বিশেষ প্রতিবেদন

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল: রহস্য, ইতিহাস ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ

২০২৫ আগস্ট ০২ ১১:৫৩:০১
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল: রহস্য, ইতিহাস ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল (যাকে ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গলও বলা হয়) উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের একটি কাল্পনিক ত্রিভুজাকার অঞ্চল, যেখানে লোকমুখে বলা হয়ে থাকে যে ৫০টির বেশি জাহাজ এবং ২০টিরও বেশি বিমান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এই এলাকাকে ঘিরে নানা ঘটনার কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে এবং অদ্ভুতভাবে জাহাজ-উড়োজাহাজ উধাও হয়ে যাওয়ার গল্প জনপ্রিয় সংস্কৃতি ও জনমনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

অবস্থান ও ভৌগোলিক সীমা

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল মূলত উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমাংশে অবস্থিত একটি অঞ্চলের ধারণাগত নাম। এর সুনির্দিষ্ট সীমানা সর্বজনস্বীকৃত নয়, তবে সাধারণভাবে এই ত্রিভুজের কোণ তিনটি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি উপকূল, আটলান্টিকের বারমুডা দ্বীপ, এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের পুয়ের্তো রিকোর সান জুয়ান। এই বিন্দুগুলোকে যোগ করলে সমুদ্রে একটি প্রশস্ত ত্রিভুজাকৃতি এলাকা গঠিত হয়, যার মোট আয়তন বিভিন্ন হিসাবে প্রায় ১৩,০০,০০০ থেকে ৩৯,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার হতে পারে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল কোনো প্রশাসনিক বা সরকারি স্বীকৃত অঞ্চল নয়; যুক্তরাষ্ট্রের ভূগোল নামকরণ বোর্ড এই নামে কোনো স্থানকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং আনুষ্ঠানিক মানচিত্রেও এটির সীমারেখা চিহ্নিত নেই।

Baromuda

ছবি: মানচিত্রেবারমুডা ট্রায়াঙ্গল

ইতিহাস ও গুরুত্বপূর্ণ নিখোঁজ ঘটনা

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের ইতিহাস উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। তখন থেকেই মাঝে মাঝে এমন প্রতিবেদনের কথা শোনা গেছে যে কিছু জাহাজ সমুদ্রে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে কিংবা কোনো বিপদ সংকেত পাঠানো ছাড়াই হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। বিশেষ করে বিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এই অঞ্চলে একের পর এক নিখোঁজির ঘটনার কাহিনি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং “বারমুডা ট্রায়াঙ্গল” একটি আলোচিত রহস্যে পরিণত হয়। নিম্নে এ পর্যন্ত আলোচিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিখোঁজ ঘটনার তালিকা তুলে ধরা হলো:

এইচএমএস এটলান্টা (১৮৮০): রয়্যাল নেভির প্রশিক্ষণ帆 জাহাজ এটলান্টা (পূর্ব নাম এইচএমএস জুনো) ৩১ জানুয়ারি ১৮৮০ তারিখে বারমুডা থেকে ইংল্যান্ডের ফ্যালমাউথের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর পূর্ণ ক্রুসহ অদৃশ্য হয়ে যায়। ধারণা করা হয় পথিমধ্যে এক প্রবল ঝড়ে জাহাজটি ডুবে যায়, যদিও পরবর্তীতে অনেকেই এটিকে ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় নিখোঁজের অংশ বলে প্রচার করেছিলেন।

ইউএসএস সাইক্লোপ্স (১৯১৮): মার্কিন নৌবাহিনীর কয়লা বহনকারী জাহাজ ইউএসএস সাইক্লোপ্স বার্বাডোস দ্বীপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পথে মার্চ ১৯১৮ সালে ৩০৬ জন ক্রুসহ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছিল। যুদ্ধকালীন শত্রুদের আক্রমণ, ঝড় অথবা অতিরিক্ত ভারের কারণে জাহাজের কাঠামোগত ভাঙ্গনসহ নানা কারণ অনুমান করা হলেও কোনোটির পক্ষেই দৃঢ় প্রমাণ মেলেনি এবং জাহাজের ধ্বংসাবশেষও আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ক্যারল এ. ডিয়ারিং (১৯২১): পাঁচ-মাস্তওয়ালা বাণিজ্যিক পালতোলা জাহাজ ক্যারল এ. ডিয়ারিং ৩১ জানুয়ারি ১৯২১ তারিখে নর্থ ক্যারোলাইনার কাছাকাছি ডায়মন্ড শোলস অঞ্চলে ধ্বংসাবশেষসহ আটকে থাকতে দেখা যায়, কিন্তু জাহাজটিতে একজনও ক্রু উপস্থিত ছিল না। তদন্তে জলদস্যুতা, নাবিকদের বিদ্রোহ, রাম চোরাচালানসহ নানা সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হলেও কী কারণে জাহাজটি পরিত্যক্ত হয়েছিল তার নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা মেলেনি।

ফ্লাইট ১৯ (১৯৪৫): এটি ছিল পাঁচটি টিবিএম অ্যাভেঞ্জার টর্পেডো বোমারু বিমানের একটি নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ মিশন, যারা ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৫ তারিখে ফ্লোরিডার ফোর্ট লডারডেল ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করার পর আটলান্টিকের উপর দিক নির্ধারণে বিভ্রান্তিতে পড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। নৌবাহিনীর তদন্তে ধারণা করা হয় যে দিকভ্রান্ত হয়ে জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে বিমানগুলো সাগরে বিধ্বস্ত হয়েছিল। এই বিমানের খোঁজে পাঠানো একটি উদ্ধারকারী PBM মেরিনার উড়োজাহাজও বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়ে নিখোঁজ হয় এবং ১৩ জন উদ্ধারকর্মীরও কেউ জীবিত ফেরত আসেননি।

স্টার টাইগার ও স্টার এরিয়েল (১৯৪৮–১৯৪৯): ব্রিটিশ সাউথ আমেরিকান এয়ারওয়েজের দুইটি যাত্রীবাহী বিমান স্টার টাইগার (৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮) এবং স্টার এরিয়েল (১৭ জানুয়ারি ১৯৪৯) আটলান্টিক উড়ানে চলাকালীন হঠাৎ রেডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রথমটি অ্যাজোরেস থেকে বারমুডাগামী ও দ্বিতীয়টি বারমুডা থেকে জ্যামাইকার পথে ছিল। দুটো বিমানই তাদের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত জ্বালানি নিয়ে উড়ছিল এবং সামান্য যান্ত্রিক ত্রুটি বা নাবিকদের ভুল দিকচ্যুতি ঘটালে ছোট দ্বীপ লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়ত বলে তদন্তকারীরা উল্লেখ করেন। কোনো বিমানটিরই ধ্বংসাবশেষ সন্ধান করা যায়নি।

ডগলাস ডিসি-৩ (১৯৪৮): ২৮ ডিসেম্বর ১৯৪৮ তারিখে সান জুয়ান (পুয়ের্তো রিকো) থেকে মিয়ামিগামী একটি চার্টার্ড ডগলাস ডিসি-৩ বিমান (নম্বর NC16002) ৩২ জন আরোহীসহ আচমকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। বিমানটি কি কারণে হারিয়ে গেল তা নির্ণয়ের মতো পর্যাপ্ত তথ্য তদন্তকারীরা পাননি, এবং এটিও বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় ঘটনাগুলোর একটি হিসেবে আলোচিত হয়ে আছে।

ছবি: বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের সমুদ্রগর্ভে বিলিন হওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ

উপরোক্ত ঘটনাসমূহ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অনেক নৌযান ও উড়োজাহাজের দুর্ঘটনা বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের সাথে জুড়ে জনশ্রুতিতে স্থান পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেছেন যে বহু ক্ষেত্রে এগুলো প্রকৃতপক্ষে খারাপ আবহাওয়া, প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা মানবিক ভুলের ফল হলেও জনমনে “রহস্য” হিসেবে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাক।

জনপ্রিয় তত্ত্ব ও কল্পনাবারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ঘটনাগুলোর জন্য নানা জনপ্রিয় তত্ত্ব ও কল্পনাপ্রবণ ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। গণমাধ্যম ও লোককাহিনীতে বারবার উঠেছে এমন কিছু কাল্পনিক তত্ত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো:

ভিনগ্রহের প্রাণী (এলিয়েন) কর্তৃক অপহরণ: অনেকের বিশ্বাস, এলিয়েনরা গবেষণার জন্য মানুষ বা যানবাহনকে অপহরণ করে থাকে এবং বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকা এসব ভিনগ্রহবাসীদের ক্রিয়াকলাপের একটি হটস্পট হতে পারে। উড়ন্ত সাজ এবং অদ্ভুত আলো দেখার দাবিও মাঝে মাঝে এই এলাকার সাথে যুক্ত করে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

আটলান্টিসের ডুবে যাওয়া মহাদেশের প্রভাব: কিংবদন্তি মহাদেশ আটলান্টিস আটলান্টিক মহাসাগরে তলিয়ে গেছে বলে যাদের বিশ্বাস, তারা মনে করেন আটলান্টিসের অবশিষ্ট অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বা শক্তির ক্ষেত্র বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাহামার বিমিনি দ্বীপের উপকূলের রহস্যময় প্রস্তর কাঠামো “বিমিনি রোড” কেউ কেউ আটলান্টিসের সড়ক বলে রটনা করেন, যদিও ভূতত্ত্ববিদদের মতে এটি প্রাকৃতিক গঠন।

টাইম ওয়ার্প বা অন্য মাত্রায় প্রবেশ: কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকায় সময় ও স্থান বাস্তবতার বিকৃতি ঘটে; অর্থাৎ এখানে এক ধরনের টাইম ওয়ার্প বা সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গমস্থল রয়েছে, যেখানে প্রবেশ করলে জাহাজ-উড়োজাহাজ অন্য কোন কাল-মাত্রায় হারিয়ে যেতে পারে। এমনকি “ভূতুড়ে ত্রিভুজে” প্রবেশ করে ভিন্ন সময়ে পৌঁছে যাওয়ার কাহিনিও কল্পনায় শোনা যায়।

কল্পনা থেকে এনিমেটেড ছবি

অতিপ্রাকৃত বা ভৌতিক শক্তি: ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গল নামটিই ইঙ্গিত করে অনেকের ধারণায় এটি কোন শয়তানি বা অতিপ্রাকৃত শক্তির আখড়া। কিছু লেখক দাবি করেছেন এই অঞ্চলে এমন অজানা শক্তি কাজ করে যা কম্পাস বিকল করে দেয়, যন্ত্রপাতি অচল করে দেয় কিংবা মানুষকে বুদ্ধিভ্রষ্ট করে ফেলে। ভূত-পেত্নীর অভিশাপ থেকে শুরু করে সমুদ্রের দানব—এ ধরনের নানা অলৌকিক ব্যাখ্যাও লোকমুখে প্রচলিত।

এই সব তত্ত্বের পক্ষে বাস্তব প্রমাণ না থাকলেও সত্তরের দশকে জনপ্রিয় বই, চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারির মাধ্যমে এগুলো ব্যাপক প্রচার পায় এবং বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যকে ঘিরে জনинтерес আরও বাড়িয়ে তোলে।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও গবেষণালব্ধ তথ্য

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অনুসন্ধানে যেসব বাস্তবসম্মত কারণ উঠে এসেছে, সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

কম্পাসের চৌম্বক বিচ্যুতি: অনেক নিখোঁজ ঘটনার বর্ণনায় কম্পাস অস্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করেছে বলে দাবি করা হয়। আসলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে চৌম্বক উত্তর ও ভৌগোলিক উত্তরের মধ্যে প্রাকৃতিক ভ্রম থাকেই, এবং বারমুডা অঞ্চলেও কম্পাসের দিক কিছুটা পরিবর্তিত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু পুরনো নাবিক হয়তো এ বিষয়ে কম জ্ঞাত ছিলেন এবং ভুল করে কম্পাসের নির্দেশনা মেনে পথভ্রষ্ট হন। তবে আধুনিক জরিপে ঐ অঞ্চলে কোনো অস্বাভাবিক চৌম্বকীয় অনিয়ম পাওয়া যায়নি।

সাগরের স্রোত (গাল্ফ স্ট্রিম): এই ত্রিভুজাক্ষেত্রের ভেতরে গাল্ফ স্ট্রিম নামের একটি প্রবল সাগরধারা মেক্সিকো উপসাগর থেকে উত্তরমুখী হয়ে প্রবাহিত হয়। একটি নৌযান ইঞ্জিন বিকল হয়ে ভাসতে থাকলে বা ছোট বিমানের সমুদ্রে اضطرকালী অবতরণ ঘটলে এই স্রোত সেটিকে মূল অবস্থান থেকে বহুদূরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। ফলে দুর্ঘটনাস্থলের ভুল হিসেবের কারণে পরবর্তীতে ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়।

মানবিক ভুল: সমুদ্র ও আকাশপথে ঘটে যাওয়া বহু দুর্ঘটনার মূল কারণই মানবীয় ভুল বা অবহেলা বলে তদন্তে দেখা গেছে। অভিজ্ঞতার অভাব, ভুল সিদ্ধান্ত, দুর্বল নকশার জাহাজ কিংবা পাইলটের দূর্নিবার জেদ - এসব কারণে খারাপ আবহাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ পথে পাড়ি দিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার উদাহরণ আছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসায়ী হার্ভি কোনোভার ১ জানুয়ারি ১৯৫৮ তারিখে ঝড়ের মধ্যে জোর করে নিজের ইয়ট নিয়ে রওনা হলে সেটিও ফ্লোরিডা উপকূলে ডুবে যায়।

প্রচণ্ড আবহাওয়া ও ঝড়: আটলান্টিক মহাসাগরের এই অংশে ট্রপিক্যাল ঘূর্ণিঝড় ও হারিকেন প্রায়শই আঘাত হানে, যা অতীতে হাজারো প্রাণহানি ও জাহাজডুবির কারণ হয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক আবহাওয়া সতর্কতার যুগের আগে, হঠাৎ করে উদয় হওয়া হারিকেনে সতর্কবার্তা ছাড়াই বহু জাহাজ নিমেষে ডুবে যেত। এছাড়া বজ্রঝড় থেকে সৃষ্টি হওয়া আকস্মিক ডাউনড্রাফট বা মাইক্রোবার্স্টও সমুদ্রপৃষ্ঠে বোমার মতো আঘাত হেনে জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে। ১৯৮৬ সালে Pride of Baltimore নামক জাহাজ এমন এক ভয়ানক প্রবল বায়ুর ধাক্কায় ডুবে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

দৈত্যাকার ঢেউ: সমুদ্রের বুকে খুব কমই হলেও হঠাৎ অত্যন্ত বিশাল আকারের ঢেউ জন্ম নিতে পারে, যাকে রোগ ঢেউ বলা হয়। এই ঢেউ সাধারণ সমুদ্রের তরঙ্গ থেকে বহু গুণ বড় (১০০ ফুট বা তারও বেশি উচ্চতা) হতে পারে এবং শিকারকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট না রাখার ক্ষমতা রাখে। বারমুডা অঞ্চলে বহুমুখী ঝড়-ঝঞ্ঝার মিলনক্ষেত্র হওয়ায় এমন ঢেউ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে কিছু জাহাজ বা বিমানের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এমন বিরল প্রকৃতির বিশাল ঢেউ দায়ী থাকতে পারে।

মিথেন গ্যাসের উদ্গিরণ: সমুদ্রতলের নিচে প্রচুর পরিমাণে জমাট বাঁধা মিথেন হাইড্রেট গ্যাস রয়েছে, যা কোনো কোনো সময় হঠাৎ বড় বুদবুদ আকারে পানির মধ্যে মুক্ত হতে পারে। গবেষণাগারে দেখা গেছে, মিথেন গ্যাসের বিস্তর বুদবুদ পানির ঘনত্ব কমিয়ে দিতে পারে এবং এর মধ্যে কোনো জাহাজ পড়লে তা হঠাৎ নিমজ্জিত হয়ে যেতে পার। এধরনের গ্যাস উদ্গিরণের ফলে জাহাজডুবি ঘটলে ধ্বংসাবশেষ দ্রুত তলিয়ে যায় বা স্রোতে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে সন্ধান পাওয়া কঠিন হয়। তবে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (USGS) জানিয়েছে যে গত ১৫,০০০ বছরে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকায় এ ধরনের বিশাল মিথেন উদ্গিরণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, উপরের কারণগুলো ছাড়াও আরও নানা বাস্তব কারণ (যেমন যান্ত্রিক ত্রুটি, আগুন, আটকে পড়া ইত্যাদি সাধারণ দুর্ঘটনা) অনেক তথাকথিত রহস্যময় ঘটনার নেপথ্যে ছিল। কিন্তু মানুষের মন সাধারণ কারণের বদলে অজানা এবং রোমাঞ্চকর কারণকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখে বলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে জল্পনা কল্পনা দীর্ঘদিন ধরে টিকে ছিল।

রহস্যেরপ্রভাব

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যের গল্প বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম ও populaire সংস্কৃতিতে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল এবং জনমনে ভীতি ও কৌতূহল দুটোই তৈরি করেছিল।

গণমাধ্যম ও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে: ১৯৭০-এর দশকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে একপ্রকার ক্রেজ সৃষ্টি হয়েছিল। এই সময়ে বিখ্যাত লেখক চার্লস বার্লিৎস ১৯৭৪ সালে The Bermuda Triangle নামে একটি বেস্টসেলার বই প্রকাশ করেন, যা বিশ্বব্যাপী ২০ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয় এবং জনসাধারণের কল্পনাশক্তিকে উসকে দেয। জনপ্রিয় টিভি সিরিজ Scooby-Doo কিংবা Wonder Woman-এর এপিসোডে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের প্রসঙ্গ এসেছে, ভিনসেন্ট প্রাইস বর্ণিত ১৯৭৪ সালের তথ্যচিত্র The Devil’s Triangle-এ নানা তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে, এমনকি বারি ম্যানিলো (১৯৮১) ও ফ্লিটউড ম্যাক (১৯৭৪) ব্যান্ডের গানে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের উল্লেখ রয়েছে। এসবের ফলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যটি বিশ্বজনীন জনপ্রিয় সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়। পত্র-পত্রিকায়, সিনেমায় এবং সাহিত্যেও এ রহস্যের উল্লেখ বহুবার এসেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে উদ্দীপনা ও শিহরণ জাগিয়ে তোলে।

জনমনে ভীতি ও কৌতূহল: বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের গল্পগুলি একদিকে যেমন রোমাঞ্চকর কৌতূহল সৃষ্টি করেছে, তেমনি অনেকের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্কও জাগিয়েছে। বিশেষ করে যাত্রীবাহী জাহাজ বা বিমানে এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে ভ্রমণ করবেন যাঁরা, কখনও কখনও তারা অমূলক ভীতিতে ভোগেন। বাস্তবে যদিও এই ত্রিভুজ এলাকার মধ্য দিয়ে নিয়মিত অসংখ্য জাহাজ ও উড়োজাহাজ নির্ঘাতপূর্বক যাতায়াত করছে এবং কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে না, তবু লোককাহিনি এবং মিডিয়ার প্রভাবে মানুষের মনে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে ঘিরে এক রহস্যময় বিপদের ধারণা থেকে গেছে। এমনকি আধুনিক যুগে শিশুরাও কখনও কখনও বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়, ফলে অভিভাবকদের তাদের ভুল ধারণা ভাঙতে হয় বলে শোনা যায়। এসবই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল মিথের গণমনের উপর প্রভাবের উদাহরণ।

পর্যটন ও বাস্তবতা: ভয়ের পাশাপাশি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল পর্যটন সংশ্লিষ্ট কৌতূহলের বিষয়ও হয়ে উঠেছে। অনেক পর্যটক বরং এই রহস্যময় এলাকাকে কাছ থেকে দেখতে আগ্রহী। বাস্তবে আজকের দিনে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে ঘিরে কোনো বাস্তব বিপদ না থাকায় ক্রুজ জাহাজ কোম্পানিগুলি নিশ্চিন্তে এই পথ দিয়ে চলাচল করে এবং কিছু পর্যটন প্যাকেজে “বারমুডা ট্রায়াঙ্গল ট্যুর” বলে আকর্ষণও তৈরি করা হয়। আধুনিক নৌপরিবহন ও বিমান চলাচলের জন্য এই অঞ্চল সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং নিয়ন্ত্রিত, তাই ইচ্ছুক পর্যটকরা ভয়ের বদলে রোমাঞ্চের স্বাদ নিতেই এখানে আসেন।

সমসাময়িক দৃষ্টিকোণ

আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আর ততটা রহস্যময় নয়, যতটা আগে ভাবা হত। বহু বছরের তদন্ত ও পরিসংখ্যান থেকে বিশেষজ্ঞদের সার্বিক মত হলো:

বিশ্বমানের অন্যান্য সমুদ্রপথের তুলনায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে দুর্ঘটনা বা নিখোঁজের ঘটনা সংখ্যাগতভাবে বেশি নয়। মার্কিন নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড স্পষ্টভাবে বলেছে যে এখানে ঘটে যাওয়া রহস্যময় ঘটনাগুলো প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ও মানবীয় ভুলের সাধারণ ফলাফল – এর পিছনে অলৌকিক কিছু নেই । কোনো সরকারি সংস্থার রেকর্ডে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আলাদা করে বিপজ্জনক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত নয় এবং আনুষ্ঠানিক মানচিত্রে এর সীমানা চিত্রিত করা হয় না। আধুনিক জিপিএস ন্যাভিগেশন, উন্নত আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে জাহাজ ও বিমান এখন সমুদ্রে অনেক নিরাপদ এবং নজরদারির মধ্যে চলাচল করে। তাই আগে যেসব ঘটনা রহস্যে ঢেকে ছিল সেগুলোরও অধিকাংশ ব্যাখ্যা উদঘাটিত হয়েছে বা সহজ ব্যাখ্যা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এক সময় যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে ‘মৃত্যুত্রিভুজ’ বলে ভয় করা হত, আজ তা বাস্তবে নির্ঝঞ্ঝাট ও পর্যটনবান্ধব এলাকা – রহস্যের চেয়ে যার গুরুত্ব এখন রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক কিংবদন্তি হিসেবেই বেশি। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল হল মানুষের স্মৃতিতে জায়গা করে নেয়া একটি নগরকথা (আর্বান লেজেন্ড), যার পেছনে বাস্তবিক বিশেষত্বের চেয়ে মানুষের ভুল ধারণা এবং গল্প বলার প্রবণতাই বেশি দায়ী।


মানুষকে ‘ভিন্ন জগতে’ নেওয়া ৬টি প্রাণী

২০২৫ ডিসেম্বর ১৭ ১১:৪৭:৪৩
মানুষকে ‘ভিন্ন জগতে’ নেওয়া ৬টি প্রাণী
ছবি: সংগৃহীত

মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে এমন সব উপাদান ব্যবহার করে আসছে, যা মনের অবস্থা, অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়কে সাময়িকভাবে বদলে দিতে পারে। এ ধরনের সাইকোঅ্যাকটিভ বা মন-পরিবর্তনকারী রাসায়নিকের সবচেয়ে পরিচিত উৎস হলো উদ্ভিদ। তবে উদ্ভিদের বাইরেও প্রকৃতিতে এমন কিছু প্রাণী রয়েছে, যাদের দেহে বা নিঃসৃত পদার্থে থাকা রাসায়নিক মানুষের চেতনায় অস্বাভাবিক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এসব প্রাণীজাত উপাদান কখনো বিনোদন, কখনো আধ্যাত্মিক অনুশীলন, আবার কখনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো কোনো প্রাণী নিজস্ব বিপাকক্রিয়ার ফল হিসেবে এসব রাসায়নিক তৈরি করে, যা সাধারণত শিকারি প্রতিরোধ বা রোগ প্রতিরোধে কাজে লাগে। আবার কিছু প্রাণীর শরীরে এই রাসায়নিক জমা হয় তাদের খাদ্যের মাধ্যমে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এসব পদার্থের অপব্যবহার মারাত্মক এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে।

‘স্বপ্নের মাছ’ স্যালেমা পোরজি

ভূমধ্যসাগর ও পূর্ব আটলান্টিক অঞ্চলে পাওয়া যায় স্যালেমা পোরজি নামের সামুদ্রিক মাছটি, যাকে অনেকেই ‘ড্রিম ফিশ’ বা ‘নাইটমেয়ার ফিশ’ বলে থাকেন। কিছু ঐতিহাসিক বিবরণে দাবি করা হয়, প্রাচীন রোমানরা এর মন-পরিবর্তনকারী প্রভাবের কথা জানত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মাছ খেলে কোনো সমস্যা হয় না, তবে কিছু বিরল ঘটনায় তীব্র দৃশ্য ও শব্দজনিত বিভ্রম দেখা গেছে, যাকে বলা হয় ইকথিওঅ্যালেইনোটক্সিজম। কেন এমন হয়, তা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।

পাফার ফিশ: মারাত্মক বিষ, তবু আকর্ষণ

বিশ্বজুড়ে পাওয়া পাফার ফিশের শরীরে থাকে টেট্রোডোটক্সিন নামের শক্তিশালী স্নায়ুবিষ। ভুলভাবে খেলে এটি পক্ষাঘাত বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তবু জাপানে প্রশিক্ষিত শেফরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ‘ফুগু’ নামে এই মাছ পরিবেশন করেন। সামান্য বিষাক্ত অংশ অনেকের মধ্যে হালকা উচ্ছ্বাস বা অবশ ভাব তৈরি করে, যদিও ঝুঁকি থেকেই যায়।

সোনোরান মরুভূমির ব্যাঙ ও ‘গড মলিকিউল’

উত্তর মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলে পাওয়া সোনোরান ডেজার্ট টোডের দেহনিঃসৃত পদার্থে রয়েছে ৫-মিও-ডিএমটি নামের শক্তিশালী হ্যালুসিনোজেন। কিছু আধুনিক আধ্যাত্মিক গোষ্ঠী এটিকে ‘গড মলিকিউল’ নামে অভিহিত করে। তবে এই পদার্থ শরীরে প্রবেশ করলে গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং প্রাণীটির সংরক্ষণ নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে।

সাপের বিষ: উচ্ছ্বাস না মৃত্যু

কিছু দেশে এলাপিড গোত্রের সাপের বিষ অল্প মাত্রায় চেতনা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ঘটনা শোনা যায়। যদিও সাময়িক উচ্ছ্বাস বা ব্যথা কমার অনুভূতির কথা বলা হয়, বাস্তবে সাপের বিষ অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়।

বিচ্ছুর বিষের ভয়ংকর আকর্ষণ

দক্ষিণ এশিয়ার কিছু এলাকায় বিচ্ছুর বিষ সস্তা বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এই বিষ তীব্র যন্ত্রণা সৃষ্টি করার পর বিভ্রম বা স্বপ্নময় অনুভূতির জন্ম দিতে পারে বলে দাবি করা হয়। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

ক্যালিফোর্নিয়া হারভেস্টার পিঁপড়া ও আদিবাসী আচার

উত্তর আমেরিকার কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক আচার-অনুষ্ঠানে ক্যালিফোর্নিয়া হারভেস্টার পিঁপড়ার বিশেষ ভূমিকা ছিল। শত শত পিঁপড়া গিলে ‘স্বপ্ন-সহকারী’ পাওয়ার বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। গবেষকরা মনে করেন, এসব অভিজ্ঞতার পেছনে বিষের প্রভাবের পাশাপাশি দীর্ঘ উপবাস ও আচারিক পরিবেশও বড় ভূমিকা রাখত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব প্রাণী ও তাদের রাসায়নিক নিয়ে কৌতূহল বৈজ্ঞানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তব জীবনে এগুলোর ব্যবহার বা অপব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সচেতনতা ও গবেষণাই হতে পারে এসব বিস্ময়কর কিন্তু বিপজ্জনক প্রাকৃতিক উপাদান বোঝার নিরাপদ পথ।


আজও টিকে থাকা ছোট রাজতন্ত্রগুলোর অজানা গল্প

২০২৫ ডিসেম্বর ০৯ ১০:৫৯:০৮
আজও টিকে থাকা ছোট রাজতন্ত্রগুলোর অজানা গল্প
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থা বিশ শতকে ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়ে এবং তাদের জায়গায় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তবুও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখনো বেশ কিছু ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক একক রয়েছে যেখানে রাজপরিবার বা বংশগত শাসকের উপস্থিতি বজায় আছে। কোথাও শাসক জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, আবার কোথাও ঐতিহ্যগতভাবে নির্দিষ্ট বংশ থেকে মনোনীত হন। এখানে বিশ্বের ছোট ছয়টি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ওয়ালিস ও ফুটুনা: ফরাসি অঞ্চলের ভেতরে তিনটি ঐতিহ্যবাহী রাজত্ব

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ওয়ালিস ও ফুটুনা দ্বীপপুঞ্জ মাত্র ১৪০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি ফরাসি ওভারসিজ কালেক্টিভিটি হলেও এর ভেতরে তিনটি ঐতিহ্যগত রাজত্ব এখনো সক্রিয় রয়েছে। ফরাসি সরকার এখানে একজন প্রশাসক নিয়োগ করলেও স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিজস্ব প্রথা অনুযায়ী রাজা বা প্রধান নির্বাচন করে থাকে। ওয়ালিস দ্বীপের শেষ রাজা কাপেলিয়েল ফাউপালা ২০০৮ সালে সিংহাসনে বসেন এবং ২০১৪ সালে স্থানীয় নেতাদের সিদ্ধান্তে পদচ্যুত হন। তাকুমাসিভা বংশ ১৭৬৭ সাল থেকে এ অঞ্চলে শাসন করছে, যদিও ১৮১৮ থেকে ১৮২০ পর্যন্ত কুলিটেয়া বংশ স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় ছিল। ফুটুনা দ্বীপে দুটি স্বতন্ত্র প্রধানতন্ত্র রয়েছে সিগাভে এবং তুয়া। সিগাভের বর্তমান রাজা পোলিকালেপো কোলিভাই এবং তুয়ার চার বছর শাসকশূন্য থাকার পর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পেটেলো সি এখানকার রাজা নির্বাচিত হন।

ভুটান: নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পথে

হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ভুটান ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি বৌদ্ধ রাজত্ব। বিশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত দেশটি একটি সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র হিসেবে পরিচালিত হতো। আইন ব্যবস্থা, কোড বা আলাদা বিচারিক কাঠামো সবই রাজাধিরাজের সিদ্ধান্তনির্ভর ছিল। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক তাঁর স্বেচ্ছা উদ্যোগে কিছু ক্ষমতা ত্যাগ করেন এবং গণতন্ত্রায়নের পথ উন্মুক্ত করেন। ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো টেলিভিশন সম্প্রচার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াও এই পরিবর্তনেরই অংশ।

টোঙ্গা: প্রশান্ত মহাসাগরের শতবর্ষী সাংবিধানিক রাজতন্ত্র

দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের ১৭০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত টোঙ্গা ১৮৭৫ সাল থেকে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। এর মোট আয়তন মাত্র ৭৪৮ বর্গকিলোমিটার হলেও টোঙ্গার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সম্রাজ্ঞী সালোতে টুপো তৃতীয় ১৯১৮ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত শাসন করেন এবং তাঁর মর্যাদাপূর্ণ আচরণে জনগণ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। ১৯৫৩ সালে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয়ের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও খোলা রথে বসে উৎসব উদযাপনে অংশ নেওয়া তাঁর দৃঢ়তা এবং আন্তরিকতা জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।

ব্রুনাই: তেলসমৃদ্ধ ইসলামি সুলতানাত

বর্নিও দ্বীপের উত্তরাংশে অবস্থিত ব্রুনাই দারুসসালাম ৫৭৬৫ বর্গকিলোমিটারের একটি ইসলামি সুলতানাত। সুলতান দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধান উভয় পদেই অধিষ্ঠিত। দীর্ঘ শতাব্দী ব্রিটিশ রক্ষণশীলতার অধীনে থাকার পর ১৯৮৪ সালে ব্রুনাই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নব্বইয়ের দশক থেকে সুলতান ক্রমে কঠোর ইসলামি মূল্যবোধ অনুসরণের আহ্বান জানান এবং ২০১৪ সালে দেশটি শরিয়াভিত্তিক ফৌজদারি আইন কার্যকর করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে।

লেসোথো: পর্বতমালা বেষ্টিত আফ্রিকার একটি ছোট রাজত্ব

লেসোথো ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, যা সম্পূর্ণভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বারা বেষ্টিত। উনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনি এই অঞ্চলকে দখল করলে সোটো জনগোষ্ঠী অস্ত্রধারণ করে স্বাধীনতা রক্ষায় লড়াই করে এবং ১৮৮০ থেকে ১৮৮১ সালের গান যুদ্ধ দেশটিকে আবার ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে নিয়ে যায়। এই বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা লেসোথোকে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তির হাত থেকে রক্ষা করে এবং ১৯৬৬ সালে দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

এসওয়াতিনি: ঐতিহ্য, সম্পদ এবং দারিদ্র্যের বৈসাদৃশ্য

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিবেশী এসওয়াতিনি প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি রাজতন্ত্র। এর বর্তমান শাসক রাজা মসোয়াতি তৃতীয় প্রয়াত রাজা সোবুজা দ্বিতীয়ের প্রায় ৭০ স্ত্রীর মধ্যে একজনের সন্তান। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ডজনেরও বেশি। রাজপরিবারের বিলাসী জীবনযাত্রা সাধারণ মানুষের বাস্তবতার সঙ্গে প্রবল বিরোধ সৃষ্টি করে কারণ দেশে দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং এইচআইভি সংক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি। গবাদিপশু এখানে শুধু খাদ্য বা পরিশ্রমের উৎস নয় বরং সম্পদের প্রতীক এবং বিবাহের সময় কন্যাদায় হিসেবে গরু দেওয়া হয়। লুদজিদজিনিতে অবস্থিত রাজকীয় গ্রাম এবং পবিত্র গবাদিপশুর খোঁয়াড় এসওয়াতিনির ঐতিহ্যবাহী সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।

সূত্র: ব্রিটানিকা


পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পাখি কারা? জানুন ভয়ংকর তথ্য

২০২৫ ডিসেম্বর ০৪ ১৩:২০:৫৩
পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পাখি কারা? জানুন ভয়ংকর তথ্য
ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৩ সালে আলফ্রেড হিচকক নির্মাণ করেন তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম বিখ্যাত থ্রিলার দ্য বার্ডস। ছবিতে দেখানো হয়, যদি হঠাৎ অসংখ্য পাখি একযোগে কোনও উপকূলীয় শহরকে আক্রমণ করে, তবে কী ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। সিনেমাটি পুরোপুরি কল্পকাহিনি নয়। ১৯৬১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাপিটোলা শহরে ঘটে যাওয়া এক রহস্যময় ঘটনার ওপর ভিত্তি করেই ছবিটির নির্মাণ। সে সময় সুটি শিয়ারওয়াটার প্রজাতির হাজারো পাখি বিষাক্ত ডায়াটমে আক্রান্ত অ্যাঙ্কোভি খেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে বাড়িঘরের ছাদে আছড়ে পড়ে, রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মৃতদেহ। এই অদ্ভুত ঘটনাই পরবর্তীতে হিচককের কল্পনাকে উসকে দেয়।

আজও দ্য বার্ডস বা দ্য হ্যাপেনিং এর মতো চলচ্চিত্রে প্রকৃতির হঠাৎ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠার কাহিনি দেখা যায়। কিন্তু সত্য হলো, বাস্তব জীবনেও পাখির আক্রমণ কখনো কখনো মারাত্মক হতে পারে। বিশেষ করে, এলাকা রক্ষা ও ছানাদের সুরক্ষার বিষয়টি পাখিদের কাছে অত্যন্ত সংবেদনশীল। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু প্রজাতির পাখি এমনভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে যে তা মানুষের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলে দেয়।

ক্যাসোয়ারি: পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পাখি

অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনির ঘন বনে বসবাসকারী ক্যাসোয়ারিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পাখি বলা হয়। উড়তে না পারা এ পাখির পায়ের ভেতরের আঙুলে থাকে লম্বা ছুরির মতো ধারালো নখ। এই নখের এক আঘাতে মানুষ পর্যন্ত মারা যেতে পারে। ক্যাসোয়ারি ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াতে পারে, আর কৌতূহলবশত মানুষের কাছে ঘন ঘন চলে আসে।

ক্যাসোয়ারির আক্রমণ খুব বেশি ঘটে না, তবে সাধারণত হয় খাবারের লোভে। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার এক পর্যটককে ক্যাসোয়ারি লাথি মেরে পানিতে ফেলে দেয়, যদিও বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে ১৯২৬ সালে, যখন ক্যাসোয়ারি শিকারে যাওয়া এক কিশোরকে পাখিটি মাটিতে ফেলে তার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে জুগুলার শিরা কেটে ফেলে।

অস্ট্রিচ: দানবাকার পাখি, ভয়ংকর লাথির শক্তি

আফ্রিকার তৃণভূমিতে বসবাসকারী উটপাখি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জীবিত পাখি। পুরুষ উটপাখির উচ্চতা ৯ ফুট পর্যন্ত হতে পারে, ওজন ১৫০ কেজির বেশি। তারা ঘণ্টায় প্রায় ৭২ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াতে পারে। তবে শত্রুর মুখোমুখি হলে উটপাখি ভয়ংকর লাথি মারতে সক্ষম, যা বড় শিকারী প্রাণীকেও মেরে ফেলতে পারে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উটপাখির আক্রমণ ঘটে মানুষের উত্তেজনা বা প্ররোচনার কারণে। ১৯৮১ সালে বিখ্যাত আমেরিকান গায়ক জনি ক্যাশ নিজ বাড়ির কাছে হাঁটার সময় একটি আক্রমণাত্মক উটপাখির মুখোমুখি হন। পাখিটি তার পেটে ধারালো নখ দিয়ে আঘাত করে—সৌভাগ্যবশত শক্ত বেল্ট বাকলের কারণে প্রাণঘাতী ক্ষতি হয়নি।

ইমু: দ্রুত দৌড়বিদ কিন্তু বিপজ্জনক প্রতিরক্ষক

ইমু ক্যাসোয়ারির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। প্রায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াতে পারে, তবে কোণঠাসা হলে ভয়ংকর লাথি দিতে সক্ষম। ইমুর আক্রমণে মানব মৃত্যুর ঘটনা প্রায় নেই বললেই চলে, তবে চিড়িয়াখানা ও খামারে ইমুর আক্রমণে আহত হওয়ার ঘটনা বহুবার নথিবদ্ধ হয়েছে। ২০০৯ সালে এক বছরেই বিশ্বজুড়ে ১০০টিরও বেশি ইমু আক্রমণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়।

ল্যামারগায়ার: আকাশে ভাসমান অস্থিখাদক শকুন

হিমালয় থেকে আফ্রিকার পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ল্যামারগায়ার বা দাড়িওয়ালা শকুন তাদের অনন্য খাদ্যাভ্যাসের জন্য পরিচিত। এরা বড় হাড় আকাশ থেকে পাথরের ওপর ফেলে ভেঙে ভেতরের মজ্জা খায়। আক্রমণাত্মক আচরণ মানুষের প্রতি খুব কম দেখা গেলেও প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার এস্কাইলাসকে নাকি এমন একটি পাখি কচ্ছপ ফেলে ভুলবশত হত্যা করেছিল—যদিও আধুনিক বিশেষজ্ঞরা এটিকে কিংবদন্তি বলেই মনে করেন।

প্যাঁচা: নীরব শিকারি, ভয়ংকর প্রতিরক্ষামোড

প্যাঁচা সাধারণত লাজুক হলেও বাসা বা ছানার সুরক্ষায় অস্বাভাবিক আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেট-হর্নড ও বার্ড প্যাঁচার আক্রমণের বহু ঘটনা রয়েছে। ২০১২ সালে সিয়াটলে একাধিক মানুষ একই গ্রেট-হর্নড প্যাঁচার আক্রমণের শিকার হন। ওরেগনে এক দৌড়বিদের মাথায় বারবার আঘাত করে আরেকটি প্যাঁচা।

গ্রেট-হর্নড প্যাঁচার টালন বা নখর ৫০০ পিএসআই শক্তিতে চাপ দিতে পারে, যা গার্ড ডগের কামড়ের সমান। আক্রমণের সময় তারা সাধারণত মানুষের মাথা ও মুখ লক্ষ্য করে।

প্যাঁচা-সম্পর্কিত সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে উত্তর ক্যারোলিনার একটি হত্যা মামলা, যেখানে দাবি করা হয় যে এক নারীর মাথায় প্যাঁচার আঘাত থেকে শুরু হওয়া দুর্ঘটনাতেই তার মৃত্যু ঘটে।


বাস্তবতা বনাম প্রচারণা: টাইটানিক রহস্য উন্মোচন

২০২৫ ডিসেম্বর ০৪ ১২:৩৬:৪২
বাস্তবতা বনাম প্রচারণা: টাইটানিক রহস্য উন্মোচন
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের অন্যতম বড় সামুদ্রিক দুর্ঘটনা টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পরই “আনসিঙ্কেবল” বা ‘অডুবিত’ জাহাজ–সংক্রান্ত গল্পটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়। কিন্তু জাহাজটি ডুবে যাওয়ার আগেও কি সেটিকে সত্যিই অডুবিত বলা হয়েছিল? ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজ বলছে, হ্যাঁ যদিও বিষয়টি ছিল অনেকটা প্রচারণার অংশ, নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের আস্থার ব্যাপারে।

টাইটানিক নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত ডিজাইনার থমাস অ্যান্ড্রুস। ৫০ হাজার টনেরও বেশি ওজনের এই জাহাজটিকে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ও নিরাপদ যাত্রীবাহী জাহাজ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। জাহাজটির প্রচারণা ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বহু প্রতিবেদনে এটিকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ‘অডুবিত’ বলে দাবি করা হয়েছিল। সেই দাবি এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে যে জাহাজ ডোবার মুহূর্তেও অনেক যাত্রী আতঙ্কিত হননি।

জাহাজ ডোবার সময়ও হোয়াইট স্টার লাইনের একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্কিন কংগ্রেসকে জানিয়েছিলেন, প্রথমে তিনি টাইটানিক ডুবছে—এই খবরই বিশ্বাস করতে পারেননি, কারণ তার ধারণা ছিল জাহাজটি অডুবিত।

নিরাপত্তা নকশাই জন্ম দিল ‘অডুবিত’ তকমা

টাইটানিককে অডুবিত মনে করার প্রধান কারণ ছিল জাহাজটির অত্যাধুনিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। এর হালের ভেতরে ছিল ১৬টি বিশাল ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্ট, যেগুলোর দরজা একটিমাত্র সুইচ টিপে বন্ধ করে ফেলা যেত। ধারণা ছিল, জাহাজের কোনও অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই কম্পার্টমেন্টগুলো খুব দ্রুত সিল করে দিলে জাহাজ ভেসে থাকতে পারবে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নকশায় ত্রুটি ছিল। কম্পার্টমেন্টগুলো উপরের দিকে সম্পূর্ণ সিল করা ছিল না, ফলে আইসবার্গে ধাক্কা লাগার পর পানি এক কম্পার্টমেন্ট থেকে পরেরটিতে গড়িয়ে পড়ে পুরো জাহাজকে ডুবিয়ে দেয়।

বিলাসিতা, প্রচারণা এবং ট্র্যাজেডির পর জন্ম নেওয়া একটি ‘মিথ’

ডুবির আগ পর্যন্ত টাইটানিকের মূল আকর্ষণ ছিল এর বিলাসবহুল কেবিন, বিশাল আকার ও অভিজাত সুবিধা। যাত্রীরা এটি বেছে নিয়েছিলেন নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং এর আভিজাত্যের জন্য। সংবাদমাধ্যমেও জাহাজটির বিলাসিতা নিয়ে বেশি লেখা হতো, নিরাপত্তা নিয়ে নয়।

জাহাজ ডোবার পরই ‘আনসিঙ্কেবল’ তকমাটি যেন নাটকীয়তা বাড়ানোর জন্য আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। অথচ বাস্তবতা হলো, জাহাজটিকে সম্পূর্ণ অডুবিত বলা হলেও, সেই দাবি ছিল অতিরঞ্জিত। তবে এটাও সত্য প্রচারণা, বিজ্ঞাপন ও সংবাদ প্রতিবেদনে টাইটানিককে ‘অত্যন্ত নিরাপদ’ বলা হয়েছিল বারবার।

টাইটানিক দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, প্রকৃতিকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। জাহাজটি অডুবিত এই আত্মবিশ্বাসই অনেককে দেরিতে লাইফবোটে উঠতে বাধ্য করেছিল এবং বাড়িয়েছে প্রাণহানির সংখ্যা।

সূত্র: ব্রিটানিকা


শীতে সাদা হয়ে যায় যে সাত প্রাণী, জানুন তাদের রহস্য

২০২৫ ডিসেম্বর ০৩ ১২:৫৯:০৮
শীতে সাদা হয়ে যায় যে সাত প্রাণী, জানুন তাদের রহস্য
ছবি: সংগৃহীত

উত্তর গোলার্ধে শীত নেমে আসতেই প্রকৃতিতে ঘটে বিস্ময়কর এক পরিবর্তন। বরফের সঙ্গে মিশে যেতে কিছু প্রাণী বাদামি বা ধূসর রঙ ত্যাগ করে হয়ে ওঠে একেবারে সাদা। গ্রীষ্মে যাদের দেখা যায় সাধারণ রঙে, শীতে তারাই অল্প সময়ে রূপ নেয় বরফসাদা আচ্ছাদনে। যদিও আর্কটিক অঞ্চলের অনেক প্রাণী সারাবছরই সাদা থাকে, যেমন ধবলভালুক বা স্নো-অাওল, তবে এই সাত প্রাণী মৌসুমি রঙ পরিবর্তনের অনন্য ক্ষমতা দেখায়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু আড়াল বা ক্যামোফ্লাজ নয়, বরং তাপ সংরক্ষণ, শক্তি ব্যবস্থাপনা এবং ফটোপিরিয়ডের প্রভাবও এই রঙ পরিবর্তনের পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। মেলানিনহীন সাদা লোমের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া বায়ুফাঁক শীতে অতিরিক্ত উষ্ণতা ধরে রাখতে সাহায্য করে, যা বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

নীচে একে একে তুলে ধরা হলো শীতে রঙ বদলানো সাত প্রাণীর বৈজ্ঞানিক রহস্য-

১. খরগোশজাতীয় প্রাণী: ফটোপিরিয়ডের জাদু

আর্কটিক হেয়ার, মাউন্টেন হেয়ার ও স্নোশু হেয়ার শীতের শুরুতেই বাদামি ও ধূসর লোম বদলে সাদা হয়ে যায়। দিনের আলোর পরিমাণ কমতে থাকলে চোখের রেটিনা সেই সংকেত মস্তিষ্কে পাঠায়, এবং শরীরে নতুন সাদা লোম গজাতে শুরু করে। প্রথমে পা, কান ও বাহ্যিক অংশ সাদা হয়, পরে পুরো শরীর।

গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তুষারাবরণ দ্রুত কমে গেলে এই প্রাণীরা সাদা হয়ে পড়ে মাটির রঙের বিপরীতে ফলে শিকারিদের কাছে সহজ টার্গেট হয়।

২. বেজি বা উইজেল: রাজকীয় পোশাকের উৎস

তিন প্রজাতির উইজেল লিস্ট উইজেল, লং-টেইল্ড উইজেল এবং স্টোট শীতে বরফসাদা লোম পায়। স্টোটের সাদা লোমকেই মধ্যযুগ থেকে পরিচিত ‘আরমাইন’ নামে, যা রাজা-রাজড়াদের পোশাকের গলায় ব্যবহৃত হতো। দক্ষিণাঞ্চলে থাকা উইজেলরা রঙ না বদলালেও উত্তরাঞ্চলের উইজেলরা পুরোপুরি সাদা হয়। গবেষণা বলছে, এদের রঙ পরিবর্তনও তাপমাত্রার কারণে নয়, বরং ফটোপিরিয়ডের প্রভাবে ঘটে।

৩. পিয়ারি ক্যারিবু: একমাত্র রঙ বদলানো ক্যারিবু উপপ্রজাতি

কানাডা ও গ্রিনল্যান্ডের উচ্চ আর্কটিকে পাওয়া পিয়ারি ক্যারিবু শীতে রূপ নেয় সম্পূর্ণ সাদা আচ্ছাদনে। অন্য উপপ্রজাতির ক্যারিবুরা সারাবছর বাদামি-ধূসরই থাকে। ছোট আকার, ভিন্ন শিং কাঠামো ও রঙ বদলানোর ক্ষমতার কারণে এগুলোকে একসময় আলাদা প্রজাতি ভাবা হতো।

৪. কলার্ড লেমিং: অদ্ভুত শীতের নখর

ডিক্রোস্টনিক্স গণের লেমিংগুলো শীতে পুরোপুরি সাদা হয়ে যায়। যদিও এরা বেশিরভাগ সময়ই বরফের নিচে বাস করে, যেখানে ক্যামোফ্লাজ খুব দরকার নেই, তবুও বিবর্তনে এ বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে। শীতকালে তাদের পায়ের পাতায় গজায় বিশেষ ‘শীতের নখর’ যা বরফ খুঁড়ে বাসা বানাতে সাহায্য করে।

৫. পটারমিগান: পালকের জাদু

পটারমিগান তিন প্রজাতির পাখি, যারা শীতে বাদামি বা ছোপ ছোপ পালক ত্যাগ করে দেহজুড়ে সাদা পালক ধারণ করে। উইলো ও রক পটারমিগানের লেজে কিছু কালো পালক থাকে, তবে হোয়াইট-টেইলড পটারমিগান পুরোপুরি সাদা হয়ে যায়। এমনকি মাথা থেকে পা পর্যন্ত ‘হোয়াইট বুট’ গজায়, যা তুষারের ওপর হাঁটতে সুবিধা দেয়। সাদা রঙের উজ্জ্বলতা আসে পালকের ভিতরে থাকা বায়ুফাঁকের কারণে।

৬. সাইবেরিয়ান হ্যামস্টার: ঘরের আলোয়ও বদলায় রঙ

একমাত্র গৃহপালিত প্রজাতি হিসেবে এই তালিকায় রয়েছে সাইবেরিয়ান হ্যামস্টার, যাকে অনেকে ‘উইন্টার হোয়াইট’ নামেও চেনে। যদি এদের এমন ঘরে রাখা হয় যেখানে প্রাকৃতিক আলো প্রবেশ করে, তবে শীতে তারা ধূসর-রূপালি রঙ থেকে সাদা হয়ে যায়। তাপমাত্রা নয়, আলোই নিয়ন্ত্রণ করে এদের মোল্টিং চক্র।

৭. আর্কটিক ফক্স: রঙ বদলের প্রতিযোগীতা

গ্রীষ্মে বাদামি-ধূসর আর শীতে বরফসাদা এই দারুণ পরিবর্তনের জন্য আর্কটিক ফক্স বিখ্যাত। তবে আলাস্কা ও কানাডার উপকূলীয় এলাকায় এদের ‘নীল রঙের’ ভ্যারিয়েন্টও পাওয়া যায়, যারা শীতে কেবল অল্প হালকা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লাল শেয়াল এখন আর্কটিক অঞ্চলে ঢুকে পড়ছে, এবং খাদ্য প্রতিযোগিতায় অনেক সময় আর্কটিক ফক্সকে হারিয়ে দিচ্ছে।

তথ্যসূত্র: ব্রিটানিকা


সুগার বিট: পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ চিনির উৎস

ফিচার ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ ডিসেম্বর ০২ ০৮:৩৬:১৭
সুগার বিট: পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ চিনির উৎস
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের চিনি উৎপাদনে আখের পরেই যে ফসলটি সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে, তা হলো সুগার বিট বা বিটা ভালগারিস। আধুনিক কৃষি, খাদ্যশিল্প ও বায়োটেকনোলজির অগ্রগতির কারণে এই ফসল এখন ইউরোপসহ পৃথিবীর বহু অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উচ্চমাত্রার সুক্রোজসমৃদ্ধ রসের জন্য সুগার বিটকে আজ চিনি শিল্পের প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সুগার বিট মূলত অ্যামারান্থেসি পরিবারের উদ্ভিদ এবং বহু শতাব্দী ধরে এটি পুষ্টিকর সবজি ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৭৪৭ সালে জার্মান রসায়নবিদ আন্দ্রেয়াস মার্গগ্রাফ প্রথমবারের মতো বিট থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চিনি উৎপাদন করেন। তবে শিল্পকারখানায় বিট থেকে চিনি তৈরির যাত্রা শুরু হয় ১৮০২ সালে সিলেশিয়ায় প্রথম বিট সুগার ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

ন্যাপোলিয়ন ১৮১১ সালে এ শিল্পের প্রসারের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখান। ব্রিটিশ অবরোধে যখন ফরাসি সাম্রাজ্যের আখের চিনি আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি বিকল্প হিসেবে বিট সুগার উৎপাদনকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার দেন এবং চারোনদিকে দ্রুত কারখানা স্থাপন শুরু হয়। যদিও ন্যাপোলিয়নের পতনের পর শিল্পটি সাময়িকভাবে ম্লান হয়েছিল, তবে ১৮৪০-এর দশক থেকে ইউরোপজুড়ে এর বিস্তার দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ১৮৮০ সালের মধ্যেই ইউরোপে বিটের উৎপাদন আখকে ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় শতভাগ চিনি উৎপাদন বিট থেকে হয়।

চাষাবাদ ও উৎপাদন চক্র

সুগার বিট সাধারণত শীতল নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন ফসল হিসেবে চাষ হয়; তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের উষ্ণ অঞ্চলে এটি শীতকালীন ফসল হিসেবেও ব্যাপক প্রচলিত হয়েছে। সাধারণত ১৭০ থেকে ২০০ দিনের ফসলচক্রে এটি পূর্ণবয়স্ক হয়।

বীজ বপন থেকে শেকড় পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত আবহাওয়া তুলনামূলক ঠান্ডা হলে ফলন বাড়ে এবং সুক্রোজের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। উপযুক্ত অবস্থায় প্রতিটি বিটের ওজন ১ থেকে ২ কেজি পর্যন্ত হতে পারে এবং এতে ৮ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত সুক্রোজ পাওয়া যায়।

সুগার বিটের জন্য আদর্শ মাটি হচ্ছে হিউমাসসমৃদ্ধ লোম; তবে বালুকামাটি থেকে শুরু করে ভারী মাটি পর্যন্ত বিভিন্ন মাটিতেই এটি চাষ করা যায়। শিল্পোন্নত কৃষি খামারে গভীর চাষ, যথাযথ সারের ব্যবহার, প্রিসিশন ড্রিলিং, কীটনাশক ও হার্বিসাইড ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চমানের ফসল উৎপাদন করা হয়।

রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের হুমকি

কালো রুট রট, সারকোসপোরা লিফ স্পটসহ নানান ছত্রাকঘটিত রোগ সুগার বিটের শেকড়ের ওজন ও সুক্রোজ মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া নিমাটোড, পোকামাকড় ও বিভিন্ন ধরনের গুবরেপোকার আক্রমণ ফসলের বড় অংশ নষ্ট করে দিতে সক্ষম। এজন্য নিয়মিত ফসল ঘুরিয়ে চাষ এবং রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করা হয়।

জেনেটিক উন্নয়ন ও ব্রিডিং

উচ্চ সুক্রোজমাত্রা, রোগপ্রতিরোধ এবং ভারী শেকড় নিশ্চিত করার জন্য বহু দেশে উন্নত হাইব্রিড ও পলিপ্লয়েড জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে গ্লাইফোসেট-সহনশীল জিএম (জেনেটিকালি মডিফাইড) সুগার বিট এখন বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত।

ফলন, রোগপ্রতিরোধ, অভিযোজনশক্তি এবং চিনি আহরণশীলতা—এই চারটি বৈশিষ্ট্য বাড়াতে বিশ্বব্যাপী গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।


শুক্রগ্রহে বজ্রগতির বাতাস: নতুন রহস্য উদঘাটন

২০২৫ ডিসেম্বর ০২ ০৮:১৪:২৯
শুক্রগ্রহে বজ্রগতির বাতাস: নতুন রহস্য উদঘাটন
ছবি: সংগৃহীত

শুক্রগ্রহে এমন অবিশ্বাস্য গতির ঝড়ো বাতাস বইছে, যার শক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর হারিকেনকেও ছাড়িয়ে যায়। এই তীব্র বায়ুপ্রবাহ ঘণ্টায় ১০০ মিটারেরও বেশি গতিতে পুরো গ্রহ প্রদক্ষিণ করে, যা আমাদের দৃষ্টিতে বিপর্যয়কর হলেও শুক্রে এটি বায়ুমণ্ডলের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত। বিজ্ঞানীরা এই বিস্ময়কর ঘটনাকে বলেন ‘সুপাররোটেশন’, অর্থাৎ গ্রহের পৃষ্ঠের তুলনায় তার বায়ুমণ্ডলের ঘূর্ণন অনন্ত গুণ দ্রুত হওয়া।

শুক্রগ্রহ নিজের অক্ষে একবার ঘুরতে সময় নেয় প্রায় ২৪৩ পৃথিবী–দিন, যা আমাদের সৌরজগতের মধ্যে সবচেয়ে ধীর ঘূর্ণনগুলোর একটি। অথচ তার বায়ুমণ্ডল মাত্র চার পৃথিবী–দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ গ্রহ প্রদক্ষিণ সম্পন্ন করে। এই বৈপরীত্য বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের কাছে একটি বড় রহস্য ছিল।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় পাওয়া নতুন তথ্য বলছে, সূর্যের তাপে সৃষ্ট ‘দৈনিক বায়ু–জোয়ার’ বা ডায়ার্নাল টাইডই শুক্রের বায়ুমণ্ডলের এই অস্বাভাবিক সুপাররোটেশনের প্রধান চালিকা শক্তি। প্রতিদিন সূর্যের তাপে বায়ুমণ্ডলে যে ওঠানামা তৈরি হয়, সেটিই শক্তি সঞ্চালনের মাধ্যমে বাতাসকে দ্রুত বাড়িয়ে তোলে। গবেষকদের মতে, এই টাইড অন্য যেকোনো প্রক্রিয়ার তুলনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। যদিও সেমিডায়ার্নাল টাইড (দিনে দুইবার তাপজোয়ার), গ্রহজ–তরঙ্গ এবং উত্তর–দক্ষিণমুখী বায়ুপ্রবাহও কিছু মাত্রায় ভূমিকা রাখে, তবুও প্রধান নিয়ামক হলো দৈনিক তাপজোয়ার।

গবেষণায় ২০০৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার ভেনাস এক্সপ্রেস এবং জাপানের আকাতসুকি উপগ্রহ শুক্রের বায়ুমণ্ডলে রেডিও তরঙ্গের বাঁক (রেডিও অকালটেশন) পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বহু মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে। পাশাপাশি উন্নত কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলের ভেতরে শক্তি কীভাবে স্থানান্তরিত হয় এবং সুপাররোটেশন কীভাবে সৃষ্টি হয় তা পরীক্ষা করা হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্যের তাপ থেকে উৎপন্ন এই বায়ু–জোয়ার বুঝতে পারলে শুক্রের বায়ুমণ্ডলীয় গতিশীলতার আরও গভীর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে অন্যান্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলের আচরণ বোঝার পথও সুগম হবে, যা ভবিষ্যতের গ্রহ–বিজ্ঞান গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে।

-রাফসান


৩৬০ আউলিয়ার দেশ সিলেটে ইসলামের পতাকা ওড়ার নেপথ্য কাহিনী

ফিচার ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ নভেম্বর ৩০ ২০:৫৬:৩৮
৩৬০ আউলিয়ার দেশ সিলেটে ইসলামের পতাকা ওড়ার নেপথ্য কাহিনী

সিলেট, যাকে বলা হয় ৩৬০ আউলিয়ার দেশ। বাংলাদেশের এই উত্তর-পূর্ব জনপদের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। কিন্তু এই পবিত্র ভূমিতে ইসলামের বিজয়ের ইতিহাসটি ছিল এক বিশাল সংঘাত ও অলৌকিক ঘটনার সমষ্টি। ইতিহাসের পাতা ও লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, ইয়েমেনের মাটি থেকে আসা সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) এবং তৎকালীন সিলেটের অত্যাচারী রাজা গৌর গোবিন্দের মধ্যে যে লড়াই হয়েছিল, তা কেবল অস্ত্রশস্ত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল সত্যের আধ্যাত্মিক শক্তির সঙ্গে মিথ্যার কালো জাদুর লড়াই।

গৌর গোবিন্দের অত্যাচার ও বুরহান উদ্দিনের আর্তনাদ

চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সিলেট (তৎকালীন শ্রীহট্ট) শাসন করতেন রাজা গৌর গোবিন্দ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী কিন্তু নিষ্ঠুর শাসক। ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে, রাজ্যে মুসলমানরা বসবাস করলেও তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল অত্যন্ত সীমিত। ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন শেখ বুরহান উদ্দিন নামক এক মুসলিম তার নবজাতক পুত্রের জন্ম উপলক্ষে একটি গরু জবাই করেন। এই খবর রাজার কানে পৌঁছালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বুরহান উদ্দিনের নবজাতক শিশুটিকে হত্যা করেন এবং তার হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেন।

হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর আগমন

নিরুপায় বুরহান উদ্দিন বিচারের আশায় দিল্লির সুলতানের দ্বারস্থ হন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তার ভাগ্নে সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে সৈন্য পাঠান, কিন্তু গৌর গোবিন্দের যাদুবিদ্যা ও শক্তির কাছে তারা পরাস্ত হন। পরবর্তীতে হযরত শাহজালাল (রহ.) তার ৩৬০ জন সফরসঙ্গী বা আউলিয়াকে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার আধ্যাত্মিক শক্তি এবং আল্লাহভীরুতা ছিল তার মূল সম্বল।

কালো জাদু বনাম আধ্যাত্মিক শক্তি

লোকশ্রুতি রয়েছে, রাজা গৌর গোবিন্দ তার রাজ্যকে রক্ষা করতে কালো জাদুর আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি তার প্রাসাদের চারপাশে জাদুকরী আগুনের বেষ্টনী তৈরি করেছিলেন এবং লোহার বিশাল সব বল ছুড়ে মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ অস্ত্রের মাধ্যমে এই জাদু প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না।

কথিত আছে, হযরত শাহজালাল (রহ.) ও তার সঙ্গীরা যখন সুরমা নদীর তীরে পৌঁছান, তখন নদী পার হওয়ার কোনো নৌকা ছিল না। তখন শাহজালাল (রহ.) তার জায়নামাজ বিছিয়ে অলৌকিকভাবে নদী পার হন। এরপর যখন গৌর গোবিন্দের জাদুকরী প্রতিরোধের সম্মুখীন হন, তখন হযরত শাহজালাল (রহ.) তার সঙ্গীদের আজান দেওয়ার নির্দেশ দেন। আজানের সুমধুর ও শক্তিশালী ধ্বনিতে গৌর গোবিন্দের জাদুকরী প্রাসাদ কাঁপতে শুরু করে এবং তার সমস্ত কালো জাদু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

সিলেট বিজয় ও ইসলামের প্রচার

অবশেষে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা গৌর গোবিন্দ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান এবং সিলেটে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়। হযরত শাহজালাল (রহ.) কেবল একজন বিজেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সংস্কারক। তার আগমনের মাধ্যমেই সিলেটে এবং পরবর্তীতে বাংলার এই অঞ্চলে ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে পড়ে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ তার আধ্যাত্মিকতার ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।

সিলেটে ইসলাম বিজয়ের এই ইতিহাস আজও মানুষের মনে জীবন্ত। হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় করেন। গৌর গোবিন্দের দম্ভ চূর্ণ করে যেভাবে সত্য ও ন্যায়ের বিজয় হয়েছিল, তা ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।


শীতের ভোরে প্রকৃতির অপূর্ব সাজ

২০২৫ নভেম্বর ২৭ ০৮:৪৫:১৯
শীতের ভোরে প্রকৃতির অপূর্ব সাজ
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশজুড়ে শীত এখন পুরোপুরি তার আবহ নিয়ে হাজির। কুয়াশায় মোড়ানো আকাশ, হিমেল বাতাসের তীব্র ছোঁয়া, ভোরের আলোয় ঝলমলে শিশিরবিন্দু, খেজুরের রস বিক্রেতার ডাক সব মিলিয়ে শীতের সকাল যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব শিল্পকর্ম। বছরের সবচেয়ে শীতল ঋতু হিসেবে শীত সাধারণত বাংলা ক্যালেন্ডারের পৌষ ও মাঘ মাস জুড়ে থাকে এবং এই সময়ে প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতিতে নানা বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন দেখা যায়।

শীতের ভোরে প্রাকৃতিক দৃশ্য হয়ে ওঠে মনোমুগ্ধকর। আকাশে হালকা বা ঘন কুয়াশার চাদর, দূর থেকে দেখা যায় গাছপালা আর পথঘাট ধূসর পর্দায় মোড়া। ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকা শিশিরবিন্দু রোদ উঠলে মুক্তোর মতো আলো ছড়ায়। পুকুরপাড়, কৃষিজমি, গ্রামের রাস্তা সবকিছুই যেন স্নিগ্ধ ঠান্ডার কোমল ছোঁয়ায় নতুন রূপ পায়।

আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্যে দেখা যায়, শীতের সকালে বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা থাকে বেশ উঁচু। এর ফলে শীত আরও তীব্র অনুভূত হয়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ পঞ্চগড়, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুরে কনকনে ঠান্ডা ও হালকা শৈত্যপ্রবাহ অনুভূত হওয়া এখন নিয়মিত। এসব অঞ্চলে সকালে ঘরের বাইরে বের হওয়া মানেই ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ।

শীতে মানুষের জীবনধারা বদলে যায়। সকালবেলা রাস্তা ঘাটে দেখা যায় গরম কাপড়ে মুড়ানো মানুষদের ব্যস্ত যাতায়াত। অফিসগামী মানুষের হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ জড়িয়ে থাকে উষ্ণতার আরাম। অনেকেই আবার ঘরে বসে উপভোগ করেন খেজুরের পাটালি কিংবা খেজুরের রস। গ্রামাঞ্চলে ভোরবেলা রস সংগ্রহের দৃশ্য শীতের অন্যতম আনন্দময় অনুষঙ্গ।

শীতকাল নানা পুষ্টিকর ফলমূল ও সবজির মৌসুম। কমলা, কুল, সফেদা, ডালিম, গাজর, ব্রোকলি, ফুলকপি, পালং শাক এসব সবজি ও ফল শুধু স্বাদেই নয়, স্বাস্থ্য উপকারিতায়ও অনন্য। শীতের সকাল তাই হয়ে ওঠে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের উপযুক্ত সময়।

সাংস্কৃতিকভাবে শীতের সকাল বাঙালির জীবনকে বরাবরই প্রভাবিত করে এসেছে। বাংলা কবিতা, গান, গল্পে শীতের সকাল তার নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে বারবার স্থান দখল করেছে। কুয়াশা, শিশির, শীতের রোদ, খেজুরের রস এসবই বাঙালির লোকজ স্মৃতি, আবেগ ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে।

পাঠকের মতামত:

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

রাষ্ট্রের ধারণাটি একসময় কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনের শাসন এবং নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ভূমিকা এখন... বিস্তারিত