মতামত

১২ দিনের যুদ্ধ ও বিশ্বব্যবস্থার বিপর্যয়ের পূর্বাভাস

রিয়ার এডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম
রিয়ার এডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম
পরিচালক,সেন্টার ফর বে অব বেঙ্গল স্ট্যাডিজ, আইইউবি।
২০২৫ জুলাই ০৯ ১৩:১৩:৪৩
১২ দিনের যুদ্ধ ও বিশ্বব্যবস্থার বিপর্যয়ের পূর্বাভাস

২০২৫ সালের জুনে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘটিত ১২ দিনের যুদ্ধকে যদি কেউ শুধুমাত্র একটি “কৌশলগত বিজয়” হিসেবে মূল্যায়ন করেন, তবে নিঃসন্দেহে তিনি এই সংঘাতের অন্তর্নিহিত বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক বারুদ বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। যুদ্ধটি ছিল আকারে ছোট, সময়কালেও সীমিত, কিন্তু এর অভিঘাত বৈশ্বিক রাজনৈতিক ভারসাম্যে একটি বিশাল কম্পনের মতো। এটি একদিকে ছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাব্য রিহার্সাল, অন্যদিকে বিশ্বের নতুন শক্তির বিন্যাস ও কৌশলগত ভারসাম্যের সীমানা পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।

১২ জুন, ইসরায়েল তাদের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা তথ্য ও সামরিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামক একটি সার্জিক্যাল এয়ারস্ট্রাইক পরিচালনা করে ইরানের ন্যাটানজ, ফরদু, আরাকসহ বেশ কয়েকটি গোপন ও উন্মুক্ত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর উপর। লক্ষ্য ছিল ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)-এর কমান্ড স্ট্রাকচার এবং ভবিষ্যৎ পারমাণবিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেওয়া। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, হিজবুল্লাহর সিরিয়ায় বিস্তৃত তৎপরতা এবং ইরানের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি এই পদক্ষেপের প্ররোচক।

তবে এই হামলা ছিল সম্পূর্ণ একতরফা। ইসরায়েল এই অভিযানের আগে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ বা ন্যাটো কোনো পক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করেনি। বরং এটি ছিল এক ধরনের ‘পলিসি অ্যাম্বুশ’, যার মাধ্যমে বিশ্বকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় একটি অসম্ভব সিদ্ধান্তের সামনে—‘তুমি আমার সঙ্গে আছো, না বিপক্ষে?’

ইরান এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পাল্টা জবাব দেয়। হাইফা ও দিমোনার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর ওপর ড্রোন স্কোয়াড এবং মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। ইসরায়েলের পারমাণবিক চুল্লির সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক গ্রুপ জানিয়েছে, ইরান একাধিক সাইবার হামলার মাধ্যমেও ইসরায়েলি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায়।

এই উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ায়। “আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার” নামে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর অত্যাধুনিক বাংকার-ব্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করে। এই হামলা সরাসরি ইরানের স্থায়ী পারমাণবিক সক্ষমতাকে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয় এবং এটি এক অর্থে ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবেই গণ্য হয়।

এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া কাস্পিয়ান সাগরে ব্যাপক সামরিক মহড়া শুরু করে। মস্কো সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিবৃতি না দিলেও ইঙ্গিত দেয় যে ইরানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও তাদের জাতীয় কৌশলগত স্বার্থের অন্তর্ভুক্ত। একই সময়ে চীন এক বিবৃতিতে জানায়, "সার্বভৌম অঞ্চলে কোনো বহিরাগত হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না", এবং ওয়াশিংটনকে সতর্ক করে দেয় যে ‘অতিরিক্ত উত্তেজনা’ তাদের সামরিক জবাবের কারণ হতে পারে।

ভারত পরিস্থিতি অনুধাবন করে ‘উপেক্ষণযোগ্য কৌশল’ গ্রহণ করে। একদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং মার্কিন কৌশলগত মৈত্রীর বাস্তবতা, অপরদিকে ইরানের সঙ্গে জ্বালানি নির্ভরতা ও চাবাহার বন্দর-সংযুক্ত ভূরাজনীতি। ফলে মোদি প্রশাসন এক ধরনের কৌশলগত দ্ব্যর্থতার মধ্যে পড়ে। ভারত উচ্চ নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করে কিন্তু কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেয় না—এটা ছিল এক অর্থে ভারতীয় কূটনীতির চিরাচরিত 'সন্তুলন ও ধোঁয়াশার' কৌশল।

এই যুদ্ধে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বার্তা হলো ‘স্পয়লার রাষ্ট্র’-এর শক্তি ও সম্ভাব্যতা। ইসরায়েল যেমন নিজের আঞ্চলিক স্বার্থে একতরফা পদক্ষেপ নিয়ে এক সুদূরপ্রসারী সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছে, তেমনি ইরানও আঞ্চলিক আধিপত্যের সংকীর্ণ রাজনীতিকে ব্যবহার করেছে বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে।

আজকের বিশ্বে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নয়, বরং ব্যক্তি নেতৃত্বের উদ্ভট ও একক সিদ্ধান্তমূলক প্রবণতা। নেতানিয়াহুর রাজনীতি যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তেমনি ট্রাম্পের কূটনীতি হচ্ছে ‘বিশ্ব আমার খেলার মাঠ’ ধরনের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিফলন।

আধুনিক কূটনীতির ব্যর্থতা ও প্রতিরোধমূলক কাঠামোর প্রয়োজনএই যুদ্ধ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—বর্তমান বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা কাঠামো কতটা দুর্বল ও যুগপোযোগী নয়। জাতিসংঘ, ন্যাটো কিংবা আঞ্চলিক সংস্থাগুলো কেউই এই সংকট প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের একতরফা পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু যৌথভাবে কোনো প্রতিবাদ প্রকাশ করেনি।

এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দেয়, “পারস্পরিক প্রতিরক্ষা” ধারণা এখন প্রতিস্থাপিত হওয়া দরকার “পারস্পরিক সংযম” দিয়ে। প্রতিরোধমূলক কূটনীতি বলতে এখন শুধু শত্রুকে থামানো নয়, মিত্রকেও নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বকেও বোঝাতে হবে।

যুদ্ধটি প্রমাণ করেছে, আজকের আন্তর্জাতিক রাজনীতি একটি গভীর সংকটে। একদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যেমন নিজেরা সরাসরি সংঘাতে যেতে চায় না, তেমনি তাদের আঞ্চলিক মিত্ররা—যেমন ইসরায়েল বা তাইওয়ান—নিজ নিজ সংকীর্ণ লক্ষ্য অর্জনে সেই পরাশক্তিদের ছায়া ব্যবহার করে আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়। বিপদ এখানেই—বিশ্বযুদ্ধ আজ শুরু হবে কোনো বৃহৎ পরিকল্পনার মাধ্যমে নয়, বরং তৃতীয় পক্ষের বেপরোয়া সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গভীর শিক্ষা হলো: আজকের দিনে আমাদের শত্রুরা যতটা না ভয়ানক, তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে আমাদের বন্ধুরা।

১২ দিনের ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে—পারমাণবিক যুদ্ধ, গ্লোবাল কনফ্লিক্ট কিংবা পরাশক্তি সংঘর্ষ এখন আর কল্পনা নয়, বরং তা বাস্তবের হাতছানি। এবং সেই বাস্তবতা আজ আর কেবল শক্তির ভারসাম্য দিয়ে থামানো যাবে না। প্রয়োজন নৈতিক সংযম, পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সিদ্ধান্ত, এবং মিত্রদের অব্যবস্থাপনা ঠেকাতে কার্যকর কূটনৈতিক কাঠামো।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ