সমুদ্রের অতল গভীরে চীনের অভিযাত্রা: এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার অদৃশ্য রূপ ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

সমুদ্র ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৪ ১১:১১:২৪
সমুদ্রের অতল গভীরে চীনের অভিযাত্রা: এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার অদৃশ্য রূপ ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

পৃথিবীর বুকে এমন এক জায়গা রয়েছে, যেখানে এখনও মানুষের পা পড়েনি, সূর্যের আলো পৌঁছায় না, আর প্রতিটি বর্গ ইঞ্চিতে চাপ সৃষ্টি করে হাতির ওজনের সমতুল্য একটি বল। সেই স্থানটি হলো ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ — বিশ্বের সবচেয়ে গভীর সমুদ্রগহ্বর, যা প্রায় ১১,০০০ মিটার গভীরে অবস্থিত। একে বলা হয় পৃথিবীর শেষ অববিষ্ট সীমান্ত, যেখানে চীনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে এক নিঃশব্দ কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতা।

যখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সমুদ্র গবেষণায় বাজেট কমিয়ে দিচ্ছে, তখন চীন বিপরীত পথে হাঁটছে। তারা সমুদ্রের অতলে পাঠাচ্ছে রোবট, তৈরি করছে পানির নিচে গবেষণা ঘাঁটি, আর অনুসন্ধান করছে সেইসব সম্পদের, যেগুলোর উপর আধিপত্য ভবিষ্যতের বৈশ্বিক ক্ষমতার কাঠামো নির্ধারণ করতে পারে।

অজানা জগতের দ্বারপ্রান্তে

ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ফিলিপাইনের পূর্বে অবস্থিত একটি বিশালাকার সামুদ্রিক খাদ। এর গভীরতম স্থান চ্যালেঞ্জার ডিপ, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার নিচে। এই গভীরতায় নামতে হলে সমুদ্রের বিভিন্ন স্তর পেরোতে হয়— সূর্যালোকপূর্ণ ফোটিক জোন, গোধূলি মেসোপেলাজিক জোন, তারপরে পুরোপুরি অন্ধকার মিডনাইট জোন, এবং শেষমেশ হেডাল জোন।

এই অঞ্চলগুলোতে প্রচণ্ড ঠান্ডা, প্রায় শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা, এবং ৪০০-৬০০ গুণ বেশি জলচাপ বিরাজ করে। অথচ এখানেই দেখা মেলে অদ্ভুত ও রহস্যময় প্রাণীর, যারা আত্মপ্রকাশ করে আলোর সাহায্য ছাড়াই, বেঁচে থাকে রাসায়নিক শক্তিতে, কিংবা মৃত তিমির দেহ থেকে জন্ম নেয় সম্পূর্ণ একটি ক্ষুদ্রজীবজগত।

এখানে রয়েছে জেনোফোর নামের এককোষী প্রাণী, হালকা, নমনীয় দেহের শুঁয়োপোকার মতো কিছু রোবটসদৃশ চিংড়ি, এমনকি কিছু এমন জীব, যারা কোটি বছর ধরে বদলাতে বদলাতে এই নিঃসীম অন্ধকারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।

বিজ্ঞান নয়, এবার লক্ষ্য শক্তি ও সম্পদ

চীন প্রথমবার ২০২০ সালে নিজস্ব সাবমেরিন ফেন্দৌঝে-কে চ্যালেঞ্জার ডিপে পাঠিয়ে ইতিহাস তৈরি করে। কিন্তু এটি ছিল শুরু মাত্র। এরপর তারা যেটা করল তা ছিল একেবারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি— বারবার ফিরে আসার মতো অভিযানে মনোযোগ। তারা ছোট আকারের স্বয়ংক্রিয় রোবট বানাল, যেগুলো মানুষ ছাড়াই চলতে পারে, সমুদ্রের তলদেশে ঘুরে বেড়াতে পারে, তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসতে পারে।

২০২৪ সালের মধ্যেই তারা রোবট বহর তৈরিতে মনোযোগ দেয়। এখন এই রোবটগুলো সমুদ্রের তলায় একসঙ্গে কাজ করছে— কেউ স্যাম্পল নিচ্ছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ তথ্য পাঠাচ্ছে। ব্যয় কম, গতি বেশি, আর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ নিজস্ব।

এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতির উদ্দেশ্য শুধুমাত্র প্রাণিজগৎ বোঝা নয়। সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে অপরিসীম সম্পদ— যেমন, পলিমেটালিক নডিউল (তামা, কপার, নিকেল, কোলবাল্টে সমৃদ্ধ), মিথেন হাইড্রেট বা ফায়ার আইস, যা প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এছাড়া রয়েছে কোল্ড সিপস, যেখান থেকে রাসায়নিক গ্যাস বেরিয়ে আসে এবং তার চারপাশে গড়ে ওঠে সৌরশক্তি ছাড়া জীবন্ত জীবজগৎ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এমন পরিবেশ হয়তো বৃহস্পতি বা শনির উপগ্রহেও রয়েছে। ফলে এই অঞ্চলগুলো শুধুই জীববিজ্ঞান নয়, ভবিষ্যতের জ্বালানি ও মহাকাশ গবেষণার পরীক্ষাগার হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

অভিযান নয়, এটি এক বৈশ্বিক পুনর্বিন্যাসের শুরু

এই সাগরতলীয় প্রতিযোগিতা কেবল বৈজ্ঞানিক নয়। এটি একধরনের কৌশলগত শক্তি-প্রতিষ্ঠা। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মহাসাগর সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা NOAA-র বাজেট কমিয়ে ফেলছে, সেখানে চীন তার বিপরীতে অভূতপূর্ব বিনিয়োগ করছে।

চীন গড়ে তুলছে জলতলের গবেষণা ঘাঁটি, যেখানে একসঙ্গে ছয়জন বিজ্ঞানী এক মাস পর্যন্ত থাকতে পারবেন। এটি মূলত সমুদ্রতলীয় স্পেস স্টেশন, যা দীর্ঘমেয়াদে ডেটা সংগ্রহ, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, ও খনিজ উত্তোলনের প্রস্তুতির জন্য নির্মিত।

আর এর মাধ্যমে চীন সময় পাচ্ছে— অগ্রগামী হওয়ার সময়, অভিজ্ঞতা অর্জনের সময়, এবং অন্য কেউ সেখানে পৌঁছানোর আগেই প্রস্তুত থাকার সময়।

যেসব হুমকি নিচে অপেক্ষা করছে

তবে এর পাশাপাশি রয়েছে গভীর উদ্বেগ। এই গভীর সাগরীয় পরিবেশটি অত্যন্ত ভঙ্গুর। যেখানে একবার ক্ষত সৃষ্টি হলে, তা সহস্রাব্দেও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। মিথেন উত্তোলনের সময় ছোট একটি ভুল বিশাল আকারের জলপৃষ্ঠ ধস বা মিথেন নির্গমণ ঘটাতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

আর রয়েছে ডিপ সি ইন্টারনেট কেবল— সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচ দিয়ে ছড়িয়ে থাকা এই কেবলগুলো আমাদের ইন্টারনেট, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, এমনকি সামরিক যোগাযোগের স্নায়ুতন্ত্র। সামান্য একটি নোঙর কিংবা একটি কৌশলগত আঘাত এই কেবলগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে।

২০২৫ সালে চীন এক ধরনের রোবট প্রকাশ করে, যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে কেবল মেরামতের জন্য নির্মিত। কিন্তু নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, এই প্রযুক্তি নীরবে কেবল বিচ্ছিন্ন করতেও সক্ষম — যা হতে পারে আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর হুমকির একটি।

বিশ্ব যখন পিছাচ্ছে, চীন তখন নেতৃত্বে

বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যেখানে বিজ্ঞানীদের জন্য তহবিল বন্ধ করছে, চীন সেখানে গবেষণা, প্রযুক্তি, এবং তরুণ বিজ্ঞানী তৈরিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। তারা শুধু নিজেদের প্রতিভাই নয়, বিশ্বের শীর্ষ মেধাকেও আকর্ষণ করছে।

এই মুহূর্তে চীন শুধু অনুসন্ধান করছে না, তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। তারা তৈরি করছে এমন প্রযুক্তি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, যা পৃথিবীর গভীরতম অঞ্চলে নিরবিচারে কার্যক্রম চালাতে সক্ষম।

একটি যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন

এই মহাসাগরীয় প্রতিযোগিতা কেবল একটি দেশের বিষয় নয়। এটি একটি মানবিক ও বৈশ্বিক দায়িত্ব। আমরা চাইলে চাঁদের মতো এই গভীরতাও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র হতে পারে। কারণ, একবার যদি এই গভীরতা ধ্বংস হয়, তার ফলাফল শুধু পরিবেশগত নয়, মানব সভ্যতার উপরও পড়বে।

আজ যখন চীন সাগরের গভীরতা অনুসন্ধান করছে, তারা শুধু জীবন নয়, প্রবেশের পথ ও থাকার কারণ খুঁজে পেয়েছে। তারা অনিয়মিত অভিযানকে পুনরাবৃত্ত কৌশলে রূপ দিচ্ছে, আর সেটাই ভবিষ্যতের শক্তির নিয়ামক হয়ে উঠতে চলেছে।

সমুদ্রের গভীরতলেই লুকিয়ে রয়েছে আগামী শতাব্দীর জ্বালানি, যোগাযোগ ও ক্ষমতার চাবিকাঠি। এটি এখন আর কল্পনা নয়। যে দেশ আজ প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেই দেশ কাল নিয়ন্ত্রণ করবে।

এখন প্রশ্ন একটাই— আমরা কি প্রস্তুত হচ্ছি, নাকি সাগরের নিচে এক নতুন বিশ্বশক্তির উত্থান ঘটছে আমাদের অজান্তেই?

বাংলাদেশের সম্ভাবনাও অনন্য নয়

এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, শুধু চীন নয়, বাংলাদেশও ইতোমধ্যে সমুদ্রসম্পদ বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মুখোমুখি হয়েছে। সামুদ্রিক বিষয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে (EEZ) প্রায় ১০৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (TCF) পরিমাণ মিথেন হাইড্রেট বা বরফাকৃতির প্রাকৃতিক গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে। এই বিশাল মজুত, যা সাগরের তলদেশে উচ্চচাপ ও নিম্নতাপমাত্রায় তৈরি হয়, ভবিষ্যতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও জ্বালানি উৎসের বৈচিত্র্যকরণে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। তবে, এখানেও রয়েছে প্রযুক্তিগত ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ। এই সম্পদ উত্তোলনের জন্য যেমন উন্নত সাবমেরিন প্রযুক্তি দরকার, তেমনি প্রয়োজন সতর্কতা, কারণ সামান্য ভুলে ঘটতে পারে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়— যেমন সমুদ্রতল ধস বা বিপুল পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন।

এই আবিষ্কারটি ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের সামুদ্রিক অঞ্চলও হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যদি পরিকল্পিত ও টেকসই উপায়ে তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ