মৃত ৮ মিনিট, জীবনের সন্ধান: এক নারীর অতিলৌকিক অভিজ্ঞতা

২০২৫ আগস্ট ০২ ১৯:৫২:১২
মৃত ৮ মিনিট, জীবনের সন্ধান: এক নারীর অতিলৌকিক অভিজ্ঞতা
ব্রিয়ানা লাফার্টি। ছবি: সংগৃহীত।

বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে বহুকাল ধরেই মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের রহস্য ঘিরে রয়েছে এক গভীর আগ্রহ ও কৌতূহল। সভ্যতার প্রারম্ভ থেকে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান এ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা ও ব্যাখ্যার বিপরীতে বিতর্ক তুলে ধরেছে। তবে কখনো কখনো বাস্তব জীবনের কিছু বিরল অভিজ্ঞতা এই বিতর্কের কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায়— যেমনটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের এক নারী, ব্রিয়ানা লাফার্টির জীবনে। মৃত্যুর মতো এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে ফিরে এসে তিনি নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন চেতনা, অস্তিত্ব এবং মানবজীবনের গভীর অর্থ।

ব্রিয়ানা লাফার্টি, বয়স ৩৩, দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন Myoclonus Dystonia নামক একটি জটিল ও প্রাণঘাতী স্নায়বিক রোগে। একপর্যায়ে তার দেহের সব শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসকেরা তখন তাকে ‘ক্লিনিক্যালি মৃত’ ঘোষণা করেন। সময়কাল— আট মিনিট। এই আট মিনিটের মধ্যেই ঘটে যায় এমন কিছু, যা তার ভাষায় ছিল ‘জীবনের চেয়েও গভীর এক উপলব্ধি’।

‘আমি তখন আর দেহে ছিলাম না, কিন্তু বেঁচে ছিলাম— আরও বেশি জীবন্ত, আরও বেশি গভীরভাবে সচেতন।’

এভাবেই শুরু করেন ব্রিয়ানা তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তার ভাষায়, “আমি অনুভব করলাম আমার আত্মা যেন শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে, অথচ আমি সম্পূর্ণ চেতন এবং গভীর প্রশান্তিতে আচ্ছন্ন। কোনো ব্যথা ছিল না, ভয় ছিল না, বরং ছিল এক বিস্ময়কর স্বচ্ছতা।”

এই অবস্থায় তিনি উপলব্ধি করেন যে মানবজীবন আসলে এক ক্ষণস্থায়ী মায়া, যার অন্তরালে রয়েছে এক উচ্চতর সত্ত্বার উপস্থিতি— যিনি নিঃশর্ত ভালোবাসায় আমাদের রক্ষা করেন। “আমার মনে হয়েছিল, আমি এমন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছি, যেখানে সময় নেই, তবু সব কিছু নিজ নিজ স্থানে নিখুঁতভাবে সংগঠিত। সবকিছু একসাথে ঘটছিল, কিন্তু অদ্ভুত এক শৃঙ্খলার মধ্যে।”

ব্রিয়ানা জানান, তিনি এমন কিছু সত্ত্বার উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন, যারা মানুষের মতো নয়, তবুও অচেনা নয়। তাদের আচরণ ছিল আশ্বাসদায়ক, এবং তার প্রতি তারা যেন গভীর আত্মীয়তার স্নেহে সাড়া দিয়েছিল।

“মৃত্যু আসলে শেষ নয়, বরং একটি রূপান্তর।”

এটি ব্রিয়ানার অভিজ্ঞতার সারকথা। তিনি বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরে চেতনা বিলীন হয় না, বরং এক ভিন্ন মাত্রায় প্রবেশ করে— যেখানে চিন্তা ও ইচ্ছাই বাস্তবের রূপ দেয়।

এই অভিজ্ঞতা তার দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। “যে বিষয়গুলো একসময় খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো, এখন আর তা তেমন কিছু নয়। এখন আমার জীবন অর্থবহ, কারণ আমি জানি— আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য আছে।”

আবার নতুন করে জীবন শিখতে হয়েছে

এই অলৌকিক অভিজ্ঞতার পর ব্রিয়ানাকে আবার হাঁটা ও কথা বলা শিখতে হয়েছে নতুন করে। কারণ তার pituitary gland মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে তাকে এক জটিল ও পরীক্ষামূলক মস্তিষ্ক অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা এখন পর্যন্ত সফল বলে বিবেচিত হচ্ছে।

তবে ব্রিয়ানা আরেকবার এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চান না। তার ভাষায়, “শারীরিকভাবে যে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া আমাকে পেরোতে হয়েছে, তা এতটাই কষ্টকর ছিল যে দ্বিতীয়বার সেই অভিজ্ঞতা হলে হয়তো আমি ফিরতে পারতাম না।”

বিজ্ঞান বনাম অভিজ্ঞতা

ব্রিয়ানার অভিজ্ঞতা এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেখানে বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও চেতনাবিদ্যার সীমারেখা ঘোলাটে হয়ে যায়। ‘নিউরোসায়েন্স’ এখনো মৃত্যুর পরবর্তী চেতনা বা ‘near-death experience’-এর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবে এই ধরনের ঘটনা আমাদের চেতনার সংজ্ঞা ও মানব অস্তিত্বের গভীরতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।

ব্রিয়ানা লাফার্টির ঘটনা হয়তো আরও একবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়— জীবন শুধু একটি শারীরিক অস্তিত্ব নয়, বরং একটি জটিল চেতনার প্রক্ষেপ, যার উৎস ও গন্তব্য এখনো মানববুদ্ধির ধরাছোঁয়ার বাইরে। হয়তো এই জীবনই যথেষ্ট নয় তা অনুধাবনের জন্য— প্রয়োজন এমন এক অভিজ্ঞতা, যা সীমা ছাড়িয়ে দেয় অস্তিত্বের দিগন্ত।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ