ইরান-ইসরাইল সংঘাত বিশ্লেষণ

ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদাম: ইরানে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তির নিখুঁত ছকের এক নারী মুখ

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৪ ২১:০৮:৩৬
ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদাম: ইরানে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তির নিখুঁত ছকের এক নারী মুখ

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন এক রাতে বিশ্ব চমকে ওঠে, যখন জানা গেল ইরানের হৃদয়ে বসে বহু বছর ধরে কাজ করছিলেন এক নারী—সাধ্বীর বেশে, অথচ এক ভয়ানক পরিকল্পনার বাহক হয়ে। তাঁর নাম ক্যাথরিন পেরেজ-শাকডাম। যিনি পশ্চিমে জন্মালেও শিয়া মুসলিম রূপে ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাত মহলে জায়গা করে নেন। তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করা হচ্ছিল ইরানের ঘরোয়া প্রোপাগান্ডার অন্যতম স্বরলিপিকার হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি সুপরিকল্পিত গুপ্তচরবৃত্তির অংশ।

ফ্রান্সে জন্ম নেয়া ক্যাথরিন ছিলেন এক ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি পরিবারের সন্তান। মনোবিজ্ঞানে শিক্ষিত এই নারী ইয়েমেনি এক সুন্নি পুরুষকে বিয়ে করে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বিচ্ছেদ হলেও তার পরিচয়ের কাঠামো ততদিনে বদলে গেছে। ২০১৭ সালে তিনি ‘শিয়া’ রূপে ইরানে প্রবেশ করেন এবং দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। এমনকি তাঁর নিবন্ধ স্থান পায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও।

তেহরানে তিনি পরিণত হন এক অদ্ভুত দ্বৈত চরিত্রে—বাহ্যত একজন প্রভাবশালী বিশ্লেষক, অন্তরে ছিলেন মোসাদের নজরদার গৃহিণী। তিনি প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, এমনকি কারবালায় গিয়ে কুদস ফোর্সের প্রয়াত কমান্ডার কাসেম সোলেইমানির সঙ্গেও আলাপ জমিয়ে তুলেছিলেন। তার ফার্সি ভাষার সাবলীলতা ও ধর্মীয় জ্ঞানে মুগ্ধ হন শীর্ষ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক ছিল তাঁর কৌশলগত অবস্থান। তিনি ইরানের বিপ্লবী গার্ডের জেনারেলদের স্ত্রীদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁদের পারিবারিক আলাপচারিতা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, গোপন বৈঠক ও চলাচলের তথ্য খুব সূক্ষ্মভাবে সংরক্ষণ করতেন। নিজের ছদ্মনাম ব্যবহার করে ফোনে ছবি, ভিডিও ও অডিও রেকর্ড করে পাঠাতেন দূরবর্তী বিশ্লেষক দলের কাছে। এই সব তথ্য একসময় রূপ নেয় মরণ ফাঁদে।

২০২৫ সালের ১৩–১৪ জুন রাতে ইসরায়েল চালায় ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। মোসাদ ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর যৌথ পরিকল্পনায় এক বিশাল বিমান হামলা চালানো হয়, যার মূল তথ্যভিত্তি ছিল ক্যাথরিনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্য। এই হামলায় এক রাতে নিহত হন ইরানের বিপ্লবী গার্ডের অন্তত আটজন শীর্ষ কমান্ডার, সাতজন পরমাণু বিজ্ঞানী ও একাধিক কুদস ফোর্স কর্মকর্তা। ধ্বংস হয় নাতানজ, ইস্পাহান ও পারচিনের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা। এই নিখুঁত হামলার মূল রহস্য ছিল ক্যাথরিনের মোবাইলে গচ্ছিত সামরিক সময়সূচি, কার চলাচল কখন, কোথায়—এই রকম অগণন মানবিক তথ্য।

ছবি: ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিমরাইসির সাক্ষাতকার নিচ্ছেন ছদ্মবেশী মোসাদের এজেন্টক্যাথরিন। ধারণা করা হয়, রাইসির হেলিকপ্টার দূর্ঘটনার পিছনেও হাত থাকতে পারে এই এজেন্টের।

হামলার পর ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ চমকে ওঠে। কীভাবে এমন নিখুঁত হামলা সম্ভব হলো? তদন্তের মুখে আসে ক্যাথরিনের নাম। তাঁর ছবি পোস্টার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তেহরানের অলিগলিতে। একে একে ধরা পড়ে তিনজন সহযোগী, যাদের একজন তালেবান ঘরানার শরণার্থী। কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাথরিন তখন আর ইরানে নেই। ধারণা করা হয়, হামলার আগেই তিনি ইরান ছেড়েছেন এবং এখন মোসাদের আরেকটি প্রকল্পে নিযুক্ত।

তিনি নিজে অবশ্য দাবি করেন, তিনি মোসাদের মসঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক মাত্র, যিনি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান Wikistrat–এ যুক্ত ছিলেন। তবে তাঁর অতীতের ব্লগ, রেকর্ড, এবং আন্তর্জাতিক সংযোগ ইঙ্গিত করে—এই দাবি হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই বৈরী। ইসরায়েল সবসময়ই আশঙ্কা করে এসেছে যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। অন্যদিকে, ইরান বলেছে, তারা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি চায়। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে গোয়েন্দা লড়াই বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০১০ সালে স্টাক্সনেট সাইবার ভাইরাস ব্যবহার করে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো হয়, ২০১৮ সালে চুরি হয় পারমাণবিক আর্কাইভ, এবং একের পর এক বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়। ক্যাথরিনের ঘটনা যেন এই ধারাবাহিকতাকেই নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়—এইবার ব্যবহৃত হয়েছে একজন মানুষ, একজন নারী, যিনি বিশ্বাস অর্জনের নীরব নৈপুণ্যে ভেঙে দিয়েছেন একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ভিত।

এই ঘটনা গোটা মুসলিম বিশ্বে ও ইরানে এক অভ্যন্তরীণ আত্মবিশ্লেষণের দরজা খুলে দেয়। প্রশ্ন ওঠে, আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থায় কোথায় ঘাটতি রয়ে গেছে? কীভাবে একজন পশ্চিমা নারী এত সহজে বিপ্লবী গার্ড, প্রেসিডেন্টের দপ্তর এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীরে ঢুকে পড়লেন? এসব প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে তেহরানের রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে।

এই ঘটনার শিক্ষাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, শত্রু আর প্রতিপক্ষের সংজ্ঞা এখন আর ইউনিফর্ম বা অস্ত্র দিয়ে নির্ধারিত হয় না। আধুনিক গোয়েন্দাবৃত্তিতে সবচেয়ে ভয়ানক অস্ত্র এখন বিশ্বাস। দ্বিতীয়ত, ইরান যদি সত্যিই এক আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক বিপ্লবের ধারা বজায় রাখতে চায়, তাহলে অভ্যন্তরীণ সতর্কতা ও নৈতিক আত্মবিশ্বাস পুনর্গঠনের প্রয়োজন আছে।

ক্যাথরিনের গল্প শেষ হয়ে গেছে হয়তো, কিন্তু তার রেখে যাওয়া ছায়া এখনো ঘুরে বেড়ায় তেহরানের অলিতে গলিতে। রেভল্যুশনারি গার্ডের করিডোরে এখন হয়তো নতুন করে প্রশ্ন জাগে—আমরা কাকে বিশ্বাস করছি?

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, এই যুদ্ধ ছিল না বারুদের, এটি ছিল শব্দের, আস্থার এবং তথ্যের—আর সেই যুদ্ধে, একটি চাদরের নিচে লুকানো ছুরি অনেক বেশি কার্যকর হয়েছিল এক ডিভিশন সেনাবাহিনীর চেয়ে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ