নাইজেরিয়ার বাজারে ডেরিকা: টমেটো পেস্ট থেকে মাপের এককে রূপান্তরের গল্প

২০২৫ আগস্ট ২৬ ০৯:২৯:০৮
নাইজেরিয়ার বাজারে ডেরিকা: টমেটো পেস্ট থেকে মাপের এককে রূপান্তরের গল্প

লাগোসের ব্যস্ত ইদি আরাবা বাজারে প্রতিদিনের মতো ভিড়। ক্রেতারা কেউ চাল, কেউ শিম, কেউ আবার তিলের বীজ কিনছেন। হঠাৎই এক ক্রেতা চালভর্তি বাটির দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করলেন— “এক ডেরিকা কত?” সঙ্গে সঙ্গে বিক্রেতা পুরনো এক টিন কৌটায় চাল ভরে দেখালেন। টিনের গায়ে কোনো লেখা নেই, রঙ মুছে গেছে বহু আগেই। তবু সবাই জানে—এই পরিমাপই হলো ডেরিকা।

একটি ব্র্যান্ড থেকে এককের জন্ম

লাগোস, পোর্ট হারকোর্ট কিংবা এনুগু—নাইজেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সর্বত্র ডেরিকা এখন এক প্রচলিত মাপের একক। অথচ এর মূল উৎস একটি ব্র্যান্ড: ডে রিকা (De Rica) টমেটো পেস্ট।ষাটের দশক থেকেই নাইজেরিয়ার রান্নাঘরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইতালির এই টমেটো পেস্ট। এতটাই প্রচলিত ছিল যে, মানুষ টমেটো পেস্ট বলতে প্রায়শই শুধু ‘ডেরিকা’ই বলত। নাইজেরিয়ার খাদ্যলেখক ইয়েমিসি আরিবিসালা স্মরণ করেন—“ডেরিকা তখন সর্বত্র পাওয়া যেত। সবাই ভাবত এটিই সেরা টমেটো পেস্ট।”

খাবার মাপার জন্য দামি ওজন মেশিন কেনা ছিল প্রায় অসম্ভব। অথচ বাজারে অব্যবহৃত খালি টিন পড়ে থাকত হাতের নাগালেই। ফলে বিক্রেতারা দ্রুতই ৪০০ গ্রাম ওজনের এই কৌটাগুলো ব্যবহার শুরু করেন চাল, ডাল বা শিম মাপার কাজে। একেক স্কুপ হয়ে উঠল একেকটা ডেরিকা।

ইতালি থেকে নাইজেরিয়া

ডে রিকা ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু ১৯১২ সালে ইতালির এমিলিয়া-রোমাগনা অঞ্চলে একটি টমেটো প্রক্রিয়াজাত কারখানায়। কবে এটি প্রথম নাইজেরিয়ায় এলো তা নিশ্চিত নয়, তবে ষাটের দশক থেকেই নাইজেরীয়রা এর সঙ্গে পরিচিত। ব্যবসায়ী হেনরি এনজোকু জানান, তিনি আশির দশকে ইমো স্টেট থেকে লাগোসে আসেন, তখনই বাজারে ‘ডেরিকা’ শব্দটি চালু ছিল।

আইকনিক কৌটার পতন

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজারে সোনিয়া ও জিনোর মতো সস্তা ও জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছড়িয়ে পড়ে। আর ২০১৭ সালে নাইজেরিয়া সরকার টমেটো পেস্ট আমদানি নিষিদ্ধ করে। স্থানীয়ভাবে টিন উৎপাদন ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় ডে রিকা-সহ বেশিরভাগ কোম্পানি প্লাস্টিকের স্যাশেতে পণ্য বিক্রি শুরু করে। ফলে হারিয়ে যায় সেই চেনা টিন কৌটা। লাগোসের পাইকারি বিক্রেতা আগাথা ওকোনকো বলেন, “এক সময় ডেরিকা মানেই ছিল টমেটো পেস্ট। এখন শুধু স্যাশেতে পাওয়া যায়।”

অটল ব্র্যান্ডনিষ্ঠা

তবুও অনেকের কাছে ডেরিকা আজও অবিস্মরণীয়। আবুজার একটি অভিজাত হোটেলের শেফ ভিক্টর মোজেস বলেন, তার বিশেষ স্মোকি জলোফ রাইস-এর গোপন রহস্য হলো সামান্য পুড়িয়ে রান্না করা চালের সঙ্গে ডেরিকা মেশানো। এটি নাকি খাবারে অনন্য স্বাদ ও উজ্জ্বল লাল রং আনে। ইউরোপের বাজারেও প্রবাসী নাইজেরীয়দের কারণে আবারও জনপ্রিয় হচ্ছে ডেরিকা। ডাচ আমদানিকারক সংস্থা ইউনিডেক্সের কর্মকর্তা টিম শেইজনোগার মতে, “নাইজেরীয়রা ব্র্যান্ড সচেতন। একবার যে ব্র্যান্ডে আস্থা রাখে, তা সারা জীবন আঁকড়ে ধরে রাখে।”

টিন নেই, নাম রয়ে গেছে

আজ আর ডে রিকার টিন নাইজেরিয়ার বাজারে মেলে না। চাল, ডাল বা বীজ মাপতে বিক্রেতারা হয়তো অন্য ব্র্যান্ডের খালি কৌটা ব্যবহার করেন। কিন্তু মাপের নাম এখনো একটাই—ডেরিকা।যে ব্র্যান্ড একসময় শুধু রান্নাঘরের উপকরণ ছিল, সেটি আজ নাইজেরিয়ার খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। টমেটো পেস্টের এক টিন তাই পরিণত হয়েছে পরিচয়ের প্রতীকে—একটি সাধারণ জিনিস, যার গল্প অসাধারণ।


হিটলার কেন ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন? নেপথ্যের কারণ কী?

২০২৫ অক্টোবর ১৩ ২০:৫৭:০১
হিটলার কেন ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন? নেপথ্যের কারণ কী?
ছবিঃ সংগৃহীত

১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল, এই পাঁচ বছরের মধ্যে অ্যাডলফ হিটলার প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন। এই ভয়াবহ গণহত্যার পর তিনি বলেছিলেন যে, কিছু ইহুদিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন কারণ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানতে পারে কেন তিনি এই হত্যাযজ্ঞে মেতেছিলেন। গ্যাস চেম্বার, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা গণগুলি বর্ষণের মতো ভয়ানক উপায়ে হিটলার ইহুদি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। শুধু ইহুদি নয়, তিনি ১ লাখ সমকামী পুরুষকেও হত্যা করেছিলেন।

আত্মহত্যার আগে, ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল, হিটলার একটি নোটে লিখেছিলেন যে, কয়েক শতাব্দী পর ইহুদিরা পৃথিবীতে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালাবে এবং ইউরোপীয়রা এই রক্তপাতের জন্য দায়ী থাকবে।

ইহুদিদের প্রতি হিটলারের ঘৃণার কারণ:

নিকৃষ্ট জীব ও অশান্তির মূল: হিটলার ইহুদিদেরকে 'নিকৃষ্ট জীব' (আর্গানিমাস নিদ্রিম নিভেউ) বলে অভিহিত করতেন। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী 'মাইন ক্যাম্প' (Mein Kampf) বইয়ে তিনি লেখেন, "পৃথিবীর সকল অশান্তির মূল ইহুদিরাই। নর্দমার কিটের মতো তাদের আচরণ, এরা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে মানব সমাজের ধ্বংস শুরু করে"।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা:

আর্ট স্কুলের প্রত্যাখ্যান: জন্মসূত্রে অস্ট্রিয়ান হিটলারের স্বপ্ন ছিল চিত্রশিল্পী হওয়ার। কিন্তু ভিয়েনার আর্ট স্কুল একাডেমি টানা দুই বছর তার ভর্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। শোনা যায়, সেই আর্ট স্কুলের রেক্টর ছিলেন একজন ইহুদি, এবং ধারণা করা হয় এখান থেকেই তার ইহুদি বিদ্বেষের সূত্রপাত।

মায়ের চিকিৎসকের ধর্ম: হিটলারের মা ক্লারা হিটলার স্তন ক্যান্সারে মারা যান। তার চিকিৎসা করেছিলেন একজন ইহুদি চিকিৎসক ডক্টর এডোয়ার্ড ব্লক। কিছু মানুষ দাবি করে, মায়ের মৃত্যুর কারণে ইহুদিদের প্রতি হিটলারের ক্ষোভ বেড়েছিল, যদিও এই যুক্তি যথেষ্ট দুর্বল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়: ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শোচনীয় পরাজয় হয়। হিটলার নিজে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জার্মান আর্মির সঙ্গে কাজ করেছিলেন। তিনি এবং অনেক জার্মান জাতীয়তাবাদী বিশ্বাস করতেন যে, জার্মানি যুদ্ধে পরাজিত হয়নি, বরং দেশের অভ্যন্তরে থাকা ইহুদি ও সমাজতান্ত্রিকরাই জার্মানির বুকে ছুরি মেরেছে। এই ধারণা থেকেই হিটলার ইহুদিদেরকে 'বেইমান জাতি' মনে করতে শুরু করেন এবং তাদের কারণেই জার্মানির পরাজয় হয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন।

ক্ষমতায় আগমন ও জনসমর্থন: ১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব এবং হতাশায় ভোগা জার্মান জনগণকে তিনি আশার আলো দেখিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে এবং দেশের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর হবে—এই বিশ্বাস তিনি জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন। এই বিপুল জনসমর্থন ছাড়া হিটলারের পক্ষে ইহুদি নিধনযজ্ঞ চালানো সম্ভব হতো না।

হলোকাস্ট ও ফাইনাল সলিউশন:

১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে সংঘটিত ইহুদি নিধনের এই প্রয়াসকে 'হলোকাস্ট' (Holocaust) বলা হয়। হিটলারের 'ফাইনাল সলিউশন' (Final Solution) নীতির ওপর ভিত্তি করে হলোকাস্ট বাস্তবায়িত হয়েছিল। 'ফাইনাল সলিউশন' বলতে হিটলারের সেই চূড়ান্ত পরিকল্পনাকে বোঝায়, যার লক্ষ্য ছিল ইউরোপ থেকে ইহুদি জাতিকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এই পরিকল্পনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪২ সালে ওয়ানসি কনফারেন্সে গৃহীত হয়।

ইউরোপীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

হিটলারের ইহুদি গণহত্যার খবর প্রচারের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে একপেশে নীতি অনুসরণের অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়, গণমাধ্যমগুলো হিটলারের নৃশংসতা এবং ৬০ লাখ ইহুদি হত্যার ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরলেও, কী কারণে তিনি এতটা ইহুদি-বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন, সেই প্রেক্ষাপটকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এড়িয়ে যায়।

অভিযোগ রয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পেছনে ইহুদিদের কথিত ষড়যন্ত্রের মতো বিষয়গুলো ইউরোপীয় গণমাধ্যম সচেতনভাবে চেপে রাখে। একইভাবে, হিটলারের কিছু ভিন্ন দিক, যেমন তাঁর ধূমপান-বিরোধী কঠোর প্রচারণা বা সমকামিতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান, এগুলো নিয়েও আলোচনা করা হয় না বলে মনে করা হয়।

ধারণা করা হয়, এই একপেশে প্রচারণার মূল কারণ হলো, গণহত্যার পেছনের কারণগুলো প্রকাশ পেলে ইহুদিদের কথিত ষড়যন্ত্র এবং তাতে ইউরোপীয়দের স্বার্থ জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে পারে, যা গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়।


পূর্বের আটলান্টিস: চীনের সেই ডুবো শহর যেখানে সময় থেমে আছে!

২০২৫ অক্টোবর ১৩ ১৯:১৬:৪১
পূর্বের আটলান্টিস: চীনের সেই ডুবো শহর যেখানে সময় থেমে আছে!
ছবিঃ সংগৃহীত

চীনের ঝেঝিয়াং প্রদেশের কিয়ানদাও হ্রদের গভীর তলদেশে লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন শহর— শি চেং, যার অর্থ 'সিংহ শহর'। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে পূর্ব হান রাজবংশের আমলে গড়ে ওঠা এই শহরটি একসময় অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন ছিল। রাজপ্রাসাদ, পাথরের খোদাই করা তোরন, রাজকীয় মন্দির, সুশৃঙ্খল বাজার এবং পাথরের খিলান ও সিংহ মূর্তিতে সাজানো রাস্তা নিয়ে এটি দক্ষিণ চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। এক লাখেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল এই শহরটি তার চারপাশের পাহাড় ও নদীর সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল।

ডুবে যাওয়ার পেছনের ইতিহাস:

১৯৫০-এর দশকে চীন যখন শিল্পায়নের পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল, তখন সরকারের একটি বড় পরিকল্পনা ছিল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সিনান নদীর উপর বিশাল বাঁধ নির্মাণ করা। ১৯৫৯ সালে গড়ে ওঠে কিয়ানদাও হ্রদ প্রকল্প, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যাম তৈরি করবে। কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য যে বিশাল জলাধার প্রয়োজন ছিল, তার গভীরে চলে যেত শি চেং সহ প্রায় ১৩৭৭টি গ্রাম এবং একাধিক শহর। সরকার মাত্র কয়েক মাসের নোটিশে এসব এলাকার মানুষদের উচ্ছেদ করে, এবং হাজার বছরের ইতিহাস ও স্মৃতির শহর শি চেং নিমেষেই পানির নিচের নগরীতে পরিণত হয়।

অক্ষত অবস্থায় টিকে থাকার রহস্য:

সাধারণত পানির নিচে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো কাঠামো অক্ষত থাকে না, কিন্তু শি চেং যেন সময়ের নিয়ম মানতে অস্বীকার করেছে। ২০০১ সালে যখন ডুবুরিরা প্রথম এই শহরটি খুঁজে পান, তখন তারা বিস্মিত হয়ে দেখেন যে, পাঁচতলা ভবন, রাস্তার খিলান, মন্দিরের খোদাই করা সিংহ ও ড্রাগনের মূর্তি সবই প্রায় অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। এমনকি দরজার ফ্রেম ও কাঠের শিল্পকর্মও অনেক জায়গায় অক্ষত ছিল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পানির নিচে স্থিরতা, অক্সিজেনের স্বল্পতা এবং সূর্যের আলো না পৌঁছানো— এই তিনটি কারণে শহরটি প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত হয়ে আছে। কিয়ানদাও হ্রদের পানির তাপমাত্রা সারা বছর প্রায় একই থাকে, যা শহরের কাঠামো রক্ষা করেছে।

অটলান্টিস অফ দ্য ইস্ট:

আজ শি চেং ডুবুরিদের জন্য এক স্বর্গ, যেখানে অভিজ্ঞ ডুবুরিরা পানির নিচের এক বিশাল রাজপ্রাসাদে ভাসার অনুভূতি পান। নীলচে সবুজ পানির গভীরে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের তোরন, খোদাই করা সিংহ মূর্তি এবং চীনা ড্রাগনের কারুকাজ এক মায়াবী অনুভূতি দেয়। বহু আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল, ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং ইতিহাসবিদ এখানে গবেষণা করেছেন। চীনের সরকার এখন এই শহরকে "অটলান্টিস অফ দ্যা ইস্ট" বা "পূর্বের অটলান্টিস" বলছে এবং পর্যটকদের জন্য এখানে বিশেষ ডাইভিং ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে। হাজার বছরের পুরনো এই শহরকে পানির নিচে সুরক্ষিত রাখতে নানা প্রকল্পও চলছে।

শি চেং শুধু একটি শহর নয়, এটি মানুষের অগ্রগতির নামে ইতিহাসের মর্মান্তিক সিদ্ধান্তের এক জীবন্ত সাক্ষ্য। শিল্পায়নের তাড়নায় আমরা কত সভ্যতাকে হারিয়ে ফেলেছি, তারই প্রতিচ্ছবি এই ডুবে যাওয়া নগরী।


কুরআন ও বিজ্ঞানের মহাবিস্ময়: যেভাবে মিলে যাচ্ছে ‘বিগ ক্রাঞ্চ’ তত্ত্ব ও কিয়ামতের ভবিষ্যদ্বাণী!

২০২৫ অক্টোবর ১২ ২১:২৮:২৩
কুরআন ও বিজ্ঞানের মহাবিস্ময়: যেভাবে মিলে যাচ্ছে ‘বিগ ক্রাঞ্চ’ তত্ত্ব ও কিয়ামতের ভবিষ্যদ্বাণী!

মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে যেমন 'বিগ ব্যাং' (Big Bang) তত্ত্ব বহুল পরিচিত, তেমনই এর সম্ভাব্য শেষ পরিণতি নিয়েও বিজ্ঞানীরা এক নতুন তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন, যার নাম 'বিগ ক্রাঞ্চ' (Big Crunch)। আশ্চর্যজনকভাবে, এই তত্ত্বের সাথে ইসলামী আকিদায় বর্ণিত কিয়ামতের দিনের ধারণার এক গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি আধুনিক বিজ্ঞানও কিয়ামতকে 'স্বীকার' করতে শুরু করেছে? কোরআন ও বিজ্ঞান মহাবিশ্বের এই শেষ অধ্যায় সম্পর্কে কী বলে?

বিগ ক্রাঞ্চ কী?

প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে 'বিগ ব্যাং'-এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্ম হয়। এরপর থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে থাকে, যেখানে তারকা, গ্যালাক্সি, গ্রহ, নক্ষত্র সবই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা প্রথমে ভেবেছিলেন মহাকর্ষ এই সম্প্রসারণ থামিয়ে দেবে, কিন্তু ১৯৯৮ সালে তারা জানতে পারেন যে মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিতই হচ্ছে না, বরং 'ডার্ক এনার্জি' (Dark Energy) নামক এক রহস্যময় শক্তির প্রভাবে এটি দ্রুত গতিতে প্রসারিত হচ্ছে।

তবে নতুন গবেষণা বলছে, এই ডার্ক এনার্জিও একসময় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যদি মহাকর্ষ তখন শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাহলে মহাবিশ্বের প্রসারণ থেমে গিয়ে সংকোচন শুরু হবে। এই সংকোচনকেই বিজ্ঞানীরা 'বিগ ক্রাঞ্চ' নাম দিয়েছেন।

বিগ ক্রাঞ্চের পরিণতি

'বিগ ক্রাঞ্চ' তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে শুরু করলে গ্যালাক্সিগুলো ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে ধেয়ে আসবে, গ্রহ ও তারাগুলোর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটবে। সময় ও স্থান 'রিভার্স মোডে' (reverse mode) চলে যাবে, এবং পুরো মহাবিশ্ব যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে। মহাবিশ্ব তার চিরচেনা রূপ হারাবে এবং আমরা যেভাবে মহাবিশ্বকে জানি, তার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

কোরআন ও বিগ ক্রাঞ্চের মিল

বিগ ক্রাঞ্চের এই ধারণা, যেখানে গ্যালাক্সি, গ্রহ, তারা এমনকি সময় সবকিছু একসাথে গুটিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে, তা ইসলামী আকিদায় বর্ণিত কিয়ামতের দিনের অবস্থার সাথে অনেক মিল রাখে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: "সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নিব যেমন গুটানো হয় লিখিত কাগজপত্র। যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। ওয়াদা পালন করা আমার কর্তব্য, আমি তা পালন করবই"। এই আয়াত স্পষ্টভাবে মহাবিশ্বের সংকোচন বা গুটিয়ে নেওয়ার ধারণাকে সমর্থন করে।

কোরআনে আরও বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের পর আল্লাহ সবকিছু নতুন করে সৃষ্টি করবেন। বিজ্ঞানও 'বিগ ক্রাঞ্চ'-এর পর আরেকটি নতুন মহাবিশ্বের জন্মের সম্ভাবনার কথা বলে, যাকে তারা 'বিগ বাউন্স' (Big Bounce) নাম দিয়েছে।

সময় ও স্থান রিভার্স মোডে চলে যাওয়ার বিষয়ে কোরআনের অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে: "এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়কে দেখবে ভয়ে নত যেন হয়ে আছে। প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের আমলনামা দেখতে বলা হবে, তোমরা যা করতে অদ্য তোমাদেরকে তার প্রতিফল দেয়া হবে"। এই আয়াত ইঙ্গিত দেয় যে, কিয়ামতের দিনে সময়ের পুনরাবৃত্তি বা প্রতিফলন ঘটবে, যেখানে মানুষের সমস্ত কাজ তাদের সামনে প্রকাশিত হবে, যা বিগ ক্রাঞ্চে মহাবিশ্বের পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

দেখা যাচ্ছে, কোরআন ও বিজ্ঞান উভয়ই মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে প্রায় একই রকম ধারণা দিচ্ছে। কোরআন এটিকে আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করে এর অবশ্যম্ভাবিতা নিশ্চিত করেছে, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান এখনও এটিকে হাইপোথেটিক্যাল বা কল্পবিজ্ঞানের পর্যায়ে রেখে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। 'বিগ ক্রাঞ্চ' বা কিয়ামত, উভয়ই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই মহাবিশ্ব চিরকাল থাকবে না, এবং দুনিয়াতে আমাদের প্রতিটি কাজ ও পদক্ষেপের গুরুত্ব অপরিসীম।


চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং-এর রহস্যময় সমাধি: মাটির সেনাবাহিনী, পারদের নদী আর অমরত্বের অভিশাপ

২০২৫ অক্টোবর ১০ ১২:২১:২৭
চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং-এর রহস্যময় সমাধি: মাটির সেনাবাহিনী, পারদের নদী আর অমরত্বের অভিশাপ

রহস্য—এই শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে কোনো অজানা, অলৌকিক বা অতি প্রাকৃত ঘটনার ছায়া। ইতিহাসেও এমন বহু রহস্য লুকিয়ে আছে, যা আজও বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়। আজ আমরা জানব এমনই এক সত্যিকারের ঐতিহাসিক রহস্য—চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং-এর সমাধি—যা আজও মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং অমীমাংশিত রহস্যগুলোর একটি।

খ্রিস্টপূর্ব ২২১ সালে চীনকে প্রথমবারের মতো একত্রিত করে এক সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন কিন শি হুয়াং। তাঁর নেতৃত্বেই চীনের প্রাচীর নির্মাণের সূচনা হয়। কিন্তু এই সম্রাটের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কেবল শাসনক্ষমতায় সীমাবদ্ধ ছিল না—তিনি মৃত্যুর পরও “অমর” হয়ে থাকার স্বপ্ন দেখতেন। সেই অদ্ভুত স্বপ্ন থেকেই শুরু হয় তাঁর বিশাল সমাধি নির্মাণের কাজ। মাত্র ১৩ বছর বয়সে রাজা হওয়ার পর তিনি নিজের সমাধি নির্মাণের আদেশ দেন, যা চলেছিল ৩৮ বছর ধরে—তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

এই সমাধি কোনো সাধারণ কবরস্থান নয়; এটি আসলে একটি ভূগর্ভস্থ রাজপ্রাসাদ—যেখানে লুকিয়ে আছে সেনাবাহিনী, ধনরত্ন, মারাত্মক ফাঁদ এবং রহস্যময় বিষাক্ত নদী। ইতিহাস বলে, সম্রাট তাঁর মৃত্যুর পরও যেন রাজা হিসেবেই রাজত্ব করেন, সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছিল এই “অমর প্রাসাদ”।

এই রহস্যের আবিষ্কার ঘটে ১৯৭৪ সালে, যখন কিছু চীনা কৃষক সেচের জন্য কূপ খনন করতে গিয়ে হঠাৎ মাটির নিচে সৈন্যদের আকৃতির বিশাল মূর্তি দেখতে পান। পরে প্রত্নতাত্ত্বিকরা যখন খনন শুরু করেন, দেখা যায় হাজার হাজার মাটির সৈন্য, যাদের মুখাবয়ব, পোশাক, এমনকি চুলের বিন্যাস পর্যন্ত একে অপরের থেকে ভিন্ন। যেন আসল কোনো সেনাবাহিনীকে মাটির ভাস্কর্যে রূপ দেওয়া হয়েছে। আজ এই অবিশ্বাস্য আবিষ্কারটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত ‘টেরাকোটা আর্মি’ নামে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রতিটি মূর্তি বাস্তব আকারের এবং এমন নিখুঁতভাবে তৈরি যে মনে হয়, তারা মুহূর্তেই জীবন্ত হয়ে উঠবে। সৈন্যদের পাশাপাশি পাওয়া গেছে ঘোড়া, রথ, ধনুক-বাণ, অস্ত্র—সবই মাটির তৈরি। ইতিহাসবিদদের মতে, এই মাটির সৈন্যরা ছিল সম্রাটের পরকালীন প্রহরী, যারা মৃত্যুর পরও তাঁর রাজ্য রক্ষা করবে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয় রহস্যের জাল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখনো পর্যন্ত মূল সমাধি চেম্বারে প্রবেশ করেননি। কারণ, প্রাচীন নথিতে উল্লেখ আছে, সমাধির ভেতরে তৈরি করা হয়েছিল পারদের নদী—যেখানে পারদ বা মার্কারি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম জলপ্রবাহ। আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন অস্বাভাবিক মাত্রার পারদের উপস্থিতি, যা প্রমাণ করে যে সমাধির ভেতর সত্যিই কোনো মারাত্মক রাসায়নিক ফাঁদ বিদ্যমান। পারদের ঘনত্ব এত বেশি যে, সমাধিতে প্রবেশ করলে মানুষ মুহূর্তে মৃত্যুবরণ করতে পারে।

চীনা প্রাচীন দলিল “শিজি” তে বলা আছে, সম্রাটের কফিনের চারপাশে স্থাপন করা হয়েছিল যান্ত্রিক ফাঁদ—যা এখনো সক্রিয় থাকতে পারে। বলা হয়, কেউ যদি সমাধির ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে, এই ফাঁদগুলো সক্রিয় হয়ে প্রাণঘাতী তীর ছুড়ে মারবে অনধিকারপ্রবেশকারীকে। এ কারণেই আজ পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানী বা প্রত্নতত্ত্ববিদ সমাধির কেন্দ্রে প্রবেশের সাহস করেননি।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই সমাধির ভেতরে বিলিয়ন ডলারের মূল্যবান রত্ন ও প্রাচীন নিদর্শন লুকিয়ে আছে। কারণ যিনি জীবিত অবস্থায় নিজেকে দেবতুল্য মনে করতেন, মৃত্যুর পরেও তাঁর জন্য নিশ্চিতভাবে তৈরি করা হয়েছিল “অমর রাজ্য”—যেখানে সব থাকবে যেমন ছিল জীবদ্দশায়।

আজ পর্যন্ত চীনা সরকারও এই সমাধি খোলার অনুমতি দেয়নি। তাদের বক্তব্য, বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে সমাধির ভেতরের শিল্পকর্ম ও জীবাশ্ম সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়; তাই অযথা ইতিহাসের এই মহামূল্যবান রহস্যকে নষ্ট করা ঠিক হবে না।

তবুও প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে হাজারো মানুষ চীনের শানশি প্রদেশের শি’আন শহরে আসে কেবল এক ঝলক দেখার জন্য—কিন শি হুয়াং-এর সেই রহস্যময় সেনাবাহিনীর। কেউ কেউ বলেন, এই সমাধি আসলে অমরত্বের প্রতীক, আবার কেউ মনে করেন, এটি এক অভিশপ্ত রাজ্যের দরজা—যেখানে সময় থেমে আছে ২,২০০ বছর ধরে।

একটি সমাধির ভেতরে রাজপ্রাসাদ, সেনাবাহিনী, বিষাক্ত নদী, অমরত্বের স্বপ্ন আর শতাব্দীর গোপন রহস্য—সব মিলিয়ে কিন শি হুয়াং-এর এই সমাধি শুধু ইতিহাস নয়, এক জীবন্ত ধাঁধা, যার উত্তর হয়তো মানবসভ্যতা কখনোই পুরোপুরি জানতে পারবে না।


বিপ্লব থেকে স্বৈরশাসন? ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর রাজনৈতিক বার্তা

২০২৫ অক্টোবর ০৭ ১৮:২৭:১০
বিপ্লব থেকে স্বৈরশাসন? ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর রাজনৈতিক বার্তা
ছবি: সংগৃহীত

যেকোনো রাজনৈতিক বিপ্লব বা ক্ষমতার পালাবদলের পর জর্জ অরওয়েলের কালজয়ী রূপক উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কেন বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে? ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত এই বইটি কেবল একটি রূপকথার গল্প নয়, বরং এটি ক্ষমতা, আদর্শচ্যুতি এবং দুর্নীতির এক নির্মম আয়না, যা যেকোনো দেশের যেকোনো সময়ের জন্যই এক শক্তিশালী সতর্কবার্তা।

এক নতুন দিনের স্বপ্ন

ইংল্যান্ডের এক খামারের মালিক ছিলেন মিস্টার জোনস।

মি. জোন্স; Source: villains.wikia

তিনি পশুদের দিয়ে দিনরাত খাটাতেন, কিন্তু তাদের ঠিকমতো খাবার দিতেন না এবং তাদের ওপর অনেক অত্যাচার করতেন। একদিন, খামারের সবচেয়ে বয়স্ক এবং জ্ঞানী শুকর ‘ওল্ড মেজর’

বৃদ্ধ মেজর; Source: pinterest.com

সব পশুদের নিয়ে এক গোপন সভা ডাকে। সে তার দেখা এক স্বপ্নের কথা বলে—এমন এক স্বপ্নের কথা, যেখানে কোনো মানুষের শাসন নেই, পশুরা স্বাধীন এবং তাদের খাটুনির সব ফসল তারাই ভোগ করছে। তার ভাষণে পশুরা এতটাই উৎসাহিত হয় যে, তারা মানুষের শাসনের অবসানের জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকে।

বিদ্রোহের সেই দিন

ওল্ড মেজর কিছুদিন পর মারা গেলেও, তার দেখানো স্বপ্ন পশুদের মনে গেঁথে ছিল। একদিন মিস্টার জোনস মদ খেয়ে এসে পশুদের খাবার দিতেই ভুলে যান। ক্ষুধার্ত পশুদের সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তারা সবাই মিলে একসঙ্গে জোনসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে খামার থেকে তাড়িয়ে দেয়। সেই রাত ছিল তাদের মুক্তির রাত। তারা মানুষের অত্যাচারের সমস্ত চিহ্ন, যেমন—চাবুক, লাগাম, ছুরি—সবকিছু আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং খামারের নতুন নাম দেয় ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বা ‘পশু খামার’।

পশুরা মিলেমিশে থাকার জন্য সাতটি নিয়ম তৈরি করে, যা খামারের বড় দেয়ালে লিখে রাখা হয়। নিয়মগুলো ছিল খুব সহজ:

১. যারা দুই পায়ে হাঁটে, তারা শত্রু।২. যারা চার পায়ে হাঁটে বা যাদের ডানা আছে, তারা বন্ধু।৩. কোনো পশু মানুষের পোশাক পরবে না।৪. কোনো পশু মানুষের বিছানায় ঘুমাবে না।৫. কোনো পশু মদ পান করবে না।৬. কোনো পশু অন্য কোনো পশুকে হত্যা করবে না।৭. সব পশু সমান।

প্রথম মিথ্যা এবং বৈষম্যের শুরু

প্রথমদিকে সবকিছু খুব ভালোভাবেই চলছিল। পশুরা আগের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করে অনেক ফসল ফলালো। কিন্তু সমস্যার শুরু হলো তখনই, যখন খামারের গরুর দুধ দোহানোর পর তা গায়েব হয়ে গেল। পরে জানা গেল, বুদ্ধিমান বলে পরিচিত শুকররা সেই দুধ নিজেদের জন্য রেখে দিয়েছে। তারা বাকি পশুদের বোঝালো, “আমরাই তো খামারের সব কাজ বুদ্ধি দিয়ে চালাই। আমাদের মাথা খাটানোর জন্য ভালো খাবার দরকার। আমরা যদি ঠিকমতো খেতে না পাই, তাহলে বুদ্ধি কাজ করবে না এবং মিস্টার জোনস আবার ফিরে আসবে। তোমরা কি চাও জোনস ফিরে আসুক?” ভয়ে সব পশু চুপ করে গেল। আর এভাবেই খামারে শুরু হলো প্রথম বৈষম্য।

দুই নেতার ঝগড়া এবং একনায়কের শাসন

খামারের পশুদের মধ্যে দুটি শুকর—স্নোবল ও নেপোলিয়ন—ছিল সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং তারাই খামারের নেতা হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে সব সময় ঝগড়া লেগে থাকত। স্নোবল চাইত একটি বায়ুকল তৈরি করতে, যা থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হবে এবং পশুদের কাজ অনেক কমে যাবে। কিন্তু নেপোলিয়ন এর বিরোধিতা করত।

তাদের দ্বন্দ্ব যখন চরমে, তখন নেপোলিয়ন এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করে। সে তার গোপনে পালন করা কয়েকটি হিংস্র কুকুরকে লেলিয়ে দিয়ে স্নোবলকে খামার থেকে তাড়িয়ে দেয়।

কুকুরগুলো নেপোলিয়নের নির্দেশে স্নোবলকে হিংস্রভাবে ধাওয়া করে; Image Source: telegraph

এরপর সে নিজেকে খামারের একচ্ছত্র অধিপতি বা নতুন রাজা হিসেবে ঘোষণা করে।

নতুন রাজার অধীনে কঠিন জীবন

নেপোলিয়নের শাসনে পশুদের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। সে স্নোবলের সেই বায়ুকল তৈরির পরিকল্পনা চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয় এবং পশুদের আগের চেয়েও দ্বিগুণ খাটাতে শুরু করে। যখন প্রবল ঝড়ে বায়ুকলটি ভেঙে যায়, তখন নেপোলিয়ন মিথ্যা প্রচার করে যে, পালিয়ে যাওয়া স্নোবল এসে এটি ভেঙে দিয়ে গেছে। স্নোবলকে ‘জনগণের শত্রু’ বলে ঘোষণা করা হয় এবং খামারের সমস্ত খারাপ ঘটনার জন্য তাকেই দায়ী করা হতে থাকে।

ধীরে ধীরে শুকররা খামারের সাতটি নিয়মই ভাঙতে শুরু করে। তারা মানুষের বাড়িতে থাকতে শুরু করে, তাদের বিছানায় ঘুমাতে শুরু করে। যখন অন্য পশুরা প্রশ্ন তুলত, তখন তাদের ভয় দেখানো হতো যে, বেশি কথা বললে মিস্টার জোনস ফিরে আসবে।

সবচেয়ে দুঃখের গল্প: এক বিশ্বাসী কর্মীর করুণ পরিণতি

খামারে বক্সার নামে একটি ঘোড়া ছিল, যে ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বিশ্বাসী কর্মী।তার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল দুটি—"আমি আরও বেশি পরিশ্রম করব" এবং "নেপোলিয়ন সবসময় সঠিক"। সে নিজের শরীরের কথা না ভেবে দিনরাত খাটত।

বক্সার; Source: shukketsushi665 – DeviantArt

একদিন অতিরিক্ত পরিশ্রমে বক্সার অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। নেপোলিয়ন বাকি পশুদের বলে যে, সে বক্সারকে চিকিৎসার জন্য শহরের সবচেয়ে ভালো পশু হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। কিন্তু আসলে সে বক্সারকে টাকার বিনিময়ে এক কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়, যে তাকে মেরে ঘোড়ার মাংস ও আঠা তৈরি করবে। সেই টাকা দিয়ে শুকররা মদ কিনে উৎসব করে। সবচেয়ে বিশ্বাসী কর্মীর সাথে এই চরম বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে নেপোলিয়নের নিষ্ঠুরতার আসল রূপ প্রকাশ পায়।

সবকিছু বদলে গেল: নতুন অত্যাচার

বছরের পর বছর কেটে যায়। খামারের নতুন প্রজন্মের পশুরা বিদ্রোহের কথা ভুলে যায়। তাদের ইতিহাস বইয়ে কেবল নেপোলিয়নের বীরত্বের কথাই লেখা থাকে। একদিন পশুরা এক অবাক করা দৃশ্য দেখে। তারা দেখে, তাদের নেতা নেপোলিয়ন এবং অন্যান্য শুকররা মানুষের মতো দুই পায়ে হাঁটছে!

খামারের দেয়ালে লেখা সাতটি নিয়ম মুছে দিয়ে সেখানে লেখা হয় মাত্র একটি নিয়ম:

Source: Decoding Satan“সব পশু সমান, কিন্তু কিছু পশু অন্যদের চেয়ে বেশি সমান।”

গল্পের শেষে দেখা যায়, শুকররা মানুষের পোশাক পরে মানুষের সাথেই তাস খেলছে আর মদ খাচ্ছে। বাইরে থেকে তাকিয়ে থাকা বাকি পশুদের কাছে তখন শুকর এবং মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য বোঝা যাচ্ছিল না। যে অত্যাচারী মানুষের বিরুদ্ধে তারা একদিন বিদ্রোহ করেছিল, তাদের নতুন নেতারা এখন সেই মানুষের মতোই হয়ে গেছে।

কেন ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ আজও প্রাসঙ্গিক?

‘অ্যানিমেল ফার্ম’ দেখায় যে, শুধু শাসক পরিবর্তনই মুক্তি নয়। বিপ্লবের পর যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আদর্শের চর্চা না থাকে, তবে সেই বিপ্লব নিজেই এক নতুন স্বৈরশাসনের জন্ম দিতে পারে। এটি যেকোনো সমাজের জন্য একটি শক্তিশালী সতর্কবার্তা, যা ক্ষমতা ও দুর্নীতির চিরন্তন চক্রকে উন্মোচিত করে।


পৃথিবীর ধ্বংসের সময় ২০৬০ সাল? নিউটনের রহস্যময় ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়!

২০২৫ অক্টোবর ০৭ ১৬:০০:৪৭
পৃথিবীর ধ্বংসের সময় ২০৬০ সাল? নিউটনের রহস্যময় ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়!
সত্য নিউজ গ্রাফিক্স

মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন, যিনি গতি ও মহাকর্ষ সূত্রের জন্য বিখ্যাত, তিনি নাকি পৃথিবীর ধ্বংসের সুনির্দিষ্ট একটি সাল ঘোষণা করে গেছেন। প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি আগে করা তার এই ভবিষ্যদ্বাণী বর্তমান সময়ে এসে আবারও বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। নিউটনের মতে, ২০৬০ সালেই পৃথিবীর সমস্ত কিছুর অবসান ঘটবে। কিন্তু কোন সূত্রের ভিত্তিতে তিনি এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছিলেন?

বাইবেলের গণিত ও নিউটনের ভবিষ্যদ্বাণী

১৭১৪ সালে লেখা একটি চিঠিতে স্যার আইজ্যাক নিউটন পৃথিবীর শেষ সময় সম্পর্কে তার এই ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করেন। তিনি গতি ও মধ্যাকর্ষণ সূত্রের জন্য বিখ্যাত হলেও, এই ভবিষ্যদ্বাণীটি কোনো জটিল বৈজ্ঞানিক গণনা বা ক্যালকুলাসের ওপর ভিত্তি করে করেননি। বরং, বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার প্রতি বিশ্বাসী হয়ে তিনি বাইবেল শাস্ত্রের বিভিন্ন দিন ও বছরকে গণনার জন্য ব্যবহার করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সাল থেকে হিসাব করে নিউটন ২০৬০ সালকে পৃথিবীর শেষ সময় হিসেবে নির্ধারণ করেন।

কানাডার হেলিফ্যাক্সের কিংস কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসের অধ্যাপক স্টিফেন ডি স্নোবেলেন এই প্রসঙ্গে বলেন যে, নিউটন তার ভবিষ্যদ্বাণীতে শিশুদের পাটিগণিতের মতো সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বাইবেলের পবিত্র বুক অফ ডেল ও রেভলেশনসে উল্লিখিত ১২৬০, ১২৯০, ১৩৩৫ এবং ২৩০০ দিনগুলোকে গণনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন।

ভবিষ্যদ্বাণীর পেছনের উদ্দেশ্য

তবে, নিউটন শুধু পৃথিবীর ধ্বংসের সময় জানানোর উদ্দেশ্যেই এই ভবিষ্যদ্বাণী করেননি। তার চিঠিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, "পৃথিবীর শেষ সময় সম্পর্কে ঘন ঘন ভবিষ্যদ্বাণী করা সমস্ত কল্পনাকে বন্ধ করার জন্য আমি এটা করেছি। পবিত্র গ্রন্থনির্ভর ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ব্যর্থ হলে গ্রন্থ অসম্মানিত হয়"। অর্থাৎ, তিনি চেয়েছিলেন যেন মানুষ বারবার ভিত্তিহীন ভবিষ্যদ্বাণী করে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অসম্মান না করে।

বিজ্ঞানী নিউটন কি শুধুই বিজ্ঞানী ছিলেন?

অধ্যাপক স্নোবেলেনের মতে, আধুনিক অর্থে নিউটন কেবল একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন প্রাকৃতিক দার্শনিক। মধ্যযুগ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত প্রচলিত প্রাকৃতিক দর্শনে কেবল প্রকৃতির অধ্যয়নই অন্তর্ভুক্ত ছিল না, বরং প্রকৃতিতে ঈশ্বরের উপস্থিতি নিয়েও অধ্যয়ন করা হতো। নিউটনের জন্য ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো অভেদ্য পার্থক্য ছিল না। তিনি তার দীর্ঘজীবন জুড়ে প্রকৃতি ও ধর্মগ্রন্থের মধ্যে নিহিত সত্যগুলো আবিষ্কার করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন।

সুতরাং, আইজ্যাক নিউটনের এই ভবিষ্যদ্বাণী কেবল একটি গাণিতিক হিসাব নয়, বরং এটি বিজ্ঞান, ধর্ম এবং দর্শনের এক দুর্লভ মিশ্রণ, যা আজও মানুষকে বিস্ময় ও আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে।


বাবিলের অভিশাপ থেকে মায়ং-এর তন্ত্র: কালো জাদুর আদি ইতিহাস

২০২৫ অক্টোবর ০৬ ১৯:২২:০১
বাবিলের অভিশাপ থেকে মায়ং-এর তন্ত্র: কালো জাদুর আদি ইতিহাস
ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘শয়তান’ সিনেমার ট্রেইলারকে কেন্দ্র করে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে কালো জাদুর (Black Magic) অন্ধকার ও রহস্যময় জগৎ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকা এই গুপ্তবিদ্যার চর্চা আধুনিক যুগেও থেমে নেই। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের একটি গ্রামে পেরেকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত একটি রহস্যময় পুতুল পাওয়া যায়, যা বশীকরণ জাদুবিদ্যার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু কী এই কালো জাদু? এর উৎপত্তি কোথায় এবং এর ক্ষমতা কতটুকু?

মেক্সিকোর ডাইনি বাজার থেকে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা

কালো জাদুর চর্চা শুধু লোককথায় সীমাবদ্ধ নয়। মেক্সিকোতে অবস্থিত ‘সোনোরা উইচেস মার্কেট’ নামে একটি বাজার রয়েছে, যেখানে মাথার খুলি, পুতুল, জীবজন্তুর চামড়া থেকে শুরু করে কালো জাদুর বিভিন্ন সরঞ্জাম খোলাখুলিভাবে বিক্রি হয়। নৃতত্ত্ববিদ (Anthropologist) অ্যান্থনি জাভালেটা এই বাজারের ওপর ২৫ বছর ধরে গবেষণা চালান। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তথ্য অনুসারে, এক পর্যায়ে তিনি মেক্সিকোর উপত্যকায় ‘কালো জাদুর আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত একটি স্থানে পৌঁছান। সেখানে তিনি একটি বড় পাথরের নিচে কাচের বোতলে ভরা মানুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, জীবজন্তুর রক্ত, বাদুড়ের চামড়া এবং মানুষের চুল খুঁজে পান। জাভালেটার মতে, সেই বোতলগুলো ধ্বংস করার পর তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন, যা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।

প্রাচীন উৎস: বাবিল, মিশর এবং আসাম

ঐতিহাসিকভাবে কালো জাদুর চর্চা শুরু হয়েছিল প্রাচীন বাবিল শহরে। কুরআন ও বাইবেলের তথ্যমতে, এর সূচনা হয় হজরত ইদ্রিস (আ.) এর সময়ে হারুত ও মারুত নামক দুই ফেরেশতার মাধ্যমে। এছাড়া, প্রাচীন মিশরের পিরামিডের গায়ে হায়রোগ্লিফিক ভাষায় লেখা মন্ত্র এবং ‘বুক অফ দি ডেড’ নামক গ্রন্থেও এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে মিশরীয়দের মতে, জাদুর উদ্দেশ্য কেবল ক্ষতি করা ছিল না, বরং এর মূল লক্ষ্য ছিল মৃত্যুকে জয় করা, এমনকি মমিতে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার করা।

ভারতীয় উপমহাদেশে কালো জাদুর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত আসামের ‘মায়ং’ বা ‘ময়ং’ গুহা, যা ‘কালো জাদুর ভূমি’ নামে পরিচিত। মহাগ্রন্থে এই জায়গাকে ‘প্রাগজ্যোতিষপুর’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়, আসামের এই গুহা থেকেই প্রাচীন ভারতের তিনটি ভয়ঙ্কর কালো জাদুর সূত্রপাত হয়:

বশীকরণ (Vashikaran): কাউকে জাদুর মাধ্যমে নিজের আয়ত্তে আনা, যা ‘শয়তান’ সিনেমার মূল উপজীব্য।

মোহন ক্রিয়া (Mohon Kriya): এর মাধ্যমে যে কাউকে সম্মোহিত করা বা আকর্ষণ করা সম্ভব বলে মনে করা হয়।

মারণ ক্রিয়া (Maron Kriya): এটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বলে পরিচিত। এর মাধ্যমে প্রেত বা পিশাচ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা হয়। তবে মন্ত্র পাঠে সামান্য ভুল হলে, জাদু উল্টো প্রয়োগকারীরই প্রাণ কেড়ে নিতে পারে।

নেক্রোনমিকন এবং অমীমাংসিত রহস্য

কালো জাদু সম্পর্কিত যত বই পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হিসেবে ‘নেক্রোনমিকন’ বইটির কথা উল্লেখ করা হয়। কথিত আছে, এই বইয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হিটলারের উত্থান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা ছিল।

বিজ্ঞান যেখানে শেষ, সেখান থেকেই যেন সেরকম রহস্যময়তার শুরু। যদিও আধুনিক বিশ্বে এগুলো নিছকই কুসংস্কার, তারপরেও এর অন্ধকার জগৎ নিয়ে মানুষের কৌতূহল আজও অমীমাংসিত।


আদালতে দণ্ড থেকে রাষ্ট্রপ্রধান: তিন রাষ্ট্রের সাক্ষী ড. ইউনূসের অবিশ্বাস্য জীবনগাঁথা

২০২৫ অক্টোবর ০৬ ১৫:৫৫:১৮
আদালতে দণ্ড থেকে রাষ্ট্রপ্রধান: তিন রাষ্ট্রের সাক্ষী ড. ইউনূসের অবিশ্বাস্য জীবনগাঁথা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস

যে জীবন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়, যেখানে সম্মান, সংঘাত, পতন আর ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ—সবই যেন একই সুতোয় গাঁথা। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি কিছু দিন আগেও শ্রম আদালতের বারান্দায় হয়রানির শিকার হয়েছিলেন, তাঁকেই আজ দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব নিতে হয়েছে। প্যারিস অলিম্পিকের সম্মানীয় অতিথি থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা—এই অবিশ্বাস্য উত্তরণই ড. ইউনূসের জীবনের সবচেয়ে বড় নাটকীয়তা।

এক স্বপ্নের শুরু: গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ

তাঁর জীবন তিনটি ভিন্ন রাষ্ট্রের সাক্ষী—ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ। ১৯৪০ সালে যখন তিনি চট্টগ্রামের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন, তখন সেটি ছিল ব্রিটিশ ভারত। সেই ক্ষণজন্মা পুরুষ, মুহাম্মদ ইউনূস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পড়াশোনা শেষ করে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। পিএইচডি শেষ করে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু দেশের ভয়াবহ দারিদ্র্য তাঁকে স্বস্তি দেয়নি।

১৯৭৬ সালে তিনি যুগান্তকারী এক ধারণা নিয়ে আসেন—ক্ষুদ্রঋণ। তিনি দেখলেন, গ্রামের গরিব নারীরা সামান্য পুঁজির অভাবে মহাজনের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন। প্রচলিত ব্যাংকগুলো জামানত ছাড়া ঋণ দেয় না। ড. ইউনূস এই অচলায়তন ভাঙতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্রামীণ ব্যাংক’। জামানত ছাড়াই দরিদ্র মানুষদের, বিশেষ করে নারীদের, ছোট ছোট ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করার এই মডেল বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রায় ৯৭ শতাংশ নারী ঋণগ্রহীতার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক শুধু অর্থনৈতিক মুক্তিই আনেনি, নারীর ক্ষমতায়নেও বিপ্লব ঘটিয়েছে।

সম্মানের চূড়ায় আরোহণ ও সংঘাতের শুরু

গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য ড. ইউনূসকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এর চূড়ান্ত স্বীকৃতি আসে ২০০৬ সালে, যখন তিনি ও গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। পুরো জাতি তখন গর্বে উদ্বেলিত। গ্রামীণ টেলিকমের হাত ধরে দেশের সর্ববৃহৎ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের জন্মও তাঁর হাত ধরেই।

কিন্তু এই খ্যাতির পরই শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপোড়েন। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া এবং পরবর্তীতে ‘নাগরিক শক্তি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোকে রুষ্ট করে। বিশেষ করে, পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে।

সরকারের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হয় যখন বয়সসীমা অতিক্রমের কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এরপর পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের পেছনে ড. ইউনূসের লবিংকে দায়ী করে তৎকালীন সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে তাঁকে "পদ্মা নদীতে দুটি চুবানি" দেওয়ার কথাও বলেন, যা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

আদালতের বারান্দায় নোবেলজয়ী

এরপর ড. ইউনূসের জীবনে শুরু হয় এক অন্ধকার অধ্যায়। একের পর এক শ্রম আইন লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় ১৯টি মামলা করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের লভ্যাংশ না দেওয়া এবং কর্মীদের চাকরি স্থায়ী না করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়। এই রায়কে তাঁর সমর্থকরা "রাজনৈতিক হয়রানিমূলক" বলে আখ্যা দেন। বারাক ওবামা থেকে শুরু করে বিশ্বের শতাধিক নোবেলজয়ী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এর প্রতিবাদ জানালেও তৎকালীন সরকার এটিকে বিচারিক প্রক্রিয়া বলে অভিহিত করে।

নাটকীয় প্রত্যাবর্তন

যখন দেশের মাটিতে ড. ইউনূস আইনি লড়াইয়ে বিপর্যস্ত, তখন বিশ্বজুড়ে তাঁর সম্মান এতটুকুও কমেনি। প্যারিস অলিম্পিকের প্রধান অতিথি হিসেবে যখন তিনি ফ্রান্সে, ঠিক তখনই বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলন সরকারের পতন ঘটায়।

আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর এক অভাবনীয় পরিস্থিতিতে ছাত্রনেতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেন। তিনি সেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে দেশে ফেরেন। সবচেয়ে নাটকীয় ব্যাপার হলো, দেশে ফেরার আগেই যে মামলায় তাঁর কারাদণ্ড হয়েছিল, সেই মামলার আপিলে তিনি খালাস পেয়ে যান। এর ঠিক পরের দিনই তিনি বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

একজন সাধারণ শিক্ষক থেকে ক্ষুদ্রঋণের জনক, নোবেল বিজয়ী থেকে সরকারের রোষানলে পড়া আসামি এবং সবশেষে এক গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকার প্রধান—ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবন এক অবিশ্বাস্য উত্থান-পতনের মহাকাব্য, যা আগামী দিনেও মানুষকে বিস্মিত করবে।

/আশিক


আধুনিক বিজ্ঞান ও কোরআনের আলোকে জিন: রহস্যময় অস্তিত্বের এক নতুন দিগন্ত!

২০২৫ অক্টোবর ০৫ ২১:৩৬:১৪
আধুনিক বিজ্ঞান ও কোরআনের আলোকে জিন: রহস্যময় অস্তিত্বের এক নতুন দিগন্ত!
ছবি: সংগৃহীত

এই পৃথিবীতে আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টি রয়েছে। এদের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেও, এমন অনেক সৃষ্টি আছে যাদের অস্তিত্ব আমাদের কাছে রহস্যময়। জিন জাতি তাদেরই এক উদাহরণ। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, জিন হলো আগুনের শিখা থেকে সৃষ্ট এক অদৃশ্য সত্তা, যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। দীর্ঘকাল ধরে, এক শ্রেণীর মানুষ যারা যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছু বিশ্লেষণ করতে চান, তারা জিনদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে, কোরআনের আয়াত ও আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব এখন জিনদের রহস্যময় অস্তিত্বের নতুন এক ব্যাখ্যা দিচ্ছে।

জিন: কোরআনের বর্ণনা ও তাদের প্রকৃতি

ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থ কোরআনে জিনদের সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, "আমি জ্বীন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি"। মানুষের মতোই জিনদেরও নিজস্ব জীবনধারা, পরিবার ও সমাজ রয়েছে, তবে তারা ভিন্নভাবে সৃষ্ট। কোরআনে বলা হয়েছে, "এবং আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে এবং জিনকে সৃষ্টি করেছি আগুনের বিষাক্ত শিখা থেকে"। আরবি 'জিন' শব্দের অর্থ গুপ্ত বা অদৃশ্য।

আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও জিনদের অস্তিত্ব

১. অ্যান্টিম্যাটার থিওরি:

পার্টিকেল ফিজিক্স অনুযায়ী, পৃথিবীতে যেমন বস্তু রয়েছে, তেমনি প্রতিবস্তু বা অ্যান্টিম্যাটারও থাকতে পারে। পদার্থের কণা যেমন পদার্থ তৈরি করে, তেমনি প্রতি-কণা দিয়ে প্রতিপদার্থ গঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রতি ইলেকট্রন ও একটি প্রতি প্রোটন মিলিত হয়ে একটি প্রতি হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করে। এই প্রতিপদার্থগুলো অদৃশ্য এবং এদের গতি কোনো যন্ত্র দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা যায় না, কিন্তু বিজ্ঞান এদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে না। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের বিপরীতে যদি ৮০০ কোটি প্রতি-মানুষ থাকে, তাহলে তাদের জিন হিসেবে আখ্যায়িত করা কি ভুল হবে?

২. কোয়ান্টাম সুপারপোজিশন ও কোয়ান্টাম টানেলিং:

কোয়ান্টাম স্তরে বস্তুর আচরণ অদ্ভুতভাবে পরিবর্তিত হয়। একটি কণা একইসাথে একাধিক অবস্থানে থাকতে পারে, যাকে সুপারপোজিশন বলে। এছাড়াও, কোয়ান্টাম টানেলিং তত্ত্ব অনুযায়ী কণাগুলো যেকোনো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সক্ষম। এর অর্থ হলো, কোনো কিছু অদৃশ্য বা আমাদের চোখে ধরা না পড়লেও তার অস্তিত্ব ঠিকই রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, "নিঃসন্দেহে আল্লাহ শ্রবণকারী এবং সকল বিষয়ে জানেন যা তোমরা জানো না"। কোরআনের এই আয়াত কোয়ান্টাম তত্ত্বের অদৃশ্য বিশ্ব বা প্যারালাল রিয়ালিটির বাস্তব প্রতিফলন ঘটায়। এই তত্ত্বগুলো থেকে বোঝা যায়, মানুষের পাশাপাশি জিন জাতীয় সত্তাও সহাবস্থান করতে পারে এবং তারা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সক্ষম।

৩. প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরি:

এই তত্ত্বটি এমন একটি ধারণা যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বর্তমানে গবেষণা করছেন। এটি হলো সমান্তরাল মহাবিশ্ব, যেখানে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরে আরেকটি বিশ্ব একই সময়ে বিভিন্ন অবস্থানে আলাদা আলাদা নিয়মে চলতে পারে। এই ধারণা আল্লাহ তাআলা আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে কোরআনে দিয়ে রেখেছেন। কোরআনে বলা হয়েছে, "আল্লাহ সাত আসমান এবং অনুরূপভাবে সাত জমিন সৃষ্টি করেছেন। এসবের মধ্যে তার আদেশ অবতীর্ণ হয় যাতে তোমরা জানতে পারো আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সবকিছু তার জ্ঞানের মধ্যে"। কোরআনের এই ধরনের সৃষ্টির বিবরণ আধুনিক বিজ্ঞান এখন 'মাল্টি' বা 'অনন্ত মহাবিশ্ব' নামে অভিহিত করছে। যদি আমাদের জগতের মতো আরেকটি জগত থাকে, তাহলে সেখানে জিন জাতির বসবাস করাটা খুব অযৌক্তিক নয়।

জিনদের বিভিন্ন রূপ:

জিনদের একেবারেই দেখা যায় না, এমনটা নয়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে জিনদের আকৃতি বিষয়ক যেসব বর্ণনা এসেছে, তা মৌলিকভাবে তিন প্রকার:

অদৃশ্যমান ও আকৃতিবিহীন: এদের শুধু শারীরিক উপস্থিতি টের পাওয়া যায় এবং এরা আকাশে উড়তে পারে।

দৃশ্যমান (মানুষের মতো): এরা মানুষের মতো আকার ধারণ করে মানুষের সাথেই বসবাস করে, কিন্তু আপনি নিজেও জানবেন না যে আপনার পাশের লোকটি জিন।

দৃশ্যমান (বিকৃত রূপ): এরা কুকুর, বিড়াল, সাপ ইত্যাদি বিকৃত রূপ ধারণ করে সমাজে চলাফেরা করে।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এই তত্ত্বগুলো জিন জাতির অস্তিত্ব অস্বীকারের পথ অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছে। বরং, পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, জিনের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি ততই জোরালো হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা হয়তো এর নাম দিয়েছেন এলিয়েন, তবে এলিয়েন নিয়েও ইসলামের ব্যাখ্যা রয়েছে।

/আশিক

পাঠকের মতামত: