জাতীয় রাজনীতিতে ফের জোরালো হচ্ছেন তারেক রহমান

২০২৫ জুলাই ১৬ ২১:২১:০০
জাতীয় রাজনীতিতে ফের জোরালো হচ্ছেন তারেক রহমান

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাজনৈতিক প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দৃঢ় হয়েছে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে। ২০২৫ সালের ১০ থেকে ১৩ জুন লন্ডনে সফরের সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়।

২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করলেও তারেক রহমান এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রভাবশালী নাম। ইউনূস-তারেক বৈঠক এটিই প্রমাণ করে যে প্রবাসে থেকেও তার রাজনৈতিক গুরুত্ব অটুট রয়েছে।

জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি হন। তার স্ত্রী খালেদা জিয়া দুই দফা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে তাঁদের ছেলে তারেক রহমান দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। দেশের রাজনীতিতে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। উভয়পক্ষের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, বৈঠকটি ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছায় তারা।

এর আগে বিএনপি নির্বাচন দ্রুত আয়োজনের পক্ষে ছিল এবং ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ভোট চায়। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার বলছিল, সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার শেষ না হলে ভোট হবে না। ড. ইউনূস পরে জানান, নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথম ভাগে অনুষ্ঠিত হবে।

এই ঘোষণায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে। কারণ এপ্রিল গ্রীষ্মকাল ও রমজান মাসের কারণে প্রচারণার অনুপযোগী সময়। ফলে বিএনপি আশঙ্কা করে, এই সময় নির্ধারণ রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। এমন অবস্থায় লন্ডন বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে ভোটের সমঝোতা দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়।

লন্ডনের এই বৈঠকটি দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একমত হওয়ার ঘটনা বিরল। তাই একে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে সমঝোতা দ্বন্দ্ব এড়ানোর এক ইতিবাচক ইঙ্গিতও দেয়।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রশ্ন—ড. ইউনূস কেন তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করলেন? এবং প্রবাসে থেকেও তারেক রহমানের প্রভাব কতটা গভীর?

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন। এটি সম্ভব হয় ছাত্র আন্দোলন, বিএনপির ধারাবাহিক আন্দোলন এবং সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকায়। তবে ইউনূসকে নিয়ে বিএনপির মধ্যে আস্থার সংকট ছিল। তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পক্ষে মত দিলেও বিএনপি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

মে মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং পরে তারেক রহমান—দুজনেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলেন। কিন্তু ড. ইউনূস তাতে রাজি না হয়ে নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলেই করবেন বলে ঘোষণা দেন। এতে বিএনপি আন্দোলনের হুমকি দেয়।

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অতীতে দুর্নীতি ও সহিংসতার অভিযোগ ছিল। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও পরে শাস্তি বাতিল হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাঁর বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

তারেক রহমান ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশজুড়ে সফর করে তৃণমূলে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ২০১৮ সালে খালেদা জিয়ার কারাবন্দিত্বের পর থেকে তিনিই দলের নেতৃত্ব দেন। বিদেশে থেকেও তিনি হোয়াটসঅ্যাপ ও জুমের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, খোঁজখবর নিতেন পরিবার-পরিজনের, আর এভাবেই গড়ে তুলেছেন একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

তারেক রহমানের সাংগঠনিক দক্ষতা ও তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ বিএনপিকে শক্ত ভিত দিয়েছে। এমনকি আওয়ামী সরকারের দমন-পীড়নের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তা বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছে।

নেত্র নিউজ সম্পাদক তাসনিম খলিল বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে তরুণদের মধ্যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার আশাবাদ তৈরি হয়েছে। তবে বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হলো—আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কিছু নেতার অপরাধমূলক কার্যকলাপ।

বহু নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করেছেন তারেক রহমান। কিন্তু আগামী নির্বাচনে জয় পেতে হলে তাঁকে দেশে ফিরে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে হবে।

তরুণদের মধ্যে অনেকে বিএনপির পুরনো রাজনীতিকে সন্দেহের চোখে দেখে। তাই বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তারেক রহমানের নেতৃত্বে কতটা ভিন্ন, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ একটি দল গড়ে তোলা যায়—তার ওপর।

লেখক : দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি বিষয়ক সিডনিভিত্তিক একজন বিশ্লেষক ও গবেষক।সূত্র : দ্য ডিপ্লোম্যাট

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ