনের পথে পা রাখি।”

পুরোনো স্মৃতি ছেড়ে, নতুন স্বপ্নে যাত্রা

চরের জীবনের শুরুটা ছিল চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু একরকম স্নেহশীলও। ছোটবেলার বন্ধু, আত্মীয়, খেলার মাঠ, উঠোনের আমগাছ ছেড়ে আসা সহজ ছিল না। তারপরও স্বপ্ন ছিল—এই নতুন চরে জীবন গড়ে তোলা যাবে, শান্তিতে থাকা যাবে। নদীভাঙা আরও অনেক পরিবার এসে ঘর বাঁধে। জমি, পুকুর, বাড়ি—সবকিছু মিলিয়ে এক নতুন আশার আলো ফুটেছিল সবার চোখে।

কিন্তু নদী থেমে থাকেনি

পাঁচ-ছয় বছর যেতে না যেতেই সেই চরে শুরু হয় নতুন ভাঙন। আবারও আশঙ্কা, আবারও উদ্বেগ। সেই তরুণ বলেন, “গত বছর নদী এসে দাঁড়াল আমাদের নতুন বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে। আমরা জানতাম কী আসছে। তাই আগেভাগেই জায়গা খুঁজতে শুরু করলাম।”

চরের মানুষের কাছে জায়গা বদল মানে শুধুই ঠিকানা বদল নয়, এটা মানে আত্মপরিচয়ের এক টুকরো হারিয়ে ফেলা।

নতুন সন্তানের জন্ম, পুরোনো ভিটার মৃত্যু

সেই বাড়িতে সদ্য বাবা হয়েছেন তিনি। ঘরজুড়ে ছিল নবজাতকের কান্না আর স্বপ্নের হাসি। কিন্তু মাস ঘুরতে না ঘুরতেই মেঘনা গিলে খেল সেই স্বপ্নের বাসস্থান।

“বাবার সারা জীবনের উপার্জন, আমাদের জমা স্মৃতি, সদ্য তৈরি দালান—সব কিছু নদীর তলায়। আমি তখনই বাবার মতো, আবার নতুন ভিটা খুঁজছি। আমাদের মতো আরও অনেক পরিবার—যারা এক জীবনে বারবার ‘পুনর্বাসিত’ হয়, কিন্তু একবারও ‘স্থায়ী’ হতে পারে না।”

চরের মানুষের জীবন মানেই: উঠে দাঁড়াও, আবার ভাঙো

এই যে বারবার গৃহহীন হয়ে নতুন জীবন শুরু, এর নামই যেন ‘চরের জীবন’। নদীভাঙা মানুষ কখনো শিকড় গাঁথতে পারে না। প্রতিবার তারা গড়তে যায় একটা নতুন ঘর, অথচ জানে এই ঘরও চিরস্থায়ী নয়।

প্রতিদিন যেখানে আমরা ভাবি, নদী মানে প্রকৃতি, সেখানে চরের মানুষ ভাবেন—নদী মানে অনিশ্চয়তা। নদী শুধু জমি নয়, ঘরবাড়ি নয়, তা গিলে খায় স্বপ্ন, স্থিরতা, ভালোবাসা, এমনকি নতুন শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যৎও। এটি কেবল একার গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নদীভাঙা মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

প্রেস সচিবের বক্তব্যে বাকস্বাধীনতা, মব কালচার ও সাংবাদিকতার দ্বন্দ্ব: পাঠবিশ্লেষণ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক দীর্ঘ বক্তব্যে দেশের সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত... বিস্তারিত