সমুদ্রের অতল গহ্বরে নাসার গুপ্ত অভিযান: মহাকাশ অনুসন্ধানের নতুন চাবিকাঠি?

সমুদ্র ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৫ ০০:৫৮:২৩
সমুদ্রের অতল গহ্বরে নাসার গুপ্ত অভিযান: মহাকাশ অনুসন্ধানের নতুন চাবিকাঠি?

এটি কোনো বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনি নয়। এটি কোনো হলিউডি থ্রিলারও নয়। এটি বাস্তব— ঠান্ডা, অন্ধকার, চাপময় ও রহস্যে মোড়ানো বাস্তবতা। পৃথিবীর সমুদ্রের গহ্বরে নামছে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা, সেই মহাসাগরের ভেতরকার প্রাণজগত, রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং হাইড্রোথার্মাল চিমনির মতো গঠনগুলোকে অন্বেষণ করতে, যার সম্ভাব্য প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেতে পারে শত্রু শক্তির নজরে থাকা মহাকাশের ইউরোপা বা এনসেলাডাসের বরফঘেরা চাঁদে।

এই অভিযান শুধুই বৈজ্ঞানিক নয়, এটি এক স্ট্র্যাটেজিক প্রচেষ্টা। নাসা কেবল পৃথিবী নিয়ে ভাবছে না, তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে মহাকাশে জীবনের উপস্থিতির প্রমাণ পেলে তা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই গোয়েন্দা কৌশল তৈরিরও। এমন এক সময়ে, যখন ইরান প্রতিনিয়ত নিজের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়াচ্ছে, এমনকি মহাকাশেও নিজস্ব অবস্থান তৈরির পথে এগিয়ে চলেছে, তখন নাসার এই সমুদ্রাভিযান এক অন্যরকম বার্তা বহন করে।

মহাসাগর ও মহাকাশ: ছায়ায় ভরা দুই জগত

সমুদ্রের অতল এবং মহাকাশ- এই দুই স্থানই মানুষের কাছে অপরিচিত, রহস্যময় ও শ্বাসরুদ্ধকারী। উভয় জায়গাতেই আলো প্রবেশ করে না, অক্সিজেন নেই, এবং উভয় ক্ষেত্রেই প্রবল চাপ বা শূন্যতার কারণে মানুষ নিজে উপস্থিত থাকতে পারে না। সেখানে কাজ করে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি, দূরনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র এবং অত্যাধুনিক গবেষণা। একদিকে যেমন মহাকাশে রয়েছে বৃহস্পতির ইউরোপা কিংবা শনির এনসেলাডাস, অন্যদিকে ঠিক তেমনি পৃথিবীর হ্যাডাল জোনে (৬০০০ থেকে ১১০০০ মিটার গভীর) রয়েছে অসংখ্য জীবপ্রজাতি, জীবরস ও গোপন প্রক্রিয়া, যেগুলো আমাদের ধারণা পাল্টে দিতে পারে।

SUBSEA প্রকল্প ও নাসার সমুদ্রঘেঁষা পরিকল্পনা

নাসার SUBSEA (Systematic Underwater Biogeochemical Science and Exploration Analog) প্রকল্প সেই সূত্রেই গঠিত হয়েছে, যেখানে সমুদ্রের হাইড্রোথার্মাল ভেন্টগুলোকে মহাকাশে সম্ভাব্য প্রাণের বাসস্থান হিসেবে কল্পনা করা হচ্ছে। যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সেখানে ভেন্ট থেকে নির্গত রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এক নতুন বাস্তুতন্ত্র। এই ধারণাই মহাবিশ্বে 'চন্দ্র-সমুদ্র'তে প্রাণের অস্তিত্বের বাস্তবতা তৈরি করছে।

SeaSat থেকে ওরফিয়াস পর্যন্ত

১৯৭৮ সালে SeaSat ছিল নাসার প্রথম সমুদ্র পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের ঢেউ, তাপমাত্রা, এবং স্রোতের তথ্য দিয়েছিল। এরপর আসে NEEMO (NASA Extreme Environment Mission Operations) প্রকল্প, যেখানে নাসার নভোচারীরা ফ্লোরিডার উপকূলে পানির নিচে অবস্থিত Aquarius গবেষণাগারে মহাকাশের অনুরূপ পরিস্থিতিতে জীবনধারণ ও কাজ করার প্রশিক্ষণ নেন। এখানেই মহাকাশচলাচল, যানবাহির কর্ম এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা অর্জন হয়।

NEEMO-র সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তৈরি হয়েছে Orpheus, একটি ক্ষুদ্র ও অটোনোমাস সাবমেরিন, যা ক্যামেরা ও কম-শক্তির সেন্সর ব্যবহার করে সমুদ্রের অন্ধকার জগতে অন্বেষণ চালাতে সক্ষম। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এটি একদিন ইউরোপার বরফ-ঢাকা সমুদ্রেও নামতে পারে।

হ্যাডাল জোন: এক নরকের নামান্তর

সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর অঞ্চল — হ্যাডাল জোন, যা গ্রীক পুরাণের মৃতের দেবতা হেডিস-এর নামে নামকরণ। সেখানে চাপ এমন যে মানুষের দেহের কোষ পর্যন্ত গুঁড়িয়ে যেতে পারে। এখানেই প্রথম ১৯৭৭ সালে আবিষ্কৃত হয় হাইড্রোথার্মাল চিমনি, যার চারপাশে ছিল জীবনে পূর্ণ এক জগৎ। সূর্যের আলো ছাড়াই এখানে জীবজগৎ বেড়ে উঠেছে 'কেমোসিন্থেসিস' নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই অঞ্চলেই দেখা গেছে বিশাল "বিগফিন স্কুইড", টিউবওয়ার্ম, অতিকায় অ্যামফিপড প্রজাতির জীব — যাদের আচরণ ও গঠন এমন, যেন ভিনগ্রহের প্রাণী।

যেখানে ভয় সেখানে সাহস: নাসার নতুন মিশন

২০১৪ সালে নিরেউস নামের ROV একবার গিয়ে ফিরতে পারেনি। চাপের কাছে হার মেনেছিল। কিন্তু নাসা থেমে থাকেনি। তৈরি করেছে Orpheus, যা আরও হালকা, বেশি চটপটে এবং বহুগুণ বেশি স্থিতিশীল। পরবর্তী পদক্ষেপ — নেটওয়ার্ক গঠন করে এই ধরণের সাবমেরিন দিয়ে হ্যাডাল অঞ্চল ম্যাপিং ও জীবনের খোঁজ। এ যেন এক গুপ্তচরবৃত্তির পরিকল্পনা — মহাসাগরের অন্ধকারে চলে এক নিঃশব্দ গোয়েন্দা যুদ্ধ।

মহাকাশের চাঁদে প্রাণের সম্ভাবনা

বৃহস্পতির ইউরোপা ও শনির এনসেলাডাস — এই দুই চাঁদে রয়েছে বরফের নিচে বিশাল সমুদ্র। গ্যালিলিও ও ক্যাসিনি যানে প্রাপ্ত চৌম্বক ও প্লাম-তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপার পৃষ্ঠের নিচে রয়েছে লবণাক্ত পানিতে ভরা গভীর মহাসাগর। এমনকি এনসেলাডাস থেকে দেখা গেছে গিয়েসার-সদৃশ বরফগলিত জল মহাকাশে ছিটিয়ে পড়ছে। ক্যাসিনি যখন এই জলরাশি সংগ্রহ করেছিল, সেখানে জৈব উপাদান মিলেছে, যা প্রাণের পূর্বশর্ত।

ক্রায়োবট: বরফগলা ভবিষ্যৎ

এই চাঁদগুলোতে পৌঁছাতে হলে দরকার এমন যন্ত্র, যা বরফ গলিয়ে সমুদ্রের গভীরে যেতে পারে। এই লক্ষ্যেই তৈরি হচ্ছে ক্রায়োবট — একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত রোবট, যা বরফ ভেদ করে নিচে নামবে, আর সাথে নিয়ে যাবে ক্যামেরা ও সেন্সর। উপরের পৃথিবীর সাথে সংযোগ রক্ষা করতে একটি দীর্ঘ কেবলও থাকবে। মূল লক্ষ্য: জীবনের অস্তিত্ব প্রমাণ করা।

গভীর সমুদ্র থেকে মহাশূন্যে

এখন প্রশ্ন — নাসা কেন এসব করছে? উত্তর নিহিত আছে এক রহস্যে: মহাশূন্যে প্রাণের অস্তিত্ব আবিষ্কার হলে, তা প্রথম কারা দেখবে, বিশ্লেষণ করবে, নিয়ন্ত্রণ করবে? এসব অভিযান শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, এক কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক লড়াই। ঠিক যেমন ইরান তার বিজ্ঞানচর্চা ও প্রতিরক্ষা কার্যক্রমে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করছে। মহাকাশ ও সমুদ্র — উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পৃথিবীর গভীর মহাসাগরের রহস্য আমাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। নাসার এই অভিযান শুধু বিজ্ঞান নয়, বরং এক প্রতীক — যেখানে জীবন কেবল সূর্যের আলোর মধ্যেই নয়, বরং অন্ধকার, ঠান্ডা, চাপময় পরিবেশেও বিকশিত হতে পারে। এই ধারণা যদি সত্যি হয়, তবে ইউরোপা বা এনসেলাডাসে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা নয় — সম্ভাব্য বাস্তবতা। এবং সেই বাস্তবতার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, সেটাই পরবর্তী লড়াইয়ের মঞ্চ নির্ধারণ করবে।

নাসার সমুদ্র অভিযান তাই আর নিছক সমুদ্রবিজ্ঞান নয় — এটি এক নিঃশব্দ যুদ্ধ, এক কৌশলগত অভিযান এবং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ