বিশেষ প্রতিবেদন

মহানবীর বংশধর আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি: পশ্চিমাদের আতঙ্ক, মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের কণ্ঠস্বর

২০২৫ জুন ২৭ ১১:৩১:০২
মহানবীর বংশধর আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি: পশ্চিমাদের আতঙ্ক, মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের কণ্ঠস্বর

বিশ্ব রাজনীতি যখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে, আর মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনা প্রায়শই নিয়তিকে প্রভাবিত করছে, তখন একজন নেতা তার ব্যক্তিত্ব, আদর্শ ও নেতৃত্বগুণে অসাধারণভাবে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি হলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। শুধু ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, বরং তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক, বিশেষত শিয়া-সুন্নি বিভাজনের যুগে এক মেরুদণ্ডস্বরূপ সত্তা।

ধর্মীয় ও পারিবারিক বংশপরিচয়: ঐতিহ্যের গৌরবময় ভিত্তি

আয়াতুল্লাহ খামেনি ১৯৩৯ সালের ১৭ জুলাই ইরানের পবিত্র শহর মাশহাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আয়াতুল্লাহ সৈয়্যেদ জাওয়াদ খামেনি ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় শিয়া আলেম, যিনি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রদানে সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। আলী খামেনি নিজেও বহুবার নিজেকে 'হোসাইনী সাইয়্যেদ' পরিচয়ে উপস্থাপন করেছেন, যার অর্থ তিনি ইমাম হোসাইন (রা.)–এর বংশধর। ইমাম হোসাইন ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাতি, এবং ইসলামী ইতিহাসে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ শহীদের অন্যতম। আয়াতুল্লাহ খামেনিকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ৩৮তম বংশধর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরান সরকার ও ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রকাশিত আত্মজীবনীতে এই বংশানুক্রমিক দাবি সমর্থন পেয়েছে।

‘সাইয়্যেদ’ উপাধি শিয়া মুসলিম সমাজে বিশেষ মর্যাদার বহনকারী। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় বংশপরিচয়ের নিদর্শন নয়, বরং ইসলামী আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের প্রতি জনসমর্থনের প্রতীক। যদিও আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই বংশগত দাবির যথাযথ পরীক্ষা এখনো হয়নি, তথাপি ঐতিহ্য ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে এটি মুসলিম বিশ্বে গভীর প্রতীকী ও নৈতিক গুরুত্ব বহন করে।

ইসলামী বিপ্লব ও রাষ্ট্রপতিত্ব: বিপ্লবী যাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে

আয়াতুল্লাহ খামেনির রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ সংগ্রামময় অধ্যায়। ১৯৭৯ সালের ইরানি ইসলামি বিপ্লব ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা, যেখানে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান কৌশলগত নেতৃত্বদাতা। বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রথম আলেম রাষ্ট্রপতি হিসেবেই তিনি দায়িত্ব পালন করেন। একজন ধর্মীয় পটভূমির মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রপতি হওয়া ছিল সেই সময়ের জন্য এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর, আলী খামেনি দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনিই ইরানের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী।

তিনি শুধু একটি ধর্মীয় বা সাংবিধানিক নেতা নন; বরং তিনি বিচারিক, সামরিক, কূটনৈতিক ও ধর্মীয় নীতিনির্ধারক—সব ক্ষেত্রেই তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। খামেনি ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় শীর্ষ পদ ‘মারজায়ে তাকলিদ’ ধারণ না করলেও, তাঁর রাজনৈতিক ও বিপ্লবী মর্যাদা তাঁকে ইরানি সমাজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্ব প্রদান করেছে।

শিয়া নেতা থেকে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রবক্তা

আয়াতুল্লাহ খামেনি একজন শিয়া আলেম হলেও, তাঁর বক্তৃতা ও কার্যক্রমে বারবার উঠে এসেছে ‘উম্মাহর ঐক্য’ রক্ষার বার্তা। তিনি বারবার বলেছেন, শিয়া-সুন্নি বিভাজন ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বকে দুর্বল করে। তার মতে, এটি ইসলামবিদ্বেষী শক্তির একটি চিরায়ত ষড়যন্ত্র, যাতে মুসলিম জাতিকে বিভক্ত করে দুর্বল করা যায়। তিনি তেহরানে আয়োজিত বিভিন্ন ইসলামী ঐক্য সম্মেলনে বলেন, “আমাদের মধ্যে বিভক্তির চেয়ে মিল অনেক বেশি। আল্লাহ আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।” এই বক্তব্যে তিনি কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতকে বারবার উদ্ধৃত করেন—“তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।”

এই ঐক্যবদ্ধ মানসিকতার জন্য তিনি সৌদি আরব, মিশর, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের সুন্নি আলেমদের সঙ্গে সংলাপ ও বন্ধুত্ব গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই ধারায় তাঁর অবস্থান নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী, কারণ একটি শাসক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হয়ে তিনি নিজেকে শুধুমাত্র শিয়া মতবাদে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং পুরো মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বে উঠার চেষ্টা করেছেন।

ফিলিস্তিন প্রশ্ন ও ইসলামী প্রতিরোধে দৃঢ় অবস্থান

আয়াতুল্লাহ খামেনি বারবার ফিলিস্তিন ইস্যুকে শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয় ও অস্তিত্বগত সংগ্রাম হিসেবে দেখেছেন। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের সময় তিনি ঘোষণা করেন, “ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো মানেই আজকের দিনে ইসলামের পক্ষে দাঁড়ানো।” তাঁর মতে, ফিলিস্তিন প্রশ্নে নির্লিপ্ততা মানেই ইহুদি জাতীয়তাবাদী সম্প্রসারণবাদের কাছে আত্মসমর্পণ। এ কারণে তিনি শুধু কূটনৈতিক স্তরে নয়, সামরিক ও বৈপ্লবিক স্তরেও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে গেছেন। এই অবস্থান অবশ্য নানা বিরোধও সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরব ও উপসাগরীয় কিছু সুন্নি নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র তাঁর এই নীতিকে ‘শিয়া সম্প্রসারণবাদ’ আখ্যা দিয়ে খামেনির নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে।

সমালোচনার মুখোমুখি হলেও অটল

যদিও আয়াতুল্লাহ খামেনি বহির্বিশ্বে ও মুসলিম বিশ্বের বহু অংশে প্রশংসিত, তবে তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীদের দমন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বিরোধী দল, জাতিগত সংখ্যালঘু ও সংস্কারপন্থীদের ওপর দমনমূলক নীতির কারণে ইরানে তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিমতও রয়েছে। তথাপি খামেনি দৃঢ়ভাবে বলেন, “আমার লক্ষ্য কোনো সম্প্রদায়ের আধিপত্য নয়; বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সম্মিলিত মুক্তি ও ঐক্য।”

একটি ইতিহাসের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি

আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি শুধু ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির অন্যতম মূল চালক। তাঁর বক্তৃতা, কৌশল এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে যে তিনি একদিকে বিশ্ব পরাশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক, অপরদিকে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি আদর্শিক সেতুবন্ধনের প্রতিচ্ছবি। শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই যেমন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের ভিত্তি, তেমনি বিভক্ত মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ঐক্য আনয়ন তাঁর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক অভিপ্রায়।

বর্তমান বিশ্বে যখন ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রায়শই সংকুচিত হচ্ছে শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠানে, তখন আয়াতুল্লাহ খামেনি হয়ে উঠেছেন এক বিপ্লবী চিন্তার ধারক—যিনি ধর্ম, রাজনীতি, প্রতিরোধ এবং ঐতিহাসিক চেতনার একত্রিত রূপ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, আলী খামেনি কেবল একজন নেতা নন, তিনি একটি প্রজন্মের রাজনৈতিক বিবেক, ইতিহাসের পাঠ্য, এবং ভবিষ্যতের ভাবনার বিষয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

প্রেস সচিবের বক্তব্যে বাকস্বাধীনতা, মব কালচার ও সাংবাদিকতার দ্বন্দ্ব: পাঠবিশ্লেষণ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক দীর্ঘ বক্তব্যে দেশের সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত... বিস্তারিত