বিশেষ প্রতিবেদন

সেন্ট মার্টিন ও বঙ্গোপসাগর: ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন ভূকেন্দ্র

সমুদ্র ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০১ ১৬:০২:৩৪
সেন্ট মার্টিন ও বঙ্গোপসাগর: ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন ভূকেন্দ্র
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপ

বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত হলেও সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দ্বীপটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কৌশলগত প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু। মিয়ানমার, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক রাষ্ট্রের আগ্রহে এ দ্বীপ ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলটি এখন পরিণত হয়েছে একটি ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার হটস্পটে।

মিয়ানমারের আগ্রাসী দাবি ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া

২০১৮ সালের অক্টোবরে মিয়ানমারের জনসংখ্যা মন্ত্রণালয় এবং মিয়ানমার ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট ইউনিট (MIMU) -এর ওয়েবসাইটে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মিয়ানমারের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এমনকি দ্বীপের বাসিন্দাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে দেখানো হয়। বাংলাদেশের তীব্র প্রতিবাদের মুখে এই দাবি প্রত্যাহার করা হলেও এটি মিয়ানমারের সুদূরপ্রসারী কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর আগে ২০০৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দাউই কোম্পানিকে মিয়ানমার যে এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পাঠিয়েছিল, তা বাংলাদেশের জলসীমার কাছাকাছি হওয়ায় দুটি দেশের নৌবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়।

সামরিক প্রেক্ষাপট ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য আগ্রহ

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নৌঘাঁটি স্থাপন পরিকল্পনার গুঞ্জন ছড়িয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এমন দাবি অস্বীকার করেছে এবং সামরিক বিশ্লেষকরাও দ্বীপটির ছোট আকার ও ভৌগলিক কাঠামোর কারণে এর সামরিক ব্যবহার উপযোগিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তথাপি এসব আলোচনা প্রমাণ করে যে বঙ্গোপসাগরের প্রতি পরাশক্তিদের নজর বাড়ছে।

বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ও চীনের প্রবেশ

চীনের জন্য মালাক্কা প্রণালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মাধ্যমে তারা দক্ষিণ চীন সাগর থেকে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে। তবে মালাক্কা প্রণালীর উপর মার্কিন ও ভারতীয় নজরদারি এবং সেনা ঘাঁটি থাকার কারণে চীনের বিকল্প রুট খোঁজার প্রবণতা বাড়ছে। এক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে একটি বিকল্প বাণিজ্য ও জ্বালানি পথ গড়ে তোলাই চীনের অন্যতম কৌশল।

চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং মেরিটাইম সিল্ক রোড (MSR)-এর অংশ হিসেবে চীন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও সোনাদিয়া বন্দর উন্নয়নে চীনের আগ্রহ থাকলেও, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত সোনাদিয়ায় চীনের সঙ্গে চুক্তিতে না গেলেও, চীন মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সফল হয়েছে।

ভারতের পাল্টা কৌশল ও বাংলাদেশের ভূমিকা

ভারতও তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্তির জন্য বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চেয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। ২০১৮ সালে তারা চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি লাভ করে। পাশাপাশি মিয়ানমারের কালাদান নদীর মোহনায় ভারতের একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চলছে, যা তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধির জন্য বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের জবাবে ভারত ২০১৪ সালে "Act East" নীতি গ্রহণ করে। এই নীতির আওতায় মিয়ানমার ভারতের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশগুলোর একটি, যার ফলে চীন-ভারত প্রতিযোগিতা সেখানে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

সামরিক প্রতিযোগিতা ও সাবমেরিন রাজনীতি

বাংলাদেশ ২০১৬ সালে চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন ক্রয় করে, যার ফলে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর জবাবে ভারত মিয়ানমারকে সাবমেরিন বিধ্বংসী টরপেডো এবং একটি রাশিয়ান সাবমেরিন সরবরাহ করে। এ থেকেই বোঝা যায় বঙ্গোপসাগর ঘিরে সামরিক প্রতিযোগিতা কীভাবে গভীরতর হচ্ছে এবং কৌশলগত সামরিক ভারসাম্য কীভাবে গঠিত হচ্ছে।

জাপানের ভূরাজনৈতিক অনুপ্রবেশ

এই অঞ্চলে চীন-ভারত প্রতিযোগিতার পাশাপাশি জাপানও সক্রিয় হয়েছে। কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে জাপানের বিনিয়োগ এবং এটি থেকে যুক্ত হওয়া বে অফ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (BIG-B) প্রকল্প বাংলাদেশের লজিস্টিকস, বিদ্যুৎ এবং শিল্প উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ: প্রতীকী গুরুত্ব ও বাস্তবতা

যদিও সামরিক বিশ্লেষকদের মতে সেন্ট মার্টিনের কৌশলগত গুরুত্ব সীমিত, তথাপি এটি প্রতীকী দিক থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের একতরফা দাবি, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কৌশলগত আগ্রহ এবং সমুদ্রপথে বাণিজ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশের উচিত হবে কূটনৈতিক এবং সামরিক প্রস্তুতি যুগপৎভাবে জোরদার করা।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং তার আশপাশের জলসীমা বর্তমানে একটি জটিল ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঠে পরিণত হয়েছে, যেখানে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের স্বার্থ পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে ভবিষ্যতের বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতির অনেক কৌশল নির্ধারিত হবে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশকে কৌশলগত দূরদর্শিতা, নিরপেক্ষতা এবং সক্রিয় কূটনৈতিক ভূমিকায় অভ্যস্ত হতে হবে যেন সেন্ট মার্টিন এবং বঙ্গোপসাগর—এই দুই ভূভাগ ও জলসীমা তার সার্বভৌম স্বার্থের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ