বিশেষ প্রতিবেদন

"ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে" — ওবামার এক বাক্যে কাঁপলো কূটনীতি 

২০২৫ জুলাই ২৪ ১৯:৩১:২০
"ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে" — ওবামার এক বাক্যে কাঁপলো কূটনীতি 

২০২৩ সালের এক রাজকীয় সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউসের প্রাসাদোপম কক্ষে আলো ছড়িয়ে পড়েছিল এক ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় আয়োজনে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আয়োজিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। করতালির মধ্য দিয়ে তার আগমন, মুখে এক প্রশান্ত হাসি এবং পাশে ছিলেন বাইডেনের উজ্জ্বল অভ্যর্থনা। এই মুহূর্তটি ছিল কূটনৈতিক সৌজন্যের নিখুঁত উপস্থাপন, যেখানে দুই বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠেছিল।

কিন্তু এই জাঁকজমকপূর্ণ কূটনৈতিক আয়োজনের বাইরেই চলছিল আরেকটি নাটক। একই দিনে, হাজার মাইল দূরে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সাক্ষাৎকারে এমন এক মন্তব্য করেন যা গোটা বিশ্বমাধ্যম এবং কূটনৈতিক মহলে আলোড়ন তোলে।

ওবামার সতর্কতা: ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে

সাক্ষাৎকারে ওবামার কণ্ঠ ছিল শান্ত, কিন্তু তার বক্তব্য ছিল বিস্ফোরণের মতো। তিনি বলেন, যদি ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিকার রক্ষা না করা হয়, তবে একদিন এই দেশটি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, "আমি যদি মোদির সামনে বসতাম, তাকে বলতাম সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সম্মান করুন। নইলে ভারতের ঐক্য ধরে রাখা যাবে না।"

এই বক্তব্য নিছক রাজনৈতিক নয়, বরং অভিজ্ঞতার আলোকে এক গম্ভীর ভবিষ্যদ্বাণী। ওবামা ও মোদি অতীতে একাধিকবার মুখোমুখি হয়েছেন, একে অপরকে ব্যক্তিগতভাবে জানেন। ফলে ওবামার এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং আন্তরিক উদ্বেগ হিসেবেই বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা।

একদিকে হাসির ছবি, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিদ্যুৎচমক

সেই সময়ে হোয়াইট হাউসে বাইডেন ও মোদির হাসিমুখে ছবি তোলার দৃশ্য চলছিল। বাইডেন বলছেন, "ভারত ও আমেরিকার ডিএনএ-তে গণতন্ত্র রয়েছে।" মোদির পক্ষ থেকেও ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশংসা। তিনি বলেন, "গণতন্ত্রকে সফলভাবে পরিচালনা করার উদাহরণ আমরা তৈরি করেছি।"

তবে এই সৌজন্যবাক্যের আড়ালে চলছিল অন্য এক বাস্তবতা। কারণ ঠিক তার কয়েক ঘণ্টা আগেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন একটি চিঠি পান, যেখানে ৭৫ জন মার্কিন কংগ্রেস সদস্য মোদির সঙ্গে আলোচনায় মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রেস কনফারেন্সে মোদি বলেন, "ভারতে বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। আমাদের সংবিধান সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে।" তবে উল্লেখযোগ্যভাবে, সেখানে কেবল দুজন সাংবাদিককে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়। একজন ভারতীয় এবং একজন আমেরিকান, এবং প্রশ্নগুলো ছিল পূর্বনির্ধারিত। তবুও মোদি আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং প্রশ্নবিদ্ধ কৌশলগত সম্পর্ক

ওবামার মন্তব্য ভাইরাল হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। এনডিটিভি, সিএনএন, বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ শীর্ষ গণমাধ্যমগুলো শিরোনাম করে "India risks breaking apart if minority rights not protected: Obama warns"।

ভারতে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরে সাংবাদিকদের দমন, দলিত এবং মুসলিমদের ওপর সহিংসতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে। তবে এই প্রথম এত উচ্চপর্যায়ের কোনও ব্যক্তি এত সরাসরি ভাষায় সতর্কবার্তা দিলেন।

ওবামার মন্তব্য শুধু বিতর্ক সৃষ্টি করেনি, বরং একটি নৈতিক প্রশ্ন সামনে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্র কি কৌশলগত স্বার্থে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উপেক্ষা করবে, নাকি সত্য প্রকাশের নৈতিক দায়িত্ব পালন করবে?

ভারতের অভ্যন্তরেও এই মন্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ মহল একে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে, অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো বলছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের বাস্তবতা অবশেষে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

এক সন্ধ্যার হাসি আর এক বাক্যের ছায়া

হোয়াইট হাউসের সেই রাজকীয় সন্ধ্যা হয়তো বাইরের চোখে মোদির জন্য ছিল সফল সফর। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেই সফলতার ভিতরেই লুকিয়ে ছিল এক গভীর সতর্কবার্তা। ওবামার এক বাক্য যেন অন্ধকারে ছোড়া এক আলোকশলাকা, যা বলেছিল গণতন্ত্র শুধু কাগজে নয়, তা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সাহস, সহনশীলতা এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা।

২০২৫-এর বাস্তবতা: ওবামার আশঙ্কা কি সত্যি হতে চলেছে?

২০২৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে ভারতের সংখ্যালঘু পরিস্থিতির মৌলিক চিত্র এখনো অপরিবর্তিত। বরং আরও উদ্বেগজনকভাবে, ধর্মীয় বিভাজন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা ভারতের ভেতরে-বাইরের স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, ওবামার সতর্কবাণী কি বাস্তবের দিকে এগোচ্ছে? ভারত কি জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সত্যিই একটি বিভক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে?

এই প্রশ্ন এখন শুধু ভারতের নয়, বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ