বিশেষ প্রতিবেদন

তালেবানের আফগানিস্তান: ধ্বংসস্তূপ থেকে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০২ ১৫:৩৮:৫৬
তালেবানের আফগানিস্তান: ধ্বংসস্তূপ থেকে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ

আফগানিস্তান—একটি দেশ যার ভূখণ্ডে ইতিহাস বারবার রক্তাক্ত হয়েছে; উপনিবেশ, গৃহযুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধের ক্রীড়াভূমি এবং আধুনিক ভূরাজনীতির এক কড়া প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। দেশটির রাষ্ট্রিক কাঠামো প্রায়ই ভেঙে পড়েছে, আবার নতুনভাবে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণ দেশটির রাজনৈতিক মানচিত্রে এক বড়সড় পরিবর্তনের সূচনা করে। বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও, তালেবান সরকার এখন আফগানিস্তানকে একটি কার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে—যা অনেকের কাছেই বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে।

সম্প্রতি তালেবান প্রশাসন নুরিস্তান প্রদেশের কামশ ও বারগামতাল জেলায় প্রায় ৮.৯ কোটি আফগানি ব্যয়ে পাঁচটি উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করেছে। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে সেচ, সড়ক নির্মাণ এবং সেতু উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব প্রকল্পের তদারকি করছে নুরিস্তান গ্রামীণ পুনর্বাসন ও উন্নয়ন বিভাগ। এমন অবকাঠামোগত বিনিয়োগ শুধুই দৃশ্যমান উন্নয়ন নয়, বরং এটি তালেবান সরকারের নিজস্ব সক্ষমতা ও প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতি এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ।

বিশ্লেষকদের মতে, তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টায় এক ধরনের অর্থনৈতিক শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করেছে। এক সময়ের আফিমনির্ভর অর্থনীতিকে তারা কৃষি উৎপাদন ও রপ্তানিনির্ভর কাঠামোতে রূপান্তর করছে। আফিম চাষে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে উৎপাদন ৯৫ শতাংশ কমে এসেছে। এর পরিবর্তে তারা কৃষকদের জাফরান ও গম চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। আজ আফগানিস্তান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাফরান উৎপাদক। ডালিম ও অন্যান্য কৃষি পণ্যের রপ্তানিতেও আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক খাতে স্থিতিশীলতা আনতে তালেবান সরকার মুদ্রানীতিতেও বেশ কঠোর হয়েছে। আফগান মুদ্রা ‘আফগানি’-কে প্রধান বিনিময় মাধ্যমে পরিণত করতে ডলার ও পাকিস্তানি রুপির ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে। অর্থপাচার বন্ধে কঠোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আফগানি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম স্থিতিশীল মুদ্রাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

আফগানিস্তান বর্তমানে খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর উদ্যোগেও অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। চীনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে খনি ও প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন বিষয়ে বহু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশেষত লিথিয়াম, তামা ও দুষ্প্রাপ্য খনিজ উত্তোলনে চীনের ২০টিরও বেশি কোম্পানি কাজ করছে আফগান মাটিতে। এই অংশীদারিত্ব আফগান অর্থনীতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গঠনে সহায়ক হতে পারে।

অর্থনীতির এই ইতিবাচক সূচকগুলো পরিসংখ্যানেও প্রতিফলিত হচ্ছে। তালেবান ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০২১ সালে আফগানিস্তানের জিডিপি ২০.৭ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালে এই হার কমে দাঁড়ায় ৬.২ শতাংশে। মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে এসেছে—২০২২ সালের জুনে যা ছিল ১৮.৩ শতাংশ, তা নভেম্বরে কমে দাঁড়ায় ৯.১ শতাংশে। রপ্তানি আয়ে বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে—২০২১ সালে যেখানে রপ্তানি আয় ছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৩ সালের মধ্যে তা পৌঁছে যায় ১.৭ বিলিয়ন ডলারে। একই সময়ে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে আফগানিস্তান দুই থেকে তিন শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ানো যায়, তবে আফগানিস্তান একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে যেতে পারে।

তবে এ উন্নয়নপ্রচেষ্টা একেবারে অনুকূল পরিবেশে হচ্ছে না। তালেবান সরকারের মানবাধিকার পরিস্থিতি, নারী শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা, গণমাধ্যমের দমন-পীড়ন ইত্যাদি কারণে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো সীমিত। ফলে বৈদেশিক অনুদান ও সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। অনেক দেশ এখনো তালেবানকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। এই বাস্তবতায় তালেবান সরকারকে অর্থনীতির পথে টিকে থাকতে হচ্ছে প্রায় একা। তবুও তারা যে কৌশলগতভাবে বিকল্প মিত্রতা গড়ে তুলছে—বিশেষত চীন, রাশিয়া, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু রাষ্ট্রের সাথে—তা স্পষ্ট।

সুতরাং, তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানকে একপাক্ষিক ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বিচার করা এখন আর সহজ নয়। রাজনৈতিক দমনপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা একদিকে থাকলেও, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আত্মনির্ভরতার যে চেষ্টা দেখা যাচ্ছে তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আফগানিস্তান আজ এক ‘কনট্রাডিক্টরি রিয়্যালিটি’—যেখানে একদিকে আছে কট্টর আদর্শ, অন্যদিকে আত্মস্থ রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা গঠনের উচ্চাভিলাষ। এই দ্বৈত বাস্তবতা আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ গন্তব্য নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরীক্ষা হয়ে উঠতে পারে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ