সন্তানের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করছেন না তো? কিভাবে জানতে পড়ুন

জীবনযাপন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৯ ২০:১৫:০৩

শিশুর বেড়ে ওঠা শুধু খাবার, শিক্ষা কিংবা নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করে না। এটি এক অত্যন্ত সংবেদনশীল ও মনস্তাত্ত্বিক যাত্রা। প্রতিটি শিশু একটি আলাদা জগৎ নিয়ে জন্মায় এবং তার মানসিক গঠনে বড় ভূমিকা রাখে পরিবেশ, বিশেষ করে বাবা-মায়ের আচরণ ও কথাবার্তা। শিশুর প্রথম শেখা ভাষা, সম্পর্কের ধরন, নিজের মূল্যবোধ এবং আত্মবিশ্বাস সবকিছুর বীজ রোপিত হয় পরিবারেই।

ভাষা: আদরের হাতিয়ার নাকি মানসিক আঘাতের মাধ্যম?

শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো চিন্তা করতে পারে না। তারা অভিভাবকদের মুখের প্রতিটি কথা গভীরভাবে নেয় এবং সেটাকেই বাস্তব সত্য বলে ধরে নেয়। বাবা-মায়ের মুখ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো অনেক সময় শিশুর আত্মপরিচয়ের ভিত্তি হয়ে ওঠে। তাই বাবা-মায়ের হঠাৎ রেগে গিয়ে বলা কোনো কথাও শিশুর মনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে।

যেমন, “তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না” এই কথাটি হয়তো মুহূর্তের রাগে বলা, কিন্তু শিশুর মনে তা স্থায়ী দাগ রেখে যায়। সে তার সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে তার মন বলে দেয়, “আমি পারব না”, কারণ তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানুষ তাকে বলেছে সে অক্ষম।

তুলনা: উৎসাহ নয়, আত্মঘৃণার জন্ম দেয়

অভিভাবকদের অনেকেই সন্তানের উন্নতির জন্য তাকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। যেমন, “অমুক ক্লাসে কত ভালো করছে, আর তুমি?” কিন্তু এই তুলনা মোটেও গঠনমূলক হয় না। বরং এতে শিশুর মধ্যে এক ধরনের হিংসা, অপূর্ণতা ও আত্মবোধের দুর্বলতা তৈরি হয়।

তুলনা শিশুর মনে এক প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরি করে, যেখানে সে নিজেকে নয়, বরং অন্যকে হারানোর জন্য লড়াই করে। এভাবে সে নিজস্বতা হারায় এবং সারাজীবন অন্যের ছায়া অনুসরণ করে চলে। ভালো ফলাফল বা আচরণ করলেও আত্মতৃপ্তি আসে না, কারণ তার মাপকাঠি সবসময় অন্য কেউ।

ভুল: শেখার মাধ্যম নাকি অপমানের সুযোগ?

শিশুরা ভুল করবেই। এটি শিখন প্রক্রিয়ার অঙ্গ। কিন্তু “তুমি সবসময় ভুল করো”, “তোমার কোনো কাজই ঠিক হয় না” এই কথাগুলো শিশুর মধ্যে এক ধরনের অক্ষমতার ধারণা তৈরি করে। ধীরে ধীরে সে চেষ্টা করা ছেড়ে দেয়, কারণ তার ভুলগুলো বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয় সে ‘ভালো নয়’।

এমন আচরণ শিশুর শেখার স্পৃহা নষ্ট করে। সে চেষ্টা করলেও ফলাফল যে নেতিবাচক হবে, তা আগেই ধরে নেয়। ফলে তার সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে।

আবেগের ওপর নিষেধাজ্ঞা: “চুপ করো, ছোটদের এত কথা বলতে হয় না”

শিশুরা যখন কিছু বলতে চায়, তখন তাদের থামিয়ে দেওয়া, কথাকে গুরুত্ব না দেওয়া, কিংবা অবজ্ঞাসূচক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মাধ্যমে আমরা অজান্তেই তাদের আবেগ প্রকাশের পথ রুদ্ধ করি। এতে তারা মনে করে, তাদের অনুভূতির কোনো মূল্য নেই।

পরিণত বয়সে তারা নিজের আবেগ প্রকাশে সংকোচবোধ করে। অনেক সময় সম্পর্কের সমস্যাও শুরু হয় এই আবেগ চেপে রাখার প্রবণতা থেকে। শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকেই শেখে, তাদের কথা গুরুত্বহীন, তবে তারা পরবর্তীতে নিজেকেও তেমনই মনে করে।

ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল: ভালোবাসার নামে বোঝা চাপানো

শিশু যখন একটু বড় হয়, তখন বাবা-মা অনেক সময় বলেন, “তোমার জন্য সারাজীবন কষ্ট করলাম, একটু কথা শুনতে পারো না?” এই ধরনের বাক্য এক ধরনের আবেগিক চাপে ফেলে দেয় সন্তানকে। সন্তান অনুভব করে, সে যেন ভালোবাসার বিনিময়ে ঋণগ্রস্ত।

এভাবে সন্তানের মনে দুঃখ, অপরাধবোধ ও বিদ্রোহের মিশ্র আবেগ জন্ম নেয়। ভালোবাসাকে সে চুক্তিভিত্তিক মনে করতে শুরু করে। ভবিষ্যতে নিজের সন্তান বা অন্য সম্পর্কেও এই মানসিক কাঠামো সে বহন করে ভালোবাসা মানেই দায়, বাধ্যবাধকতা।

‘তোমার জন্য আমি আমার স্বপ্ন ছাড়তে বাধ্য হয়েছি’

এই বাক্যটি সবচেয়ে বেশি মানসিক বোঝা তৈরি করে সন্তানের ওপর। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজের সিদ্ধান্তে সন্তান ধারণ করেন, বা তার জন্য পেশাগত কিছু ছাড় দেন। কিন্তু সেই ত্যাগের দায় যদি পরবর্তীতে সন্তানের ঘাড়ে ফেলা হয়, তাহলে সে তার নিজের স্বপ্নের জায়গা খুঁজে পায় না।

শিশুর ওপর বাবা-মায়ের অতৃপ্ত জীবনের ভার চাপিয়ে দিলে সে নিজেকে একজন দায়ভার হিসেবে ভাবতে শুরু করে। এতে সে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, স্বপ্ন কিংবা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে ভয় পায়।

এসব বাক্য কী ধরনের ক্ষতি করে?

  • এই কথাগুলোর প্রভাব অতি সূক্ষ্মভাবে শিশুর ব্যক্তিত্বে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
  • শিশুর আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ বিকশিত হয় না।
  • সে নিজের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
  • নতুন কিছু শেখার বা চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভয় পেয়ে যায়।
  • নিজের অনুভূতি চেপে রাখায় আবেগজনিত সমস্যা তৈরি হয়।
  • অবসাদ, মানসিক চাপ, আত্মবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়।
  • সে ভাবতে শেখে, খারাপ ভাষা বা আক্রমণাত্মক আচরণ স্বাভাবিক।

কীভাবে শিশুকে সুরক্ষিত রাখবেন এই ক্ষতির হাত থেকে?

  • শিশু ভুল করলে তাকে শোধরানোর সুযোগ দিন, ব্যক্তিত্বকে আঘাত দেবেন না।
  • নরম ভাষা ব্যবহার করুন, কারণ গলার স্বরও শিশুর মনে দাগ ফেলে।
  • প্রশংসা করুন, বিশেষ করে যখন সে ভালো আচরণ বা ছোট কোনো কাজ করে।
  • তুলনা নয়, তার নিজের আগের চেয়ে উন্নতির কথা বলুন।
  • আবেগ প্রকাশে উত্সাহ দিন, তাকে শুনুন মনোযোগ দিয়ে।
  • তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিন, ছোট করে দেখাবেন না।
  • তাকে বোঝান আপনি বিশ্বাস করেন—সে পারবে, সে ভালো।

একটি শব্দ গড়ে দিতে পারে ভবিষ্যৎ, আবার ভেঙেও দিতে পারে

আমরা অনেক সময় সন্তানকে ‘শিক্ষা’ দিতে গিয়ে এমন কথা বলে ফেলি, যা তাকে সারা জীবনের জন্য আঘাত দেয়। অথচ একটু সংবেদনশীল হলে, একটু সহনশীল হলে শিশুর আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে পারি।

শিশুরা যা শুনে, তাই বিশ্বাস করে। তাই বাবা-মায়ের প্রতিটি শব্দ যেন হয় ভালোবাসায় মোড়ানো, সম্মানে পরিপূর্ণ। প্রতিটি বাক্য ভাবুন এটি আপনার সন্তানের মনোজগতে কী বার্তা দিচ্ছে?

একটি সুন্দর কথা তার জীবন গঠনের ভিত্তি হতে পারে। আবার একটি ভুল কথা সারাজীবনের জন্য তাকে হারিয়ে দিতে পারে। সুতরাং সচেতন হোন, সংবেদনশীল হোন কারণ আপনি যা বলছেন, তা শুধু শব্দ নয়, তা একটি ভবিষ্যৎ গড়ে দিচ্ছে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ