বাংলাদেশে শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনায় বিপজ্জনক মাত্রায় বিষাক্ত ধাতুর উপস্থিতি

স্বাস্থ্য ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৭ ১৬:৪৮:০১
বাংলাদেশে শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনায় বিপজ্জনক মাত্রায় বিষাক্ত ধাতুর উপস্থিতি
শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনার অন্তত ৭০ শতাংশেই বিপজ্জনক মাত্রায় বিষাক্ত ভারী ধাতু রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনার অন্তত ৭০ শতাংশেই বিপজ্জনক মাত্রায় বিষাক্ত ভারী ধাতু রয়েছে—যা আন্তর্জাতিক নিরাপদ সীমার তুলনায় ১০ থেকে ৭০ গুণ বেশি। এসব খেলনায় পাওয়া গেছে সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও অ্যান্টিমনি—যেগুলোর প্রভাব শিশুদের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, ভাষা বিকাশ, আচরণগত স্থিতি এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।

বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়নমূলক সংগঠন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসব তথ্য জানায়। ‘Toxic Play-Time: Uncovering Heavy Metals in Children’s Plastic Toys’ শীর্ষক গবেষণায় উন্নত এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সরবরাহ করেছে ফিলিপাইনভিত্তিক সংস্থা ব্যান টক্সিক্স।

গবেষণায় ঢাকার চকবাজার থেকে সংগ্রহ করা হয় ৭০টি কঠিন প্লাস্টিকের খেলনা, যার মধ্যে ছিল লাল, কমলা ও হলুদ রঙের খেলনার আধিক্য। এসব রঙে বিষাক্ত রঞ্জক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি হওয়ায় এগুলোর দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। সংগ্রহকৃত খেলনার মধ্যে ১৮টি ছিল স্থানীয় ব্র্যান্ডের, ২টি ছিল চীনা ব্র্যান্ডের এবং ৫টি নামবিহীন।

এসডোর গবেষণায় চমকপ্রদ যে তথ্যগুলো উঠে এসেছে:

  • এক খেলনায় সিসার মাত্রা ছিল ২,৩৫০ পিপিএম, যেখানে নিরাপদ মাত্রা ৯০ পিপিএম।
  • পারদের মাত্রা ছিল ১,০৮০ পিপিএম (নিরাপদ সীমা ৬০)।
  • ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে ৪,৩০০ পিপিএম পর্যন্ত (নিরাপদ সীমা ৬০)।
  • ক্যাডমিয়ামের পরিমাণও ছাড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক সীমা—৬৪০ পিপিএম, যেখানে সীমা মাত্র ৭৫।

বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, আমান টয় গার্ডেন, খোকন প্লাস্টিক প্রোডাক্টস, এবং শাহজালাল টয়স গ্যালারি—এই তিনটি স্থানীয় প্রস্তুতকারকের শতভাগ খেলনাই নিরাপদ মাত্রা অতিক্রম করেছে। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, উজ্জ্বল রঙের খেলনাগুলোতে ক্লোরিন ও ব্রোমিন-এর উপস্থিতিও রয়েছে, যা পিভিসি ও ফ্লেম রিটার্ডেন্ট উপকরণ ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।

এসডোর সিনিয়র গবেষণা সহযোগী নওশিন নায়লা বলেন, “শিশুদের দাঁত ওঠার সময় খেলনা মুখে দেওয়ার প্রবণতা থাকে, ফলে এই বয়সেই তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। আমরা এসব খেলনায় ভয়াবহ মাত্রার ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছি, যা তাদের জীবনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে হুমকিস্বরূপ।”

শিশুদের জন্য কী ঝুঁকি তৈরি করছে এসব খেলনা?

গবেষণায় বলা হয়, এসব খেলনা থেকে রাসায়নিক পদার্থ শিশুর মুখে, ত্বকে এবং খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে—ফলে বুদ্ধিমত্তা হ্রাস, শেখার ও কথাবলার দেরি, কিডনি সমস্যা, আচরণগত জটিলতা, মনোযোগের ঘাটতি ও এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিও তৈরি হয়। এছাড়া বাতাসের মাধ্যমেও বিষাক্ত কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:

এসডোর চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মুর্শেদ বলেন, “একটি জাতি হিসেবে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলতে পারি না। এটি আমাদের নীতিগত ব্যর্থতার নগ্ন প্রকাশ। সরকারকে অবিলম্বে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং প্রস্তুতকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নিরাপদ খেলনা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি শিশুদের মৌলিক অধিকার।”

ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “খেলনা শিশুর আনন্দ ও বুদ্ধিবিকাশের মাধ্যম, কিন্তু তা যদি বিষে ভরা থাকে তাহলে এটি সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন। এখনই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবুল হাশেম বলেন, “এই গবেষণা আমাদের সবচেয়ে ভয়াবহ শঙ্কাকেই সত্য করেছে। শিশুরা প্রতিদিন খেলনার মাধ্যমে নিউরোটক্সিন ও কার্সিনোজেনের সংস্পর্শে আসছে—যা তাদের বিকাশকে ধ্বংস করছে।”

এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, “এটি কেবল স্বাস্থ্য সংকট নয়, এটি শিশুদের অধিকার হরণের বড় উদাহরণ। সরকারকে কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।”

বিএসটিআই-এর মনজুরুল করিম বলেন, “আমরা এ বিষয়ে সচেতন। আমাদের চারটি মানদণ্ড নির্ধারিত আছে এবং পরীক্ষার সক্ষমতাও রয়েছে। প্রয়োজন শুধু বাস্তবায়নের।”

এসডোর সুপারিশ:

১. খেলনায় ভারী ধাতুর সীমা নির্ধারণ করে বাধ্যতামূলক মান নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন২. পণ্য পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা ও সঠিক লেবেলিং নিশ্চিত করা৩. বিএসটিআই, শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত কাজ৪. প্রস্তুতকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা ও রিকল ব্যবস্থা চালু করা৫. সকল শ্রেণির মানুষের জন্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ

একটি শিশুবান্ধব ও নিরাপদ সমাজ গঠনে শুধুমাত্র ভালোবাসা বা খেলনা যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন নিরাপদ, বিজ্ঞানভিত্তিক, নিয়ন্ত্রিত এবং দায়িত্বশীল উৎপাদন ব্যবস্থা। শিশুদের শরীর ও মস্তিষ্ক গঠনের শুরুতে যদি বিষ ঢুকে পড়ে, তবে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই সংকট এখনই সমাধান করা জরুরি।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ