মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কার হাতে, তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে

ড. বাতেন মোহাম্মদ
ড. বাতেন মোহাম্মদ
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ জুলাই ০৪ ২৩:৩২:২৪

“স্যার, আপনাকে আমরা বসাইছি, আপনি নিজের যোগ্যতায় এখানে আসেননি।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াহিয়ার কক্ষে এক যুবক আঙুল উঁচিয়ে এই কথা বলছেন—ঘটনাটি সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে।

আমি জানি না, উক্ত মন্তব্যকারী তরুণটির রাজনৈতিক পরিচয় কী। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে সামান্য ধারণা যাঁদের আছে, তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করবেন—তিনি জামায়াত-শিবিরের কেউ হতে পারেন।

তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা আশ্চর্য হইনি। বরং এ ঘটনায় অধ্যাপক ইয়াহিয়ার জন্য তেমন খারাপ লাগাও জন্মায়নি। কেননা, আমার ধারণা—তিনি নিজেও হয়তো লজ্জিত নন। যদি লজ্জিত হতেন, এমন প্রকাশ্য অপমানের মুখোমুখি হওয়ার পর ন্যূনতম আত্মমর্যাদাবোধ থেকে পদত্যাগ করতেন।

আসলে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ অধ্যাপক ইয়াহিয়ার প্রশাসন যেদিন কয়েকজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনে ফুলস্টপ টেনে দিয়েছিল, সেদিনই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, তিনি এই ক্যাম্পাসে আসল কর্তৃত্বের সামনে সাহস করে দাঁড়াবেন না। তখন তিনি ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নয়, বরং ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর আনুগত্যকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

তাঁর প্রশাসন সেদিন বলেছিল, কিছু শিক্ষার্থী নাকি শিক্ষকদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। তাই তাদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

আজ উপাচার্যের কক্ষে একজন যুবক দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে অপমানজনকভাবে কথা বলছে—“আপনাকে আমরা বসাইছি”—এই ঘটনার কী পরিণতি হবে? যেহেতু ঘটনার পেছনে অন্য ধরনের ছাত্ররাজনীতি, তাই কি এবারও প্রশাসন একই কঠোরতা দেখাবে? নাকি এবার 'বট বাহিনী' ঝাঁপিয়ে পড়বে, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করাবে?

একটি ভিডিও ক্যামেরার সামনে ঘটনাটি ঘটায় হয়তো এবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মানুষ, যারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন, তারা বাস্তবতা বুঝতে পারছেন।

স্যার ইয়াহিয়া, আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা করবেন। আপনি উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার দিন আমি অত্যন্ত আশাবাদী হয়ে আপনার যোগ্যতার ওপর একটি উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেছিলাম। কিন্তু আজ যখন দেখি একজন ব্যক্তি আপনাকে আঙুল উঁচিয়ে বলছে—“আপনি নিজের যোগ্যতায় আসেননি”—তখন আমি মনে মনে তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হই। যদি আপনি সত্যিই যোগ্য হতেন, আপনি এমন অপমানের পর নিজেকে আর সেই পদে রাখতে পারতেন না।

সম্প্রতি সরকারের মাননীয় পরিকল্পনা উপদেষ্টা (সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা) স্বীকার করেছেন—বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করা হয়েছে। এমন বক্তব্য শুনে আমাদের আগের ভিসিদের নিয়ে সমালোচনা করার নৈতিক অধিকারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

আমরা এক সময় অনেক আশাবাদী ছিলাম। ভাবতাম, শিক্ষার পরিবেশ পাল্টে যাবে। অনেক ভিসির সিভি দেখে মনে হয়েছে, এঁরা নিঃসন্দেহে পেশাদার, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল মানুষ। কিন্তু সময় প্রমাণ করেছে—সিভির ভাষা আর বাস্তব ভূমিকায় বড় ধরনের ফারাক থাকতে পারে।

হ্যাঁ, হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আওয়ামী ছাত্রলীগের সন্ত্রাস থেকে কিছুটা মুক্ত হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন মুক্ত? না কি এখন তারা অন্য ধরনের দখলে?

আজকের ভিডিও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন এক ধরনের ক্যাপচারের শিকার। এখন মুদ্রার উল্টো পিঠের শক্তিগুলো, যারা নিজেদের নিরপেক্ষতা বা প্রফেশনালিজমের মুখোশ পরে থাকে, তারাও নিজেদের আর আড়াল রাখতে পারছে না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার আলমা ম্যাটার। গত পনেরো বছর ধরে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্বের চেয়ে লজ্জাই বেশি অনুভব করেছি। আজও সেই লজ্জা থেকে মুক্ত হতে পারিনি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে কার হাতে? কারা সেখানে ক্ষমতার আসল ধারক? উত্তরটি আজ আর খুব কঠিন নয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ