বাস্তবায়নের পথে তিস্তা প্রকল্প: উত্তরাঞ্চলের প্রাণ ফিরে পাওয়ার শেষ আশা

সারাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ২৪ ১৭:৩৬:৪৬
বাস্তবায়নের পথে তিস্তা প্রকল্প: উত্তরাঞ্চলের প্রাণ ফিরে পাওয়ার শেষ আশা
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প। ছবি: সংগৃহীত।

উজানে ভারতের হঠাৎ পানি ছেড়ে দেওয়া কিংবা শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখার কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা নদী দীর্ঘদিন ধরে এক দুঃসহ অভিশাপ হয়ে আছে। কখনো বন্যা, কখনো খরা, কখনো ফসল হারানো, আবার কখনো গৃহহীন হওয়া, এই নদী আজ এক বিষাদগ্রস্ত স্মৃতির নাম। হাজার হাজার কৃষকের স্বপ্ন মাটিচাপা পড়েছে এর তীরে, হারিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ জমি, তলিয়ে গেছে জীবনের সম্ভাবনা। ঠিক এমন এক সময়, বহু প্রতীক্ষার পর, বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা মহাপরিকল্পনা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ চীনের কাছে প্রস্তাবিত ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে এবং চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই প্রকল্পের লক্ষ্য শুধু নদীভাঙন রোধে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন রূপকল্প হিসেবে কাজ করবে। দুই তীরে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ, ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, ১৭৩ কিলোমিটার তীর সুরক্ষা, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা, স্যাটেলাইট শহর, পর্যটন নগরী, শিল্পাঞ্চল, নৌবন্দর, মেরিন ড্রাইভ এবং সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ এক বিস্তৃত পরিকল্পনা এর অন্তর্ভুক্ত। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার কৃষিজ উৎপাদন, এক লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান এবং নদীভাঙনে প্রতিবছর হারিয়ে যাওয়া শত শত কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা সম্ভব হবে। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পানি-অধিকার নিশ্চিত করার পথে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।

তিস্তাকে ঘিরে এতদিন ধরে চলে আসা আন্তর্জাতিক অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে চীনের সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৬ সালে চীনের সঙ্গে সমঝোতা সই হলেও দিল্লির আপত্তির কারণে প্রকল্পটি থমকে ছিল। তবে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে চীন সক্রিয় আলোচনায় আছে এবং আগামী অক্টোবরের মধ্যেই প্রকল্পের চূড়ান্ত নকশা প্রস্তুত হবে বলে জানা গেছে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিস্তাকে ঘিরে গড়ে উঠবে কৃষিভিত্তিক শিল্প, পর্যটন শহর, নদী শাসনের মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো এবং এক স্বনির্ভর উত্তরাঞ্চল। নদীর নাব্যতা ফিরলে ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমবে, লবণাক্ত পানির অগ্রযাত্রা রোধ হবে, শুষ্ক মৌসুমে কৃষিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিত হবে এবং বর্ষায় বন্যা প্রতিরোধ সম্ভব হবে। জীববৈচিত্র্য ফিরে পাবে স্বাভাবিকতা, নদীর বুকে আবার উড়বে পাখি, সাঁতরাবে মাছ।

এই প্রকল্প কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, এটি কূটনৈতিক বার্তাও বয়ে আনবে। তিস্তা বাংলাদেশের নদী এবং এর উপর বাংলাদেশিদের অধিকার রয়েছে। স্থানীয় মানুষের পরামর্শ এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রকল্পে গণশুনানি ও পরামর্শ সংযুক্ত করা হয়েছে।

তিস্তাপারের মানুষ যারা দীর্ঘদিন ধরে নদীভাঙন, খরা ও বন্যার শিকার হয়ে জীবিকা হারিয়েছেন, তাদের কাছে এই প্রকল্প কেবল উন্নয়ন নয়, এটি এক নতুন জীবনের স্বপ্ন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা, জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিশ্চিত করতে হবে। উত্তরাঞ্চল আর যেন অবহেলার ছায়াতলে না থাকে, সেটিই হোক রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ