সৃজনশীলতার ৫টি ধাপ: একটি বিশ্লেষণধর্মী বাংলা প্রতিবেদন

জীবনযাপন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০১ ১৮:১৫:১৩
সৃজনশীলতার ৫টি ধাপ: একটি বিশ্লেষণধর্মী বাংলা প্রতিবেদন
ছবি: সংগৃহীত

সৃষ্টিশীলতা কেবল নতুন কিছু তৈরি করার ব্যাপার নয় বরং এটি বিদ্যমান উপাদানগুলোর মধ্যকার নতুন সম্পর্ক আবিষ্কারের প্রক্রিয়া। মার্কিন বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ জেমস ওয়েব ইয়াং ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তাঁর বই A Technique for Producing Ideas-এ এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োচিত ধারণা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "নতুন ধারণা মানে হলো পুরাতন উপাদানের মধ্যে নতুন সংযোগ সৃষ্টি করা।" এই তত্ত্বই সৃজনশীলতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

এই ধারণার ভিত্তিতে ইয়াং সৃষ্টিশীল চিন্তার পাঁচটি ধাপ ব্যাখ্যা করেন। নিচে আমরা প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করবো এবং দেখাবো কীভাবে এগুলো বাস্তবজীবনের উদাহরণে প্রয়োগযোগ্য।

ধাপ ১: নতুন উপাদান সংগ্রহ

সৃষ্টিশীল হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় শেখা থেকে। এটি দুটি ভাগে বিভক্ত:

১. বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জন: আপনি যে সমস্যাটি নিয়ে কাজ করছেন, তার বিষয়ে নির্দিষ্ট জ্ঞান সংগ্রহ করা যেমন, একটি নির্দিষ্ট প্রকল্প বা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ।

২. বিস্তৃত ও বিচিত্র জ্ঞান অর্জন: শুধু একটিমাত্র বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে, বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করুন। কারণ, বৈচিত্র্যপূর্ণ জ্ঞানই নতুন সংযোগ তৈরির উপাদান যোগায়।

যত বেশি আপনি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানবেন, তত বেশি আপনার মস্তিষ্কের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির উপাদান থাকবে।

ধাপ ২: উপাদান নিয়ে চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ

এই পর্যায়ে আপনি সংগ্রহ করা তথ্যগুলোর মধ্যে গভীরভাবে সম্পর্ক খুঁজবেন। আপনি বিভিন্ন উপাদানকে মিলিয়ে দেখবেন, তাদের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করবেন।

এই ধাপটি অনেক সময় জটিল এবং ধৈর্যের পরীক্ষা হয়ে থাকে। অনেকেই এ সময় হতাশ বোধ করেন কারণ মনে হতে পারে কিছুই এগোচ্ছে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই ‘জটিল ভাবনা’র মধ্য দিয়েই মস্তিষ্ক নতুন সংযোগ তৈরির পথে হাঁটতে শুরু করে।

ধাপ ৩: সমস্যার কাছ থেকে সরে আসা

তৃতীয় ধাপে আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে সমস্যা থেকে মন সরিয়ে নেবেন। মানসিকভাবে নিজেকে বিশ্রাম দেওয়া এবং অন্য কাজে মন দেওয়া খুব জরুরি। এটি হতে পারে ঘুরতে যাওয়া, বই পড়া, গান শোনা বা স্রেফ ঘুমানো।

জেমস ওয়েব ইয়াং বলেন, "এই পর্যায়েই মনের অচেতন অংশ সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করে এবং চমৎকার সমাধান তৈরি করতে পারে।" অনেক বিখ্যাত চিন্তাবিদ, যেমন আইনস্টাইন ও নিউটনও এভাবেই সমস্যার সমাধান পেয়েছেন সমস্যা থেকে সরে দাঁড়িয়ে।

ধাপ ৪: হঠাৎ করে সমাধান আসা

হঠাৎ করেই আপনার মনে উদ্ভাসিত হবে একটি সমাধান বা একটি দৃষ্টিভঙ্গি এটিকেই আমরা বলি ‘ইউরেকা মুহূর্ত’। এটি সাধারণত আসে যখন আপনি নিজেকে চাপমুক্ত করেছেন এবং মস্তিষ্ক স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

এই পর্যায়টি অনেক সময় ঘুমানোর সময়, গোসল করার সময় বা হাঁটাহাঁটির সময় ঘটে। কারণ, তখন মস্তিষ্কের ডেল্টা ও আলফা ওয়েভ সক্রিয় থাকে- যা সৃষ্টিশীল চিন্তার জন্য সহায়ক।

ধাপ ৫: সমাধান যাচাই ও পরিমার্জন

চূড়ান্ত ধাপে আপনি আপনার ধারণাটি বাস্তবজগতে প্রয়োগ করবেন এবং তা মানুষের সামনে উপস্থাপন করবেন। এখানেই বোঝা যাবে আপনার ধারণাটি আসলে কতটা কার্যকর। আপনি প্রতিক্রিয়া পাবেন, সমালোচনা শুনবেন এবং তা অনুযায়ী আপনার ধারণাকে আরও উন্নত করবেন।

অনেকেই ধারণার প্রথম খসড়া নিয়েই তৃপ্ত হয়ে যান। কিন্তু প্রকৃত সৃষ্টিশীলতা হলো ধারাবাহিক উন্নয়ন। অনেক বড় উদ্ভাবকই তাদের আবিষ্কার বারবার পুনর্গঠন ও উন্নয়নের মাধ্যমে সফল করেছেন।

উদাহরণ: ফ্রেডেরিক ইউজিন আইভসের উদ্ভাবনী চিন্তা

আইভস নামের এক উদ্ভাবক এই পাঁচ ধাপ অনুসরণ করে নতুন ফটোগ্রাফিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি প্রথমে মুদ্রণ ও ফটোগ্রাফির কাজ শেখেন (ধাপ ১), এরপর দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন (ধাপ ২)। একপর্যায়ে তিনি সমস্যাটি থেকে সরে গিয়ে ঘুমান (ধাপ ৩) এবং ঘুম থেকে উঠে একটি নতুন ধারণা পান (ধাপ ৪)। পরে তিনি ওই পদ্ধতির আরো উন্নয়ন করে দ্বিতীয় পেটেন্ট নেন (ধাপ ৫)।

রবার্ট ফ্রস্ট একবার বলেছিলেন, “একটি ধারণা হলো একধরনের সম্পর্কের কীর্তি, আর এর চূড়ান্ত রূপ হলো ভালো রূপক।” এই কথাই বোঝায়- সৃজনশীলতা মানেই সম্পর্ক খুঁজে বের করা।

সুতরাং, আপনি যদি সৃষ্টিশীল হতে চান, তাহলে শুধু এক বসে নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টায় সময় নষ্ট করবেন না। বরং পড়ুন, ভাবুন, দূরে সরে যান, অনুভব করুন, আবার ফিরে এসে তার পরিমার্জন করুন। এই ধাপগুলো অনুশীলনের মাধ্যমেই আপনি একজন সৃজনশীল চিন্তাবিদ হয়ে উঠতে পারবেন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ