সম্পাদকীয়

ব্রেক্সিট, ফেসবুক ও গণতন্ত্রের ছায়াযুদ্ধ: বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ জুলাই ২৫ ১৪:৪৩:৩২
ব্রেক্সিট, ফেসবুক ও গণতন্ত্রের ছায়াযুদ্ধ: বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা

২০১৬ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্য একটি ঐতিহাসিক গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়; এটি জাতিগত বিভাজন, ভৌগোলিক বৈষম্য এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে। ওই ভোটের পরপরই এক ব্রিটিশ সাংবাদিক ফিরে যান ওয়েলসের দক্ষিণাঞ্চলের শহর ইব্বু ভেইল-এ, যেখানে প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ "Leave" অর্থাৎ EU ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। অথচ এই শহরটি ছিল ইউরোপীয় অনুদানের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীদের একটি। উন্নত কলেজ, ক্রীড়া কমপ্লেক্স, রাস্তা, রেললাইনসহ অবকাঠামোগত প্রতিটি স্তরে ছিল EU অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

এই দৃশ্যমান উন্নয়নের বিপরীতে স্থানীয় জনগণের অনুভূতিতে ছিল অবজ্ঞা ও উপেক্ষার একধরনের ক্ষত। এখানে তৈরি হয় এক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। উন্নয়ন চোখে দেখা গেলেও জনগণ অনুভব করছিল একধরনের প্রান্তিকতা। তারা মনে করছিল, বিদেশি অভিবাসীদের কারণে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। অথচ সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইব্বু ভেইল ছিল যুক্তরাজ্যের অভিবাসী কম সংখ্যক অঞ্চলগুলোর একটি।

এই অযৌক্তিক ভয় ও ক্ষোভ ছড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখে সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক। এক স্থানীয় নারীর ভাষ্যমতে, গণভোটের আগের সপ্তাহগুলোতে তার ফেসবুক নিউজফিডে এমন বহু ভীতিকর পোস্ট আসে যেখানে বলা হচ্ছিল তুরস্ক শিগগির EU সদস্য হতে যাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মুসলিম ইউরোপে ঢুকে পড়বে, এবং ব্রিটিশ সমাজ ভেঙে পড়বে। ভোটের পর সেই পোস্টগুলো আর দেখা যায়নি। কারণ এগুলো ছিল তথাকথিত "ডার্ক অ্যাড", যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীর নিউজফিডে একবারের জন্য প্রদর্শিত হয়, পরবর্তীতে তা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে এক অদৃশ্য ডিজিটাল ছায়াজগতে বাস্তবায়িত হয় যুক্তরাজ্যের একটি যুগান্তকারী গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত।

এই তথ্য-নির্ভর ছায়াযুদ্ধের পেছনে ছিল ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা নামক এক রাজনৈতিক পরামর্শক সংস্থা, যারা ৮৭ মিলিয়নেরও বেশি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে অবৈধভাবে তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা তৈরি করে মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল এবং প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ভয়, দুশ্চিন্তা ও অসন্তোষকে টার্গেট করে বিভ্রান্তিকর বার্তা পাঠায়।

একইসাথে ‘Vote Leave’ নামক অফিসিয়াল প্রচার সংস্থা নির্বাচন কমিশনের নিয়ম ভেঙে গোপনে প্রায় ৭.৫ লক্ষ পাউন্ড ব্যয় করে, যা নির্বাচনী কমিশনের তদন্তে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই অর্থে তৈরি হয় অসংখ্য বিভ্রান্তিকর ডিজিটাল বিজ্ঞাপন, যার মধ্যে তুরস্ক-সংক্রান্ত ভিত্তিহীন তথ্যও ছিল। ডিজিটাল প্রযুক্তির এমন অপব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, এবং জনমত গঠিত হয় বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে।

আরও গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, এই পুরো ঘটনাপ্রবাহে ফেসবুক, গুগল এবং ইউটিউবের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টগুলো রয়ে যায় জবাবদিহির বাইরে। যুক্তরাজ্যসহ নয়টি দেশের সংসদ মার্ক জুকারবার্গকে সাক্ষ্যদানের জন্য আহ্বান জানালেও তিনি উপস্থিত হননি। কেউ জানে না কে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, কী তথ্য ব্যবহার করেছে, কত খরচ হয়েছে কিংবা এই প্রচারণার পেছনে কোন দেশের অর্থ ছিল। এই জবাবদিহিহীন প্রযুক্তি ব্যবহার শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর নৈতিক শূন্যতার প্রতিচ্ছবিও।

এই অভিজ্ঞতা কেবল যুক্তরাজ্য বা ব্রেক্সিট ঘিরেই সীমাবদ্ধ নয়। ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ব্রাজিল, মায়ানমার কিংবা নিউজিল্যান্ডেও দেখা গেছে একই ধরণের ডিজিটাল প্রচারণা ও মিথ্যাচার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। এই বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারী একটি নতুন তথ্য-রাজনীতির ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। ফেসবুক এখন আর শুধু যোগাযোগ বা বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলের প্রচার ও জনমত গঠনের একটি মুখ্য হাতিয়ার। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিগত গোষ্ঠীগুলোও এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছে মত প্রভাবিত করতে।

২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছাত্র ও যুব অভ্যুত্থান এবং তার পরবর্তী সময়ে ফেসবুকে গুজব, বিকৃত তথ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের স্রোত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথাকথিত ‘সাইবার বাহিনী’ বা ‘ডিজিটাল অ্যাক্টিভিস্ট’রা, যারা শুধু সমালোচক, সাংবাদিক কিংবা বিরুদ্ধমতের মানুষদের নয়, বরং সাধারণ নাগরিকদের প্রতিও ট্রলিং, হুমকি এবং তথ্য বিকৃতির মাধ্যমে ডিজিটাল নিপীড়ন চালাচ্ছে।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। নির্বাচন কমিশনের উপর জনসচেতনতা, স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে দায়িত্ব, তা কতটা কার্যকরভাবে পালন করা হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। একই সঙ্গে সংশোধিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কতটা ভারসাম্যপূর্ণ হবে এবং বহুজাতিক টেক কোম্পানিগুলোর প্রতি কতটা জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সে প্রশ্নগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের সামনে রয়েছে কিছু জরুরি করণীয়। প্রথমত, রাজনৈতিক ডিজিটাল প্রচারের ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য যাচাইয়ের জন্য আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে স্থানীয়ভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি, নাগরিকদের মধ্যে তথ্য বিশ্লেষণের সক্ষমতা ও ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।

গণতন্ত্র কোনো স্থায়ী বা প্রাকৃতিক অধিকার নয়। এটি সচেতনতা, দায়িত্ব ও লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জন ও রক্ষা করতে হয়। ব্রেক্সিট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে প্রযুক্তি যেমন জনগণকে সংযুক্ত করতে পারে, তেমনি সেটি বিভ্রান্তিও ছড়িয়ে দিতে পারে। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের — আমরা কি এই অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি শক্তির সামনে দাঁড়াব, নাকি চুপচাপ আমাদের ভবিষ্যৎ তাদের হাতে তুলে দেব?

-লেখক মো. অহিদুজ্জামান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম "সত্য নিউজ"-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জনপ্রিয় ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্যারল ক্যাডওয়ালাডারের এক উন্মুক্ত বক্তৃতা থেকেই এই লেখার অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ