মতামত

জুলাই এবং ঐতিহাসিক অস্বীকারের রাজনীতি

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ জুলাই ০৩ ০০:৪৫:২৮
জুলাই এবং ঐতিহাসিক অস্বীকারের রাজনীতি

জুলাই নিয়ে আওয়ামী লীগের বয়ান এখন সামনে আসা শুরু হয়েছে। বিগত কয়েক মাসে পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে রেকর্ডগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের যেসব পোস্ট আমরা দেখছি, তার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের বয়ানের কিছু বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই বয়ানের কেন্দ্রে আছে কয়েকটি মূল থিম:

১। জুলাই মূলত বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র, বিশেষ করে মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতায় বসানোর ষড়যন্ত্র।

২। আন্দোলনটি ইসলামী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত।

৩। সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

৪। হাজার হাজার পুলিশ সদস্যকে হ...ত্যা করা হয়েছে।

৫। আওয়ামী লীগ কোনো ভুল করেনি; বরং যারা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে তারা ভুল করেছে এবং এখন যদি তারা সমর্থন ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আওয়ামী লীগ তাদের ক্ষমা করবে।

এর বাইরে আরও কোনো পয়েন্ট থাকলে তা যোগ করা যেতে পারে, তবে বয়ানের মৌলিক কাঠামো এটিই। আওয়ামী লীগের এই বয়ানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তারা জুলাই আন্দোলনের ‘কালমিনেটিভ ক্যারেক্টার’ বুঝতে পারছে না, অথবা বুঝেও অস্বীকার করছে।

জুলাইকে যদি কেবল কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থাকবে। বাস্তবে, জুলাইয়ের গোড়াপত্তন ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যেই নিহিত ছিল। তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, নির্বাচনের উদ্দেশ্য গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো হবে। কিন্তু সেই কথা আওয়ামীলীগ পরে গিয়ে অস্বীকার করেছে। সেই নির্বাচনের পরে নতুন কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আর হয়নি। বরং ২০১৪ ও ২০১৮ দুটি নির্বাচনই ছিল অংশগ্রহণবিহীন ও বিতর্কিত। ফলে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের কাঠামো একপ্রকার ভেঙে পড়ে। এই প্রতিনিধিত্বশূন্যতা থেকেই আসে রাজনৈতিক এলিয়েনেশন যা রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হান্না আরেন্ড্ট বা অ্যান্তোনিও গ্রামসির ভাষায় “ক্রাইসিস অফ হেজেমনিক রুল”। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, জুলাই আসলে সেই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের এক বিস্ফোরণ। এ ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে গভীর অবিশ্বাসের প্রতিফলন, একধরনের "collective outburst of deferred frustrations."।

হ্যাঁ, ১৬ জুলাইয়ের পর সংঘর্ষ হয়েছে। কেউ তা অস্বীকার করছে না। কিন্তু সেই সংঘর্ষের সূচনা রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও আওয়ামীলীগের ক্যাডারা করেছে, এর দায় একতরফাভাবে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা অংশ ও জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া ঐতিহাসিক বিকৃতি। আন্দোলনকারীদের মধ্যেও সংঘর্ষে জড়ানোর ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তা ছিল প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিরোধ। এই সংঘর্ষের নেতৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক অংশ, সাধারণ মানুষ এতে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল না।

প্রশ্ন আসে, রাজনৈতিক অংশ কেন সহিংস হলো? উত্তরে আমরা রাজনৈতিক তত্ত্বে ফিরে যেতে পারি। যখন কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের পথ পায় না, তখন তারা চরম পথে যেতে পারে, এটা পিওরলি Rational Choice Theory বা Political Process Model এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। আওয়ামীলীগ ও একই কাজ করেছিল। ২০০৭ সালে বিএনপি যখন আইন পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রভাবিত করতে চায় নির্বাচনের জয়লাভের লক্ষে, তখন তা বাতিলের চেষ্টায় আওয়ামী লীগ ভয়ঙ্কর সহিংসতা করেছিল। ঠিক একই ফ্রেমে বলা যায় কেন এই আন্দোলনের রাজনৈতিক অংশের মধ্যের একদল গোষ্ঠী সহিংস পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সাধারণ মানুষদের এভাবে ঢালাওভাবে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বানিয়ে দেওয়া রাজনীতির একধরনের “scapegoating strategy” যেটি রাজনৈতিক দলগুলো বারবার রাজনৈতিক পরাজয়ের দায় এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাবহার করে।

আওয়ামী লীগ এখন বলছে, যারা আন্দোলন সমর্থন দিয়েছে তারা ভুল করেছে, ভবিষ্যতে যদি তারা অনুতপ্ত হয় তাহলে তাদের ক্ষমা করা হবে। এই বক্তব্য একধরনের মোড়কবদ্ধ ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা (authoritarian moral positioning) যেখানে দল নিজেকে ‘নিরাপরাধ’ এবং জনগণকে ‘ভুলে বিভ্রান্ত’ হিসেবে ফ্রেম করে। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরবে, এইটা ঠেকানোর কোনো গণতান্ত্রিক পথ নেই। এমনকি অগণতান্ত্রিক পথেও তাদের স্থায়ীভাবে নির্মূল করা যাবে না। বাংলাদেশের মতো প্যাট্রিমনিয়াল রাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী, প্রাতিষ্ঠানিক এবং বিত্তশালী দলকে ‘ব্যানিশ’ করা সম্ভব না। এর উদাহরণ জামায়াত। যুদ্ধাপরাধের মত গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জামায়াত শেষ হয়ে যায়নি। তাহলে আওয়ামী লীগ কেন হবে?

তবে আওয়ামী লীগের বর্তমান বয়ান যদি বহাল থাকে, তাহলে তারা হয়তো নিজেদের ‘ক্যাডার ক্লাস’ ও কিছু সমর্থককে সন্তুষ্ট করতে পারবে, কিন্তু বৃহত্তর সমাজ, বিশেষ করে “অরাজনৈতিক অংশ”, তাদের সহানুভূতি পাবে না। এই অংশটি জুলাইয়ের চালিকাশক্তি ছিল। এই বাস্তবতা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে—আওয়ামী লীগ কি তাদের এই বয়ান থেকে বের হবে? তারা কি নিজেদের ভুল স্বীকার করবে? আমার পর্যবেক্ষণে, না। তারা এই বয়ানেই আটকে থাকবে। আমি একে বলি “Jamaat Syndrome”—যেখানে একটি দল নিজের অপরাধ বা ব্যর্থতা স্বীকার না করে বারবার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দাঁড় করায়, এবং একে ঘিরেই তাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি নতুন বয়ান তৈরি করে। জামাত ঠিক এই কাজটাই করেছে ১৯৭১ নিয়ে। আওয়ামীলীগ ঠিক একই কাজ করছে ২০২৪ নিয়ে।

আমাদের ইতিহাস এই রকম ভুলে ভরা। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও দাঙ্গা, ১৯৭১-এর গণহত্যা, কিংবা ২০০৭-এর সহিংসতা, সবই একসময় বিতর্ক আর মনগড়া তথ্যের ভেতরে হারিয়ে গেছে। যে ক্ষমতায় এসেছে সেই ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। আওয়ামীলীগ এইটা খুব ভালো করেই জানে। আমাদের ইতিহাসের এই দুর্বলতা জেনেই তারা নিজেদের বয়ান ঠিক করেছে। পূর্বের ঘটনাগুলোর মতন জুলাই-ও হারিয়ে যাবে, যদি এখন থেকেই এর ঐতিহাসিক ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ শুরু না হয়।

তাই যারা মনে করেন জুলাইকে চেতনার বাণিজ্য কিংবা একক মালিকানার দাবির বাইরে এনে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে, তারা দয়া করে এই ক্রেডিট যুদ্ধ বন্ধ করুন। জুলাইকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে বিশ্লেষণ করুন। গবেষণা করুন, প্রেক্ষাপট লিখুন, এবং এমন একটি স্পেস তৈরি করুন যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ ইতিহাসের পাতায় বস্তুনিষ্ঠভাবে লিপিবদ্ধ হয়। অন্যথায় আমাদের সহজাত বিস্তৃতির আরেক কুরবানি হবে জুলাই এর জনগণের আন্দোলন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ