মতামত

“সুশীল” শব্দটি কেন আজও গালি?

আলিফ ইফতেখার হোসেন
আলিফ ইফতেখার হোসেন
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২০২৫ জুলাই ২৬ ২০:২২:২৬

৫ আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে একটি অদ্ভুত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অতীতে যেসব শব্দ অবমাননার প্রতীক ছিল, সময়ের প্রবাহে তাদের কেউ কেউ কলঙ্ক ঝেড়ে ফেলে গৌরবের আসনে স্থান করে নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, “শিবির” শব্দটি একসময় ভয়ের, ঘৃণার এবং দমননীতির প্রতীক ছিল, যেটি শাসকগোষ্ঠী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। কিন্তু আজ অনেক তরুণই আর সেই শব্দে আগের ভয় খুঁজে পায় না। বরং তারা এর পেছনের রাজনৈতিক নির্যাতনের ইতিহাস বোঝে। অথচ একটি শব্দ এখনও অপমানের তীর হিসেবে সমাজে ব্যবহৃত হয়, আর সেটি হলো “সুশীল”।

“সুশীল” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘সভ্য’, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Civil’। সুশীল সমাজ অর্থাৎ ‘Civil Society’ — এরা হলেন সেই নাগরিক বুদ্ধিজীবী ও সচেতন অংশ, যারা রাষ্ট্রশক্তি, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে, ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে “সুশীল” হয়ে উঠেছে বিদ্রূপের, তাচ্ছিল্যের এবং ঘৃণার সমার্থক শব্দ। এই শব্দটিকে ব্যঙ্গ করে উচ্চারণ করেছেন স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি একবার বলেছিলেন, “সুশীলদের চোখের ডাক্তার দেখানো উচিত।” শুধু শেখ হাসিনা নন, গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই “সুশীল” শব্দটি মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে দলছুট, দুর্বল, বিদেশি দালাল কিংবা মিথ্যা শুভবোধের ধারক। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এই বিদ্রূপের মাত্রা কমেনি, বরং বেড়েছে।

এই বিদ্রূপের পেছনে কেবল রাজনীতি দায়ী নয়, দায় আমাদের সবার। কারণ আমরা — আপনি, আমি, আমরা সবাই — নিজেদের নৈতিক ও চিন্তার জায়গায় যথেষ্ট প্রস্তুত হতে পারিনি। ন্যায়-অন্যায়ের বিভাজন, সত্য-মিথ্যার সীমারেখা, ক্ষমতা ও বিবেকের পার্থক্য আজও আমাদের সামাজিক মানচিত্রে স্পষ্ট নয়। আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে যুক্তির বৈধতা নির্ধারিত হয় উচ্চকণ্ঠতা ও সমর্থকের সংখ্যা দিয়ে। ফলে সত্য বললেও যদি তা সংখ্যাগরিষ্ঠের অপছন্দ হয়, তাহলে সেটি বিদ্রূপের শিকার হয়। এভাবেই “সুশীল” হয়ে গেছে গালির সমার্থক।

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে প্রাসঙ্গিক। আমি বিপুল ব্যয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। অনেকদিন ভাবতাম — এর দরকার ছিল কি? ক্যারিয়ারে কী পেলাম? কিন্তু পরে বুঝেছি, সমাজের জটিল রূপের ভেতরে ভালো আর খারাপের পার্থক্য বুঝতে পারাই ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন। তাই বহু আগেই সিজিপিএ নিয়ে ভাবা ছেড়েছি। মননচর্চা আর যুক্তির ভিত্তিতে একটি সমাজে নিজের জায়গা খুঁজে পাওয়াটাই হয়তো শিক্ষার চূড়ান্ত রূপ।

আমরা চোখের সামনে রাষ্ট্রীয় হত্যা দেখেছি, কিন্তু প্রশ্ন তুলিনি। নয়ন বন্ড হত্যাকাণ্ড তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে রাষ্ট্র বাহবা কুড়িয়েছে। এমনকি আমার শিক্ষিত মা-ও বলেছিলেন, “ভালোই হয়েছে।” তার মৃতদেহ প্রদর্শনের জন্য পুলিশ জনগণকে লাইনে দাঁড় করিয়েছিল। একধরনের নাটকীয় জনতুষ্টিবাদকে রাষ্ট্র কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তখন কতজন প্রশ্ন করেছিলাম — একজন মানুষকেও কি আইনের বাইরে হত্যা করা যায়? আমরা কি জানতাম না, আইনের দীর্ঘসূত্রতা সমস্যা হলেও, ন্যায়বিচার মানে কখনোই হত্যা নয়?

তখন কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন — বর্তমানে যাঁদের নাম আমরা জানি। যেমন: ডা. জাহেদুর রহমান, সহুল আহমদসহ আরও অনেকে। কিন্তু আমরা তাঁদের কথা শুনতে চাইনি। কেউ কেউ আজও শুনতে চায় না। কারণ, তাঁরা “সুশীল” নামে গালির পাত্র।

২০২৫ সালে এসে কেউ যদি বলে, “আমি চাই শেখ হাসিনারও ন্যায়বিচার হোক” — আমাদের কানে সেটি কেমন শোনায়? কেউ যদি বলেন, “আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উপর হামলা নয়, প্রতিশোধ নয়, বরং আইনের মধ্য দিয়ে বিচার” — তখনও কি আমরা তাকে “সুশীল” বলে গালি দিতে চাই না? কিন্তু আসল সত্য এটিই — ন্যায়বিচার মানে প্রতিশোধ নয়, বরং আইনসিদ্ধ জবাবদিহি। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে, অপরাধীর পক্ষ হলেও তার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কারণ আইন না থাকলে বিচার নির্ভর করবে জনরোষ, রাজনৈতিক চাপ বা ক্ষমতার উপর, যা কোনোভাবেই সভ্য সমাজের মানদণ্ড হতে পারে না।

শেখ হাসিনার সরকারের সময় “সুশীল” শব্দটি পরিকল্পিতভাবে গালি বানানো হয়। এটি ছিল রাজনৈতিক ভাষাগত এক মিথ্যাচার। যেখানে যুক্তি, বিবেচনা ও নৈতিকতাকে চক্রান্ত হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে ফ্রান্সে বসবাসকারী এক ইনফ্লুয়েন্সার একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি গালি দিই, কারণ সমাজের উচ্চশ্রেণি সম্মানের ভয় পায়।” তাঁর এই বক্তব্যেই বোঝা যায়, আমাদের সমাজ কোন মানসিকতায় আটকে আছে। গালি বা সহিংসতা যেন হয়ে উঠেছে নতুন শ্রেণি-রাজনীতির ভাষা।

এটি শুধু রাজনৈতিক শোষণের কৌশল ছিল না, এটি ছিল পুরো গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করার এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। শুরুতে যারা প্রশ্ন তুলেছে, তাদের বিদেশি দালাল বলা হয়েছে। এরপর নির্বাচিত কিছু “সুশীল” দলে টেনে নেওয়া হয়েছে, বাকিদের করা হয়েছে চরিত্রহরণের শিকার। ফলে নাগরিক সমাজের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে সমাজের বিবেক গঠনের প্রক্রিয়াকে।

দুঃখজনকভাবে, আমাদের সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি নিজেরাও এই কৌশলের অংশ হয়ে গেছেন — সচেতনভাবে বা অজান্তেই। কেউ কেউ সুবিধা নিয়েছেন, কেউ কেউ ভয় পেয়েছেন, কেউ কেউ আত্মরক্ষার কৌশলে চুপ থেকেছেন। এর ফলে “সুশীল সমাজ” নামক ধারণাটির উপর নেমে এসেছে আস্থার সংকট, আর সেই ফায়দা নিয়েছে রাজনৈতিক শ্রেণি।

তবে এখনও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। আপনি যদি আজ বলেন, “আইনের চোখে সবাই সমান” — আপনি কি নিশ্চিত থাকবেন যে, আপনাকে গালি দেওয়া হবে না? আপনি কি তখনো “পিন্ডির দালাল”, “দিল্লির দালাল” বা সরাসরি “সুশীল” আখ্যা পাবেন না? এখনো কি আপনি সামাজিক বিদ্রূপের কবলে পড়বেন না? উত্তর হচ্ছে — হ্যাঁ, পড়বেন।

তবুও সত্য বলতে হবে। সমাজে যারা চিন্তা করে, প্রশ্ন তোলে, তারা নিঃসন্দেহে সমাজের মেরুদণ্ড। তাদের নাম “সুশীল” হোক বা কিছুই না হোক — তাদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে চিন্তার স্বাধীনতা ও ন্যায়বোধসম্পন্ন মানুষ দরকার। যাঁরা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়াবেন এবং বলবেন, “আমি চাই ন্যায়বিচার।”

“সুশীল” হয়ে উঠেছে এক ভয়ংকর প্রতীক — যেখানে প্রশ্ন তোলা অপরাধ, যুক্তি প্রদর্শন করা ষড়যন্ত্র, আর ন্যায়বিচার চাওয়া কপটতা। এই রাজনৈতিক অপপ্রয়োগকে প্রতিহত করতে হলে আমাদের আবার “সুশীল” হতে হবে — অর্থাৎ সভ্য, ন্যায়নিষ্ঠ, যুক্তিনির্ভর। এই সময়ের চাহিদা একজন নতুন নাগরিক — যিনি ভয় নয়, বিবেক দিয়ে সমাজ গড়বেন।

যতদিন না আমরা এ সত্য বুঝতে পারি, ততদিন “সুশীল” শব্দটি গালি হয়েই থাকবে। কিন্তু ততদিনও, কেউ না কেউ দাঁড়াবেই। কারণ সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই তো সভ্যতার আসল পরিচয়।

- লেখক আলিফ ইফতেখার হোসেন, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) এ গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। ইমেইল:✉️ [email protected]

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ