মতামত

আবু সাইদ: এক জনতার মহানায়ক

শামসুল আরেফীন
শামসুল আরেফীন
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ জুলাই ২৬ ২১:২১:৫৩
আবু সাইদ: এক জনতার মহানায়ক

সম্প্রতি আলজাজিরা টেলিভিশনের একটি ৪৯ মিনিটের অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারি দেখার সুযোগ হয়েছিল। এই ডকুমেন্টারিটি যেন আমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল ২০২৪ সালের সেই উত্তাল জুলাইয়ের দিনগুলোতে। সেই রক্তমাখা বিকেল, চোখ ভিজিয়ে দেওয়া রাত আর বুক কাঁপানো প্রতিরোধের দৃশ্যপট যেন আবার সামনে ভেসে উঠলো। স্টোরিটেলিং ও ডকুমেন্টেশনের দিক থেকে এটি ছিল নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ সাংবাদিকতামূলক কাজ। তবু, একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী হিসেবে, এতে কিছু পক্ষপাত আমার চোখে লেগেছে। বিশেষত, যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন — নাহিদ, মাহফুজ, হাসনাত — তাঁদের অনুপস্থিতি গোটা প্রতিবেদনের এক অপূর্ণতা তৈরি করেছে।

যদিও সাদিক কায়েমের বক্তব্য রয়েছে, তবুও আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংগঠনিক চালিকাশক্তির দিকটি আরও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এটি হয়তো প্রতিবেদকের রাজনৈতিক পছন্দের প্রতিফলন, কিংবা সীমিত সময় ও পরিসরের মধ্যে সব কণ্ঠ অন্তর্ভুক্ত করতে না পারার ব্যর্থতা। তবে একটি দিক ডকুমেন্টারিটি নিঃসন্দেহে স্পষ্ট করে দিয়েছে — এই আন্দোলনের সবচেয়ে প্রতীকী ও গুরুত্বপূর্ণ চেহারায় রূপ নিয়েছেন শহীদ আবু সাইদ।

এই নামটির সঙ্গে আজকের বাংলাদেশ জড়িয়ে গেছে গভীরভাবে। ইতিহাসের রক্তক্ষরণ, প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যেন আবু সাইদের ভেতর সন্নিবেশিত হয়ে আছে। রাষ্ট্র যেভাবে তাঁকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে, তা কেবল একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয় — এটি ছিল প্রতীকীভাবে একটি প্রজন্মের সাহস, আত্মজিজ্ঞাসা ও প্রতিবাদের ওপর আঘাত। কিন্তু সেই আঘাতই হয়ে ওঠে বিদ্রোহের জ্বালানি।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি, যখন শিক্ষার্থীরা কোটার সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে, তখন ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করতেই পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে। এই দমনমূলক পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশের হাতে পড়ে যান আবু সাইদ। একা, রক্তাক্ত, কিন্তু সাহসিকতায় অটল।

তাঁকে পুলিশ মাথায় আঘাত করে রক্তাক্ত করে তোলে। কিন্তু তিনি পালান না, ভীত হন না। বরং দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, “Shoot me! Shoot me!”

একজন ছাত্র সাংবাদিক তাঁকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনার নাম কী?” আবু সাইদ গর্বভরে উত্তর দেন, “আবু সাইদ, ইংরেজি বিভাগ, ১২তম ব্যাচ।” এই উত্তর ছিল আত্মপরিচয়ের ঘোষণা, একটি প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সাহসী ঘোষণা। তারপরের দৃশ্য আমাদের সবার জানা — দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে আবার বলেন, “Shoot me!” এবং পুলিশ গুলি চালায়।

সেই মুহূর্তেই যেন গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম হয়ে যায়। তাঁর রক্তাক্ত শরীর পড়ে থাকলেও, তাঁর আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে শহরের অলিতে গলিতে, গ্রামে-গঞ্জে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ঘরে। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী মুখোশ যেন খুলে পড়ে জনতার সামনে। আবু সাইদের মৃত্যু শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড ছিল না, তা ছিল দীর্ঘকাল জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ, একটি মৌলিক প্রশ্নের জাগরণ।

“Shoot me” উচ্চারণটি হয়ে ওঠে এক জাতীয় চেতনার প্রতীক। যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মতাদর্শিক ভিত্তি হিসেবে আবু সাইদের সাহস, আত্মত্যাগ ও প্রতিবাদের ভাষা নতুন মাত্রা যোগ করে। তিনি দেখিয়ে দেন যে প্রতিরোধ কেবল অস্ত্র দিয়ে হয় না — তা হয় চেতনা, আত্মপরিচয় এবং আত্মদান দিয়ে। রাষ্ট্রযন্ত্র যেখানে কণ্ঠরোধ করে, সেখানেই দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এক প্রেরণার উৎস।

আমাদের দায়িত্ব হলো এই ইতিহাস সংরক্ষণ করা। বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে, যেখানে ন্যায়বিচার নেই, শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা নেই, এবং রাষ্ট্রচিন্তা ধ্বংসপ্রায়, সেখানে আবু সাইদ শুধু আবেগের প্রতীক নন — তিনি এক রাজনৈতিক আদর্শের নাম। তাঁর স্মরণ শুধু আবেগ নয়, বরং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা।

এখন আমাদের সামনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রথমত, এই ইতিহাস দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে রক্ষা করা। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো — কীভাবে একজন শিক্ষার্থী রাষ্ট্রশক্তির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারেন। তৃতীয়ত, তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

আবু সাইদ সেদিন একা ছিলেন, কিন্তু ইতিহাসে তিনি একা নন। তিনি হয়ে উঠেছেন একটি জনতার উচ্চারণ, সাহস ও প্রতিরোধের প্রতীক। তাঁর জীবন আমাদের শিখিয়েছে, সত্যের জন্য লড়াই কখনো বৃথা যায় না। তাঁর মৃত্যু এক নতুন রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করেছে — যা আমাদের এখন ধারণ করতে হবে, রক্ষা করতে হবে এবং এগিয়ে নিতে হবে।

আবু সাইদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে, আমাদের সেই বাংলাদেশ গড়তে হবে যেখানে পুলিশের হাতে আর কোনো শিক্ষার্থী নিহত হবে না, যেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বদলে প্রতিষ্ঠিত হবে গণতান্ত্রিক শাসন, এবং যেখানে “Shoot me” উচ্চারণ হবে না আর একটি জীবন শেষ হওয়ার মুহূর্তের অভিব্যক্তি, বরং হবে আত্মমর্যাদার শুদ্ধতম উচ্চারণ।

লেখক: শামসুল আরেফিন, শিক্ষক ও গবেষক, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়পিএইচডি গবেষক, ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যামহার্স্ট, যুক্তরাষ্ট্র।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ