ঘুষের হারে পাঁচগুণ বৃদ্ধি, কোথাও কোনো সুশাসন নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই-  মির্জা ফখরুলের উদ্বেগ

অর্থনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ২৬ ১৫:০৭:৩১
ঘুষের হারে পাঁচগুণ বৃদ্ধি, কোথাও কোনো সুশাসন নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই-  মির্জা ফখরুলের উদ্বেগ
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানের লেখা ‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অনুষ্ঠানটি সিরডাপ মিলনায়তনে হয়। ছবি: প্রথম আলো

শাসনব্যবস্থার ক্রমাবনতি ও অর্থনীতির উপর দুর্নীতির ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও অর্থনীতিবিদরা। আজ রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তারা এ উদ্বেগ জানান। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান রচিত ‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা: যাপিত জীবনের আলেখ্য’ গ্রন্থের প্রকাশনা উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তারা দেশের সুশাসন, প্রশাসনিক সংস্কার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা নিয়ে গভীরভাবে আলোকপাত করেন।

অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক মারাত্মক বাস্তবচিত্র তুলে ধরে বলেন, “আগে ঘুষ দিতে হতো ১ লাখ টাকা, এখন দিতে হয় ৫ লাখ টাকা।” তিনি জানান, এই তথ্য দিয়েছেন তাঁকে একজন খ্যাতনামা বড় ব্যবসায়ী, যিনি সাম্প্রতিক প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থেকে এমন অভিমত দেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, “এই অবস্থা প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রযন্ত্রে নিয়ন্ত্রণ বলতে কিছু নেই। কোথাও কোনো সুশাসন নেই। পুলিশ বিভাগে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়নি। তবে রাতারাতি এই পরিস্থিতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সময় লাগবে। কিন্তু বসে থাকলে চলবে না। গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। সংস্কার চাপিয়ে নয়, বরং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তা আনতে হবে।”

তিনি রাজনৈতিক সংস্কার ও গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের তাগিদ দিয়ে বলেন, “অবিলম্বে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে। নইলে দুর্নীতি, অকার্যকর শাসন ও বৈষম্যের এই সংস্কৃতি আরও গভীর হবে।”

বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিগত শুল্ক আরোপ সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য বড় অর্থনৈতিক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা।”

সালেহউদ্দিন আহমেদ: “সুশাসন কেবল শব্দ নয়, এটি একটি কঠিন বাস্তবতা”

প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ভালো প্রতিষ্ঠান দেশে এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মানুষগুলো তো আগের জায়গাতেই রয়ে গেছে, তারা বদলায়নি।”

তিনি প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে বলেন, “অনেকে বলেন সবকিছু বাদ দিয়ে নতুন করে শুরু করো। কিন্তু সেটি বাস্তবসম্মত নয়। আমাদেরকে কাজ করাতে হচ্ছে কখনও মাথায় হাত বুলিয়ে, কখনও ধমক দিয়ে। কারণ এটাই বাস্তবতা।”

তিনি আরও বলেন, “সুশাসন অর্জন করা সহজ নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য পর্যন্ত সবার কার্যক্রমে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ বা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ কাঠামো নেই। এই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা না হলে যত সংস্কারই করা হোক, তা ফলপ্রসূ হবে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার সংস্কার অপরিহার্য।”

হোসেন জিল্লুর রহমান: “অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতার যোগসূত্র ধরার চেষ্টা”

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বইটির লেখক হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, “এই বইয়ে আমি চেষ্টা করেছি অর্থনৈতিক বাস্তবতা, শাসনব্যবস্থার জটিলতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকৃত অবস্থা একত্রে বিশ্লেষণ করতে। আমাদের যাপিত জীবনে এই তিনটি বিষয়ের প্রভাব গভীর এবং পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত।”

তিনি মনে করেন, “যদি আমরা অর্থনীতিকে জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে চাই, তবে শাসনব্যবস্থায় ন্যায্যতা, জবাবদিহিতা এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য। এই ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা ছাড়া কেবল নীতিগত আলোচনা দিয়ে কোনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব নয়।”

সংকটের ভেতর থেকেই উত্তরণের পথ

আজকের এই আলোচনা শুধু একটি বই প্রকাশের আয়োজন নয়, বরং বাংলাদেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পর্যালোচনার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। বক্তারা প্রত্যেকে শাসন ও সুশাসন বিষয়ে গভীর ও বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ তুলে ধরেন, যেখানে দুর্নীতি ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

যেখানে ঘুষ পাঁচগুণ বেড়ে গেছে, যেখানে প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে, সেখানে গণতন্ত্রই হতে পারে একমাত্র আশ্রয়স্থল — এমন বার্তাই হয়তো আজকের আলোচনা থেকে উঠে আসে। এই সংকটের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনীতি এক নতুন পথের সন্ধান পাবে — যদি সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি বাস্তবায়ন করা যায়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ