মতামত

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মনোবিশ্লেষণমূলক পাঠ: একটি প্রজন্মের অবচেতনের বিস্ফোরণ

ড. হাসান সাইমুম ওয়াহাব
ড. হাসান সাইমুম ওয়াহাব
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২০২৫ আগস্ট ০৩ ২১:০২:০৭
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মনোবিশ্লেষণমূলক পাঠ: একটি প্রজন্মের অবচেতনের বিস্ফোরণ

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই মাস এক গভীর, বেদনাবিধুর অথচ তাৎপর্যময় অধ্যায় হয়ে থাকবে। এই সময়টিতে দেশজুড়ে ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্বে যে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা নিছক একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ ছিল না—বরং তা ছিল একটি প্রজন্মের অবচেতনে সঞ্চিত ক্ষোভ, বঞ্চনা ও আত্মপরিচয় সংকটের বিস্ফোরণ। এই আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের চোখ রাখতে হবে কেবল রাজনীতির মাঠে নয়, বরং মনস্তত্ত্বের গভীর স্তরেও। তাই এ প্রবন্ধে আমরা এই অভ্যুত্থানকে বোঝার চেষ্টা করবো মনোবিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসচর্চা (psychoanalytical historiography)–এর আলোকে, যা মূলত সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং তাঁর শিষ্যদের বিকাশিত তত্ত্বসমূহ দ্বারা অনুপ্রাণিত।

মনোবিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসচর্চার পরিপ্রেক্ষিত

মনোবিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসচর্চা একটি পদ্ধতি, যা ইতিহাসের ঘটনাবলি, নেতৃত্ব, সামাজিক আন্দোলন ও আচরণের নেপথ্যে থাকা অবচেতন প্রেরণা, দ্বন্দ্ব, ভয়, আকাঙ্ক্ষা ও দমনচর্চাকে অন্বেষণ করে। এটি আমাদের দেখায় কীভাবে ব্যক্তিগত মানসিক কাঠামো সামষ্টিক রূপ ধারণ করে এবং তা সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। হিটলারের উন্মত্ততা বা মুসোলিনির ফ্যাসিবাদকে ব্যাখ্যা করতে যে ধরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক ছিল, বাংলাদেশেও কিছু ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়ে উঠেছে—বিশেষত বর্তমান সময়ের মতো সংকটকালীন মুহূর্তে।

দমন ও তার প্রত্যাবর্তন: অবচেতনের বিস্ফোরণ

ফ্রয়েড তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বে বলেছেন, কোনো অভিজ্ঞতা যদি চেতনায় স্থান না পায়, তাহলে তা হারিয়ে যায় না; বরং অবচেতনে জমা থেকে একসময় সহিংসভাবে ফিরে আসে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ বহু বছর ধরে যে অবহেলা, অনিশ্চয়তা ও নিরাশার মধ্যে বাস করছিল, তা দমন হয়ে অবচেতনে জমা হচ্ছিল। রাষ্ট্র, শিক্ষা ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান—সবই যেন তাদের জন্য এক অনুপ্রেরণাহীন ব্যবস্থার নামান্তর।

২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল সেই দীর্ঘস্থায়ী দমনচর্চার সম্মিলিত মানসিক প্রতিক্রিয়া। “আমাদের কথা শোনো”—এই শ্লোগান ছিল একটি আর্তনাদ, একটি স্বীকৃতি দাবি, একটি আত্মমুক্তির প্রয়াস। এই গণ-আন্দোলন ছিল নিছক রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার সংগ্রাম নয়; এটি ছিল মানসিক মুক্তির এক সমষ্টিগত প্রক্রিয়া।

রাজনীতিতে 'গদফাদারের’ প্রতিচ্ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃবৃন্দের চরিত্র অনেকাংশেই একধরনের প্রতাপশালী 'গডফাদার'-এর অনুরূপ—যিনি কঠোর, কর্তৃত্ববাদী, দমনকারী এবং প্রায়শই অনির্বাচিত শাসকসুলভ। এই রূপকল্পে তরুণদের আন্দোলন ছিল এক প্রকার প্রতীকী 'পিতৃহত্যা'।

ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ মতে, পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হলো আত্মপরিচয়ের সন্ধানে সন্তানের স্বতন্ত্র স্বরূপ গঠনের প্রচেষ্টা। এই আন্দোলনে যুবকরা যেন ঘোষণা করেছিল—“আমরা আর শিশু নই, আমাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর আছে।” এই বক্তব্যের মধ্যে নিহিত ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিশ্বাস ও একটি প্রজন্মের পরিচয় চর্চা।

প্রক্ষেপণের মনোবিজ্ঞান ও ঘৃণার উৎস

ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে 'প্রক্ষেপণ' (projection) একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা—যেখানে কোনো ব্যক্তি তার নিজের ভয়, অযোগ্যতা বা দোষ অন্যের ওপর আরোপ করে। ২০২৪ সালের আন্দোলনে, তরুণ সমাজ রাজনীতিবিদ, প্রশাসক ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিনিধিদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপণ ঘটিয়েছে।

তারা নিজেদের ব্যর্থতা বা অসন্তোষকে যাদের জন্য দায়ী করেছে, তাদের বিরুদ্ধে উগ্রতা দেখিয়েছে—যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। এই ক্ষোভের প্রকাশ একটি প্রতিক্রিয়াশীল সুরে হলেও, তার মূলে ছিল দীর্ঘদিনের অপমান, আত্মসম্মানবোধের পতন এবং জীবনের অর্থহীনতার অনুভব।

বিপ্লব না মনস্তাত্ত্বিক পশ্চাদপসরণ?

এই প্রশ্নও অবধারিত: এই আন্দোলন কি ছিল একটি বিপ্লব, নাকি এটি ছিল একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলার বহিঃপ্রকাশ? হয়তো উভয়ই। ফ্রয়েড বলেছিলেন, যখন কোনো সমাজে সুস্থ নৈতিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়, তখন মানুষের ভিতরের আদিম প্রবৃত্তি (id) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান ছিল এক ধরনের “অদৃশ্য সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ”, যা সামাজিক শৃঙ্খলার নামে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও এক প্রজন্মের মধ্যে গড়ে উঠেছিল আত্মপরিচয়ের জন্য এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তাই এই আন্দোলন একই সাথে ছিল একটি আত্ম-অন্বেষণের চেষ্টা এবং বিপ্লবী মানসিকতার প্রাথমিক প্রতিফলন।

প্রয়োজন জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক সংলাপ

২০২৪ সালের এই অভ্যুত্থান নিয়ে এখনো যতটা আলোচনা হচ্ছে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক এবং আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু প্রয়োজন জাতীয় মানসিকতার বিশ্লেষণ, প্রয়োজন ‘collective catharsis’ বা সম্মিলিত মানসিক পরিশুদ্ধি। আমাদের কিছু মৌলিক প্রশ্ন এখন অনিবার্যঃ

  • আমরা কি দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রজন্মের ক্ষোভ-আকাঙ্ক্ষাকে অবদমন করেছি?
  • বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার কেন তাদের নিজের জনগণের ওপর এতটা নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে?
  • কেন এক শ্রেণির মানুষ কেবল ব্যক্তিগত সম্পদের পেছনে ছুটেছে—একটি বৈষয়িক সত্তার বাইরে কিছু ভাবতে পারেনি?
  • কেন বিগত ফ্যাসিবাদীরা আজও দায় স্বীকার করতে নারাজ?
  • নেতৃত্ব ও সৃজনশীল চিন্তা একসঙ্গে সহাবস্থান করতে না পারার কারণ কী?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের কেবল নীতিনির্ধারকদের দিকে নয়, বরং আমাদের সামষ্টিক মানসিক কাঠামোর দিকেও তাকাতে হবে।

ইতিহাসের ক্যানভাসে অবচেতনের রেখাচিত্র

২০২৪ সালের জুলাইয়ের উত্তাল রাস্তাগুলো যেন একেকটি বিশাল ‘ক্যানভাস’—যেখানে একটি নিঃসঙ্গ, ক্ষুব্ধ ও প্রত্যাখ্যাত প্রজন্ম তাদের অনুভূতি, ক্ষোভ, ভয় ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। এই ক্ষোভকে যদি আমরা শুধুই ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করি, তাহলে আগামী দিনে এই দমন আবারও ফিরে আসবে, হয়তো আরও ভয়ঙ্কর রূপে।

এই আন্দোলনের মধ্যে আমরা দেখেছি এক ধরনের ‘psycho-social awakening’—যা নিছক সামাজিক বা রাজনৈতিক নয়, বরং মানসিক অবরুদ্ধতার মুক্তি। তাই জাতীয় স্বার্থে আমাদের প্রয়োজন এই আন্দোলনের মনোবিশ্লেষণমূলক পাঠ, প্রয়োজন গবেষণা, সংলাপ এবং আত্মসমালোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

বাংলাদেশের রাজনীতিকে যদি আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্রমুখী ও প্রগতিশীল করতে চাই, তাহলে জনগণের অবচেতন ক্ষোভের ভাষা শোনা শিখতে হবে। কারণ রাজনীতি শুধু আইন-কানুন নয়, এটি মানুষ ও মানসিকতার প্রতিফলন—আর সেই মানসিকতার স্বরূপ বোঝাই আগামী বাংলাদেশের সবচেয়ে জরুরি কাজ।

-

ড. হাসান সাইমুম ওয়াহাব

তেজগাও, ঢাকা।

[email protected]

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ