সম্পাদকীয়

গণঅভ্যুত্থানের এক বছর: মুক্তির স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ আগস্ট ০৫ ১৪:৫৩:৫৮
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর: মুক্তির স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

আজ ৫ আগস্ট ২০২৫। এক বছর আগে, ঠিক এই দিনে, বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল ছাত্র-জনতার এক রক্তস্নাত কিন্তু অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান—যা প্রায় ষোল বছরের দীর্ঘস্থায়ী আওয়ামী একদলীয় শাসনের অবসান ঘটায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের একদলীয় শাসনের কাঠামো তৈরি শুরু করেছিল। সেই প্রক্রিয়ার প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল ২০০৯ সালের কুখ্যাত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৫৭ জন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা। এই কর্মকর্তারা ছিলেন ১/১১–পরবর্তী দুই বছরের অন্তর্বর্তী প্রশাসনে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত এবং প্রভাবশালী, যাদের ক্ষমতায় এসে আওয়ামী সরকার সচেতনভাবে তৎকালীন বিডিআরে বদলি করে দেয়। ঘটনার পর সেনাবাহিনীর যে অফিসাররা এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী তদন্ত ও বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে এই হত্যাকাণ্ড কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না; বরং এটি ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের একটি সুপরিকল্পিত ও অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সাজানো নকশার অংশ।

পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি শাহবাগ আন্দোলনের উত্থান, জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, বিএনপির বহু নেতার বিচার ও দণ্ডাদেশ, বিরোধী দলের লাখো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার, তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কারাবন্দি হওয়া, শত শত গুম, এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে নজিরবিহীন দলীয়করণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। একদলীয় শাসন সুসংহত করতে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের সব অঙ্গ দলীয় স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। সর্বশেষে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ একদলীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত ধাপ সম্পন্ন করে।

এই সময়কালে ভিন্নমতকে দমন, সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ, এবং সরকারের সমালোচকদের কারাবন্দি করার প্রবণতা ছিল স্পষ্ট। সরকার সমালোচনার প্রতিটি আওয়াজ কঠোরভাবে দমন করেছে। অথচ, ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে, জনগণের কণ্ঠরোধ করে, সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। ২০২৪ সালের গণআন্দোলন সেই ঐতিহাসিক সত্যকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে।

সেই সময়ের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এক পুলিশ কর্মকর্তার ভাইরাল মন্তব্য—“গুলি করি, মরে একটা… বাকিটা যায় না, স্যার”—ছিল জনবিক্ষোভের বিস্ফোরিত ক্ষোভের প্রতীক। এই উক্তি ছিল বিদ্রোহী চেতনার বাস্তব প্রতিফলন, যা কার্ল মার্ক্সের ভাষায় “class in itself” থেকে “class for itself”-এ উত্তরণের মুহূর্ত এবং মিশেল ফুকোর বর্ণনায় ক্ষমতার দমনমূলক কাঠামো থেকে প্রতিরোধ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার নিদর্শন।

যারা ২০২৪ সালের এই গণঅভ্যুত্থানক কেবল ৩৬ দিনের আন্দোলনের ফল হিসেবে দেখেন, তারা প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করছেন। বাস্তবে, দীর্ঘ ষোল বছরের সঞ্চিত ক্ষোভ ও প্রতিরোধের বীজ ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ৩৬ দিনের আন্দোলনে তা পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। এটিকে আমরা মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সেই রূপান্তর হিসেবে দেখতে পারি, যেখানে ক্রমাগত পরিমাণগত পরিবর্তন একসময়ে গুণগত পরিবর্তনে রূপ নেয়, এবং গোটা ব্যবস্থায় আমূল রূপান্তর ঘটায়।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতা: মুক্তির স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

৫ আগস্ট ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের পর সারাদেশে একদিকে ছিল মুক্তির উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে অরাজকতার তীব্র বিস্তার। শত শত প্রাণহানি, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল, যা বেদনাদায়ক হলেও এমন এক রক্তক্ষয়ী পরিবর্তনের পর অস্বাভাবিক ছিল না। এই অরাজক পরিস্থিতির মধ্যেই নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল—দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করা, রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সংস্কার এগিয়ে নেওয়া, এবং একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করা।

একই সময়ে এই সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়ার তীব্র প্রপাগান্ডা মোকাবিলা করা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা—এই দুই ফ্রন্টে সমানভাবে কাজ করতে হয়েছে এই প্রশাসনকে।

গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও তা আশানুরূপ নয়। মব জাস্টিস, চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই—এসব অপরাধ এখনো নিয়মিত ঘটছে। একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, যা জনরোষ ও অপরাধপ্রবণতাকে উস্কে দিয়েছে। ষোল বছরের দলীয় শৃঙ্খলার ছাপ এখনো প্রশাসনে গভীরভাবে রয়ে গেছে। একইভাবে, রাজনৈতিক দলগুলোও অনেকাংশে নিজেদের দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নিরপেক্ষ সহযোগিতা করছে সেটিও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকেও একটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতি নীরব সমর্থনের অভিযোগ উঠেছে, যা নীতিগত নিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

জুলাই হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, বিবিসি ও আল জাজিরার অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উঠে এসেছে, যা বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে। যদিও শুরু থেকেই একাধিক ট্রাইব্যুনাল কার্যকর করা হলে প্রক্রিয়াটি দ্রুত এগোতে পারত। এর পরেও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বিচার প্রক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করার সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের উদ্যোগ এ সময়ে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। দীর্ঘ আলোচনার পর আজ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ বা ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে, তা সত্ত্বেও বড় ও ছোট, ডানপন্থী ও বামপন্থী সব রাজনৈতিক দল অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বে একটি অভিন্ন কাঠামোয় একমত হয়েছে—যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল এক নজির। এই ঐক্যমত্য ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের পথে একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

আগামী নির্বাচনকে ঘিরে যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা অনেকটাই কেটে গেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করবে। তবে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানামূখী চাপ সামাল দিয়ে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

দীর্ঘ দেড় দশকের ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসে একটি স্বাধীন ও স্বার্থকেন্দ্রিক কূটনৈতিক নীতি গঠন সহজ কাজ নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ভারতের মিডিয়ার প্রপাগান্ডা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং সদ্য সমাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থান অর্জন করেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি আশঙ্কাজনক মাত্রায় পৌঁছায়নি। শেয়ারবাজার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা সত্ত্বেও অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি, বরং কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ইতিবাচক সাফল্য।

সামগ্রিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ বলা যাবে না। ইতিহাসের এক সংকটময় মুহূর্তে বিপুল জনআকাঙ্ক্ষা মাথায় নিয়ে তারা অন্তত একটি প্রাথমিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে গণতান্ত্রিক উত্তরণ এখনো বহুদূরের পথ—এবং তা মোটেও সহজ হবে না।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় না; নির্বাচন হলো গণতান্ত্রিক যাত্রার সূচনাবিন্দু। সংবিধানে সংস্কার অন্তর্ভুক্ত করলেই গণতন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে না, যদি না দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, এবং নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটে। প্রকৃত গণতন্ত্রের অর্থ যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা নয়; বরং অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা ও মূল্যায়ন করা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা, এবং সুশাসনের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রমাণ করেছিল—দমন, নিপীড়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যেও জনগণ একসময় উঠে দাঁড়ায়। সেই অভ্যুত্থানের এক বছর পর বাংলাদেশের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো—এই অর্জনকে ধরে রাখা এবং তাকে একটি স্থায়ী, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রে রূপ দেওয়া। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, ক্ষমতা যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি গণআন্দোলনের সাফল্যও ক্ষণস্থায়ী হতে পারে, যদি জনগণ, নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র একসঙ্গে সেই পথকে রক্ষা না করে।

-লেখক মো. অহিদুজ্জামান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম "সত্য নিউজ"-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ