সম্পাদকীয়
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই অর্থনীতির মধ্যে চলা এই দ্বন্দ্ব, শুধু এই দুই দেশের উপরই নয়, বরং পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিবেশে প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন এবং পণ্যের দাম বৃদ্ধি, এমনকি ভোক্তাদের উপর অতিরিক্ত চাপও সৃষ্টি হচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চীনের প্রতি নির্ভরশীলতা এবং তার পরিণতি
চীনের পণ্য বৈচিত্র্য এবং ব্যাপকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পৃথিবীর কোনো দেশও এক সপ্তাহ চীনা পণ্য ছাড়াই সচল থাকতে পারবে না বলে মনে হয়। যুক্তরাষ্ট্র তার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় প্রায় সব ভোগ্যপণ্য (খাদ্যপণ্য ব্যতীত) চীন থেকে আমদানি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর চীন থেকে প্রায় ৪৬২.৬২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, যার মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিক্স, গৃহস্থালী সামগ্রী, খেলনা, পোশাক এবং আরও অনেক কিছু।
বাণিজ্যযুদ্ধের অংশ হিসেবে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চীনের পণ্যে ১৪৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে, যার ফলে এই পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি টোস্টারের দাম ৩০ ডলার থেকে বেড়ে ৭৫ ডলার হয়েছে। শুধু তাই নয়, গড়পড়তা একটি মার্কিন পরিবারের বার্ষিক ব্যয়ও প্রায় ১,৩০০ ডলার বেড়ে গেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন, এবং এই শুল্কের কারণে কিছু প্রয়োজনীয় পণ্য বাজারে অনুপস্থিত হয়ে পড়ছে।
চীনের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এবং গ্লোবাল অর্ডারের প্রতি প্রভাব
চীন, অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কৃষিপণ্য আমদানি করে থাকে প্রায় ২৭.৬ বিলিয়ন ডলারের, তবে এই নির্ভরতা ক্রমশ কমাতে শুরু করেছে। ব্রাজিল, রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশ থেকে কৃষিপণ্য আমদানির দিকে ঝুঁকছে চীন, পাশাপাশি নিজেদের উৎপাদন বাড়ানোরও উদ্যোগ নিচ্ছে। এছাড়া, প্রযুক্তি খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য চীন চিপ উৎপাদন ও অন্যান্য উচ্চপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
এদিকে, চীন বিশ্বের অন্যান্য বাজারে বিকল্পের সন্ধানে এগিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে তারা এখন বিকল্প বাজার হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে, চীনের অভ্যন্তরীণ বাজার এমনকি ২৫-৩০ কোটি ভোক্তা হারানোর পরেও দেশটির অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ধাক্কা আসবে না। কারণ, চীন আরও বৃহৎ এবং শক্তিশালী বাজারের দিকে ঝুঁকছে, এবং তাদের উৎপাদন সক্ষমতা আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং পরিণতি
যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি এখন বেশ কঠিন। তারা চীনের উপর এতটাই নির্ভরশীল যে, বিকল্প খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। বর্তমান বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও, চীনের জয় নিশ্চিত নয়। চীন যেহেতু সারা বিশ্বে অনেক দেশের কাছে বাজার খুঁজে নিয়েছে, এবং তারা নিজেদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম, তাই যুক্তরাষ্ট্রের চাপ তেমন কিছু প্রভাব ফেলতে পারছে না।
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধের পরিণতি আরও সুদূরপ্রসারী হতে পারে, কারণ বিভিন্ন দেশ এখন নিজেদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি শুধুমাত্র একটি সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি করেছে, এবং চীনের বাজারের বিকল্প খুঁজে বের করতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সময়ের সঙ্গে সাথে আরও সংকটজনক হতে পারে।
ভবিষ্যৎ বিশ্বব্যবস্থা এবং চীনের জয়?
এই বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে, তা এখনো অনিশ্চিত। কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র, কারণ সরবরাহ চেইনে চীনের উপর তাদের নির্ভরশীলতা এত বেশি যে বিকল্প খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তবে এক্ষেত্রে চীনের জয়ও অযৌক্তিক নয়। যদিও চীন জয়ী হওয়ার জন্য যে চূড়ান্ত শর্ত রয়েছে, তা তারা এখনো পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। তবে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ব্যবস্থা একটি বড় পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
বিশ্ব বাণিজ্যের বর্তমান কাঠামোয় চীন এক অপরিহার্য নাম। এই বাণিজ্যযুদ্ধে হয়তো একপক্ষ সাময়িকভাবে কিছু সুবিধা পেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে যে পক্ষই যতটা প্রস্তুতি নিয়ে থাকবে, সে অনুযায়ী তার লাভ বা ক্ষতি নির্ধারিত হবে। চীন বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই এই যুদ্ধে একপাশেই থাকবে না। তবে বিশ্বব্যবস্থায় যে একটা বড় পরিবর্তন আসছে, সেটি নিশ্চিত। এখন সময় এসেছে এই বাণিজ্যযুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ বিশ্ব শক্তির শিফটকে বুঝে উঠার।