বিশেষ প্রতিবেদন

আকাশ এখন আমাদের: বিমূর্ত ষড়যন্ত্রের ছায়া ভেদ করে বাংলাদেশের নীরব প্রতিরোধ

২০২৫ জুলাই ২৮ ০৯:৩২:৪৯
আকাশ এখন আমাদের: বিমূর্ত ষড়যন্ত্রের ছায়া ভেদ করে বাংলাদেশের নীরব প্রতিরোধ
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস ২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল, বুধবার ঢাকায় বিএএফ বেস বীর উত্তম এ কে খন্দকার-এ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মহড়া উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। ছবি: ফেসবুক/প্রধান উপদেষ্টা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

ঢাকার আকাশে সেদিন মেঘ ছিল। কিন্তু সেই মেঘ ছিল না কেবল প্রকৃতির; ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে জন্ম নেওয়া দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রের ছায়া, যা নির্জন আলোচিত হয়েছিল রাজধানীর এক নিষ্প্রভ সরকারি ভবনের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে। বঙ্গভবনের ছায়ায় গড়ে ওঠা ওই কক্ষে বসেছিল এক নিঃশব্দ উচ্চপর্যায়ের গোপন বৈঠক—উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একাধিক সাবেক কর্মকর্তা, একাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিক এবং এক বিশেষ দূত, যিনি এসেছিলেন দিল্লি থেকে।

টেবিলে ছিল অগোছালো কাগজপত্র, মানচিত্র ও গোপন স্ট্র্যাটেজিক নোট। আলোচনা হচ্ছিল এমন একটি বিষয়ে, যা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে সূক্ষ্ম স্তম্ভ—বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা—তাকে কীভাবে ভারতীয় কৌশলগত প্রভাবের আওতায় আনা যায়।

এক দীর্ঘ পরিকল্পনার অলিখিত রূপরেখা

এই ষড়যন্ত্র কোনো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ঘটনা নয়। বরং একটি দীর্ঘ ১৫ বছরব্যাপী প্রস্তুত করা নীলনকশা, যার প্রকৃত লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সামরিক আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাংলাদেশের আকাশসীমাকে একটি ‘সহযোগিতার মোড়কে বাধা দখলদারিত্বে’ পরিণত করা।

২০১০-এর দশকে শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার নামে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল বাহিনী—বিমানবাহিনী—কে রাজনৈতিক দয়া ও কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতার বলয়ে ঠেলে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর কঠোর সাংগঠনিক ঐতিহ্যের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানবাহিনীকে শিথিলভাবে ভারতমুখী করে গড়ে তোলা হয়।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে Dhaka Tribune একটি খবর প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল: "Indian Air Chief Visits Bangladesh, Set to Tour Major Bases." খবরটি শুধু সফরের নয়, বরং পুরো নীতির প্রতিফলন—যেখানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান বাংলাদেশের প্রধান বিমানঘাঁটিগুলো ঘুরে দেখেন, যৌথ মহড়া ও প্রশিক্ষণের নকশা তৈরি করেন, এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কাঠামো পুনর্বিন্যাসের জন্য সুপারিশ করেন।

এই প্রক্রিয়া কোনো দিন-দুপুরে শুরু হয়নি। ২০২১ সালে জয়পুরহাটে অনুষ্ঠিত বিমানবাহিনীর পাসিং আউট প্যারেডে প্রথমবারের মতো ভারতীয় এয়ার চিফ আর. কে. এস. ভাদুরিয়াকে প্রধান অতিথি হিসেবে রাখা হয়। এটি ছিল প্রতীকীভাবে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিতে আত্মসমর্পণের এক প্রক্রিয়ার সূচনা।

মৈত্রীর নামে নির্ভরতাকে পুঁজি করে কৌশলগত নিঃস্বতা

এই কৌশল শুধু কূটনীতির খাতায় সীমাবদ্ধ ছিল না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম Eurasian Times জানায়—“Historic First: Bangladesh Air Force to Operate From India.” এর অর্থ, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ভারতীয় কমান্ডের অধীনে মহড়ায় অংশ নিতে সম্মত হয়েছে। এর মাধ্যমে বন্ধুত্বের নামে শুরু হয়েছিল একতরফা নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বিগত এক যুগে একটি আধুনিক যুদ্ধবিমান পর্যন্ত পায়নি। চীন থেকে জে-১০সি অথবা পাকিস্তান থেকে জেএফ-১৭ সংগ্রহের সম্ভাবনা বারবার ‘বাজেটের অজুহাতে’ নাকচ হয়েছে। প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে সোভিয়েত যুগের মিগ-২১ বা ৮০’র দশকে কেনা পুরনো চীনা ট্রেনার প্লেন। পাইলটেরা অচল ইঞ্জিনে উড়েছেন, কেউ কেউ ফেরেননি।

এক সাবেক উইং কমান্ডার বলেন, “আমরা প্রতিদিন জানতাম আমাদের হাতে কার্যকর অস্ত্র নেই, তবুও উড়েছি—এই বিশ্বাসে যে, একদিন কেউ আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবে। সেই দিন আসেনি, যতক্ষণ না রাজনীতি বদলায়।”

একজন মানুষ, এক সঙ্কল্প, এক প্রতিরোধ

২০২৪ সালের শেষ প্রান্তে যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ঢেউ উঠছিল, তখন এক নীরব অথচ দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন—নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস। ক্ষমতায় এসে প্রথমেই তার সরকার শুরু করে বিমান বাহিনীর কাঠামোগত বিশ্লেষণ। অনুসন্ধানে উঠে আসে বিস্ফোরক সত্য: ১৫ বছরে কোনো আধুনিক যুদ্ধবিমান কেনা হয়নি, বরং ভারতীয় কারিগরদের দিয়ে পুরনো যুদ্ধবিমানের রক্ষণাবেক্ষণ করানো হয়েছে। এমনকি প্রশিক্ষণ বিষয়েও সীমিত ছিল বাংলাদেশি অধিকার।

প্রফেসর ইউনুস বুঝেছিলেন এটি নিছক অবহেলা নয়; এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত, বহুপাক্ষিক সামরিক-রাজনৈতিক নীরব দখলদারিত্ব। তিনি কূটনীতির পরিবর্তে আত্মমর্যাদাকে প্রধান অস্ত্র করেন।

তারপরই ইতিহাসের চাকা ঘুরে দাঁড়ায়।

চুক্তির ছেঁড়াফেঁড়া আর নতুন আকাশনীতি

ভারতের সঙ্গে করা সব যৌথ মহড়ার চুক্তি বাতিল করা হয়। বিমান বাহিনীর নেতৃত্বে আনা হয় সাহসী, চিন্তাশীল ও আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা—যিনি সম্প্রতি চীন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরেছেন। ঘোষণা করা হয় নতুন নীতিমালা:
“বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স থাকবে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, কিন্তু দুর্বল নয়।”

কুর্মিটোলা, যশোর ও তেজগাঁও ঘাঁটিগুলোতে বিদেশি প্রবেশ—বিশেষ করে ভারতের—নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধুত্বের নামে যে ঘাঁটিগুলোতে ভারতীয় পতাকা উড়েছিল, সেখানে আবার উড়তে শুরু করে আত্মমর্যাদার প্রতীক জাতীয় পতাকা।

নতুন মিত্রতা, নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের আকাশ আবার মুখ তুলে দাঁড়ায়। শুরু হয় তুরস্ক, পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে সমন্বিত এয়ার ড্রিল। করাচি থেকে যুদ্ধবিমান উড়ে আসে ঢাকায়। চীনের চেংডুর সঙ্গে চুক্তি হয় চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটার জেট কেনার বিষয়ে। বাংলাদেশের ক্যাডেটদের নতুন প্রশিক্ষণ মডিউলে নিয়ে আসা হয় বৈশ্বিক কৌশলগত প্রযুক্তি।

দিল্লিতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এনএসএ, এমইএ, র-এর ঘনঘন বৈঠকে উঠে আসে একটাই কথা—“প্রফেসর ইউনুস ভারতের কোনো কূটনৈতিক ফাঁদে পা দিচ্ছেন না।” এক চীনা কূটনীতিকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ঐতিহাসিক বাক্যটি—
“বাংলাদেশ এখন আর ভারতীয় ছাতার নিচে নয়। তারা নিজের মেঘে নিজের বৃষ্টি নামাতে শিখেছে।”

ইতিহাসের মুহূর্ত: আকাশে ফিরে আসা আত্মমর্যাদা

কুর্মিটোলা হেলিপ্যাডে নামলেন প্রফেসর ইউনুস। সঙ্গে ছিলেন নতুন বিমান বাহিনী প্রধান। ইউনুসের হাতে ছিল একটি কালো ফোল্ডার, যাতে লেখা—“Bangladesh’s Sky Belongs to Bangladeshis Only.”

ঠিক সেই মুহূর্তে, আকাশ থেকে ভেসে এলো এক গর্জন। করাচি থেকে উড়ে এলো একটি জেএফ-১৭ থান্ডার। কুর্মিটোলার রানওয়েতে তার অবতরণ ছিল এক নতুন ইতিহাসের সূচনা।

রানওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক সাবেক বিমান বাহিনী সার্জেন্ট, কোলে তার ছোট ছেলে। শিশুটি যুদ্ধবিমানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, আমি একদিন ওরকম উড়বো।”
পিতা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“এখন পারবি। কারণ এই আকাশ আর কারো নয়। এটা তোর, আমার, আমাদের।”

এই মুহূর্তটাই ছিল প্রতীকী। প্রফেসর ইউনুস কোনো যুদ্ধ করেননি। কিন্তু তিনি থামিয়ে দিয়েছেন এক দীর্ঘ ষড়যন্ত্র। অস্ত্র নয়, চেতনা দিয়ে।

বাংলাদেশ এখন জানে, আকাশ শুধু প্রতিরক্ষা নয়—আকাশ মানে গর্ব, মানে স্বাধীনতা, মানে অস্তিত্ব। আর সেই আকাশকে রক্ষা করেছেন যিনি, তিনি এই সময়ের নীরব বিপ্লবের নায়ক—প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ