মতামত

ফ্যাসিবাদ, শিক্ষকতা ও প্রতিরোধের সমাজতত্ত্ব

শামসুল আরেফীন
শামসুল আরেফীন
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ জুলাই ২৫ ১৫:৩২:৫৯

ফ্যাসিবাদ কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ নয়; এটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, জ্ঞান এবং নৈতিকতাকেও বন্দী করে ফেলে। বিগত ষোলো বছরের অভিজ্ঞতায় আমি প্রত্যক্ষ করেছি, কীভাবে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা নাগরিকদের অস্তিত্বকে রাজনৈতিক আনুগত্যের মানদণ্ডে বিচার করে। ব্যক্তির নৈতিকতা, মতপ্রকাশ কিংবা পেশাগত স্বাধীনতা তখন আর নিরপেক্ষ থাকে না; বরং তা নির্ধারিত হয় ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে তার সম্পর্কের উপর।

আমি গোপালগঞ্জের মানুষ, যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকের কাছে একধরনের সুবিধাজনক পরিচয় বলে বিবেচিত। অথচ এই পরিচয় রাষ্ট্র ও সমাজ যখন রাজনৈতিক আনুগত্যের মাপকাঠিতে যাচাই করতে থাকে, তখন তা হয়ে ওঠে এক বিপজ্জনক দায়। গত কয়েক বছরে আমাকে "শিবির" ট্যাগ নিয়ে চলতে হয়েছে, যদিও কোনো পর্যায়েই আমার সেই রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল না। এটি নিছক কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ ছিল না; বরং এটি ছিল একটি বৃহত্তর সাংগঠনিক ফ্যাসিজমের উপসর্গ, যেখানে পরিচয়, আনুগত্য এবং কথিত "জাতীয় স্বার্থ" ব্যবহার করে ভিন্নমতের মানুষদের সামাজিক ও পেশাগতভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষকতা একটি মুক্ত পেশা। এখানে বিবেকবোধ এবং সত্য বলার স্বাধীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, আমি রাজনৈতিক পরিচয়ের আশ্রয় নেইনি। এমন একটি সমাজে, যেখানে পিয়ের বুরদিয়ুর "academic field" ধারণা আর প্রযোজ্য থাকে না, সেখানে সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক পুঁজির বদলে রাজনৈতিক পুঁজি নিয়োগের মূল নির্ধারক হয়ে ওঠে। বোর্ডে প্রবেশের পর বুঝতে পারি, মেধা নয়, আনুগত্যই এখানে মূল্যবান। নিয়োগ পান সেই ব্যক্তি, যার একাডেমিক যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও রাজনৈতিক অবস্থান ছিল ‘সঠিক’।

গোপালগঞ্জের একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সিদ্ধান্ত ছিল আত্মিক দায়বদ্ধতা থেকে। নিজের মাটিতে, নিজের সমাজে মানুষ গড়ার বাসনায় সেখানে যাই। কিন্তু গিয়ে দেখি, শিক্ষার পরিবেশটি যেন একটি ক্ষুদ্রায়ত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি। উপাচার্য নিজেকে কর্তৃত্ববাদী ঘোষণা করেন, প্রশাসন সরাসরি একটি রাজনৈতিক দলের অনুগত, আর শিক্ষক সমাজ বিভক্ত ও বিভ্রান্ত। গ্রামসির ভাষায়, এখানে ‘consent’ ও ‘coercion’ মিলিয়ে একটি আধিপত্যবাদী কাঠামো তৈরি হয়েছে, যা প্রশ্নহীন আনুগত্যকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎসাহিত করে।

এই প্রেক্ষাপটে আমি শ্রেণিকক্ষে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের বলতাম, "তোমরা হুকুমের গোলাম নও, গেইম চেঞ্জার।" এটি কেবল অনুপ্রেরণামূলক বাক্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক প্রতিরোধী শিক্ষার ভাষ্য। আমি শিক্ষার্থীদের শেখাতাম, শিক্ষকের কাজ শুধু তথ্য সরবরাহ নয়, বরং সমাজ, রাষ্ট্র এবং ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করার সক্ষমতা তৈরি করা। পাউলো ফ্রেইরের “Pedagogy of the Oppressed” আমার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, যেখানে শিক্ষা নিজেই হয়ে ওঠে মুক্তির হাতিয়ার।

কিন্তু একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই শিক্ষাদর্শনই হয়ে ওঠে হুমকিস্বরূপ। আমার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, প্রশাসনের অপছন্দ এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনার সংস্কৃতি মিলিয়ে আমাকে ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমাকে "হাফ গোপালী" বলা হয়, যেন আমি আংশিকভাবে বৈধ, পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নই। এটি একধরনের সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক বর্গীকরণের কৌশল, যা ফ্যাননের "colonial mimicry" ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। উপনিবেশিত আত্মা কখনো পুরো স্বীকৃতি পায় না; বরং চিরকাল সীমান্তবর্তী এক অবস্থানে থেকে যায়।

এক সময়ের বন্ধু, বর্তমানে ছাত্রলীগের নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা ফোন করে অভিযোগ করেন, "সে শিবির সিম্পেথাইজার। কেন এখানে চাকরি করছে?" এটি শুধু একটি চাকরি ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র ছিল না; বরং একজন মানুষকে সামাজিক ও একাডেমিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার একটি সচেতন প্রয়াস। Judith Butler যেভাবে “social death” ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন, সেটি এখানে বাস্তব রূপ নিয়েছে, যেখানে সন্দেহভাজন রাজনৈতিক অবস্থানের মানুষদের পেশাগত এবং নৈতিকভাবে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়।

তবুও আমি থেমে থাকিনি। আমি বিশ্বাস করি, একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে মানুষকে সম্মান দেওয়া যায়, রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। ঢাকায় যাঁরা একাডেমিকভাবে সমৃদ্ধ, তাঁদের—ডান, বাম বা লিগ নির্বিশেষে—গোপালগঞ্জে এনে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস, অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষই হতে পারে মুক্তচিন্তার একমাত্র ক্ষেত্র।

আমার অবস্থানের কারণে আমার পরিবারকেও মূল্য দিতে হয়েছে। আমার স্ত্রী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন, তিনি আমার অ্যাক্টিভিজমের কারণে পেশাগতভাবে বাঁধার সম্মুখীন হন। আমেরিকায় পিএইচডি করতে আসার আগে তাঁকে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে শিক্ষকতা করতে দেওয়া হয়নি। এটি প্রমাণ করে, ফ্যাসিবাদ ব্যক্তি নয় শুধু, তার পরিবার, সম্পর্ক ও পরিসরকেও গ্রাস করে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের ছাত্র ও যুব অভ্যুত্থানে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। এই আন্দোলন কেবল শাসকবিরোধী ছিল না; বরং এটি ছিল একটি নতুন সমাজ ও ভবিষ্যতের কল্পনার ভিত্তি। আমি চাইনি এই বিপ্লব প্রতিশোধমূলক হোক। কারণ ফ্যাসিবাদ ভাঙার নামে যদি নতুন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা হবে এক নিষ্ফল বিজয়। আমি বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র কেবল সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি সমাজের কাঠামোগত ও নৈতিক পুনর্গঠনের এক দীর্ঘ সংগ্রাম।

আমার অবস্থান খুবই স্পষ্ট। কোনো ব্যক্তিকে যদি “লীগ” পরিচয় দিয়ে হত্যা করা হয়, তবে আমি তার প্রতিবাদ করব। প্রতিহতের নামে আরেকটি অনাচার হলে, তা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা নয়। কোনো পিতাকে তার পুত্রের অপরাধের দায়ে শাস্তি দেওয়া হলে, তাতেও আমি প্রতিবাদ জানাব। আমি এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে মানুষকে তার ধর্ম, অঞ্চল কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে নয়; বরং মানবিক মর্যাদা, সুবিচার এবং নৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে।

বাংলাদেশকে আমি কল্পনা করি একটি সহানুভূতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে। এখানে শিক্ষক ভয় না পেয়ে মুক্তভাবে চিন্তা করবেন, ছাত্ররাও হবে সজাগ ও চিন্তাশীল নাগরিক। এই কল্পনা শুধু একটি রাজনৈতিক স্বপ্ন নয়; এটি আমার শিক্ষকতা, চিন্তা এবং বেঁচে থাকার নৈতিক ভিত্তি।

এটাই আমার সমাজতাত্ত্বিক প্রতিরোধ।

-লেখক শামসুল আরেফীন, শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন সমাজবিজ্ঞানে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ