ইরানের স্বনির্ভর প্রযুক্তিতে ইসরাইলের ব্যর্থতা

২০২৫ জুন ৩০ ১০:৩৫:৩৮
ইরানের স্বনির্ভর প্রযুক্তিতে ইসরাইলের ব্যর্থতা

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে ইতিহাস রচিত হয়, যখন ইরান প্রথমবারের মতো ইসরাইলের ওপর একযোগে পরিচালিত একটি বিশালাকার ড্রোন, মিসাইল এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এ হামলা ছিল এক ধরনের সামরিক মহড়া এবং ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার প্রকাশ, যা ‘True Promise’ নামে অভিহিত। এই অপারেশনে একসাথে ৩০০টির বেশি ড্রোন, মিসাইল ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইরান, যা বিশ্বের আকাশপথে পরিচালিত সবচেয়ে বৃহৎ এবং ঐতিহাসিক হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ইরানের সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থিত কনস্যুলেটের বিরুদ্ধে ইসরাইলের বর্বর হামলার জবাবে এই হামলা পরিচালিত হয়। যদিও ইরান হামলায় ব্যবহৃত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের সঠিক সংখ্যা গোপন রেখেছিল, তবে ইসরাইলি সামরিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, হামলায় ব্যবহৃত হয়েছিল ১৮৫টি ড্রোন, ১১০টি ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৩৬টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। এই বিপুল আকারের হামলা ইরানের সামরিক প্রযুক্তির পরিপক্কতা এবং পরিকল্পনাগত দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।

ইরান ও ইসরাইলের দীর্ঘদিনের ছায়া যুদ্ধের পটভূমিতে ‘True Promise’ অপারেশন ইরানের সামরিক শক্তির অভূতপূর্ব প্রকাশ। এক বছরের বেশি সময়ের প্রস্তুতির পর ২০২৪ সালের এ অভিযান ইসরাইলের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। পরবর্তীতে, ২০২৫ সালের জুনে ইসরাইল-আমেরিকার যৌথ হামলা সত্ত্বেও ইরান তাদের আধুনিক ও নিজস্ব প্রযুক্তির সমন্বয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং তাদের আকাশপথে আধিপত্য বজায় রাখে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানের সুইসাইড ড্রোন প্রযুক্তি আন্তর্জাতিক সামরিক মহলে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে, বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেনে তীব্র হামলার পর। ইউক্রেনীয় সামরিক কর্মকর্তা প্রকাশ্যে জানান, রাশিয়া ইরানি নকশার শাহেদ ড্রোন ব্যবহার করে ব্যাপক ক্ষতি করেছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে। ২০১১ সালে ইরানের বিজ্ঞানীরা প্রথম ‘সিমোর্গ’ ড্রোন তৈরি করে যা পরবর্তীতে ‘শাহেদ-১২৯’, ‘শাহেদ-১৩৬’ ও ‘শাহেদ-২৩৮’ মডেলে উন্নীত হয়। এই ড্রোনগুলো কম খরচে উন্নত প্রযুক্তি সংবলিত, যা ইরানের সামরিক শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশেষ করে, মাত্র ৫০ কেজি ওজনের ‘শাহেদ-১৩৬’ এবং উচ্চগতিসম্পন্ন ‘শাহেদ-২৩৮’ ড্রোনগুলো ইরানের আকাশ ও মাটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইরান, জর্ডান ও অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের আকাশপথ পেরিয়ে, এই ড্রোনগুলো ইসরাইলের আকাশে প্রবেশ করে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। যদিও ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো বেশ কিছু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হয়, তবুও অনেক হামলা ইসরাইলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ক্ষতি সাধন করে।

ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তি ও দক্ষতা এতটাই উন্নত হয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর মতো আমেরিকার সরাসরি নির্ভরশীলতা এড়িয়ে তারা নিজেদের শক্তিশালী সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থনৈতিক অবরোধ, আন্তর্জাতিক চাপ ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও ইরানের প্রযুক্তিগত মেধা ও পরিকল্পনাগত দক্ষতা তাদেরকে এক নির্ভরযোগ্য ও সক্ষম সামরিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছে। এতে করে ইসরাইল ও আমেরিকার স্বপ্নিত বিজয়পূরণের আশা অনেকাংশেই ভেস্তে যায়।

‘True Promise’ অপারেশন এবং পরবর্তীতে ইরানের প্রতিরক্ষা কৌশল ও ড্রোন প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক শক্তির ভারসাম্যে একটি নতুন অধ্যায় সূচিত করেছে। ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তি ও আত্মনির্ভরশীলতা প্রমাণ করেছে, আধুনিক যুদ্ধ আর কেবল বড় অস্ত্র কিংবা শক্তিশালী বাহিনীর লড়াই নয়, বরং প্রযুক্তি ও কৌশলের সমন্বয়েই নির্ধারিত হয় সামরিক সফলতা। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও অভিযোজন মধ্যপ্রাচ্যের সংকট ও শক্তির ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

প্রেস সচিবের বক্তব্যে বাকস্বাধীনতা, মব কালচার ও সাংবাদিকতার দ্বন্দ্ব: পাঠবিশ্লেষণ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক দীর্ঘ বক্তব্যে দেশের সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত... বিস্তারিত