ভারতের নাগরিক হয়েও ‘বাংলাদেশি’ তকমা! জোর করে পুশ-ইন

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ২৫ ১০:৩৪:৪৮
ভারতের নাগরিক হয়েও ‘বাংলাদেশি’ তকমা! জোর করে পুশ-ইন

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার দুটি পরিবারকে বাংলাদেশি পরিচয়ে সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের দাবি এই ছয় ব্যক্তি বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার বাসিন্দা, তবে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনীতিকদের সুনির্দিষ্ট দাবি, অন্তত একটি পরিবার শতভাগ ভারতীয় নাগরিক এবং আরেকটি পরিবারেরও ভারতীয় হওয়ার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পাওয়া গেছে।

দিল্লি পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এরা সবাই বাংলাদেশি এবং তাদের স্থায়ী ঠিকানা বাগেরহাটের মোলারগাং ছেপুয়ার পাড় গ্রামে। এই দাবি মেনে তাদের পশ্চিম দিল্লির রোহিনী থানা থেকে আটক করে পরবর্তীতে এফআরআরও (Foreigners Regional Registration Office)-র মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রতিনিধিরা, মানবাধিকারকর্মী এবং পরিযায়ী শ্রমিক সংগঠনগুলো।

বীরভূম জেলার মুরারই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরকারি রেকর্ড থেকে প্রাপ্ত অন্তত ১০টি নথি উপস্থাপন করেছেন, যেখানে সুইটি বিবির পরিবারের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ মেলে। নথিগুলোর মধ্যে রয়েছে আধার কার্ড, জন্মনিবন্ধন, স্থানীয় পঞ্চায়েত ও বিডিও (ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার)-র সুপারিশপত্র এবং ১৯৬৬ সালের একটি জমির দলিল। এছাড়া ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলায় তাদের পূর্বপুরুষদের বসবাসের প্রমাণস্বরূপ একটি স্বাক্ষরিত বংশতালিকাও উপস্থাপন করা হয়েছে।

অন্য পরিবারটির সদস্য সোনালি খাতুন, তার স্বামী ও শিশু সন্তানকে একই সময়ে আটক করা হয়। তারা পাইকর থানা এলাকার বাসিন্দা বলেই দাবি করেন স্বজনরা। যদিও এখনো তাদের সমস্ত নথি যাচাই শেষ হয়নি।

এই ঘটনা নিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান ও তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন। তিনি সামাজিক মাধ্যমে ১৯৫০, ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকের জমির দলিলসহ বিভিন্ন প্রমাণপত্র প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ট্যাগ করে একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সুইটি বিবি নামের একজন নারী কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, “আমরা ভারতীয়। দিল্লি থেকে কাজ করতে গিয়ে পুলিশ ধরল। আধার কার্ড দেখালাম, তবু জোর করে বাংলাদেশি বানিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিল।” ওই নারী আরও বলেন, থানায় ও একটি অজানা বাড়িতে চারদিন আটকে রাখা হয়েছিল, যেখানে জোর করে কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়, হাতের ছাপ নেওয়া হয় এবং নানা রকম পরীক্ষাও করানো হয়।

সুইটি বিবি অভিযোগ করেন, বর্তমানে তারা বাংলাদেশে কোথায় আছে, সেটি নিজেরাও নিশ্চিত নন। শুধু জানেন, তারা এখন রাস্তায়, মশায় ভরা বারান্দায় এক কাপড়ে দিন কাটাচ্ছেন। ভিডিওতে দু’জন নারী, দুটি শিশু, একজন কিশোর ও এক পুরুষকে দেখা যায় যাদের অভিযোগ, ভারতীয় হয়েও তাদের ‘ভুল দেশ’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভিডিও বার্তায় সুইটি কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করেন, “মমতা দিদি, আমাদের এখান থেকে ফিরিয়ে নিন। আমরা ভারতীয়, বাংলাদেশি নই।”

এই ঘটনায় শুধু দুই পরিবার নয়, পুরো ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিক সমাজের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় রাজনীতিকদের ভাষ্য, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, পরিচয় ও নাগরিকত্ব যাচাইয়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। যেখানে ৫০ বছরের পুরনো জমির দলিল, আধার কার্ড ও সরকারি প্রশংসাপত্র রয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোকে একতরফাভাবে বাংলাদেশি ঘোষণা করে ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং ভারতীয় সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী।

এখন পর্যন্ত এ পরিবারগুলো বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে অবস্থান করছে তা স্পষ্ট নয়। তবে তারা যে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা ও অবমাননাকর জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, সেটি ভিডিও বার্তাগুলোতেই পরিষ্কার। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠছে মানবিকতা, তথ্যের নির্ভুলতা এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার দায়বদ্ধতা নিয়ে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ