মতামত

মব, প্রেশার গ্রুপ এবং রাজনৈতিক স্বার্থ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ জুলাই ০৫ ২৩:৩৬:৩৭

বাংলাদেশে মব সন্ত্রাস বা গণপিটুনির ঘটনা ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক মা, ছেলে ও মেয়েকে চুরির অভিযোগে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গাজীপুরে হৃদয় নামের এক যুবক, ঢাকায় আল আমিন, লালমনিরহাটে এক সেলুন কর্মী এবং সিরাজগঞ্জে এক মানসিক প্রতিবন্ধীসহ গত ছয় দিনে অন্তত ছয়জন মানুষ এই সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ২৫৩টি মব সন্ত্রাসের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬৩ জন। আহত হয়েছেন ৩১২ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্বাস সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে।

বাংলাদেশে মবের ঘটনা নতুন নয়। ২০১২ সালে ঢাকার বাড্ডায় গুজবের ভিত্তিতে নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে ফেসবুক পোস্টের গুজব ছড়িয়ে হামলা, ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের কিছু পরের সময় ‘রাজাকারের বাড়ি পুড়াও’ ধরনের আচরণ ও জনতার আদালতের নামে সহিংসতার ঘটনা আমরা আগে দেখেছি। তবে সন্দেহ নেই যে অতীতের থেকে এই সময়ে মবের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে ও এই নিয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সন্তোষজনক নয়। আর সেই প্রেক্ষিতেই মব শব্দটি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, ‘মব’ শব্দের প্রয়োগও রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনকভাবে হচ্ছে। যেমন, যদি কোনো পক্ষের নিজেদের লোক মব আচরণ করে, তখন তারা সেটাকে ‘বিপ্লব’ বা ‘প্রতিরোধ’ বলে ব্যাখ্যা করে। আবার প্রতিপক্ষের একই আচরণকে ‘মব ভায়োলেন্স’ বলে চিহ্নিত করে। অর্থাৎ, “মব” হওয়ার সংজ্ঞাটা এখন নির্ধারিত হচ্ছে সেটা কার রাজনৈতিক স্বার্থ সার্ভ করছে তার উপর ভিত্তি করে।

আসুন কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনা করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের কক্ষে যে ঘটনা ঘটেছে, তা শিবির করেছে। শিবিরপন্থীরা একে 'বিপ্লবী প্রতিরোধ' বলছে। আবার পটিয়ার পুলিশ স্টেশনে হামলায় শিবির, বিএনপি ও এনসিপি একদল কর্মী অংশ নিয়েছে বলে এই তিন পক্ষই সেটিকে রাজনৈতিক প্রতিরোধ হিসেবে তুলে ধরছে, ‘মব’ হিসেবে নয়। আবার এনসিপি-ঘনিষ্ঠ একদল কর্মী যখন ধানমন্ডিতে এক প্রকাশকের বাসায় জোর করে ঢোকার চেষ্টা করে এবং পরে হান্নান মাসুদ তাদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে, তখন সেটাকে মব বলা হয় না। আরেকদিকে, "সরকারঘনিষ্ঠ একটি ইসলামি গোষ্ঠী" যখন কোনো সংবাদপত্রের সামনে যিয়াফত করে ও হুমকি দেয়, সরকার হয়তো তাকে মব মনে না করে ‘প্রেশার গ্রুপের কার্যক্রম’ হিসেবে বিবেচনা করে।

মব ও প্রেশার গ্রুপ নিয়ে এই বৈষম্যমূলক সংজ্ঞায়নের পেছনে আছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। মব নিয়ে এই সংজ্ঞায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো মব প্রতিরোধ করা নয়, বরং সেটি দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থানকে কতটা শক্তিশালী করে তা নিশ্চিত করা। ফলে আমরা মবকে আর আইনের শাসনবিরোধী বা সমষ্টিগত সহিংস আচরণ হিসেবে দেখছি না, বরং তাকে রাজনৈতিক বর্গগুলোর স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে দেখছি।

তাহলে মব কী? সমাজবিজ্ঞানে “মব” বলতে বোঝায় এমন একধরনের স্বতঃস্ফূর্ত, সাময়িক, আবেগতাড়িত ও নিয়ন্ত্রণহীন জনসমষ্টি, যারা কোনো এক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হঠাৎ সংগঠিত হয় এবং সহিংস, আইনবহির্ভূত, কখনোবা উন্মত্ত আচরণ করতে পারে। Ralph Turner Lewis Killian বলেন, মব হলো collective behavior-এর একটি রূপ। এখানে ব্যক্তিরা নিজস্ব বোধ হারিয়ে জনতার মনস্তত্ত্বে মিশে যান। ভিড়ের মাঝে থেকে তারা এমন সব কাজ করেন, যা তারা স্বাভাবিক সময়ে একা করতেন না। Gustave Le Bon তার বিখ্যাত বই The Crowd: A Study of the Popular Mind-এ বলেন, মবের ক্ষেত্রে আবেগ, গুজব ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি-মানসে প্রভাব বিস্তার করে যুক্তিকে সরিয়ে দেয়। অন্যদিকে Herbert Blumer বলেন, মব হলো সমাজে জমে থাকা উত্তেজনার হঠাৎ বিস্ফোরণ।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি সমাজে মব তৈরি হওয়ার মতো অবস্থা বিরাজমান আছে। আর এই অবস্থাকেই কাজে লাগাচ্ছে তথাকথিত প্রেশার গ্রুপ। তবে মব ও প্রেশার গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য আছে। একদিকে প্রেশার গ্রুপ হলো একটি সংগঠিত, সুপরিকল্পিত গোষ্ঠী যারা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করে বা সমাজে নিজেদের ক্ষমতার জানান দেয়। নিয়মতান্ত্রিক প্রেশারগ্রুপ হলে এরা সাধারণত অহিংস উপায় নেয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তারা সহিংস হতে পারে।

মব এবং প্রেশার গ্রুপের ধারণা বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কোরআন অবমাননার গুজবে একদল লোক মন্দিরে হামলা করলে, তা মব হিসেবে চিহ্নিত হয়। অপরদিকে, কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্ররা অবস্থান কর্মসূচি চালালে, তা প্রেশার গ্রুপ হিসেবে বিবেচিত হয়। বড় আন্দোলনের সময় কিংবা বিপ্লবের সময়ে মব হিসেবে আচরণ হতে পারে, তবে শান্তির সময় মব এবং প্রেশার গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য ভিন্নভাবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মব এবং প্রেশার গ্রুপের কাজের মধ্যে পার্থক্য ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে। অনেক প্রেশার গ্রুপ, বিশেষ করে যারা গোপনে রাজনীতি করে এবং নিজেদের দলীয় কাঠামো প্রকাশ করেন না, নিজেদের দাবিকে জোরালো করতে মব তৈরি করছে।

এমনকি যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে রাজনীতি করে, তাদের কিছু সদস্যও নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে এই কাজ করছে। এই অবস্থাকে আমরা বলতে পারি “স্ট্র্যাটেজিক মবিলাইজেশন অফ রেজেন্টমেন্ট”—জনগণের আবেগ, ক্ষোভ ও রাগকে রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পনা করে ব্যবহার করা। অর্থাৎ, আমরা বর্তমানে যা দেখছি তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রেশার গ্রুপ দ্বারা প্ররোচিত মব।

যে রাজনীতির স্বার্থে আমরা মবকে বৈধতা দিচ্ছি, সেই রাজনীতি আমাদের রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে তুলছে। আমরা এখন দেখছি, অনেক রাজনৈতিক প্রেশার গ্রুপ যেমন শিবির, এনসিপি, বিএনপির একটি অংশ, কিংবা তাওহিদী জনতার কিছু নেতাকর্মী পূর্বনির্ধারিত কৌশলে জনতাকে উত্তেজিত করছে। জনতা পরে মব আচরণে লিপ্ত হচ্ছে। আরেক বিপজ্জনক প্রবণতা হলো, সরকার অনেক সময় এই রাজনৈতিক পরিচয়ধারী মবদের ছাড় দিচ্ছে। যথাযথ তদন্ত করছে না। আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

আর দুঃখজনক ব্যাপার হলো, যারা এই মব ও প্রেশার গ্রুপের মব ব্যবহার নিয়ে আলাপ করছে, তাদের সফট আওয়ামী লীগ বা বিপ্লববিরোধী বলে ফ্রেম করে সমালোচনাকে ছাই চাপা দেওয়া হচ্ছে। আর এই কাজ করছে যে প্রেশার গ্রুপ মবের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে, তাদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ন্যারেটিভ উৎপাদকরাই।

আমার মতে, মবের সংজ্ঞা একমাত্রিক নয়, এটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে জটিল একটি বিষয়। কিন্তু যত জটিলই হোক, মবকে আইন ও নৈতিকতার জায়গা থেকে মোকাবিলা করা জরুরি। মবের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়ানোর আগে আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কি সত্যিই আইনের শাসন চাই, নাকি ক্ষমতার স্বার্থে আইনও ‘মব’ দিয়ে চালাতে চাই? আমরা যদি আইনের শাসনকে শক্তিশালী না করি তবে, রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র থাকবে নাশুধু থাকবে ভয়ার্ত জনতা ও সংগঠিত মব।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ