মতামত

ইরানের পরে পাকিস্তান পরবর্তী টার্গেট? পশ্চিমা বর্ণনা-রাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক হুমকির ছায়া

ফয়সাল হানিফ
ফয়সাল হানিফ
মিডিয়া বিশ্লেষক, সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং
২০২৫ জুলাই ১৮ ১২:০২:৩৩
ইরানের পরে পাকিস্তান পরবর্তী টার্গেট? পশ্চিমা বর্ণনা-রাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক হুমকির ছায়া
২৪ জুন ২০২৫, পাকিস্তানের হায়দরাবাদে বিক্ষোভকারীরা ইরানের প্রতি সংহতি প্রকাশ এবং ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন (ছবি: হুসনাইন আলী/এএফপি)।

যখন গত মাসে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ সতর্ক করে বলেন, “মুসলিম দেশগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তাহলে একে একে সবার পালা আসবে,” সেটি ছিল কেবল কূটনৈতিক আক্ষেপ নয়—বরং এক ধরনের সাংকেতিক এসওএস।

যখন ইসরায়েল গত মাসে সরাসরি ইরানি ভূখণ্ডে হামলা চালায় এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রনেতা ও গণমাধ্যম উল্টো ইরানকেই হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করে, তখন এক শীতল প্রশ্ন উঠে আসে: এরপর কার পালা?

অনেকে একে 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' বলে উড়িয়ে দিতে চাইবেন, তবে যেসব দেশকে "বৈশ্বিক নিরাপত্তা"র নামে দশকের পর দশক ধরে কালিমালিপ্ত, বৈধতাহীন এবং ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে—সেই চেনা ছককে আর অস্বীকার করার উপায় নেই।

আজকের পশ্চিম আর ট্যাংক বা জাতিসংঘের প্রস্তাবনার ওপর নির্ভর করে না। আজ তাদের হাতিয়ার শিরোনাম, অর্থনৈতিক অবরোধ ও ন্যারেটিভ যুদ্ধ। যখন এগুলো ব্যর্থ হয়, তখন ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে অজুহাত বানিয়ে আগাম হামলা জায়েজ করা হয়।

এই প্রসঙ্গে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে একটুখানি কৃতিত্ব দেওয়া যায়: তিনি অনেক সময়ই মুখের কথায় ভেতরের সত্যটা বলে ফেলেন। গত কয়েক দশক ধরেই তিনি মুসলিম দেশগুলোর পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন নিয়ে ভয় ছড়িয়েছেন। এক সময় ইরাককে বোমা মারা হলো, লিবিয়াকে নিঃশস্ত্র করা হলো, এখন ইরানকে চেপে ধরা হচ্ছে।

আর পাকিস্তান? এটি যেন শেষ 'ফ্রন্টিয়ার'—কারণ, পাকিস্তান কোনো দেশ দখল করেনি, বরং এটি পশ্চিমা ও জায়নবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত, আদর্শিক এবং প্রযুক্তিগত অস্বীকৃতি প্রকাশ করে।

এই বক্তব্য ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া সম্প্রতি এমন একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে যেখানে দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তান এমন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে যা যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম। এর সত্যতা প্রমাণের দরকার নেই—এই ধরনের সন্দেহ উস্কে দিতেই যথেষ্ট।

এই পরিস্থিতি ২০০১ সাল নয়। কেউ আজকাল আর ঝাপসা স্যাটেলাইট ছবিতে “নাশকতামূলক অস্ত্র” বিক্রি করছে না। তবে লক্ষ্য সেই পুরনোই: পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তিকে বৈশ্বিক ঝুঁকি হিসেবে চিত্রায়ন করা।

ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ও নিরাপত্তা গবেষণা সংস্থাগুলো এখন নিয়মিত পাকিস্তানকে একটি অস্থিতিশীল, চরমপন্থার ঝুঁকিতে থাকা এবং পরমাণু যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরছে।

সম্প্রতি ডেইলি মেইল একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে আবারো সেই পুরোনো আখ্যান সামনে আনে: পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নাকি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, এবং তাদের পরিচালনা নাকি যুক্তি নয়—ধর্মীয় উন্মাদনায় চালিত। আর এই ব্যাখ্যা আবার এক ‘ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক’-এর ওপর ভর করে পাকিস্তানকে একটি চরমপন্থী ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করে।

পাকিস্তান নিয়ে পশ্চিমের সমস্যা হলো—ওরা কী করেছে তা নয়, বরং ওরা কী প্রতিনিধিত্ব করে—একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র, একটি পারমাণবিক শক্তি, এবং চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। বর্তমান বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামোয় এই ত্রয়ীই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ‘রেড লাইন’।

কিন্তু যারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখে, তাদের কাছে এসব বক্তব্য ফাঁপা মনে হয়। সাত দশকের ইতিহাসে পাকিস্তান কখনোই কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে ক্ষমতায় আনেনি। জনসাধারণ ধারাবাহিকভাবে ধর্মতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

অপরদিকে, ভারত একাধিকবার একজন নেতাকে ক্ষমতায় এনেছে, যিনি ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং বহু পর্যবেক্ষক মনে করেন তিনি তা অনুমোদন করেছেন কিংবা চোখ বন্ধ রেখেছেন। আজ সেই নেতা, নরেন্দ্র মোদি, এমন একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করছেন যা প্রকাশ্যেই হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে—যেখানে মুসলিমসহ সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করা হয়।

তবু ব্রিটিশ ও পশ্চিমা গণমাধ্যমে ভারতকে ‘সাবালক রাষ্ট্র’, ‘যুক্তিবাদী পক্ষ’, এবং ‘গণতন্ত্রের আলো’ হিসেবে দেখা হয়। এই দ্বৈত মানদণ্ড শুধু হাস্যকর নয়—প্রয়োজনে ভয়ানকও।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর হামলার ঘটনার পর, ভারতের প্রতিক্রিয়া দেখার মতো ছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ ছাড়াই ভারত সীমান্ত পেরিয়ে সামরিক হামলা চালায়। পশ্চিমা গণমাধ্যম ভারতীয় সরকারের বিবৃতি চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করে, আর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের টেলিভিশনে এনে আবারো ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর প্রশ্নে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়—এক বিষণ্ন পুনরাবৃত্তি।

এখানে এক নীরব কিন্তু সুস্পষ্ট যুক্তি কাজ করে: হিন্দুত্ববাদী উগ্রতা যত ভয়ানকই হোক, সেটিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়—খারাপ হতে পারে, কিন্তু বৈধ। অন্যদিকে ইসলামপন্থা, ক্ষমতার ধারেকাছেও না থাকলেও, সবসময় অস্তিত্ববাদী হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়।

এটি কেবল অলস সাংবাদিকতা নয়, বরং এটি অবিচারের পক্ষে এক প্রাতিষ্ঠানিক রেহাই তৈরি করে। ভারতের চরমপন্থা বা আগ্রাসনকে প্রশ্ন না করে পশ্চিমা মিডিয়া দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যকে আরও বিকৃত করে তুলছে—যেখানে পাকিস্তান চিরকাল ‘উসকানিকারী’, আর ভারত সব সময় ‘শান্তিপূর্ণ শক্তি’, এমনকি যদি সেটি ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদে নিমজ্জিত হয়।

এই প্রশ্নটি শুধু ন্যায়ের নয়, বরং আঞ্চলিক শান্তির—দক্ষিণ এশিয়ায় কখনো কি স্থিতিশীলতা আসবে, যদি একটি রাষ্ট্রের আগ্রাসনকে হালকা করে দেখা হয়, আর আরেক রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়?

পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তি হিসেবে মেনে নেওয়া বহুদিন ধরেই ইসরায়েল, ভারত ও অ্যাংলো-আমেরিকান নিরাপত্তা কাঠামোর কাছে অস্বস্তির কারণ। এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমনকি মডার্ন ডিপ্লোমেসি–র মতো প্রকাশনাও প্রকাশ্যেই লিখছে, নীতিনির্ধারকেরা যেটি গোপনে হয়তো কল্পনা করছেন—ইরানকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তানকে নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে।

এখানে কেবল ভূরাজনীতি নয়, মনস্তত্ত্বও কাজ করছে। জনমতকে এমনভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে যাতে একটি পারমাণবিক ইসলামী প্রজাতন্ত্র—যার রয়েছে চীনের সঙ্গে কৌশলগত সেতুবন্ধ—তাকে আর স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, বরং ‘বিশ্বব্যবস্থার জন্য হুমকি’ হিসেবে মনে হয়।

কেবল পাকিস্তানের অস্ত্রভাণ্ডার নয়, বরং তাদের ভূ-কৌশলগত অবস্থানই চিন্তার কারণ। ইসলামাবাদ যখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে, বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)-এর মাধ্যমে, তখন এটি একটি পোস্ট-কলোনিয়াল নির্ভরতা থেকে এক বহুপাক্ষিক চ্যালেঞ্জে রূপ নিচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর সব পথ এখন বেইজিংয়ের দিকে যায়—যুক্তরাষ্ট্র জানে, ব্রিটেন জানে, ইসরায়েলও জানে। আর এই করিডোরে পাকিস্তানের অবস্থানই একে আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।

সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার পটভূমিতে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আসিম মুনির যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ নিয়ে প্রশ্নের চেয়ে উত্তর কম। এটি কি মোহভঙ্গ প্রতিরোধ? হুঁশিয়ারি? কূটনৈতিক পুনর্মূল্যায়ন? উত্তর যাই হোক, এটি পাকিস্তানের বৈশ্বিক অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তাকে সামনে এনেছে—একটি রাষ্ট্রকে একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় আবার অবিশ্বাসিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত, পশ্চিমের সমস্যা পাকিস্তান কী করেছে, তা নয়। সমস্যা হলো—পাকিস্তান কী প্রতিনিধিত্ব করে: একদিকে এটি একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র, অন্যদিকে পারমাণবিক শক্তিধর, এবং তৃতীয়ত এটি চীনের মিত্র। বর্তমান বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোয় এই ত্রিমাত্রিক পরিচয়ই সবচেয়ে বড় সীমারেখা।

২০০৯ সালে, মঙ্গোল সাম্রাজ্য নিয়ে একটি পোস্টগ্র্যাজুয়েট সেমিনারে এক ব্রিটিশ অধ্যাপক ক্লাসরুমে একটি মানচিত্র ছুড়ে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন—“তুমি কি জানো পাকিস্তানকে বিভক্ত করার নিওকনservative পরিকল্পনা আছে?” তিনি আমাকে প্ররোচিত করতে চাননি। তিনি জানতেন আমি পাকিস্তানের সংস্কৃতি ভালোবাসি, ক্রিকেট দলের ভক্ত, এবং দেশের বাস্তবতাকে স্পর্শ করি। ওটা ছিল সতর্কবার্তা—ষড়যন্ত্র নয়।

আজ, সেই মানচিত্র আর ষড়যন্ত্র বলে মনে হয় না। সেটা যেন এক চলমান কৌশলের খসড়া।

-ফয়সাল হানিফ সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং-এ একজন মিডিয়া বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে তিনি দ্য টাইমস এবং বিবিসি-তে সংবাদ প্রতিবেদক ও গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ