আজ কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন

২০২৫ জুলাই ১১ ১০:৫৩:১৪
 আজ কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন

আজ ১১ জুলাই, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, আধুনিক কাব্যধারার অনন্য নির্মাতা আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ, যিনি পরবর্তীতে শুধু ‘আল মাহমুদ’ নামেই হয়ে ওঠেন বাংলা ভাষার চিরকালীন কাব্যচরিত্র। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পরপারে পাড়ি জমালেও তাঁর সাহিত্য, তাঁর ভাষা, তাঁর কবিতা আজও বাংলা সাহিত্যে দীপ্ত হয়ে জ্বলছে অন্ধকারে আলোর মতো, নিস্তব্ধতায় উচ্চারণের মতো।

সাহিত্যে নতুন ধারা: মাটি ও মানুষের কণ্ঠস্বর

আল মাহমুদের কাব্যবিশ্বের প্রধান উপাদান ছিল বাংলার মাটি, কৃষকজীবন, নদী, ঋতু, প্রেম এবং ইতিহাসবোধ। নগরায়ণের বিপরীতে গ্রামীণ আবহমান জীবন, লোকজ সংস্কৃতি ও ইসলামি চেতনার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণে তাঁর কবিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ বাংলা কবিতায় নতুন ঢেউ তোলে। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ তাঁকে নিয়ে যায় পাঠকহৃদয়ের গভীরে।

বিশেষ করে ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থ বাংলা আধুনিক কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এই গ্রন্থে প্রেমিক কবি, গ্রামবাংলার কবি, ইতিহাসসচেতন কবি—সব মিলিয়ে এক আল মাহমুদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কবি রফিক আজাদের কথায়, “তিনি ছিলেন গ্রাম থেকে শহরে আসা এক আত্মপ্রত্যয়ী কবি।”

বহুমাত্রিক সাহিত্যচর্চা

কবিতার পাশাপাশি আল মাহমুদ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং শিশুসাহিত্যে রেখেছেন শক্তিশালী উপস্থিতি।

উপন্যাসে তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • কবির মৃত্যু
  • দ্বিতীয় ভাঙন
  • উপমাহীন উপকূল
  • যেভাবে বেড়ে উঠি

জনপ্রিয় ছোটগল্প:

  • লোকটি
  • মায়া
  • তোমার চোখে আলো দেখে

তাঁর প্রবন্ধ ও কলামে ফুটে উঠেছে ধর্ম, ইতিহাস, সাহিত্য এবং জাতিসত্তার গাঢ় অনুধ্যান। বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাস ও আত্মানুসন্ধানের দিক তাঁর লেখায় প্রখর হয়ে উঠেছে—যা অনেকের কাছে রক্ষণশীলতার প্রতীক হলেও সাহিত্যিক সৌন্দর্যে তা সবসময়ই ছিল উদার ও হৃদয়গ্রাহী।

সাংবাদিকতা ও কর্মজীবন

শুধু সাহিত্যিক নন, আল মাহমুদ ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ সাংবাদিক ও গবেষক। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাব্য পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করে পরবর্তীতে দৈনিক মিল্লাত, ইত্তেফাক, কর্ণফুলী ও গণকণ্ঠে কাজ করেন। দৈনিক গণকণ্ঠে তিনি ছিলেন সম্পাদক। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক হিসেবে যোগ দিয়ে পরবর্তীতে পরিচালক হিসেবে অবসর নেন ১৯৯৭ সালে।

সাহিত্যজীবনে সম্মাননা ও পুরস্কার

বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আল মাহমুদ পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮)
  • একুশে পদক (১৯৮৭)
  • ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার
  • নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার
  • ত্রিকাল সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা)

এক কবির উত্তরাধিকার

আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে এমন এক নাম, যিনি সাহিত্যের ভেতর দিয়ে সমাজের গভীর সত্তাকে উন্মোচন করেছেন। তাঁর কবিতা শুধু প্রেম বা প্রকৃতি নয় তা ছিল আত্মজিজ্ঞাসা, ইতিহাসপাঠ, জাতির জাগরণ এবং একটি ধর্মীয় সংস্কৃতির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইও।

তিনি ছিলেন একাধারে প্রেমিক, বিপ্লবী, ধর্মচিন্তক, ইতিহাসসন্ধানী এবং আত্মার কবি। তাঁর কাব্যভাষা ছিল সাবলীল, চিত্রাত্মক, একান্ত নিজস্ব। তাঁর লেখায় যেভাবে ‘সোনালি কাবিন’ আবেগের আকাশে পতাকা তুলে দেয়, সেভাবেই তাঁর উপন্যাসে দেখা মেলে বেদনার রূপকল্প, বঞ্চনার ইতিহাস।

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আজ তাঁর ৮৯তম জন্মদিনে সাহিত্যপিপাসু মানুষ, তরুণ লেখক, পাঠক, গবেষক সবাই তাঁকে স্মরণ করছেন গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায়। তাঁর সাহিত্যের আলো আজও প্রজন্মের চিন্তা ও কল্পনায় দীপ্ত।

“সোনালি কাবিনের ছায়া পড়ে আছে আজও কবিতার প্রতিটি সোনার পাতায়।”- এই কবিতার জন্মকারিগর আল মাহমুদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও কাব্যিক ভালবাসা।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ