বিশেষ প্রতিবেদন

মাহাথির মোহাম্মদ ও মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক রূপান্তর: নীতি, সংস্কার ও উত্তরাধিকার

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ আগস্ট ২৪ ২৩:৪১:৪৮
মাহাথির মোহাম্মদ ও মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক রূপান্তর: নীতি, সংস্কার ও উত্তরাধিকার

বিশ শতকের শেষভাগে মালয়েশিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক রূপান্তরের কৃতিত্ব প্রায়ই মাহাথির মোহাম্মদের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সাহসী নীতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তিনি ১৯৮১ থেকে ২০০৩ এবং পরে আবার ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম ২২ বছরের শাসনামলে মাহাথির মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণ ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। একটি পণ্যনির্ভর পশ্চাৎপদ অর্থনীতি থেকে এটিকে রূপান্তরিত করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে গতিশীল উদীয়মান শিল্প অর্থনীতির একটিতে।

তিনি জাতীয় উন্নয়নের জন্য উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি হাতে নেন। এর মধ্যে ছিল Look East Policy, Vision 2020 এবং বিশাল অবকাঠামোগত প্রকল্পসমূহ। তিনি প্রচলিত ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে দ্বিধা করেননি। ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটে আইএমএফ-এর সহায়তা প্রত্যাখ্যান এবং পুঁজি নিয়ন্ত্রণ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি এর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মাহাথির মূলধারার অর্থনীতিতে ইসলামী নীতিমালা যেমন ইসলামী ব্যাংকিং ও সুকুক বন্ড সংযুক্ত করেন। উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেন এবং রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত উদ্যোগ তৈরি করেন উন্নয়নের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।

আশির দশকের শুরু: শিল্পায়ন উদ্যোগ ও “লুক ইস্ট” নীতি

১৯৮১ সালে মাহাথির ক্ষমতায় আসার সময় মালয়েশিয়া তীব্র বাজেট ঘাটতি এবং রাবার, টিন ও পাম তেল রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির চাপে ভুগছিল। শিল্পায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে তিনি একটি বৃহৎ শিল্পায়ন কর্মসূচি হাতে নেন এবং ১৯৮২ সালে প্রবর্তন করেন “Look East Policy”। এর উদ্দেশ্য ছিল জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মনৈতিকতা ও শিল্প দক্ষতাকে অনুসরণ করা।

এই নীতির আওতায় হাজার হাজার মালয়েশিয়ান শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীকে জাপানে পাঠানো হয় এবং জাপানি বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয় মালয়েশিয়ায়। আশা করা হয়েছিল যে পূর্ব এশীয় দক্ষতা ও শৃঙ্খলা মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে স্থানান্তরিত হবে। লুক ইস্ট নীতির ৪০তম বার্ষিকীতে মাহাথির উল্লেখ করেন যে ১৯৮২ সালের পর থেকে ২৬,০০০-এরও বেশি মালয়েশিয়ান জাপানে পড়াশোনা করেছে এবং প্রায় ১,৫০০ জাপানি কোম্পানি মালয়েশিয়ায় কার্যক্রম চালাচ্ছে, যেখানে চার লক্ষাধিক মানুষ কর্মরত।

এই নীতি প্রাথমিকভাবে মালয়েশিয়ার কৌশলগত ঝোঁককে পশ্চিমা নির্ভরতা থেকে সরিয়ে পূর্ব এশীয় মডেলের দিকে নিয়ে যায়। এতে যেমন অর্থনৈতিক বাস্তববাদ প্রতিফলিত হয়, তেমনি উন্নয়নে অধিক জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের জন্য মাহাথিরের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও স্পষ্ট হয়।

মাহাথিরের প্রথম দিককার বছরগুলোতে জাতীয় শিল্প অগ্রদূত তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মালয়েশিয়ার প্রথম জাতীয় গাড়ি কোম্পানি Proton (মিতসুবিশির প্রযুক্তিগত সহায়তায়), যার লক্ষ্য ছিল দেশীয় অটোমোবাইল শিল্প গড়ে তোলা। ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো ভারী শিল্পগুলোকে উৎসাহিত করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত Heavy Industries Corporation of Malaysia (HICOM) এর মাধ্যমে, যা প্রায়ই স্বল্পসুদে জাপানি ঋণ ব্যবহার করে যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হতো।

এই পদক্ষেপগুলোর লক্ষ্য ছিল দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করা এবং শিল্পপণ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো। রাজনৈতিকভাবে এর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল: আধুনিক শিল্পে বুমিপুত্রা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং জাতীয় গর্বের প্রতীক তৈরি করা (যেমন মালয়েশিয়ায় তৈরি গাড়ি), যা জাতিগত অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে সহায়ক হতো। তবে এই রাষ্ট্রনেতৃত্বাধীন শিল্পায়ন উদ্যোগ ব্যয়বহুল ছিল এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতাও দেখা দেয়। যেমন, Perwaja Steel প্রকল্প পরবর্তীতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। তবুও, এই নীতি মালয়েশিয়ার শিল্প অর্থনীতির প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করে।

অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগের উত্থান (মধ্য আশির দশক–নব্বইয়ের দশক)

মধ্য আশির দশকে বৈশ্বিক মন্দা এবং পণ্যের দামের পতন মালয়েশিয়াকে কঠোরভাবে আঘাত করে। ১৯৮৫ সালে দেশটি মন্দার কবলে পড়ে। এই পরিস্থিতি মাহাথিরকে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে। ১৯৮৬ সালের পর তাঁর সরকার রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ থেকে বাজারমুখী নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। অর্থমন্ত্রী দাইম যায়নুদ্দিনের নেতৃত্বে সরকার কৃচ্ছ্রসাধন, নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণের মতো পদক্ষেপ নেয়।

এর আগেই ১৯৮৩ সালে মাহাথির “Malaysia Incorporated” ধারণা উত্থাপন করেছিলেন, যেখানে সরকার ও বেসরকারি ব্যবসাকে উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে কল্পনা করা হয়। নব্বইয়ের দশকে এই ধারণা গতি পায়। অনেক সরকারি দপ্তর করপোরেট রূপে রূপান্তরিত হয় বা বেসরকারীকরণ করা হয়। Telekom Malaysia, Tenaga Nasional, এমনকি Malaysia Airlines-কেও আংশিক বা সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দক্ষতা বাড়ানো, সরকারের আর্থিক বোঝা হ্রাস করা এবং একই সঙ্গে মালয় উদ্যোক্তাদের একটি করপোরেট শ্রেণি তৈরি করা।

মাহাথিরের অবসর গ্রহণের সময় ২০০৩ সালে দেখা যায়, ১৯৮১ সালের তুলনায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়ে ৯০৬-এ দাঁড়িয়েছে এবং বাজার মূলধন ৫৫ বিলিয়ন রিঙ্গিত থেকে বেড়ে ৬৪০ বিলিয়ন রিঙ্গিতে পৌঁছেছে। এটি প্রমাণ করে তাঁর শাসনামলে বেসরকারি খাত কতটা সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণও ছিল এই নীতির আরেকটি মূল লক্ষ্য। ১৯৮৬ সালে সরকার Promotion of Investments Act চালু করে, যেখানে রপ্তানিমুখী উৎপাদনকারীদের জন্য কর প্রণোদনা দেওয়া হয় এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করা বুমিপুত্রা মালিকানার কিছু শর্ত শিথিল করা হয়। এর ফলে উচ্চমূল্যের রপ্তানিমুখী শিল্প, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়।

সময়ও ছিল অনুকূল। ১৯৮৫ সালের Plaza Accord-এর পর জাপানি ইয়েনের মান বাড়তে শুরু করে। ফলে অনেক জাপানি কোম্পানি (পরে কোরিয়ান ও তাইওয়ানিজ কোম্পানিও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উৎপাদন স্থানান্তর করতে থাকে। মালয়েশিয়ার নতুন উদার বিনিয়োগ পরিবেশ এই ঢেউয়ের প্রধান সুবিধাভোগীতে পরিণত হয়। ফলে মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলে সেমিকন্ডাক্টর, ইলেকট্রনিক্স ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার প্রসার ঘটে। পূর্ব এশিয়া থেকে মূলধন ও প্রযুক্তির প্রবাহ মালয়েশিয়াকে নব্বইয়ের দশকে এক দশকব্যাপী উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও কাঠামোগত রূপান্তরের পথে এগিয়ে দেয়। ফলে নব্বইয়ের শুরুর দিকেই মালয়েশিয়া এক প্রধান ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়।

রাজনৈতিকভাবে এ নীতি ছিল মাহাথিরের এক বাস্তববাদী রূপান্তর। পূর্বের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি এটি ছিল Vision 2020-এর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বৈদেশিক মূলধন ও বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াস। নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়া নিয়মিতভাবে ৮–১০ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এবং কৃষি ও খনিজের বাইরেও অর্থনীতিকে দৃঢ়ভাবে বহুমুখীকরণ করে। মাহাথির নিজেও বলেছিলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়া বিশ্বের শীর্ষ ২০ বাণিজ্যিক দেশের একটিতে পরিণত হয়।

প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় মালয়েশিয়া বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে নিজেদের শর্তে একীভূত হতে সক্ষম হয়েছিল। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বাগত জানালেও সরকার-সংযুক্ত কোম্পানি ও নীতির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করা হয়েছিল। এর ফলে প্রবৃদ্ধির সুফল মালয়েশিয়ার জনগণ ভোগ করতে পেরেছিল।

ভিশন ২০২০ ও উচ্চাভিলাষী আধুনিকায়ন কর্মসূচি

১৯৯১ সালে আত্মবিশ্বাসের জোয়ারে ভেসে মাহাথির ঘোষণা করেন Vision 2020। এটি ছিল এক সাহসী জাতীয় কর্মসূচি, যার লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়াকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তর করা। এই দীর্ঘমেয়াদি ভিশন শুধু অর্থনীতি নয়, আরও বিস্তৃত একটি কাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে নয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল একটি বৈজ্ঞানিক ও প্রগতিশীল সমাজ গঠন থেকে শুরু করে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করা পর্যন্ত।

অর্থনৈতিকভাবে ভিশন ২০২০ প্রতি বছর প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ওপর জোর দেয়। রাজনৈতিকভাবে এর উদ্দেশ্য ছিল জাতিগত ভেদাভেদ অতিক্রম করে সকল মালয়েশিয়ানকে সমৃদ্ধি ও আধুনিকতার যৌথ লক্ষ্যের চারপাশে ঐক্যবদ্ধ করা। এটি New Economic Policy (১৯৭০–১৯৯০)-এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে প্রণীত হয়েছিল। NEP মূলত দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পদের পুনর্বিন্যাসে গুরুত্ব দিয়েছিল। আর Vision 2020 সেই ধাপ অতিক্রম করে এক সমন্বিত আধুনিক উন্নয়ন কৌশল প্রস্তাব করে। একই বছর মাহাথির National Development Policy চালু করেন, যা NEP-এর উত্তরসূরি হলেও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণে বেশি জোর দেয়।

নব্বইয়ের দশকের অর্থনৈতিক বুম ও অবকাঠামো উন্নয়ন

নব্বইয়ের দশকের প্রথম ও মধ্যভাগে মালয়েশিয়া এক অর্থনৈতিক বুমের সাক্ষী হয়। এই সময় মাহাথির সরকার দেশকে আধুনিকায়নের জন্য বিশাল অবকাঠামো ও নগর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। মহাসড়ক, আকাশচুম্বী ভবন, বিমানবন্দর, এমনকি নতুন শহরও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় গড়ে ওঠে।

একটি ঐতিহাসিক প্রকল্প ছিল North–South Expressway। এটি ৮৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়ক, যা থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করে। ১৯৯৪ সালে এটি সম্পন্ন হয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সংযোগ বৃদ্ধি পায়। রাজধানী কুয়ালালামপুরের আকাশরেখা পাল্টে যায় Petronas Twin Towers নির্মাণের মাধ্যমে। ৪৫২ মিটার উচ্চতার এই ভবন দুটি ১৯৯৮ সালে সম্পন্ন হলে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনে পরিণত হয়। এতে জাতীয় তেল কোম্পানি পেট্রোনাসের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়। এটি মালয়েশিয়ার আধুনিক আকাঙ্ক্ষা ও দ্রুত উন্নয়নের প্রতীক হয়ে ওঠে।

সরকার নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর KLIA নির্মাণ করে। এটি ১৯৯৮ সালে চালু হয় এবং দ্রুতই বিশ্বমানের বিমানকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। এর পাশাপাশি নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় নতুন প্রশাসনিক রাজধানী Putrajaya-এর নির্মাণ। ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৯ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সেখানে স্থানান্তরিত হয়। পরে এটিকে ফেডারেল টেরিটরি ঘোষণা করা হয়। সুপরিকল্পিত এই শহরে বিশাল সরকারি ভবন, আধুনিক অবকাঠামো, বাগান ও স্মার্ট প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি মাহাথিরের কল্পিত আধুনিক ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিফলন।

আরেকটি দূরদর্শী প্রকল্প ছিল Multimedia Super Corridor (MSC)। ১৯৯৬ সালে চালু হওয়া এই উচ্চপ্রযুক্তি অঞ্চল কুয়ালালামপুর থেকে নতুন বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল সাইবারজায়া শহর। MSC-কে মালয়েশিয়ার “সিলিকন ভ্যালি” হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল প্রযুক্তি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প গড়ে তোলা। মাহাথির নিজেই বৈশ্বিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা প্যানেলও গঠন করেন। ২০০০ সালের মধ্যে বিল গেটসের মতো প্রযুক্তি বিশ্বনেতারা MSC-কে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রযুক্তি উদ্যোগ হিসেবে আখ্যা দেন।

কুয়ালালামপুরে অবস্থিত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, যা ১৯৯৮ সালে সম্পন্ন হয়, সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন হিসেবে খ্যাতি পায়। মাহাথির মোহাম্মদের উন্নয়ন নীতির অধীনে এগুলো শুধু আকাশচুম্বী স্থাপত্যই নয়, বরং মালয়েশিয়ার দ্রুত আধুনিকায়নের গর্বিত প্রতীক হয়ে ওঠে।

নব্বইয়ের দশকে মাহাথির সরকারের রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে শুধু এই টুইন টাওয়ারই নয়, নতুন মহাসড়ক, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং নতুন প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রাজায়া নির্মাণ করা হয়। এসব বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প মালয়েশিয়ার আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং বিশ্বমঞ্চে দেশটির সক্ষমতা তুলে ধরে।

এই প্রকল্পগুলো ছিল ব্যয়বহুল এবং অনেক সময় সমালোচিতও হয়েছে। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এগুলো মালয়েশিয়ার ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোকে উন্নত করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির ভিত্তি স্থাপন করেছে। এসব অবদানের জন্য মাহাথির “বাপা পেমোডেনান” বা “Father of Modernisation” উপাধি অর্জন করেন।

এ ধরনের বৃহৎ রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন আধুনিকীকরণের পেছনে দুটি প্রধান যুক্তি ছিল। অর্থনৈতিকভাবে মাহাথির বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বমানের অবকাঠামো ও প্রতীকী প্রকল্প বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে এবং মালয়েশিয়াকে নবশিল্পায়িত দেশের কাতারে উন্নীত করবে। সত্যিই, ২০০৩ সালের মধ্যে মালয়েশিয়া বিশ্বের ১৭তম বৃহত্তম বাণিজ্যিক জাতিতে পরিণত হয় এবং প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ও সেবা খাত গড়ে তোলে।

ইসলামী অর্থনীতি ও নীতিমালার সংযুক্তি

পশ্চিমা ধাঁচের শিল্প আধুনিকায়নের পাশাপাশি মাহাথিরের মালয়েশিয়া ধীরে ধীরে ইসলামী অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে। এতে দেশের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাস্তবতা প্রতিফলিত হয় এবং মাহাথিরের আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র গড়ার ধারণাও প্রকাশ পায়। আশির দশকে মাহাথিরের সরকার ইসলামীকরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল জনগণের চাহিদা পূরণ করা, একই সঙ্গে ইসলামী বিরোধী দলের প্রভাবও হ্রাস করা। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মালয়েশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক Bank Islam Malaysia Berhad। মাহাথির এটিকে আখ্যা দেন “একটি বৃহত্তর ইসলামী অর্থনীতির প্রথম ধাপ” হিসেবে। এর পরের বছর চালু হয় দেশের প্রথম তাকাফুল বা ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠান, যা শরীয়াহ-সম্মত আর্থিক সেবা প্রদান শুরু করে। এই প্রাথমিক উদ্যোগগুলো মালয়েশিয়াকে আধুনিক ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম অগ্রদূত করে তোলে।

নব্বইয়ের দশক জুড়ে সরকার প্রচলিত ব্যবস্থার পাশাপাশি ইসলামী আর্থিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে থাকে। ১৯৯০ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জিত হয়, যখন Shell MDS বিশ্বের প্রথম সুকুক বা ইসলামী বন্ড মালয়েশিয়ায় ইস্যু করে। এতে ১২৫ মিলিয়ন রিঙ্গিত সংগ্রহ করা হয় এবং শরীয়াহ-সম্মত মূলধনবাজারের নতুন পথ উন্মুক্ত হয়। নব্বইয়ের শেষভাগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ কমিশনে বিশেষ শরীয়াহ উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়, যাতে ইসলামী ব্যাংকিং ও মূলধন বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একই সময়ে ইসলামী আন্তঃব্যাংক অর্থবাজার চালু করা হয়, যাতে ইসলামী ব্যাংকগুলো তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে পারে। মাহাথির এসব উদ্যোগকে সমর্থন করেন, কারণ এগুলো তাঁর কল্পিত অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল ইসলামী রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ইসলাম উন্নয়নের অন্তরায় নয়। মুসলমানরা আধুনিক কাঠামোর মধ্যেও সফল হতে পারে এবং তিনি নীতির মাধ্যমে তা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।

ইসলামী অর্থনীতি সম্প্রসারণের রাজনৈতিক যুক্তি ছিল বহুমুখী। একদিকে এটি মুসলিম নাগরিকদের ধর্মীয়-অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করে। তারা যাতে বিশ্বাস অনুযায়ী ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ করতে পারে, সে সুযোগ তৈরি হ। অন্যদিকে মালয়েশিয়াকে একটি বৈশ্বিক ইসলামী আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করত, যা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মূলধন আকর্ষণ করত।

এই কৌশলের দীর্ঘমেয়াদি সুফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে মালয়েশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুকুক ইস্যুকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। একই সঙ্গে দেশটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ইসলামী ব্যাংকিং খাত গড়ে তোলে। বর্তমানে মালয়েশিয়ার প্রায় ৪৫ শতাংশ অর্থায়ন ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হয়। দেশটি ধারাবাহিকভাবে ইসলামী অর্থনীতি উন্নয়ন সূচকে শীর্ষে থাকে।

১৯৯৭–৯৮ এশিয়ান আর্থিক সংকট: আইএমএফকে অস্বীকার করে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। এটি ছিল এশিয়ান আর্থিক সংকট। ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন আঞ্চলিক মুদ্রার অস্থিরতা দেখা দেয়, মালয়েশিয়াও প্রতিবেশী দেশগুলোর মতোই গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রিঙ্গিতের মান দ্রুত পতন ঘটে, শেয়ারবাজার প্রায় অর্ধেক ধসে পড়ে এবং বিপুল মূলধন দেশ থেকে বেরিয়ে যায়। ১৯৯৮ সালের শুরুর দিকে মালয়েশিয়ার জিডিপি প্রবলভাবে সংকুচিত হচ্ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অত্যন্ত কমে গিয়েছিল।

অনেক পর্যবেক্ষক ধারণা করেছিলেন মালয়েশিয়াও থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আইএমএফের সহায়তা চাইবে এবং কঠোর মিতব্যয়ী নীতি গ্রহণ করবে। সত্যিই, প্রথমদিকে উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে সরকার সুদের হার বৃদ্ধি ও সরকারি ব্যয় কমানোর মতো আইএমএফ-ধাঁচের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মাহাথির ক্রমশ এসব পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। তিনি মনে করছিলেন এগুলো মন্দাকে আরও গভীর করছে এবং দেশের অর্থনৈতিক নীতির নিয়ন্ত্রণ বিদেশি ঋণদাতাদের হাতে চলে যাচ্ছে।

১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি মাহাথির নাটকীয়ভাবে আনোয়ারকে সরিয়ে দেন এবং একেবারে ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মালয়েশিয়া আইএমএফের সহায়তা নেবে না, বরং নিজস্বভাবে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে।

১৯৯৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া রিঙ্গিতের বিনিময় হার মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৩.৮০ নির্ধারণ করে এবং বিদেশে রিঙ্গিত লেনদেন নিষিদ্ধ করে। এর ফলে জল্পনাকারীদের মূলধন পালানোর পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগের ওপর এক বছরের জন্য উত্তোলন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় (পরে তা উত্তোলনের ওপর কর ধার্য করে পরিবর্তন করা হয়)। একই সময়ে আইএমএফের নির্দেশনার বিপরীতে সুদের হার কমানো হয়, যাতে ব্যাংক ঋণ বাড়াতে পারে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হয়। মাহাথির স্পষ্ট করে বলেন যে আইএমএফের সহায়তা প্রত্যাখ্যান করার মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক নীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং কঠোর মিতব্যয়ী পদক্ষেপ এড়ানো। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আইএমএফ-নির্ধারিত নীতির কারণে মন্দা আরও গভীর হয়েছে এবং সেখানে ব্যাপক বেকারত্ব ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়া সেই পথ এড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।

মাহাথিরের এই নীতি শুরুতে সমালোচিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ফিরবে না। কিন্তু বাস্তবে দ্রুত স্থিতিশীলতা আসে। নির্ধারিত বিনিময় হার রিঙ্গিতের পতন থামিয়ে দেয়। ব্যবসার জন্য নিশ্চয়তা তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে সহজ করার দিকে মনোযোগ দিতে পারে। মূলধনের দেশত্যাগ বন্ধ হওয়ায় রিজার্ভ রক্ষা পায় এবং নতুন করে জল্পনামূলক আক্রমণ প্রতিরোধ হয়।

১৯৯৮ সালে অর্থনীতি ৭.৪ শতাংশ সংকুচিত হলেও ১৯৯৯ সালে প্রবৃদ্ধি ফিরে আসে ৬.১ শতাংশে। তা-ও আইএমএফ ঋণ ছাড়াই। এই সাফল্য মাহাথিরের অবস্থানকে অনেকের চোখে বৈধতা দেয়। পরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করে যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অস্থায়ী পুঁজি নিয়ন্ত্রণ বৈধ নীতি হতে পারে। পল ক্রুগম্যানের মতো অর্থনীতিবিদও মন্তব্য করেন যে মালয়েশিয়ার বিকল্প প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিকে গভীর ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে এবং তা পরে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তুলনায় ইন্দোনেশিয়ার আইএমএফ কর্মসূচি এতটাই কঠোর ছিল যে ১৯৯৮ সালে অর্থনীতি ১৩ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে প্রেসিডেন্ট সুহার্তোকে ক্ষমতাচ্যুত করে। মালয়েশিয়া আইএমএফের শর্ত এড়িয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় থেকেও রক্ষা পায়।

রাজনৈতিকভাবে সংকট শুরুর ১৪ মাস পর পুঁজি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা নেতৃত্বের এক দৃঢ় প্রকাশ ছিল। এটি মন্ত্রিসভার প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আনোয়ার ইব্রাহিমকে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করা, যিনি এসব নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। বিতর্ক সত্ত্বেও ফলাফল স্পষ্ট ছিল। মালয়েশিয়া অধিকাংশ প্রতিবেশীর তুলনায় দ্রুত সংকট থেকে বেরিয়ে আসে। কোনো আইএমএফ ঋণ বা শর্ত ছাড়াই এবং মৌলিক শিল্প অক্ষত রেখেই। এই ঘটনাই স্পষ্টভাবে তুলে ধরে মাহাথির ফর্মুলা। বৈশ্বিক প্রচলিত নীতিকে অগ্রাহ্য করার সাহস এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক সংহতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

বেসরকারীকরণ ও রাষ্ট্র-সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান: রাষ্ট্র ও বাজারের মধ্যে ভারসাম্য

মাহাথিরের অর্থনৈতিক কৌশলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনা ও বেসরকারি খাতের দক্ষতার বাস্তবসম্মত সমন্বয়। এর প্রতিফলন ঘটে তাঁর বেসরকারীকরণ কর্মসূচি এবং রাষ্ট্র-সংযুক্ত কোম্পানি বা GLC (Government-Linked Companies) গঠনের মাধ্যমে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়ায় টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, মহাসড়ক থেকে শুরু করে এয়ারলাইন্স পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ করা হয়।

সরকারের দাবি ছিল যে “বেসরকারি খাত-নির্ভর প্রবৃদ্ধি” সেবার মান উন্নত করবে এবং সরকারি আর্থিক বোঝা হ্রাস করবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারীকরণ মানে এই নয় যে রাষ্ট্র পুরোপুরি ব্যবসা থেকে সরে গেছে। বরং প্রায়ই দেখা গেছে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে করপোরেট রূপ দেওয়া হয়েছে, আংশিক শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়েছে, কিন্তু সরকার বা বুমিপুত্রা ট্রাস্ট সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধরে রেখেছে। এর ফলে রাষ্ট্র-সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্থান ঘটে, যেখানে সরকার হয় শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বা রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করত।

Petronas (তেল), Tenaga Nasional (বিদ্যুৎ), Telekom Malaysia এবং POS Malaysia-এর মতো কোম্পানিগুলো করপোরেট কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তবে এসব খাতে সরকার প্রধান অংশীদার বা নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়ে যায়। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সার্বভৌম সম্পদ তহবিল Khazanah Nasional, যা এসব বিনিয়োগ সরকারের পক্ষে পরিচালনা করে।

বেসরকারীকরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল অদক্ষ ও লোকসানী সরকারি সংস্থাগুলোকে বাজারের শৃঙ্খলার আওতায় আনা। এর ফলে উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল। পাশাপাশি বিক্রির অর্থ দিয়ে সরকারের ঋণ কমানো সম্ভব হবে, যা আশির দশকে জিডিপির শতভাগেরও বেশি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মাহাথিরের সংস্কারের পর বাজেট ঘাটতি হ্রাস পায় এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সরকার উদ্বৃত্ত বাজেট চালাতে সক্ষম হয়। বেসরকারি খাতের জিডিপিতে অংশও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

রাজনৈতিকভাবে বেসরকারীকরণ ছিল একটি কৌশল। এর মাধ্যমে New Economic Policy-এর লক্ষ্য অর্থাৎ বুমিপুত্রা ব্যবসায়ী শ্রেণি গড়ে তোলা সম্ভব হয়। অনেক বেসরকারীকৃত চুক্তি বা লাইসেন্স শাসক দলের ঘনিষ্ঠ মালয় ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়। এতে রাজনীতি ও ব্যবসা গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। মহাসড়ক নির্মাণ ছিল এর একটি উদাহরণ। বেসরকারি ঠিকাদাররা দীর্ঘমেয়াদি ও লাভজনক টোল চুক্তি পেত, প্রয়োজনে সরকারি সাহায্যও পেত। এর ফলে এক শ্রেণির “কর্পোরেট মালয়” ব্যবসায়ী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা সরকারি সুবিধার মাধ্যমে উপকৃত হতো। সমালোচকরা একে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বলে অভিহিত করেন। অর্থনীতিবিদ জোমো কে এস মন্তব্য করেছিলেন যে মাহাথির আমলে অনেক সময় “privatization” আসলে “piratization” ছিল। জনগণের সম্পদ সস্তায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হতো এবং সংকটকালে রাষ্ট্র উচ্চমূল্যে আবার তা কিনে নিত।

তবুও মাহাথিরের বেসরকারীকরণ ও রাষ্ট্র-সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান কৌশলের সামগ্রিক প্রভাব মূলত ইতিবাচক ছিল। এর ফলে মালয়েশিয়ায় আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, দক্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সম্প্রসারিত পরিবহন অবকাঠামো গড়ে ওঠে। Petronas-এর মতো কিছু প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং সরকারকে বিপুল রাজস্ব প্রদান করে।

Malaysia Incorporated নীতি, যা সরকার ও ব্যবসার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা তৈরি করেছিল, জাপানের keiretsu মডেলের অনুকরণে গড়ে তোলা হয়। এর ফলে বৃহৎ প্রকল্পে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়। যদিও এতে স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং দুর্নীতি দেখা দেয়, তবুও সরকারকে জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে বেসরকারি খাতকে কাজে লাগানোর সুযোগ দেয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় মালয়েশিয়া একটি তুলনামূলক ভালো ভারসাম্য অর্জন করে। ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির চেয়ে এটি বেশি বাজারভিত্তিক, আর ফিলিপাইনের মতো ল্যাসে-ফেয়ার মডেলের চেয়ে বেশি রাষ্ট্র-সমন্বিত। এই মধ্যপন্থা মালয়েশিয়াকে অবকাঠামোতে কম বিনিয়োগের সমস্যা থেকে রক্ষা করে এবং একই সঙ্গে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অদক্ষতাও এড়াতে সাহায্য করে। এটিই মাহাথির যুগে টেকসই প্রবৃদ্ধির অন্যতম মূল রহস্য।

দ্বিতীয় মেয়াদ (২০১৮–২০২০): সংস্কার, কৃচ্ছ্রসাধন ও যৌথ সমৃদ্ধি

৯২ বছর বয়সে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসেন মাহাথির। এতে তিনি মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনায় আবারও প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পান। তবে প্রেক্ষাপট ছিল একেবারেই ভিন্ন। এ সময় তিনি একটি মধ্যম আয়ের এবং বহুমুখীকৃত অর্থনীতি উত্তরাধিকারসূত্রে পান, যা নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। সরকারি ঋণ ছিল এক ট্রিলিয়ন রিঙ্গিতেরও বেশি (দায়সহ)। পাশাপাশি ছিল 1MDB দুর্নীতির কেলেঙ্কারির প্রভাব এবং প্রবৃদ্ধি শ্লথ হওয়া ও বৈষম্যের উদ্বেগ।

একটি সংস্কারবাদী জোট Pakatan Harapan নেতৃত্ব দিয়ে মাহাথির দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলকে পরাজিত করে। ক্ষমতায় এসে তিনি প্রথমেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের দিকে মনোযোগ দেন। 1MDB কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু করেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এর মাধ্যমে তিনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে Council of Eminent Persons গঠন করেন।

দ্বিতীয় দফায় মাহাথির ব্যয়সংকোচন ও অগ্রাধিকারের ওপর জোর দেন। এটি ছিল নব্বইয়ের দশকের তাঁর বিলাসী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর প্রায় বিপরীত। তিনি যুক্তি দেন অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো জরুরি। তাই পূর্ববর্তী সরকারের শুরু করা একাধিক মেগা প্রকল্প বাতিল বা পুনর্বিবেচনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়ালালামপুর–সিঙ্গাপুর হাই-স্পিড রেল প্রকল্প বাতিল করা হয়। মাহাথির যুক্তি দেন এটি “লাভজনক নয়, আমাদের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে, কিন্তু এর থেকে আয় হবে না।” আরেকটি বড় প্রকল্প, চীন-সমর্থিত ইস্ট কোস্ট রেল লিংক, স্থগিত করে পরে কম খরচে পুনঃআলোচনা করা হয়।

দেশীয়ভাবে সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে বহুল সমালোচিত GST (Goods and Services Tax) বাতিল করে। এর পরিবর্তে চালু করা হয় সহজতর সেলস ট্যাক্স। যদিও এতে সরকারি আয় স্বল্পমেয়াদে হ্রাস পায়, তবুও এটি জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয় এবং ভোগ ব্যয় বাড়াতে সহায়ক হয়।

যৌথ সমৃদ্ধি ভিশন ২০৩০

মাহাথিরের সংক্ষিপ্ত দ্বিতীয় মেয়াদের অন্যতম প্রধান উদ্যোগ ছিল ২০১৯ সালের শেষ দিকে Shared Prosperity Vision 2030 (SPV 2030) চালু করা। স্বীকার করা হয়েছিল যে Vision 2020-এর উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জিত হয়নি, বিশেষ করে সমবণ্টনের ক্ষেত্রে। তাই নতুন এই রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে সকল মালয়েশিয়ানকে একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনমান প্রদান এবং দেশটিকে আবারও “নতুন এশিয়ান টাইগার” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, আয় ও সম্পদের বৈষম্য হ্রাস এবং নতুন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্র চিহ্নিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। উদ্বোধনী ভাষণে মাহাথির বলেন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে “ক্যানসারের মতো অঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে” দূর করতে হবে।

SPV 2030 মূলত অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও সুশাসন সংস্কারকে একত্রিত করে। এতে অতীতের অতিরিক্ততা ও বৈষম্য থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়। এটি ছিল মাহাথিরের বিদায়ী ভিশন যাতে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে সমৃদ্ধি সৃষ্টি করেছিলেন তা টেকসই হবে এবং আরও সমভাবে বণ্টিত হবে।

২০২০ সালের মার্চে রাজনৈতিক পুনর্গঠন এবং একই সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারির সূচনার কারণে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ সংক্ষিপ্ত হয়। মাত্র ২১ মাসে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ফলাফল অর্জিত না হলেও এটি প্রমাণ করে স্বল্প সময়ে পরিবর্তন আনা কতটা কঠিন। তবে প্রতীকীভাবে তাঁর প্রত্যাবর্তন উন্নয়ন দর্শনের স্থায়ী প্রভাবকে তুলে ধরে। তিনি মালয়েশিয়াকে আর্থিক শৃঙ্খলা ও নৈতিক নেতৃত্বের দিকে পুনরায় মনোযোগী করেন। তাঁর মতে, উত্তরসূরীরা যে শৃঙ্খলাবদ্ধ উন্নয়নের পথ থেকে সরে গিয়েছিল তা সংশোধন করার চেষ্টা করেন তিনি।

মাহাথির মোহাম্মদের মোট ২৪ বছরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া এক অসাধারণ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। একটি স্বল্প আয়ের পণ্য রপ্তানিকারক দেশ থেকে এটি পরিণত হয় এক বহুমুখী, উচ্চ-মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে। ১৯৮০ সালে মাথাপিছু জিডিপি যেখানে প্রায় ১,৮০০ ডলার ছিল, তা ২০০০ সালের শুরুর দিকে ৯,০০০ ডলারেরও বেশি হয়ে যায়। দারিদ্র্যের হার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। শতাব্দীর শুরুতে মালয়েশিয়া শুধু রাবার ও পাম তেল নয়, মাইক্রোচিপ ও গাড়িও উৎপাদন করছিল। জনগণ উন্নত দেশের মানসম্মত অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে। মাহাথিরের শাসনামল মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভূদৃশ্যকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে। এজন্য তিনি উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে খ্যাতি পান। দেশীয়ভাবে তিনি “Father of Modernisation” নামে পরিচিত হন। গুরুত্বপূর্ণ হলো, মাহাথির সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও কখনো কখনো কর্তৃত্ববাদী পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, তবে এই স্থিতিশীলতাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছিল।মাহাথির মোহাম্মদের অধীনে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক রূপান্তরের রহস্য ছিল দূরদর্শী পরিকল্পনা, রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ ও অভিযোজিত বাস্তববাদের সমন্বয়ে। তিনি একদিকে বৃহৎ ধারণা যেমন জাতীয় ভিশন, অবকাঠামো বিনিয়োগ ও সামাজিক প্রকৌশলকে কাজে লাগিয়েছেন, অন্যদিকে নীতিতে নমনীয়তা দেখিয়ে কখনো রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, কখনো বাজারমুখী সংস্কার গ্রহণ করেছেন। প্রয়োজনে প্রচলিত বৈশ্বিক নীতি ভেঙে গিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি আমন্ত্রণ করেছেন।

এই দ্বৈত কৌশল—একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ও বৈশ্বিক, প্রচলিত ও অপ্রচলিত—মালয়েশিয়ার অনন্য প্রেক্ষাপটে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং দেশটি একদিকে উৎপাদনশীল শিল্পশক্তি, অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতির বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

আজ মাহাথির যখন ২০২৫ সালে শতবর্ষে পা রাখছেন, সমালোচকরাও স্বীকার করেন যে তিনি মালয়েশিয়াকে রূপান্তরিত, আধুনিকায়িত, শিল্পায়িত এবং শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত করেছেন। তাঁর উত্তরাধিকার জটিল হলেও এটি নিঃসন্দেহে এক মূল্যবান পাঠ, যেখানে অর্থনৈতিক কৌশল ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির সমন্বয়ে জাতি গঠনের দিশা খুঁজে পাওয়া যায়।


দাদা-দাদী-নানা-নানীর অতিরিক্ত আদরে বাড়ছে 'সিক্স পকেট সিনড্রোম', জানুন বিস্তারিত

২০২৫ নভেম্বর ২৩ ১৩:১৬:৩২
দাদা-দাদী-নানা-নানীর অতিরিক্ত আদরে বাড়ছে 'সিক্স পকেট সিনড্রোম', জানুন বিস্তারিত
ছবি: সংগৃহীত

শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজে গত দুই দশকে শিশু লালন-পালনের ধরনে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পরিবার ছোট হচ্ছে, সন্তান সংখ্যা কমছে, কর্মজীবী বাবা-মায়ের উপস্থিতি বাড়ছে এবং যৌথ পরিবারের ভূমিকা পুনর্নির্মিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রেই জন্ম নিয়েছে নতুন একটি সামাজিক–মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা, যার নাম “Six Pocket Syndrome” বা ছয় পকেট সিনড্রোম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে শিশুকে কেন্দ্র করে ছয়জন অভিভাবকের (বাবা, মা, দাদা, দাদী, নানা, নানী) ভালোবাসা, অর্থনৈতিক সমর্থন, উপহার, মনোযোগ ও সুযোগ অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবাহিত হতে থাকে।

এই সিনড্রোম একদিকে শিশুর জীবনকে আনন্দময় ও বিলাসিতায় ভরিয়ে তুললেও, অন্যদিকে তার ব্যক্তিত্ব গঠন, দায়িত্ববোধ ও মানসিক শক্তিকে বিপজ্জনকভাবে দুর্বল করে দেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা জানান, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে সাংস্কৃতিকভাবে সন্তানকে অত্যাধিক আদর করার প্রবণতা আগে থেকেই প্রবল, সেখানে সিক্স পকেট সিনড্রোমের বিস্তার আরও দ্রুত হচ্ছে।

শিশুকে কেন্দ্র করে ছয় পকেটের অদৃশ্য বৃত্ত

প্রথাগত বড় পরিবারে সন্তানকে ভালোবাসেন অনেকেই, কিন্তু আধুনিক নিউক্লিয়ার পরিবারে যখন একমাত্র সন্তান থাকে, তখন তার চারপাশে তৈরি হয় এক বিরাট নিরাপত্তা–সুবিধা–স্নেহ–আর্থিক প্রাচুর্যের বৃত্ত।

এই বৃত্ত তৈরি হয় ছয়জন প্রাপ্তবয়স্কের আর্থ-সামাজিক শক্তি থেকে - বাবা, মা, দাদা, দাদী, নানা, নানী।

শিশুটি এই ছয়জনের আর্থিক “পকেট” থেকে যা চায়, তা পেয়ে যায়। ফলাফল শিশুর চারপাশে তৈরি হয় অতিরিক্ত সুবিধা ও অতিরিক্ত প্রাচুর্যের অভ্যস্ততা, যা তার জীবনদর্শন, আচরণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য, আবেগীয় পরিপক্বতা সব কিছুকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত করে ফেলে।

একটি বাস্তবচিত্র: একমাত্র সন্তান রাজ

এই প্রবণতা বোঝার জন্য একটি সাধারণ উদাহরণ যথেষ্ট।ধরা যাক, একটি শিশু রাজ। রাজের বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবী এবং দুজনেই পরিবারে একমাত্র সন্তান। ফলে রাজের চারজন দাদা-দাদী–নানা-নানী আছেন, যাঁরা রাজের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে চান। পরিবারের প্রতিটি মানুষই আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।

রাজের যে কোনো চাহিদা নতুন জামা, দামি খেলনা, মোবাইল, ট্যাব, ভিডিও গেম, বাইরে ঘুরতে যাওয়া, পার্টি, কোচিং, বিশেষ ক্লাস সঙ্গে সঙ্গে পূরণ হয়ে যায়।

রাজ কোনো ইচ্ছা মনে মনে করার আগেই বাস্তবে পেয়ে যায়। মন একটু খারাপ হলে দিদা খেলনা দেন, বাবা খাবার নিয়ে আসেন, নানী নতুন জামা দেন, দাদা তাকে ঘুরতে নিয়ে যান।

ধীরে ধীরে রাজ বুঝতে শেখে “আমি চাইলে পাই। আমি যা বলি, তা হবেই।” এই মানসিক কাঠামোই হলো সিক্স পকেট সিনড্রোমের সূচনা।

অতিরিক্ত সুবিধা কীভাবে শিশুর মানসিক বিকাশকে বিকৃত করে?

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশুর বিকাশের জন্য শুধু ভালোবাসা নয়- সীমাবদ্ধতা, শৃঙ্খলা, অপেক্ষা করা, ব্যর্থতা মোকাবিলা ও দায়িত্ব পালন এসব শেখাও জরুরি।

কিন্তু সিক্স পকেট সিনড্রোমে সন্তান এগুলো থেকে বঞ্চিত হয়।

১. ধৈর্য ও অপেক্ষার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে

শিশু মনে করে সবকিছু “এখনই” চাই। জীবনের বাস্তব সংগ্রাম তাকে ভয় পাইয়ে দেয়।

২. সহানুভূতি দুর্বল হয়

কেউ কষ্ট পাচ্ছে, অপেক্ষা করছে, অভাবে আছে—এসব অনুভব করার ক্ষমতা কমে যায়।

৩. ব্যর্থতার ভীতি তৈরি হয়

সামান্য পরীক্ষায় খারাপ ফল, খেলায় হেরে যাওয়া, বন্ধুর সঙ্গে সমস্যা—এসবই তাকে অস্থির করে তোলে।

৪. ‘না’ শুনতে পারে না

যে কারণে শিক্ষাজীবন, পেশাজীবন ও ব্যক্তিজীবনে সে বাস্তবতার সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়।

৫. ভোগবাদী মানসিকতা তৈরি হয়

এই ভুল ধারণায় সে আবেগীয় পরিপক্বতা হারায়।

৬. আত্মনিয়ন্ত্রণ কমে

সময় মেনে কাজ করা, পড়া, নিজের জিনিস নিজের হাতে রাখা—এসব অভ্যাস গড়ে ওঠে না।

সমাজে এর প্রভাব

এই সিনড্রোম শুধু পরিবার নয়, সমাজের ভবিষ্যৎ কর্মশক্তির ওপরও প্রভাব ফেলে।সিক্স পকেট সিনড্রোম আক্রান্ত শিশুরা-

  • বাস্তব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে
  • মানসিক চাপ সহ্য করতে পারে না
  • দায়িত্ব নেওয়া শিখে না
  • দলগতভাবে কাজ করতে সমস্যা বোধ করে
  • ‘অভিযোগমূলক মানসিকতা’ তৈরি হয়

মনোবিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন- এমন শিশুরাই বড় হয়ে সহজে হাল ছেড়ে দেওয়া, হতাশায় ভুগা, আত্মকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি সমস্যায় পড়ার ঝুঁকি বেশি।

কেন এই সিনড্রোম দ্রুত বাড়ছে?

১. ছোট পরিবার–এক সন্তান নীতি

একটি পরিবারে যখন একটিই সন্তান থাকে, তখন তার দিকে সবাই ঝুঁকে যায়।

২. কর্মজীবী বাবা-মায়ের অপরাধবোধ

সময় দিতে না পারার বদলে তাঁরা বস্তুগত উপহার দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে চান।

৩. দাদা-দাদী-নানী-নানার আবেগীয় দুর্বলতা

তাদের কাছে নাতি–নাতনি মানেই খালি হাত ভরা।

৪. বাড়তি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা

পরিবারে অনেকেরই আয় থাকায় শিশুর চারপাশে অতি-প্রাচুর্য সৃষ্টি হয়।

৫. সামাজিক প্রতিযোগিতা

অনেকে মনে করেন, “বাচ্চাকে সেরা জিনিস দিলেই সে সেরা হবে।”ফলে উপহার, টিউশন, কোচিং, ক্লাস, ডিভাইস সবই অতিরিক্ত মাত্রায় দেওয়া হয়।

সমাধান: ভালোবাসার সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা

১. “না” বলার সাহস রাখুন

সব অধিকার দিলে শিশু অধিকার চিনতে শেখে না।

২. দায়িত্ব দিন

নিজের বিছানা, ঘর, জিনিসপত্র, স্কুলব্যাগ—এসবের দায়িত্ব পালন করতে দিন।

৩. উপহারের বদলে অভ্যাস শেখান

প্রচেষ্টা, সময়ানুবর্তিতা, অধ্যবসায়ের প্রশংসা করুন।

৪. ভাগাভাগি ও শেয়ারিং শেখান

এটি সামাজিক বিকাশের মূল চাবিকাঠি।

৫. পারিবারিক নীতিতে সবাইকে এক করুন

দাদা-দাদী/নানা-নানী যেন “গোপনে সবকিছু দিয়ে দেওয়ার” নীতি না নেন।

৬. আত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ শেখান

জীবনের সত্যিকারের সফলতা পাওয়া থেকে নয়শেখা, চেষ্টা, সততা, শৃঙ্খলা ও ধৈর্য থেকে আসে।

সিক্স পকেট সিনড্রোম ভালোবাসার অতিরিক্ততার ফল। কিন্তু শিশুকে শুধু সুবিধা দেওয়া নয় নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া যেটি অনেক বেশি মূল্যবান।


বিশ্বের ১০ দামী খাবার, চোখ কপালে তোলার মতো মূল্য

২০২৫ নভেম্বর ২৩ ১২:৪৪:৪০
বিশ্বের ১০ দামী খাবার, চোখ কপালে তোলার মতো মূল্য
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের খাদ্যসংস্কৃতিতে বিলাসিতা ও দুর্লভতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে একদল বিশেষ খাবার। গ্যাস্ট্রোনমির এই শীর্ষ তালিকায় সবচেয়ে দামী খাবার হিসেবে রয়েছে আলমাস ক্যাভিয়ার, যার মূল্য কেজি প্রতি দাঁড়ায় প্রায় ৩৪ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। বিরল অ্যালবিনো বেলুগা স্টারজিয়নের ডিম থেকে তৈরি এই ক্যাভিয়ারকে অনেকেই ‘ডায়মন্ড অফ দ্য ক্যালিনারি ওয়ার্ল্ড’ বলে থাকেন।

তবে শুধু ক্যাভিয়ারই নয় দুর্লভতা, প্রাকৃতিক scarcity, পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা এবং শ্রমনির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে আরও বেশ কয়েকটি খাবার অসাধারণ উচ্চমূল্যে জায়গা করে নিয়েছে। এগুলো শুধু খাবার নয় বরং ঐতিহ্য, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ধৈর্যের মিশেলে তৈরি একেকটি বৈশ্বিক খাদ্য উত্তরাধিকার।

হোয়াইট ট্রাফল: মাটির নিচের সাদা সোনা

ইতালির পাহাড়ি বনভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এই সুগন্ধি মাশরুমকে খুঁজে পেতে প্রশিক্ষিত কুকুরের দরকার হয়। এটি কৃত্রিমভাবে উৎপাদন সম্ভব নয়, যা এর দাম প্রতি পাউন্ডে কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যায়। অনন্য ঘ্রাণ এবং গভীর স্বাদের জন্য ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁগুলোতে এর চাহিদা তুঙ্গে।

সাফরন: গোলাপের সুতোয় গড়া সোনালি মসলা

এক পাউন্ড শুকনো সাফরন তৈরি করতে লাগে ৫০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ ফুল। প্রতিটি ফুল থেকে হাতে সংগ্রহ করতে হয় মাত্র তিনটি লালচে স্টিগমা। এ কারণেই সাফরন বিশ্বের সবচেয়ে দামী মসলার মুকুট ধরে রেখেছে।

ব্লুফিন টুনা: সামুদ্রিক নিলামে মিলিয়ন ডলারের হুল্লোড়

জাপানের Tsukiji নিলামে এ মাছের দাম কয়েক মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উঠেছে। বিশেষত ওতোরো অংশ যেখানে ফ্যাটের marbling চোখে পড়ার মতো সুশি ও সাশিমি প্রেমীদের কাছে অপরিসীম আকর্ষণীয়।

ওয়াগিউ ও কোবে বিফ: মার্বেল টেক্সচারের বিলাসী মাংস

জাপানি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পালিত গরুর এই মাংসের marbling, butter-like texture এবং অপূর্ব স্বাদ বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। বিশেষ ডায়েট ও যত্নের কারণে এর দাম প্রতি পাউন্ডে কয়েকশো ডলার ছুঁয়ে যায়।

মাতসুতাকে মাশরুম: প্রকৃতির লুকানো রত্ন

জাপানে সাংস্কৃতিকভাবে মূল্যবান এই সুগন্ধি মাশরুম পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে। চাষ সম্ভব না হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো অল্প সংখ্যক মাশরুমই আন্তর্জাতিক বাজারে আসে, যার দাম লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়।

আইবেরিকো হ্যাম: স্পেনের বুকে অ্যাকর্ন-ফেড রাজকীয় স্বাদ

মুক্তচারণে বেড়ে ওঠা আইবেরিয়ান শূকর শুধুমাত্র অ্যাকর্ন খেয়ে বড় হয়। কয়েক বছরের ধীর curing প্রক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় গভীর স্বাদযুক্ত, melt-in-mouth টেক্সচারের জ্যামন আইবেরিকো—বিশ্বের অন্যতম দামী হ্যাম।

মুজ চিজ: সুইডেনের একমাত্র খামারের সৃষ্টি

বিশ্বে মাত্র একটি ফার্মেই তৈরি হয় এই চিজ। মুজ দুধ সংগ্রহ কঠিন ও অতি সীমিত হওয়ায় এর দাম কেজিপ্রতি হাজার ডলারেরও বেশি।

বার্ড’স নেস্ট স্যুপ: লালচে সোনালি লালা-নির্মিত বিস্ময়

চীনা delicacy হিসেবে বিখ্যাত এই স্যুপ swiftlet পাখির লালা দিয়ে নির্মিত বাসা থেকে তৈরি হয়। দুর্গম পাহাড় থেকে বাসা সংগ্রহ করতে প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে পড়তে হয় সংগ্রাহকদের, যা এর মূল্য কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।

কপি লুওয়াক: সিভেটের পেটে ফারমেন্টেড কফির রাজা

এশীয় পাম সিভেট খেয়ে partially digest করে যে কফি বীজ বের করে, তা পরিশোধন করে তৈরি হয় Kopi Luwak। বলা হয়, সিভেটের হজমপ্রক্রিয়ায় বিশেষ fermentation স্বাদের গভীরতা তৈরি করে যা প্রতি কেজিতে কয়েক হাজার ডলার মূল্য অর্জন করে।


অস্ট্রিচ কেন পাথর খায় কারণ জানলে চমকে যাবেন

২০২৫ নভেম্বর ২২ ১৩:০৫:৩৬
অস্ট্রিচ কেন পাথর খায় কারণ জানলে চমকে যাবেন
ছবি: সংগৃহীত

দাঁত নেই—তবু কঠিন ঘাস, বীজ, শিকড়, এমনকি শক্ত ফাইবারও সহজেই হজম করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাখি অস্ট্রিচ। এ ক্ষমতার পেছনে রয়েছে এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক কৌশল, যার নাম গিজার্ড স্টোন বা গ্যাস্ট্রোলিথ। অস্ট্রিচ সচেতনভাবেই ছোট পাথর গিলে ফেলে, যা পরে তার গিজার্ডে গিয়ে “অভ্যন্তরীণ দাঁত” হিসেবে কাজ করে। সাম্প্রতিক গবেষণা আবারও দেখিয়েছে, এই পাথরগুলোই অস্ট্রিচের পুরো হজমব্যবস্থার কেন্দ্রীয় শক্তি।

অস্ট্রিচসহ অনেক পাখি, এমনকি কিছু সরীসৃপ এবং প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরও গ্যাস্ট্রোলিথ ব্যবহার করত। দাঁত না থাকায় অস্ট্রিচকে নির্ভর করতে হয় অত্যন্ত শক্তিশালী গিজার্ডের ওপর, যেখানে প্রবেশ করা খাদ্য পাথরের সঙ্গে ঘর্ষণ হয়ে চূর্ণ হয়ে যায়। গিজার্ডের পেশির শক্ত সংকোচন পাথরগুলোকে একে অন্যের সঙ্গে ঘষে, ফলে তন্তুযুক্ত ঘাস, শক্ত বীজ ও রুট সহজেই ভেঙে যায়। এভাবে খাদ্য ছোট ছোট টুকরায় পরিণত হয়ে পুষ্টি শোষণের উপযোগী হয়।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, একটি পূর্ণবয়স্ক অস্ট্রিচের গিজার্ডে প্রায় এক কিলোগ্রাম পর্যন্ত পাথর থাকতে পারে। তবে পাথরগুলো সবসময় কার্যকর থাকে না। ঘর্ষণে ক্রমশ মসৃণ হয়ে গেলে এগুলো হজমনালী দিয়ে বেরিয়ে যায় বা কখনো কখনো উঠিয়েও ফেলে পাখিটি। এরপর তারা মাঝারি আকারের নতুন পাথর খুঁজে গিলে ফেলে, যাতে আবারও কার্যকরভাবে খাদ্য চূর্ণ করা যায়। খামারে অস্ট্রিচ পালনকারীরা তাই পাখিদের জন্য বিশেষ খাবার-গ্রিট সরবরাহ করেন, যাতে স্বাস্থ্যকর হজমপ্রক্রিয়া বজায় থাকে।

এ গবেষণা দেখিয়েছে, যদি অস্ট্রিচ পর্যাপ্ত গিজার্ড স্টোন না পায়, তবে তার হজমব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এতে দেখা দিতে পারে অপুষ্টি, পাচনতন্ত্রের বাধা, এমনকি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও। তাই এই পাথরগুলো তাদের বেঁচে থাকা ও পুষ্টি গ্রহণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

অস্ট্রিচের গ্যাস্ট্রোলিথ ব্যবহারের এই প্রাকৃতিক কৌশল শুধু পাখিটির অভিযোজনশক্তিকে তুলে ধরে না, বরং প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কেও বিজ্ঞানীদের নতুন সূত্র দেয়। দাঁত ছাড়াই কীভাবে শক্ত খাদ্য হজম হতো-তার এক জীবন্ত উদাহরণ আজকের অস্ট্রিচ।


আগ্নিবলয় বনাম খনিজভাণ্ডার: দুই রিং অফ ফায়ারের রহস্য

২০২৫ নভেম্বর ২২ ১২:৪৯:২৪
আগ্নিবলয় বনাম খনিজভাণ্ডার: দুই রিং অফ ফায়ারের রহস্য
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় চল্লিশ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ একটি অশ্বখুরাকৃতি আগ্নেয় ও ভূকম্পন বেল্ট ঘিরে রেখেছে পুরো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে। দক্ষিণ আমেরিকার আগ্নেয় পর্বতমালা থেকে শুরু হয়ে এটি উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, আলাস্কার বেয়ারিং স্ট্রেইট, তারপর রাশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া হয়ে দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত।

এই ভয়াবহ ভূত্বকীয় অঞ্চলটিই বিশ্বব্যাপী পরিচিত “আগ্নিবলয়” বা Pacific Ring of Fire নামে। এর বিস্তৃতি, গঠন ও ভূমিকম্প-প্রবণতা একে পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক বেল্টে পরিণত করেছে।

এই অঞ্চলকে বিপজ্জনক করে তুলেছে প্রধানত টেকটোনিক প্লেটের ধারাবাহিক সংঘর্ষ। প্যাসিফিক প্লেট পৃথিবীর বিভিন্ন প্লেটের নিচে ঢুকে যায়, যা সাবডাকশন নামে পরিচিত। প্লেটের এই নিমজ্জন প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় গভীর সমুদ্র খাদ, বিশাল ফল্ট লাইন এবং আগ্নেয়গিরির দীর্ঘ শৃঙ্খল। ফলস্বরূপ প্রতি বছর ছোট-বড় অসংখ্য ভূমিকম্প এই অঞ্চলে ঘটে, এবং বিশ্বের প্রায় নব্বই শতাংশ ভূমিকম্প ও পঁচাত্তর শতাংশ সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ঠিক এই বলয়ের মধ্যেই অবস্থান করে।

পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর সমুদ্র খাদ Mariana Trench-ও এই অঞ্চলের অংশ, যা টেকটোনিক চাপের তীব্রতা নির্দেশ করে। এই কারণেই বৈশ্বিক ভূকম্পন গবেষণা, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত পূর্বাভাস এবং দুর্যোগ ঝুঁকি নিরূপণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে এই রিং অফ ফায়ার অঞ্চল।

বিশ্বের বিজ্ঞানীরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের কার্যকলাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, কারণ এখানকার ভূকম্পন ও আগ্নেয় কার্যকলাপ পৃথিবীর অন্য অংশগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। ভূমিকম্প, সুনামি এবং আগ্নেয় অগ্ন্যুৎপাতের পূর্বাভাস দিতে এই অঞ্চল থেকে সংগৃহীত তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বহু বিধ্বংসী ভূমিকম্প ও সুনামির উৎস এই রিং অফ ফায়ার, যা আজও বিশ্বের লাখো মানুষের দুর্যোগপ্রবণ বাস্তবতা নির্ধারণ করে।

অন্যদিকে কানাডার উত্তরাঞ্চলে থাকা Ontario Ring of Fire সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল। এটি জেমস বে লোল্যান্ডস এলাকায় অবস্থিত একটি ক্রিসেন্ট-আকৃতির খনিজসমৃদ্ধ এলাকা, যার সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের আগ্নেয় বেল্টের কোনো সম্পর্ক নেই। এই অঞ্চল ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির কারণে গঠিত হয়নি; বরং কোটি কোটি বছরের পুরোনো ভূস্তর, শিলার রূপান্তর এবং প্রাকৃতিক খনিজ জমার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে।

এখানেই রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ chromite ভাণ্ডার। পাশাপাশি nickel, copper, cobalt, platinum group metals ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজের বিপুল উপস্থিতি এই অঞ্চলকে নতুন অর্থনৈতিক মহাস্বপ্নে পরিণত করেছে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কারণে ওন্টারিও রিং অফ ফায়ারকে কানাডার ভবিষ্যৎ “Super Economic Zone” বলা হচ্ছে। খনিজ উত্তোলন ও শিল্পায়নের সম্ভাব্য বিনিয়োগ মূল্য মাল্টি–বিলিয়ন ডলার আয়তনে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি শিল্প এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনে নিকেল-ক্রোমাইট অমূল্য সম্পদ। এ কারণেই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারকদের নজরে দ্রুত গুরুত্ব বাড়ছে এই অঞ্চলটির।

এই দুটি অঞ্চল একই নাম বহন করলেও বাস্তবিক বিচারে তাদের মধ্যে গভীর পার্থক্য রয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ার গঠিত হয়েছে টেকটোনিক প্লেটের তীব্র সংঘর্ষ ও অস্থিরতার ফলে, যেখানে ভূমিকম্প-সুনামি মানুষের জীবন ও অবকাঠামোর জন্য স্থায়ী ঝুঁকি তৈরি করে।

বিপরীতে ওন্টারিও রিং অফ ফায়ার গঠিত হয়েছে ভূতাত্ত্বিক সম্পদের উপস্থিতির ভিত্তিতে, যা প্রাকৃতিকভাবে স্থিতিশীল হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে অমূল্য। একটিকে পৃথিবীর ভয়াবহ দুর্যোগ অঞ্চল বলা হয়, অন্যটি বিশ্ব খনিজশিল্পের ভবিষ্যৎ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।

এই দুই রিং অফ ফায়ার তাই একই নামের হলেও প্রকৃতি, গঠন ও গুরুত্বে একেবারেই ভিন্ন একটি বিপর্যয়ের প্রতীক, অন্যটি সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি।


দিনে ঘুটঘুটে আঁধার, রাতে কুমির আতঙ্ক! ১০ হাজার কোটি ডলারের শহর এখন ভুতুড়ে নগরী

২০২৫ নভেম্বর ২০ ২১:১৬:৫০
দিনে ঘুটঘুটে আঁধার, রাতে কুমির আতঙ্ক! ১০ হাজার কোটি ডলারের শহর এখন ভুতুড়ে নগরী
ছবিঃ সংগৃহীত

মালয়েশিয়ার জোহর প্রণালীর তীরে সিঙ্গাপুর সীমান্ত ঘেঁষে এক বিশাল স্বপ্ননগরী গড়ার পরিকল্পনা করেছিল চীন। নাম দেওয়া হয়েছিল ফরেস্ট সিটি। ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই শহরটি হওয়ার কথা ছিল পরিবেশবান্ধব এক আধুনিক স্বর্গরাজ্য। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় ঠাসা গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলো আজ দাঁড়িয়ে আছে জনশূন্য হাহাকারের সাক্ষী হয়ে। যেখানে মানুষের কোলাহল থাকার কথা ছিল সেখানে আজ বিরাজ করছে শ্মশানের নীরবতা।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই মহাপ্রকল্পের কাজ শুরু করেছিল দেশটির শীর্ষস্থানীয় আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কান্ট্রি গার্ডেন। তাদের লক্ষ্য ছিল চারটি কৃত্রিম দ্বীপের ওপর প্রায় সাত লাখ মানুষের জন্য একটি বিলাসবহুল আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ২০১৫ সালে যখন এর নির্মাণকাজ শুরু হয় তখন চীনের আবাসন খাত ছিল তুঙ্গে। মোনাকোর চেয়ে চার গুণ বড় এই প্রকল্পটিতে গলফ কোর্স, ওয়াটার পার্ক, অফিস এবং রেস্তোরাঁ সবই রাখার পরিকল্পনা ছিল।

কিন্তু বাস্তবতা হলো ফরেস্ট সিটি এখন বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পটির খুব সামান্য অংশেই মানুষের বসবাস রয়েছে এবং যারা সেখানে আছেন তারাও এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। শহরের বেশিরভাগ ভবনই ফাঁকা পড়ে আছে। শপিং মল বা বিজনেস স্কুল থাকলেও নেই কোনো মানুষের আনাগোনা। স্থানীয়রা এই শহরটিকে এখন গোস্ট টাউন বা ভুতুড়ে শহর নামেই চেনে।

এই বিপর্যয়ের পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভুল বিপণন কৌশল। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দাবি করেছিল যে তারা মধ্যবিত্তদের জন্য এই শহরটি তৈরি করছে। কিন্তু বাস্তবে সেখানকার অ্যাপার্টমেন্টের দাম ছিল সাধারণ মালয়েশিয়ানদের ক্রয়ক্ষমতার বহু বাইরে। জোহর বাহরুর মতো প্রধান শহরে যেখানে একটি অ্যাপার্টমেন্টের গড় মূল্য ১ লাখ ৪১ হাজার ডলার সেখানে ফরেস্ট সিটির একেকটি ফ্ল্যাটের দাম হাঁকা হয়েছিল ১১ লাখ ৪০ হাজার ডলার।

এছাড়া ভূ-রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দাও এই প্রকল্পের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ চীনা ক্রেতাদের জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করেছিলেন যা প্রকল্পের সম্ভাব্য ক্রেতা গোষ্ঠীকে নিরুৎসাহিত করে। পাশাপাশি চীন সরকারও তাদের নাগরিকদের বিদেশে অর্থ লগ্নির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে। সবশেষে করোনা মহামারির ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে এই বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প।

বর্তমানে ফরেস্ট সিটির পরিবেশ এতটাই থমথমে যে দিনের বেলাতেও সেখানকার হলওয়েগুলোতে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ বিরাজ করে। শহরের পাশেই রয়েছে কুমির ভর্তি নদী যা বাসিন্দাদের ভীতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যারা এখানে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন তারা এখন চরম হতাশায় ভুগছেন এবং যত দ্রুত সম্ভব এই ভুতুড়ে পরিবেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন। এক দশকের ব্যবধানে বিশাল এক স্বপ্ন এখন মালয়েশিয়ার বুকে এক বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


আত্মহত্যার ৮০ বছর পর হিটলারের ডিএনএ পরীক্ষায় মিলল চাঞ্চল্যকর তথ্য

২০২৫ নভেম্বর ১৯ ২১:৩৮:০৮
আত্মহত্যার ৮০ বছর পর হিটলারের ডিএনএ পরীক্ষায় মিলল চাঞ্চল্যকর তথ্য
ছবিঃ সংগৃহীত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে অ্যাডলফ হিটলার এক ত্রাসের নাম, যার নির্দেশে নাৎসি বাহিনী গোটা ইউরোপকে তছনছ করে দিয়েছিল। ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা এবং ধ্বংসাত্মক সামরিক আগ্রাসনের জন্য কুখ্যাত এই একনায়কের ব্যক্তিগত জীবন ও শারীরিক গঠন নিয়ে গবেষকদের কৌতূহল আজও শেষ হয়নি। সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর গবেষণায় হিটলারের ডিএনএ পরীক্ষা করে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যা তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশের এক অজানা অধ্যায় উন্মোচন করেছে। গবেষকরা দাবি করছেন, দুনিয়া কাঁপানো এই একনায়ক সম্ভবত একটি বিরল জিনগত রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

নতুন একটি তথ্যচিত্র 'হিটলারস ডিএনএ: ব্লুপ্রিন্ট অফ আ ডিক্টেটর'-এ গবেষকরা হিটলারের শারীরিক সীমাবদ্ধতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ব্রিটেনের জিনতত্ত্ববিদ টুরি কিং এবং নাৎসি জার্মানি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স কাইয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, হিটলার সম্ভবত 'ক্যালম্যান সিনড্রোম' (Kallmann Syndrome) নামক এক জটিল জিনগত সমস্যায় ভুগছিলেন। হিটলারের উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি, যা সেই সময়ের গড় জার্মান পুরুষদের উচ্চতা (৫ ফুট ১০ ইঞ্চি) থেকে কম ছিল। গবেষকরা মনে করছেন, এই জিনগত ত্রুটিই তার উচ্চতা কম হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে।

গবেষণার প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ অভিনব। গবেষক টুরি কিং জানান, ১৯৪৫ সালে বার্লিনের যে বাংকারে হিটলার আত্মহত্যা করেছিলেন, সেখানকার সোফায় লেগে থাকা রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেই রক্তের ডিএনএ এবং হিটলারের বর্তমানে জীবিত এক আত্মীয়ের ডিএনএ মিলিয়ে এই পরীক্ষা চালানো হয়। শুরুতে বিজ্ঞানীরা সাধারণ ফলের আশা করলেও, চূড়ান্ত ফলাফল তাদের বিস্মিত করে দেয়। হিটলারের রক্তে 'PROKR2' নামক জিনের একটি পরিবর্তন বা মিউটেশন লক্ষ্য করা গেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই জিনের পরিবর্তনের কারণেই হিটলার 'ক্যালম্যান সিনড্রোম' এবং জন্মগত হরমোনজনিত সমস্যা 'হাইপোগোনাডোট্রপিক হাইপোগোনাডিজম'-এ ভুগে থাকতে পারেন। এই শারীরিক সমস্যার ফলে পুরুষদের বয়ঃসন্ধিকাল বা পিউবার্টি শুরু হতে দেরি হয় এবং শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয়। এর প্রভাবে অণ্ডকোষের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং যৌনাঙ্গের আকার স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হতে পারে।

নাৎসি বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স কাই উল্লেখ করেছেন, বিজ্ঞানের এই নতুন তথ্যগুলো হিটলারের ঐতিহাসিক নথিপত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। ১৯২৩ সালে মিউনিখে কারাগারে থাকার সময় হিটলারের একটি স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে উল্লেখ ছিল যে, তিনি 'ক্রিপ্টোরকিডিজম' বা অণ্ডকোষের বিকাশজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন, বিশেষ করে তার ডান অণ্ডকোষের বিকাশ স্বাভাবিক ছিল না। ঐতিহাসিক সেই তথ্যের সঙ্গে ক্যালম্যান সিনড্রোমের লক্ষণগুলো হুবহু মিলে যাওয়ায় গবেষকদের দাবি আরও জোরালো হয়েছে। ১৮৮৯ সালে অস্ট্রিয়ায় জন্ম নেওয়া এই একনায়ক পৃথিবীকে ওলটপালট করে দিলেও, তার নিজের শরীরের ভেতরেই হয়তো আজীবন এক জটিল জিনগত যুদ্ধ চলেছিল।


অদ্ভুত ধাতব বস্তু, রহস্যময় সংকেত: মারিয়ানার অন্ধকার গহ্বরে চীনের 'ফেন্টোজে' কী দেখল?

২০২৫ নভেম্বর ১৭ ১৮:৪৫:৫৫
অদ্ভুত ধাতব বস্তু, রহস্যময় সংকেত: মারিয়ানার অন্ধকার গহ্বরে চীনের 'ফেন্টোজে' কী দেখল?
ছবিঃ সংগৃহীত

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পৃথিবীর গভীরতম স্থান হিসেবে পরিচিত। সমুদ্রের নিচে এটি প্রায় ১১ কিলোমিটার গভীর এক অন্ধকার গহ্বর, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। এখানকার পানির চাপ এতটাই প্রচণ্ড যে তা মুহূর্তেই ধাতব বস্তুকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এই রহস্যময় স্থানটি জয়ের লক্ষ্যে চীন দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি, তাদের পাঠানো 'ফেন্টোজে' নামক ডুবোযান (সাবমার্সিবল) এমন কিছু তথ্য পাঠিয়েছে, যা বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে চীন মারিয়ানা ট্রেঞ্চে একের পর এক মানববিহীন ডুবোযান পাঠিয়েছে, যার মধ্যে 'ফেন্টোজে' ছিল সবচেয়ে উন্নত। এই অভিযানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এমন সব অজানা জীবাণু ও মাইক্রোবের সন্ধান পেয়েছেন, যার ৮৯ শতাংশই পৃথিবীর কোনো গবেষণাগারে আগে কখনো দেখা যায়নি। এই জীবগুলো এমন এক চরম প্রতিকূল পরিবেশে টিকে আছে, যেখানে কোনো অক্সিজেন বা আলো নেই, আছে শুধু মৃত্যুর সমান ভয়াবহ চাপ।

বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করছেন, এই মাইক্রোবগুলোর জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া মানব চিকিৎসা এবং জ্বালানি প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে, গবেষকরা একই সাথে গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। কারণ তারা পৃথিবীর এই গভীরতম গহ্বরেও মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক এবং রাসায়নিক দূষণের স্পষ্ট চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন।

তবে এই অভিযানের সবচেয়ে রহস্যজনক ঘটনাটি ঘটে ২০২৩ সালে। সেসময় চীনের সাবমার্সিবলের সেন্সর সমুদ্রের তলায় একটি অদ্ভুত ধাতব কাঠামোর উপস্থিতি শনাক্ত করে। প্রথমে এটিকে প্রাকৃতিক খনিজ শিলা বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর গঠন পৃথিবীর পরিচিত কোনো মিশ্র ধাতুর (অ্যালয়) সঙ্গে মিলছে না।

এর পরপরই ঘটে মূল ঘটনা। ওই ধাতব বস্তুটি থেকে একটি সংকেত পাওয়ার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সাবমার্সিবলের ক্যামেরা সিস্টেম কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ডেটা সার্ভারে ফিরে আসা কিছু ঝাপসা ছবিতে শুধু দেখা যায়, কোনো কিছু থেকে আলো প্রতিফলিত হচ্ছে এবং একটি চলমান বস্তু যেন দ্রুত সেটির পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।

এই ঘটনার পর, চীনের গবেষণা সংস্থা 'চাইনিজ একাডেমি অফ সাইন্স' বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। তারা শুধু বলেছে, "আমরা এমন কিছু পর্যবেক্ষণ করেছি, যা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।" চীনের এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ও নীরবতা বিশ্বজুড়ে নানা জল্পনার জন্ম দিয়েছে। গণমাধ্যমে কেউ কেউ এটিকে সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে থাকা কোনো অজানা প্রাণী বলে মনে করছেন, আবার কেউ কেউ ভিন্ন কোনো সম্ভাবনার কথাও ভাবছেন।

এই অভিযানের মাধ্যমে চীন প্রমাণ করেছে যে, তারা গভীর সমুদ্র গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে, প্রায়শই নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে গভীর সমুদ্রের সব তথ্য কখনোই পুরোপুরি প্রকাশ করা হয় না। চীন হয়তো সত্যিই এমন অদ্ভুত কিছুর সন্ধান পেয়েছে, যা হয়তো কোনো ভয়ঙ্কর প্রাণী নয়, বরং মানুষের অজানার প্রতি কৌতূহলকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ আমাদের শিখিয়েছে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে অন্ধকার এবং প্রতিকূল জায়গাতেও জীবনের অস্তিত্ব থাকতে পারে। কিন্তু সেই জীবন সম্পর্কে মানুষ যত জানার চেষ্টা করছে, রহস্যও যেন ঠিক ততটাই গভীর হচ্ছে।


জামায়াতে ইসলামী: অতীতের ছায়া ছাপিয়ে কি নতুন শুরু সম্ভব?

ফিচার ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ নভেম্বর ১৬ ২১:১১:০৮
জামায়াতে ইসলামী: অতীতের ছায়া ছাপিয়ে কি নতুন শুরু সম্ভব?

লাহোর প্রস্তাব, পাকিস্তান আন্দোলন, ভারত ভাগ, তারপর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির এক জটিল অধ্যায়ের নাম জামায়াতে ইসলামী। দলটি কখনো পাকিস্তান রাষ্ট্রের কঠোর বিরোধী, কখনো সেই পাকিস্তানেরই শরিক, আবার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত। স্বাধীন বাংলাদেশের ভেতরেও নিষেধাজ্ঞা, পুনরুত্থান, জোট রাজনীতি, যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাম্প্রতিক নিষিদ্ধ ঘোষণা, সব মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে প্রশ্নের শেষ নেই। আজকের আলোচনায় তাই গোড়া থেকে বর্তমান পর্যন্ত জামায়াতের রাজনৈতিক চিন্তা, কৌশল, অর্জন, ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিশদ অনুসন্ধান।

লাহোর প্রস্তাব, রাষ্ট্রধারণার জন্ম এবং পাকিস্তান আন্দোলনের ভূমিকা

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের একটি প্রস্তাব পেশ করলেন। তার সেই প্রস্তাবকে হিন্দু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত পত্রপত্রিকাগুলো প্রচার করতে লাগল পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে। কিন্তু সেই প্রস্তাবে কোথাও পাকিস্তান নামটির উল্লেখ ছিল না। এমনকি মুসলিম লীগের মুখপাত্রদেরও এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না।

হিন্দু মহলের ধারাবাহিক প্রচারণার ফলেই মুসলিম নেতৃবৃন্দের মাঝে রাষ্ট্রধারণার স্পষ্ট বোধ তৈরি হতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪১ সালের ১৫ই এপ্রিল মাদ্রাজ অধিবেশনে তথাকথিত পাকিস্তান প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের শাসনতন্ত্রে মূল নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে জোরালো হতে থাকে পাকিস্তান আন্দোলন। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনও প্রবল হয়ে উঠছিল। ইতিহাসের এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে মুসলিম রাজনীতির আরেকটি নতুন ধারার উদ্ভব ঘটে, যেখান থেকে পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী আত্মপ্রকাশ করে।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, মুসলিম লীগ এবং মতাদর্শিক বিভক্তি

যখন পাকিস্তান আন্দোলন জোরালো হচ্ছিল, সেই সময় উপমহাদেশে মুসলিমদের বড় দুটো রাজনৈতিক শিবির ছিল মুসলিম লীগ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। পাকিস্তান প্রশ্নে এই দুই পক্ষের মধ্যে স্পষ্ট মতানৈক্য দেখা দেয়। মুসলিম লীগ ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে, আর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছিল ভারতের অখণ্ডতার পক্ষে।

জমিয়তের চিন্তা ছিল, ইতিপূর্বেই ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে, ভবিষ্যতের অখণ্ড ভারতেও মুসলিমরাই শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে। তাদের কাছে ভূখণ্ড অখণ্ড রাখা এবং তার ভেতরেই মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ছিল বেশি যৌক্তিক। কিন্তু মুসলিম লীগের চোখে রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল ভিন্ন, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের ভিত্তিতে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে মুসলিম নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের পথ খুঁজছিল।

তৎকালীন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মুখপত্র ছিল ‘আল জমিয়ত’ পত্রিকা, যেই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। জমিয়তের সাথে মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে তিনি ধীরে ধীরে সেই প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে সরে যান এবং পৃথক রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন, যার ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।

জামায়াতে ইসলামী হিন্দের জন্ম ও পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান

১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ৭৫ জন সদস্যের উপস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী ঘোষণার পর মওদুদী জামাতের আমির হিসেবে মনোনীত হন। সেখান থেকেই শুরু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ও আদর্শিক যাত্রা।

সে সময় থেকেই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে দাবি করেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করা মুসলিম লীগ, জিন্না, এরা কেউই খাঁটি মুসলিম নন। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও পক্ষে ছিল না। প্রশ্ন জাগে, তাহলে জামাত তথা মওদুদীর উদ্দেশ্য কী ছিল?

মওদুদী সম্পর্কে একটি বিষয় আগে জানা দরকার। যৌবনে ভারতের মার্ক্সবাদী নেতা আব্দুস সাত্তার খায়রীর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন তিনি, আবার ছিলেন সিদ্ধহস্ত লেখক। মুসলিম সমাজের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে তার আগ্রহ ছিল ব্যাপক। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মাসিক ‘তরজমানুল কোরআন’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি নিজের মতবাদ প্রচার শুরু করেন। এই পত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় মওদুদী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে লেখেন, পাকিস্তান নামক কোন রাষ্ট্রের জন্ম হলে সেটা আহাম্মুকের বেহেশত এবং মুসলমানদের কাফেরানা রাষ্ট্র হবে।

এই ধরনের লেখালেখি ও প্রচারণার ফলে মুসলিম লীগ সমর্থকরা জামাতকে ব্রিটিশ ও কংগ্রেসের দালাল বলে মনে করতে শুরু করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কঠোর বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, এবং পরিহাসের বিষয় হচ্ছে সেই পাকিস্তানেরই মাটিতে গিয়ে ঠাঁই নিতে হয় পাকিস্তানবিরোধী জামায়াতে ইসলামী হিন্দের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীকে।

পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী: গ্রেপ্তার, দাঙ্গা ও মৃত্যুদণ্ডাদেশ

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর জামায়াতে ইসলামী হিন্দ ও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় সংগঠনটি। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমির হন মওলানা মওদুদী, আর জামায়াতে ইসলামী হিন্দের আমির হন আবুল লাইস ইসলাহী নাদভী।

পাকিস্তানে গিয়ে মওদুদী ইসলামী সংবিধান ও ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালো প্রচারণা শুরু করেন। এই কারণে পাকিস্তান সরকার জননিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেপ্তার করে। একই বছরে পাকিস্তানি জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান শাখা খোলে। এরই মধ্যে জামায়াতের সাংগঠনিক তৎপরতায় সংগঠনটির শক্তি ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৯৫০ সালে মওদুদীকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করে আইন পাশ করার দাবিতে আবারো আন্দোলন শুরু করে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। মওদুদী পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং পাকিস্তান সরকারকে আহমদীয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। সে সময় জামায়াতের কিছু সমর্থক লাহোরে আহমদীদের উপর হামলা চালায়, এর জের ধরে শুরু হয় দাঙ্গা। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে দাঙ্গা দমে গেলেও, এই সহিংসতায় প্রায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। ভারত–পাকিস্তান বিভাজনের পর কোনও একক দাঙ্গায় এত মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা এটি প্রথম।

ঘটনার পর মওলানা মওদুদীকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে। বিচারে তাকে দাঙ্গার মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মুসলিম দেশের মধ্যস্থতায় তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৫৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র শাখা ‘ছাত্র সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এখন ইসলামী ছাত্রশিবির নামে পরিচিত।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ: স্বাধীনতা যুদ্ধ, বিরোধিতা ও নিষেধাজ্ঞা

জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্পর্ক এক জটিল ও বিতর্কিত অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারী জামাত ১৯৭১ এ এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়। অনেকের বিশ্লেষণে ধরা হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতার যে ঐতিহাসিক ভুল তারা মনে করেছিল, তার কাফফারা দিতেই একাত্তরে জামায়াত শুধু বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেনি, বরং স্বাধীনতা আন্দোলন রুখে দিতে শান্তি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে।

জামায়াতের প্রেসক্রিপশন অনুসারেই তাদের ছাত্র উইং ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়েই রাজাকার, আল বদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর সময়েও পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জামায়াত নানা কার্যক্রম পরিচালিত করে, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে গোলাম আজম লন্ডনে গিয়ে পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন।

কিন্তু পাকিস্তানের বিরোধিতার মতো বাংলাদেশের বিরোধিতাও শেষ পর্যন্ত অকার্যকর প্রমাণিত হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় যখন সুনিশ্চিত, তখন জামায়াত নেতারা পালিয়ে যান সেই পাকিস্তানেই, যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা তারা একসময় করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জামাতসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সকল দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশের বিরোধিতা ও গণহত্যায় সহায়তার জন্য ১৯৭৩ সালে যে ৩৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়, তার অন্যতম ছিলেন গোলাম আজম। তবু প্রহসনের মতো কিছুদিন পরই গোলাম আজমকেও মওদুদীর মতো সেই রাষ্ট্রেই ফিরতে হয়, যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি এবং তার দল কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের পুনরুত্থান, জোটরাজনীতি ও যুদ্ধাপরাধের বিচার

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামায়াতের সামনে নতুন সুযোগ তৈরি হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার। রাষ্ট্রপতি এ এস এম সায়েম এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করেন, যা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেছিল। এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে জামাত সমমনোভাবাপন্ন ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আইডিএল) নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করে। আইডিএলের ছায়ায় জামাতের নেতা–কর্মীরা রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।

জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র নীতি ইসলামী দলগুলোর জন্য, বিশেষ করে জামায়াতের জন্য, সাপে বর হয়ে আসে। ফলস্বরূপ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ছয়টি আসন জিতে নেয়, যা জামাতের শক্তি ও মনোবল বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টির উত্থান ঘটে। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন লাভ করে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দিয়ে ১৭টি আসন ও দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পায়। যদিও ১৯৯৬ ও ২০০৮ এর নির্বাচনে যথাক্রমে মাত্র ৩টি ও ২টি আসন পায় তথাপিবাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত এক বড় ফ্যাক্টরে পরিণত হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করলে, কিছুদিন পর থেকেই যুদ্ধপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই বিচার কতটা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্য নিয়ে আর কতটা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে। কারণ সেই বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জামায়াতকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার আওয়ামী লীগের নীলনকশা অনেকটা বাস্তবায়িত হয়ে যায় বলে বিশ্লেষণ রয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগ সরাসরি জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে দলটিকে নানা উপায়ে ব্যবহার করারও চেষ্টা করেছে বলে এক ধরনের মত প্রচলিত আছে। তবু আসল সত্য এই যে, এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জামায়াত কোনোভাবে টিকে আছে, এটাকেই অনেকে তাদের সবচেয়ে বড় সফলতা হিসেবে তুলে ধরেন। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ তাদের কমই হয়েছে, প্রশ্ন থাকে কেন?

বাংলাদেশের সামাজিক মনস্তত্ত্ব ও জামায়াতের সীমাবদ্ধতা

উপমহাদেশের ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামী অন্যতম প্রাচীন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। তথাপি রাজনীতির এই দীর্ঘ সময়ে দলটির আহামরি কোনও অর্জন নেই। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতের মতন সুসংগঠিত ইসলামী দল কেন একবারের জন্যও এককভাবে ক্ষমতার স্বাদ নিতে পারেনি, কিংবা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি যেতে পারেনি, তা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

প্রথমত, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ ভক্তিপ্রবণ হলেও বিশ্বাসের দিক থেকে তুলনামূলক উদার। এই অঞ্চলের আবহাওয়া ও ভৌগোলিক বাস্তবতার পাশাপাশি সুফি ঐতিহ্য মানুষের ধর্মীয় আবেগকে নরম ও আধ্যাত্মিক রেখেছে। ধর্মের র‍্যাডিকাল ব্যাখ্যা কখনোই এই অঞ্চলের মানুষের মূল চরিত্র গড়ে দিতে পারেনি। যার ফলে জামায়াত কিংবা জামায়াতের মত রেডিক্যাল মতাদর্শের দল কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, জামায়াতসহ অনেক ইসলামী দল সেই অর্থে ‘গণমানুষের অংশ’ হয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য আমরা দেখি ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১ সালের মতো জনজাগরণের সময়ও গণআকাঙ্ক্ষার বিপরীতে তারা অবস্থান নিয়েছে। এ ধরনের অবস্থান তাদের প্রতি বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর আস্থা গড়ে ওঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তৃতীয়ত, ইসলামপন্থীদের মধ্যে শতধা বিভক্তিও এই ব্যর্থতার বড় কারণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগণের মনে ইসলাম ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব আছে, কিন্তু বাস্তবে ইসলামপন্থী রাজনীতি নানা দল এবং উপদলে বিভক্ত। এতে জামায়াতের সম্ভাব্য ভোটব্যাংক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেছে।

দেওবন্দী, সুফি, ওয়াহাবি: আকিদাগত দ্বন্দ্ব এবং জামায়াতের অবস্থান

বাংলাদেশ মূলত সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সুন্নিদের মধ্যে দেওবন্দী, সুফিবাদী ধারা এবং ওয়াহাবি মতাদর্শ একটি ডমিনেন্ট উপগোষ্ঠী হিসেবে বিদ্যমান। জামায়াতে ইসলামীর ধর্মীয় আকিদা মধ্যপ্রাচ্যের ওয়াহাবিজম দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত, আর রাজনৈতিক দিক থেকে জামায়াত ইসলাম মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মতাদর্শধারী। তাদের এই মতাদর্শিক কাঠামোর সাথে প্রচলিত সুন্নি ও দেওবন্দী ধারার দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট। অনেক সময় একদল অন্যদলকে কাফের বা ভণ্ড হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে।

এছাড়াও সুফিদের মাধ্যমে ইসলাম আসা এই ভূখণ্ডে সুফিজম বা মিস্টিসিজমের প্রভাবও লক্ষণীয়। যাদেরকে জামাত অনেকটা প্রকাশ্যেই ‘বেদাতি’ হিসেবে গণ্য করে। ফলে ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল জনগোষ্ঠীও নানাভাবে দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এই মতবিরোধের ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে। জমিয়ত তথা দেওবন্দী সিলসিলার আলেমগণ, বিশেষ করে হুসাইন আহমদ মাদানীর সাথে সায়েদ আবুল আলা মওদুদীর মতানৈক্য এবং সেখান থেকে উদ্ভূত দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই জামায়াতে ইসলামীর জন্ম। মওদুদীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, মুসলমানদের জাতীয়তা বা পরিচয় দেশ বা স্থানের সাথে নয়, বরং বিশ্বাসের সাথে যুক্ত। অপরদিকে ওলামায়ে দেওবন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, জাতীয়তা দেশ এবং ভূখণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত।

তারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, কওমে আদ এবং কওমে সামুদের মত কওমগুলোর পরিচয়ও স্থান এবং দেশের সাথে জড়িত, আল্লাহ পবিত্র কোরআনেও তাদেরকে কওম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ওলামায়ে দেওবন্দের সাথে জামায়াতের আরেকটি মৌলিক মতবিরোধ ছিল সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে সব সাহাবী ঈমান, আমল, আদর্শ – সব ক্ষেত্রে সত্যের মাপকাঠি, কিন্তু মওদুদী তার ‘মিয়ারে হক’ বইতে সাহাবায়ে কেরামকে সেই অর্থে হকের একমাত্র মাপকাঠি নন বলে মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

তার ‘খেলাফত ও মলিকিয়াত’ এবং ‘রাসায়েল মাসায়েল’ বইয়ে উটের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধ ইত্যাদি প্রসঙ্গে আমিরে মুয়াবিয়া সহ কিছু সাহাবীর প্রসঙ্গে তাঁর কিছু সমালোচনামূলক মন্তব্যকে দেওবন্দী আলেমরা সাহাবাবিরোধী মনোভাব হিসেবে দেখেন। তাদের মতে, যারা সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনায় লিপ্ত থাকে, তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ভেতর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে না। এই আকিদাগত মতপার্থক্য থেকে রাজনৈতিক মতবিরোধ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। হোসাইন আহমদ মাদানীর নেতৃত্বে তৎকালীন ওলামায়ে দেওবন্দ মওদুদীকে ‘গোমরাহ’ বলে ফতোয়া দেন বলে প্রচলিত। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের কওমী আলেম ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ – দুই ধারার মধ্যেও এই দ্বন্দ্ব এখনো কমবেশি বিদ্যমান।

জামায়াত কি ইসলামী দল, নাকি রাজনৈতিক ব্র্যান্ড?

এই প্রশ্নটি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আছে: জামায়াতে ইসলামী কি আসলেই ইসলামী দল, নাকি ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল হিসেবে অভিনয় করছে? অনেক বিশ্লেষকের মতে, ধর্মের কথা বলা হলেও মূলত ভারতের কমিউনিজমবিরোধী শক্তি হিসেবেই একটি সংগঠনের জন্ম হয়েছিল, ব্রিটিশ শাসকরাও তখন তাদের কিছুটা আনুকূল্য দিয়েছিল বলে ধারণা প্রচলিত।

মওলানা মওদুদীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামকে বাংলাদেশের অনেক ইসলামপন্থী দল ইসলামী দল হিসেবে গ্রহণ করে না। অনেক কওমী ঘরানার ও পীরপন্থী দলগুলো জামাতকে ‘গোমরাহ’ মনে করে। অন্যদিকে জামাতের ভেতরের অনুরাগীরা নিজেদেরকে একটি আদর্শ ইসলামী আন্দোলনের বাহক হিসেবে দেখেন।

নিষেধাজ্ঞা, টিকে থাকা এবং সাম্প্রতিক পুনর্নিষেধাজ্ঞা

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত অন্তত চার দফায় জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ ও ১৯৬৪ সালে, আর বাংলাদেশে ১৯৭২ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালে মোট দুইবার নিষিদ্ধ হয় দলটি। তারপরও সংগঠনটি আন্ডারগ্রাউন্ড বা বিকল্প প্ল্যাটফর্মে থেকে সাংগঠনিক উপস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।

জামাত দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তি দিয়ে আসছে, নিষেধাজ্ঞা, দমন–পীড়ন সত্ত্বেও টিকে থাকা – এটাই তাদের রাজনৈতিক সফলতা। সমালোচকদের মতে, এটি টিকে থাকা হলেও গণআকাঙ্ক্ষার মূলধারায় প্রবেশ করতে না পারার এক দীর্ঘ ব্যর্থতার ইতিহাসও বটে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট: ইসলামী ঐক্যের কথা, জেনারেশন জেড এবং ‘হিন্দু শাখা’ বিতর্ক

বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের মধ্যে জামাতের সাথে মতাদর্শিক বিবাদ থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার কিছু প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে। কিছুদিন আগে ইসলামী দলগুলোর কিছু নেতা–কর্মীকে নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখান থেকে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তথা চরমোনাই পীরও এক পর্যায়ে জামাতের সঙ্গে ঐক্যের সম্ভাবনার কথা ইঙ্গিত করেছেন, যদিও ইতিহাস বলে, ইসলামপন্থী দলগুলো ইতিপূর্বেও একাধিকবার ঐক্যের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।

অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা জেনারেশন জেড বা জেনজি প্রজন্মের বড় অংশের মধ্যে জামায়াতকে নিয়ে বিরূপ বা অন্তত মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যুদ্ধাপরাধের ইস্যু, ৭১-এর ভূমিকা, নারী ও সংখ্যালঘু প্রশ্নে জামাতের ভাবমূর্তি – সব মিলিয়ে তরুণদের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়নি।

তারপরও এখন পর্যন্ত জামাতের নেতৃস্থানীয়রা তুলনামূলক ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। জামাত যদি তাদের ঐতিহাসিক ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে গণআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, তবে আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা এযাবতকালের সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে – এমন সম্ভাবনার কথাও অনেকে বলছেন। তবে জামাত শক্তিশালী হলেই দেশে সরাসরি শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠিত হবে – এমন ধারণা করারও সুযোগ নেই। কারণ ইতিপূর্বে বিএনপির সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং ১৮ জন সংসদ সদস্য নিয়ে সরকারে থেকেও ইসলামের প্রশ্নে তারা কার্যত উল্লেখযোগ্য কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন আনেনি।

২৬ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডি টপিক হিসেবে দেখা যায়, রংপুরে জামাতের ‘হিন্দু শাখা’র কমিটি গঠন করা হয়েছে। জামাত দেশি–বিদেশি পরিমণ্ডলে এই বার্তাই দিতে চাইছে যে তারা কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠন নয়, বরং ‘মডারেট ইসলাম’-এর ধারক। ঐতিহাসিক এসব দিক পর্যালোচনা করলে অনেকে মনে করছেন, জামাতকে ইসলামী দলের চেয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করাই বেশি যুক্তিযুক্ত।

ইতিহাসের ভার, বর্তমানের হিসাব, ভবিষ্যতের প্রশ্ন

উপমহাদেশের এক বিরল রাজনৈতিক অর্গানাইজেশন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী একই সঙ্গে পাকিস্তানবিরোধী, পাকিস্তানের শরিক, স্বাধীনতা–বিরোধী এবং আবারও নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিজেদের মানিয়ে নিতে চাওয়া এক সংগঠন। লাহোর প্রস্তাব থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ – এই দীর্ঘ পথচলায় তাদের আদর্শ, অবস্থান, কৌশল বহুবার বদলেছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, জনগণের ঐতিহাসিক চরিত্র, ইসলামপন্থীদের ভেতরের বিভক্তি, আকিদাগত দ্বন্দ্ব, এবং যুদ্ধাপরাধের প্রশ্ন – সব কিছু মিলিয়ে জামাত কখনোই এই দেশে মূলধারার সর্বজনগ্রাহ্য শক্তি হতে পারেনি। তবু তারা টিকে আছে, এবং আবারও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

প্রশ্ন রয়ে যায়, আগামী দিনে কি জামায়াতে ইসলামী নিজেদের অতীতের ছায়া থেকে সত্যিই বেরিয়ে আসতে পারবে? নাকি ইতিহাসের ভারই শেষ পর্যন্ত তাদের সম্ভাবনাকে বারবার থামিয়ে দেবে? এই উত্তর সময়ই দেবে।

-সালেহিন


উড়ন্ত সরীসৃপের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ধারণা বদল ৩২০টি ফাইটোলিথ পেলেন গবেষকরা

২০২৫ নভেম্বর ১৩ ১৯:০৫:৫৯
উড়ন্ত সরীসৃপের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ধারণা বদল ৩২০টি ফাইটোলিথ পেলেন গবেষকরা
ছবিঃ সংগৃহীত

ডাইনোসরের যুগে আকাশে রাজত্ব করত বিশাল আকৃতির উড়ন্ত সরীসৃপ 'টেরাসর'। এই রহস্যময় প্রাণীদের বিভিন্ন প্রজাতি আবিষ্কৃত হলেও তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরেই ধোঁয়াশা ছিল। এতদিন কেবল তাদের মৎস্যভোজী বা মাছখাদক হওয়ার বিষয়েই প্রমাণ মিলেছিল। কিন্তু সম্প্রতি এক যুগান্তকারী আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা প্রথমবার এক প্রজাতির টেরাসরের তৃণভোজী বা উদ্ভিদভোজী হওয়ার পক্ষে অকাট্য প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন।

বেইজিং-এ অবস্থিত চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সেসের জীবাশ্মবিদ্যা বিভাগের গবেষক শাওলিন ওয়াং এবং তার সহযোগীরা এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারটি করেছেন। তারা 'সিনোপটেরাস অটাভিসামাস' (Sinopterus atavisamus) নামক এক প্রজাতির টেরাসরের জীবাশ্ম পরীক্ষা করছিলেন। উত্তর-পূর্ব চীনে খুঁজে পাওয়া এই জীবাশ্মের পেটের অংশে বিজ্ঞানীরা অসংখ্য ছোট ছোট 'গ্যাস্ট্রোলিথ' (পাকস্থলীর পাথর) এবং ৩২০টি 'ফাইটোলিথ' শনাক্ত করেন।

ফাইটোলিথ হলো একটি আণুবীক্ষণিক সিলিকা কণা, যা প্রাকৃতিকভাবে গাছের মধ্যেই তৈরি হয়। এর আগে কোনো টেরাসরের পাকস্থলীতে এই ধরনের নমুনা পাওয়া যায়নি, যা সরাসরি উদ্ভিদ খাওয়ার প্রমাণ দেয়।

যেভাবে নিশ্চিত হলেন বিজ্ঞানীরা: বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারে যেন কোনো ভুল না থাকে, তা নিশ্চিত করতে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।

প্রথমে তারা নিশ্চিত হন যে এই ফাইটোলিথগুলো অন্য কোথাও থেকে জীবাশ্মের পেটে এসে জমেনি। এর জন্য তারা জীবাশ্মের আশপাশের পাথর পরীক্ষা করেন, কিন্তু সেখানে কোনো ফাইটোলিথের চিহ্ন মেলেনি।

এরপর তারা খতিয়ে দেখেন যে, এই টেরাসরটি অন্য কোনো তৃণভোজী প্রাণীকে খাওয়ার ফলে ফাইটোলিথগুলো তার পেটে এসেছে কিনা। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্য প্রাণীর হাড়, আঁশ বা দেহের অন্য কোনো অংশের নমুনাও পেটে থাকার কথা। সিনোপটেরাসের এই জীবাশ্মে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি।

এই দুই দফা পরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হন যে, 'সিনোপটেরাস অটাভিসামাস' প্রজাতিটি সরাসরি উদ্ভিদ বা গাছপালা খেয়েই জীবনধারণ করতো, অর্থাৎ তারা তৃণভোজী ছিল।

এর আগে টেরাসরদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন অনুমান প্রচলিত ছিল। শারীরিক গঠন দেখে কোনো প্রজাতিকে মাংসাশী, পতঙ্গভুক, মৎস্যভোজী বা তৃণভোজী বলে ধারণা করা হতো। তবে পাকস্থলীর নমুনা ছাড়া তা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না। এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি টেরাসরের জীবাশ্মের পাকস্থলীর নমুনা পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলোতে মাছের আঁশ জাতীয় বস্তু মেলায় কেবল তাদের মৎস্যভোজী হওয়ার বিষয়েই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন।

'সায়েন্স বুলেটিন' সাময়িকীতে প্রকাশিত এই নতুন গবেষণাপত্রটি ডাইনোসর যুগের বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে ধারণাকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, উড়ন্ত এই সরীসৃপদের মধ্যেও খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য ছিল এবং তারা শুধু মাংস বা মাছের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং উদ্ভিদের উপরও নির্ভরশীল ছিল।

পাঠকের মতামত:

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

রাষ্ট্রের ধারণাটি একসময় কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনের শাসন এবং নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ভূমিকা এখন... বিস্তারিত