যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্ক নীতি

ট্রাম্পের ঘোষণার প্রভাব ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০২ ১১:৩৬:০৪
ট্রাম্পের ঘোষণার প্রভাব ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দেন, তা গোটা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। যদিও পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার মুখে তিনি ওই সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন, তবে কয়েক মাসের ব্যবধানে আবারও একতরফাভাবে বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপের পথে হাঁটেন।

নিজ সিদ্ধান্তকে ‘ধারাবাহিক বিজয়’ আখ্যা দিলেও, বাস্তবতা বলছে ট্রাম্পের নীতিতে এখনও বহুমুখী সংশয় রয়ে গেছে। তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, এই শুল্কনীতি অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পুনরুজ্জীবিত করবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াবে এবং মার্কিন পণ্যের চাহিদা বাড়াবে। তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে দেখা দিতে পারে।

বিশ্বের অনেক দেশের জন্য ট্রাম্পের শুল্কনীতি একধরনের 'ওয়েক আপ কল'-এ পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশ এখন নতুন বাণিজ্য জোট গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে।

সময়সীমা ও চুক্তির বাস্তবতা

‘৯০ দিনে ৯০ চুক্তি’—ট্রাম্প প্রশাসনের এমন ঘোষণা থাকলেও জুলাইয়ের শেষ নাগাদ প্রকাশিত হয় মাত্র এক ডজন সংক্ষিপ্ত চুক্তি। এসব চুক্তিতে বিস্তারিত বিধান অনুপস্থিত এবং অনেক ক্ষেত্রেই মৌখিক সম্মতির ভিত্তিতে এগুলো গৃহীত হয়েছে।

ব্রিটেনের সঙ্গে চুক্তি স্বাভাবিক মনে হলেও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের মতো বড় অর্থনৈতিক অংশীদারদের ওপর ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়। বিপরীতে যারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি পরিমাণ পণ্য কিনতে রাজি হয়নি, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তান, তাদের ওপর চাপানো হয়েছে বাড়তি শুল্ক।

বাজার প্রতিক্রিয়া ও ব্যবসায়িক বাস্তবতা

একদিকে, ব্যবসায়ীদের জন্য শুল্ক হার নির্দিষ্ট হওয়ায় অনিশ্চয়তা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তারা এখন ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও খরচের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। কিন্তু অন্যদিকে, বিদেশি পণ্যের দাম বাড়ায় ভোক্তারা চাপে পড়ছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাম বাড়াচ্ছে এবং সাধারণ পরিবারের আয় কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে পণ্যের চাহিদাও কমে যেতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে।

দেশভেদে প্রভাব: জার্মানি, ভারত ও চীন

ভারতের ওপর আরোপিত ২৫ শতাংশের বেশি শুল্ক স্বল্পমেয়াদে তেমন প্রভাব ফেলবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে, কারণ ভারতের জিডিপির মাত্র দুই শতাংশ মার্কিন রফতানির ওপর নির্ভরশীল।

জার্মানির ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ তাদের অটোমোটিভ শিল্পকে বড় ধাক্কা দিয়েছে এবং প্রবৃদ্ধি অর্ধ শতাংশেরও বেশি কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

চীনের ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা রয়েছে। অ্যাপল তার উৎপাদন ভারতে সরিয়ে নিচ্ছে এবং চীনের জায়গায় ভারত হয়ে উঠছে স্মার্টফোন রপ্তানির বড় উৎস। তবে এতে ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন্সের মতো দেশগুলোর প্রতিযোগিতাও বাড়ছে।

অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও রাজস্ব রাজনীতি

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্ক হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশে। এর ফলে আমদানি শুল্ক বাবদ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব অর্জিত হয়েছে, যা মোট ফেডারেল আয়ের প্রায় পাঁচ শতাংশ।

যদিও ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এই অর্থ ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে, তবে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন পণ্যের দামও বাড়ছে। ইউনিলিভার ও অ্যাডিডাসের মতো কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়েছে।

ট্রাম্প নিম্নআয়ের জনগণকে রিবেট চেক দেওয়ার কথা বললেও, তা বাস্তবায়নে কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন এবং এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে।

বাকি থাকা চুক্তি ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

কানাডা, তাইওয়ান ও চীনের সঙ্গে এখনো চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। ফার্মাসিউটিক্যালস ও ইস্পাত খাতে সিদ্ধান্ত বাকি এবং অনেক চুক্তি এখনো স্বাক্ষর হয়নি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব চুক্তির শর্ত কতটা কার্যকর হবে এবং কিভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা স্পষ্ট নয়। যদিও এখন পর্যন্ত বড় কোনো বাণিজ্য যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছে, তবে নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখে বিশ্ববাণিজ্য ধীরে ধীরে পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে।

ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিক ঝুঁকি

শুল্কের কারণে মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যয়ের চাপ তৈরি হলে ট্রাম্পের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হতে পারে। কারণ তিনিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তার নীতি সাধারণ আমেরিকানদের জন্য ব্যয় বাড়াবে না।

রিপাবলিকান দলের সামনে রয়েছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। উচ্চ ব্যয় ও কম প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ভোটারদের অসন্তোষ দলটির জন্য রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বৈশ্বিক বাণিজ্যে মার্কিন প্রভাব ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্যিক দিক থেকে আরও বেশি 'স্বনির্ভর' করতে চাইছেন। কিন্তু এতে দীর্ঘদিনের অংশীদাররা বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি বৈশ্বিক বাণিজ্যের কাঠামোকে আঘাত করে, তাহলে তার সুফল শেষ পর্যন্ত হয়তো আমেরিকার ভাগ্যে নাও জুটতে পারে।

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আগামী কয়েক মাসে নয়, বরং আগামী বছরগুলোতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে। আর এর প্রভাব প্রথমে পড়তে পারে ট্রাম্পের নিজস্ব ভোটারদের ওপর—চড়া দাম, সীমিত বিকল্প ও কম আয় দিয়ে।

-বিবিসি

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ