মতামত

সঠিক প্রশ্ন করা জরুরি: আমাদের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি প্রসঙ্গে

রাইয়ান হোসেন
রাইয়ান হোসেন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ জুলাই ২৫ ১৬:০৯:২২

বাংলাদেশের ইতিহাসে সাম্প্রতিক একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা গোটা জাতিকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকার একটি স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে (সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এই সংখ্যাটি প্রায় ৩০)। এই মৃত্যু শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি আমাদের জাতীয় বিবেকের ওপর এক কঠিন আঘাত। এই তরুণ প্রাণগুলো ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারত এই দেশের সম্ভাবনাময় নাগরিক। কেউ হয়তো হতো চিকিৎসক, কেউ হয়তো উদ্ভাবক, কেউ হয়তো সমাজ সংস্কারক। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল, এমন দুর্ঘটনার প্রতিটি স্তরে দায় চিহ্নিত করে দ্রুত, মানবিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

এই শোকাবহ প্রেক্ষাপটে জাতি যখন দিশেহারা এবং রাষ্ট্র যখন প্রশাসনিক ও নৈতিক পরীক্ষার মুখে, তখন পত্রিকার পাতায় হঠাৎ একটি দাবি উঠে আসে। শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আব্রার-এর পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। প্রথমে বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হলেও, পরে দেখা গেল কিছু তরুণ, কিছু গোষ্ঠী এবং কিছু প্রচারমাধ্যমে এই দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, কেন এই দাবি? এবং কে বা কারা এই দাবি করছে? এটি কি নিছক আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া, না কি সুপরিকল্পিত কোনো প্রচেষ্টা?

এইচএসসি পরীক্ষার মতো একটি উচ্চমার্গের পাবলিক পরীক্ষার ঠিক আগের দিন এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেলে, শিক্ষার্থীদের পক্ষে পরদিনই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা নিছক মানসিক নির্যাতন ছাড়া আর কিছু নয়। যারা নিজেদের চোখের সামনে সহপাঠীর মৃত্যু দেখেছে, যাদের চারপাশে এখনো পোড়া দেহের গন্ধ মিশে আছে বাতাসে, তাদের পক্ষে কলম ধরা কঠিন। রাষ্ট্র এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল, আগেই পরীক্ষা স্থগিতের মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। মধ্যরাতে নেওয়া সিদ্ধান্ত দেরিতে আসা এবং অনেকটা দায়সারা মনে হয়েছে।

তবে এই দেরির দায় কি সম্পূর্ণভাবে একজন সদ্য নিয়োজিত উপদেষ্টার কাঁধে চাপানো যুক্তিসঙ্গত? অধ্যাপক সি. আর. আব্রার মাত্র ৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। এখনো ছয় মাসও হয়নি তার দায়িত্ব গ্রহণের। এমন বাস্তবতায়, এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য তাকে এককভাবে দায়ী করা কতটা বাস্তবসম্মত, তা গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।

আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই এবং অধ্যাপক আব্রার আমার শিক্ষকও নন। কিন্তু একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এবং রাজনৈতিক-সামাজিক গতিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে আমি তার কার্যক্রম, অবস্থান ও ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি একজন শিক্ষাবিদ হওয়ার পাশাপাশি মানবাধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তিনি অধিকার নামক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেটি গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, দমন-পীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে।

বিশেষ করে, তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। যখন দেশের বহু বুদ্ধিজীবী নীরব ছিলেন, তখন অধ্যাপক আব্রার ছিলেন স্পষ্টবাদী ও আপসহীন। এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবি উঠা নিছক দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়। বরং এটি সুপরিকল্পিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত একটি প্রচেষ্টা বলেই সন্দেহ হয়।

এই দাবি কারা তুলছে, সেটিও ভাবার বিষয়। দেখা যাচ্ছে, কিছু তরুণ গোষ্ঠী এই দাবি উপস্থাপন করছে। তবে এটি কি শিক্ষার্থীদের আত্মিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, না কি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্ররোচনার ফল, সে প্রশ্নও উঠছে। মন্ত্রিসভার আরও অনেক উপদেষ্টার কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থাকলেও, তাদের কারও বিরুদ্ধে এমন দাবি দেখা যাচ্ছে না। তাহলে অধ্যাপক আব্রার-এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন?

তাঁর অপরাধ যদি কিছু থাকে, তবে তা হলো—তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী, মানবাধিকারপন্থী এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি ছিলেন জুলাই-আগস্ট মাসের ছাত্র-যুব অভ্যুত্থানের নৈতিক চেতনার ধারক ও বাহক। এই অবস্থান তাকে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর চোখে সন্দেহজনক করে তুলেছে। ফলে তাকে টার্গেট করা শুরু হয়েছে।

একজন শিক্ষক কেবল পাঠ্যবই পড়ান না, তিনি সমাজ নির্মাণের কাজ করেন। যিনি রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন তুলতে শেখান, তিনিই প্রকৃত শিক্ষকের ভূমিকায় আছেন। অধ্যাপক আব্রার সেই ভূমিকায় আছেন বলেই তিনি রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে, তাদের কাছে যাদের কাছে আনুগত্যই মূল মাপকাঠি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমালোচনার ফাঁদে আটকে থাকব, নাকি কাঠামোগত ব্যর্থতার দিকে নজর দেব? কেন সেনাবাহিনীর ট্রেনিং এমন জনবহুল এলাকায় হচ্ছিল? কেন নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি? কেন প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাব দেখা গেল? এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন না তুলে যদি আমরা একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মানবাধিকারপন্থী উপদেষ্টাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করি, তাহলে তা হবে ভবিষ্যতের প্রতি ভয়াবহ অবিচার।

আমরা যদি সত্যিই এই দুর্ঘটনায় ব্যথিত হই, তবে আমাদের উচিত সিস্টেমকে দায়ী করা, ব্যক্তি নয়। অধ্যাপক আব্রার তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং মানবিকতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি শ্রেণিকক্ষে মুক্তচিন্তা চর্চার পক্ষে, রাজনৈতিক পক্ষপাতের বিপক্ষে। তাকে আক্রমণ করা মানে, এই চেতনার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়া।

গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়, এটি একটি মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ কাঠামোর নির্মাণ। অধ্যাপক আব্রার সেই মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার মতো একজন শিক্ষক, চিন্তক ও মানবাধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে আজ পদত্যাগের দাবি তোলা মানে মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করে দেওয়া এবং প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে ফেলা।

এই অবস্থায় আমাদের করণীয় একটাই—আমরা যেন সঠিক প্রশ্ন করি। যদি এখন না করি, তাহলে কবে করব?

-লেখক রাইয়ান হোসেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি,বাংলাদেশ (আইইউবি) এর গ্লোবাল স্টাডিজ ও গভার্নেন্স বিভাগে লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত। তবে তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ইউনিভার্সিটিতে "রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক" নিয়ে পিএইচডি করছেন। ইমেইল: [email protected]

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ