মতামত

আবারও সেই পুরনো পথ? পুলিশ কি দলীয় সভার বক্তা নাকি জনগণের নিরাপত্তার রক্ষক?

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ জুলাই ০৪ ২২:৫৭:৫৩

ইত্তেফাক পত্রিকা তাদের চ্যানেলে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা-৭ এলাকার কোতোয়ালী থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা জামায়াতের কর্মী সভায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। তিনি বক্তব্যে অনেক "ভালো ভালো" কথা বলছেন, জীবনের আসল উদ্দেশ্য পরকাল, বাংলাদেশকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে, দেশপ্রেমিকদের সেবার গুরুত্ব ইত্যাদি। এরপর তিনি বলেন, জামায়াত যেন নিজেদের সদস্য সংখ্যা বাড়ায়। জনগণকে ভাগ করেন দুই শ্রেণিতে, দেশপ্রেমিক ও ফ্যাসিস্ট। আপনার মনে হতেই পারে, এই মানুষটি কত সুন্দর কথা বলছে, ধর্ম আছে, পরকাল আছে, এমনকি বক্তব্যে “জুলাইয়ের চেতনার” ছায়াও আছে। কিন্তু একটু পেছনে যাওয়া যাক। স্মরণ করুন বেনজীর আহমেদ এবং শফিকুল ইসলামের বক্তব্য। ২৬ মার্চ ২০২২, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম যেভাবে বিএনপিকে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন এবং খালেদা জিয়াকে নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন, তা কেবল অপেশাদারই নয়, ছিল রাজনৈতিক ভাষায় বিভাজনের দৃষ্টান্ত। ওই একই অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘যাঁকে তাঁর স্বামী পরিত্যাগ করছিল…যে পাকিস্তানের ওখানে কী করছে…। আর এখন সে নাকি এক নম্বর মুক্তিযোদ্ধা।’ পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে তীব্র রোষ নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাষায় একসময় মানুষকে ধমক দিতো।

তখন তারা রাজনৈতিক পক্ষের হয়ে কথা বলছিলেন “চেতনার” নামে, আজকের এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন “ধর্মের” নামে। কনটেন্ট বদলেছে, কিন্তু প্যাটার্ন বদলায়নি। অনেকে বলবেন, এটা তো ছোটখাটো ঘটনা, এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে? কিন্তু চিন্তা করুন, যদি কাল থেকে বিএনপি এই কাজ শুরু করে? যদি বড় পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের কর্মী সভায় গিয়ে বক্তৃতা দেন, “চেতনার” জায়গায় “পরিবর্তনের” কথা বলেন? সেই বক্তব্যে জনগণকে দুইভাগে ভাগ করেন, “রাষ্ট্রপন্থী” ও “রাষ্ট্রবিরোধী”? আপনি কি নিশ্চিত যে সেই দিন আসবে না?

আমরা দেখেছি অতীতে, কীভাবে পুরো পুলিশ বিভাগ ৫ আগস্ট প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমরা দেখেছি রাজনৈতিক আনুগত্য কিভাবে এক পেশাদার বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়। এখন আমাদের সামনে প্রশ্ন: আমরা কি সেই পথেই আবার হাঁটতে চাই?

'পুলিশ সংস্কার কমিশনের' একটি জরিপ অনুযায়ী, ৮৮.৭ শতাংশ মানুষ মত দিয়েছেন, পুলিশকে 'রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত' করতে হবে। 'কেমন পুলিশ চাই' শিরোনামে ৩১ অক্টোবর শুরু হওয়া এই জরিপে ২৪ হাজার ৪৪২ জন অংশগ্রহণ করেন। অর্থাৎ, দেশের জনগণ পরিষ্কারভাবে বলছে, তারা রাজনৈতিক পুলিশের বিপক্ষে।

তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, তাহলে কেন রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নিজেদের সভা-সমাবেশে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে যাচ্ছে? পুলিশ কোনো দলের নয়, রাষ্ট্রের কর্মকর্তা। তাদের কাজ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দলীয় সমাবেশে গিয়ে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বয়ান দেওয়া নয়।

এই লেখার উদ্দেশ্য জামায়াত এর সমালোচনা নয়। বরং এই লেখার উদ্দেশ্য সতর্ক করা, যদি বিএনপির মতো বড় দল এই কাজ শুরু করে, আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? আমরা যে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছি, সেই স্বপ্ন শুধু নির্বাচন দিয়ে আসবে না, প্রশাসনিক কাঠামো যদি রাজনৈতিক অনুগতদের দখলে চলে যায়, তাহলে গণতন্ত্র হবে কাগুজে বুলি মাত্র।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত দৃষ্টান্তমূলক। সরকারকে তৎপর হতে হবে, ঐ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে একটি বার্তা যায় “পুলিশ কোনো দলের নয়, দেশের”। আমরা যেন আবার ভুল পথে না হাঁটি।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ