মেধা আছে, আবিষ্কার নেই—দায়ী কে?

সত্য নিউজ:বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। অথচ একই সূচকে আফ্রিকার সেনেগাল রয়েছে ৯২তম, দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা ৮৯তম, প্রতিবেশী ভারত ৩৮তম এবং উদীয়মান প্রযুক্তি-শক্তি চীন অবস্থান করছে ১১তম স্থানে। আর এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভাবনী দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুর অবস্থান ধরে রেখেছে—বিশ্বে যার স্থান চতুর্থ।
তবে সিঙ্গাপুরের এই অগ্রগতি হঠাৎ ঘটে যায়নি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, উচ্চশিক্ষার কাঠামোগত সংস্কার, এবং গবেষণায় অবিচল বিনিয়োগ।
গবেষণায় বিনিয়োগ ও নেতৃত্ব
সিঙ্গাপুর তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ২% গবেষণায় ব্যয় করে, যা আলাদা করে শিক্ষাব্যবস্থার বাজেটের বাইরে। গবেষণার তত্ত্বাবধানে রয়েছে ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন, যা পরিচালিত হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। এই ফাউন্ডেশনের রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বোর্ড, যারা বৈশ্বিক প্রবণতা ও গবেষণার গতিপথের সঙ্গে সিঙ্গাপুরকে সংযুক্ত রাখে।
বাংলাদেশে এমন কোনো কাঠামো দৃশ্যমান নয়। গবেষণা বাজেট অপর্যাপ্ত এবং তদারকির ঘাটতি রয়েছে। শিল্প খাতে গবেষণার জন্য সরকারি চাপ বা ইনসেনটিভ নেই বললেই চলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈন্য ও শিক্ষকের যোগ্যতা
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর (NUS)—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে মাত্র ১৫ বছর নতুন হলেও—আজ বিশ্বের শীর্ষ ৩০টির মধ্যে। প্রতিবছর এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বের হয় ৫০০-এর বেশি পিএইচডি গবেষক, যাঁরা ২৫-২৬ বছর বয়সেই গবেষণা শুরু করে দেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো বৈশ্বিক বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে ৫০০-এর মধ্যে নেই। পিএইচডি শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। ২৫ বছর বয়সী পিএইচডি ছাত্রের দেখা পাওয়া যেমন দুষ্কর, তেমনি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বা পাবলিকেশনও খুব দুর্লভ।
বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য পিএইচডি ও পোস্ট–ডক্টরাল অভিজ্ঞতা আবশ্যক হলেও বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া এখনো ধারাবাহিকভাবে কার্যকর হয়নি। ফলে শিক্ষক নিয়োগে গুণমান রক্ষা করা যাচ্ছে না।
গবেষণা সংস্কৃতির অভাব
উন্নত দেশে শিক্ষার্থীরা স্নাতক পর্যায়েই গবেষণায় যুক্ত হয়ে যান। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংযুক্তি প্রায় অনুপস্থিত। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক কোর্স, প্রকল্প, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই সীমিত। ফলে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণার সাথে ভাবনাচিন্তা, বিশ্লেষণ, যুক্তি ও উদ্ভাবনের অনুশীলনে বেড়ে ওঠে না।
বাংলাদেশে পেটেন্ট আবেদনের সংখ্যাও অত্যন্ত নগণ্য। বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থা (WIPO)–তে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পেটেন্ট ফাইল করা বিরল ঘটনা। অথচ উদ্ভাবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো আন্তর্জাতিক পেটেন্ট আবেদন এবং গবেষণা নিবন্ধের সংখ্যা।
সমস্যার গভীরে: কাঠামো, মেন্টরিং, স্বচ্ছতা
গবেষণা এগিয়ে নিতে প্রয়োজন মানসম্পন্ন মেন্টর, স্বচ্ছ নিয়োগ, এবং অনুপ্রেরণামূলক পরিবেশ। বাংলাদেশে শিক্ষকতার চাকরি এখনো বয়সভিত্তিক প্রমোশনের ফাঁদে পড়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে গবেষণায় ব্যস্ততা বা প্রকাশনা না থাকলেও পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি বোর্ড, নেই আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও অংশীদারিত্ব। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তরুণদের গবেষণায় যুক্ত করার চেষ্টাও অনুপস্থিত।
সম্ভাবনা ও পথ খোঁজার প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের তরুণেরা মেধাবী, প্রতিভাবান এবং বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সক্ষম। কিন্তু প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, পরিবেশ এবং পথনির্দেশ। সঠিক রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও নীতিমালার মাধ্যমে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দৃশ্যপট বদলানো সম্ভব:
-
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাধ্যতামূলক পিএইচডি-পোস্টডক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ চালু করা।
-
সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি বোর্ড গঠন করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা।
-
বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণা ও তরুণ প্রশিক্ষণে অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য করা।
-
গবেষণার জন্য GDP–র একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ ও তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
-
আন্তর্জাতিক পেটেন্ট ও উচ্চমানের পাবলিকেশনের জন্য গবেষকদের প্রণোদনা প্রদান।
-
তরুণদের ব্যাচেলর পর্যায়েই গবেষণায় যুক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক প্রজেক্টে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে, প্রযুক্তি ও জ্ঞানে উন্নত না হলে কোনো জাতির এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শুধু ভৌত অবকাঠামো দিয়ে উন্নয়ন ধরা যায় না—মানসিক কাঠামো ও উদ্ভাবনের ভিত্তি মজবুত করতে না পারলে সমাজের অগ্রগতি থেমে যাবে। বাংলাদেশকে সেই অগ্রগতির জন্য এখনই গবেষণা, উদ্ভাবন ও উচ্চশিক্ষার নতুন কাঠামো গড়তে হবে—ভাবনায়, নীতিতে, বাস্তবায়নে।
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- মাহফুজ আলমের ফেইসবুক পোস্ট: কি বার্তা দিলেন?
- আবারও খুলছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের দুয়ার!
- “ইশরাককে দায়িত্ব দাও, শহর বাঁচাও!”- কেন এই স্লোগান!
- ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘাত: কারও প্রকৃত বিজয় নেই, শুধু দাবির প্রতিযোগিতা
- ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি: কাগজে শান্তি, মাটিতে অনিশ্চয়তা
- আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ: জনগণের সিদ্ধান্তের সঙ্গেই থাকবে বিএনপি
- রেলওয়ের আয় ১ টাকা, খরচ ২.৫!নৈপথ্যে কারন?
- চীনের কৌশলগত সহায়তায় পাকিস্তানের সামরিক শক্তির উত্থান: আঞ্চলিকশক্তির নতুন বিন্যাস
- ১০৩ বছরের নীরবতা ভাঙল এল ক্লাসিকো, দেখল অভাবনীয় গোলবন্যা!
- গেম্বলারদের দৌরাত্ম্য: আস্থা ফেরাতে চাই কঠোর শাস্তি ও কাঠামোগত সংস্কার
- তারেক রহমানের প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার কি স্বৈরাচারের পুনর্বাসন করছে?
- হবিগঞ্জে সংঘর্ষে আহত অন্তত ৪০, কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর
- শেয়ার বাজারে স্বরণকালের বড় ধ্বসঃ নেপথ্যে কি?
- নেইমার কিনলেন ১৫ কোটি টাকার ফেরারি: কারন শুনলে অবাক হবে
- আ.লীগ নিষিদ্ধে বিএনপি কি দ্বিধায়?