বিশেষ প্রতিবেদন

কর্ণফুলীর তীরে এক নীরব বিপ্লব: বাংলাদেশের অস্ত্র কারখানা নিয়ে উত্তপ্ত দক্ষিণ এশিয়া

২০২৫ আগস্ট ০১ ১৭:০১:৩৪
কর্ণফুলীর তীরে এক নীরব বিপ্লব: বাংলাদেশের অস্ত্র কারখানা নিয়ে উত্তপ্ত দক্ষিণ এশিয়া

জুলাইয়ের শেষ বিকেলে চট্টগ্রামের বাতাসে যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল এক অদৃশ্য উত্তেজনা। পাহাড়ঘেরা পুরনো একটি পরিত্যক্ত টেক্সটাইল মিল—বছরের পর বছর ধরে যেখানে নীরবতা ছিল অবিচল, সেখানে হঠাৎ করেই ঢুকে পড়ে সামরিক যানবাহনের একটি বহর। আশেপাশের মানুষ বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তবে কেউ নিশ্চিত নয় কী ঘটতে যাচ্ছে। যেন হঠাৎ করেই কারো কানে কানে কেউ বলে দিয়েছে—বাংলাদেশ বদলে যাচ্ছে।

মাত্র ৬২ কিলোমিটার দূরে ভারতের সীমান্ত রেখা। আর এই সীমান্ত ঘেঁষেই গড়ে উঠছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় অস্ত্র নির্মাণ কারখানা, সরাসরি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। এটি কেবল একটি অস্ত্র কারখানা নয়—এটি এক প্রতীক। এটি হলো আত্মবিশ্বাসের, কৌশলগত স্বাধীনতার, এবং সবচেয়ে বড় কথা, দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বদলে যাওয়া ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে বাংলাদেশের নতুন অবস্থানের।

জলিল টেক্সটাইল থেকে প্রতিরক্ষা বিপ্লব

চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী এলাকায় অবস্থিত পুরনো জলিল টেক্সটাইল মিলের ৫৪.৯৯ একর জমি এখন শুধুই স্মৃতির ধ্বংসাবশেষ নয়। এই ভূমি হয়ে উঠেছে একটি সামরিক-শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি। জমিটির সরকারি মূল্য ধরা হয়েছে ১১১ কোটি টাকা, কিন্তু সেনাবাহিনী সেটি পাচ্ছে মাত্র ১৭ কোটিতে—টোকেন মূল্যে। অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষকরা একে বলছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার "দ্বিতীয় স্তম্ভ", কারণ এটি দেশকে আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা শিল্পের দিকে ধাবিত করছে।

বাংলাদেশ এতদিন ধরে আমদানিনির্ভর অস্ত্র ও নিরাপত্তা নীতিতে চলে এসেছে। এবার নিজস্ব সামরিক শিল্প গড়ার মধ্য দিয়ে এই নির্ভরতার অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রাম: একটি কৌশলগত অবস্থানের নাম

কারখানার জন্য চট্টগ্রাম নির্বাচিত হওয়া কেবল স্থানগত সুবিধার বিষয় নয়; এটি একটি সুপরিকল্পিত কৌশল। কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এই অঞ্চল দেশের বাণিজ্যিক, সামুদ্রিক এবং সামরিক কেন্দ্র। নেভাল একাডেমি, রপ্তানিমুখী ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন, মেরিন একাডেমি ও বন্দর অবকাঠামো—সবই এই অঞ্চলে ঘনীভূত। এমন একটি জায়গায় অস্ত্র কারখানা গড়ে উঠা মানেই কেবল যুদ্ধ প্রস্তুতি নয়, বরং সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান শক্ত করা।

এই প্রতিযোগিতা এখন কেবল আঞ্চলিক নয়; চীন হাম্বানটোটা বন্দর দখল করে ফেলেছে, ভারত আন্দামানে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করছে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বঙ্গোপসাগরে সক্রিয় নৌবাহিনী ঘাঁটি। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নিজের অবস্থানকে নীরবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে।

একটি নতুন সামরিক কল্পনাঃ ড্রোন, ইলেকট্রনিকস এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর

এই কারখানা কেবল রাইফেল বা গ্রেনেড তৈরির মতো প্রাথমিক উদ্দেশ্য নয়, বরং উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর সামরিক সরঞ্জাম—ড্রোন, মিলিটারি ইলেকট্রনিকস, আর্মড ভেহিকেল, কন্ট্রোল সিস্টেম ইত্যাদি তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে গড়ে উঠছে। এখানেই এসে যাচ্ছে বিদেশি অংশীদারত্বের প্রসঙ্গ—বিশেষ করে তুরস্কের ASELSAN এবং চীনের NORINCO-এর সম্ভাব্য প্রযুক্তিগত ও যৌথ বিনিয়োগ।

অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, বাংলাদেশ এই প্রকল্পে শুধু অস্ত্র কিনবে না, বরং প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে নিজস্ব সামরিক উৎপাদন সক্ষমতা গড়ে তুলবে। অর্থাৎ এটি একটি অস্ত্র কারখানা নয়, বরং এক নতুন ভূরাজনৈতিক সক্ষমতার নাম।

দিল্লির ঘুম ছুটে গেছে

এই খবরের প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে আলোড়ন তুলেছে। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার মাঝে বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত ভারতের জন্য একটি অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ। দিল্লির থিংক ট্যাংক ও সামরিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, ভারত দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার ‘বড় ভাই’ হয়ে থাকতে চেয়েছে, কিন্তু আজ বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান একটি নতুন ‘স্ট্র্যাটেজিক ব্যালেন্স’ তৈরি করছে, যেখানে ভারত একঘরে হয়ে পড়ছে।

এটিকে ভারতীয় কূটনীতির ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন অনেকে—যেখানে সম্মান ও আস্থার জায়গায় বারবার প্রদর্শিত হয়েছে আধিপত্য ও চাপ।

নীরব বাংলাদেশ, শঙ্কিত প্রতিবেশী

বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। কিন্তু এই ‘নীরবতা’ই যেন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় বার্তা। ঢাকায় কেউ উচ্চস্বরে কিছু বলছে না, তবে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও তুরস্কের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে কর্ণফুলীর প্রতিটি নড়াচড়া।

চীন, তুরস্ক ও পাকিস্তানের সম্ভাব্য পর্দার পেছনের উপস্থিতি এবং প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ এই উদ্যোগকে পরিণত করেছে একটি ‘সাইলেন্ট ওয়ার ফ্রন্ট’-এ। কূটনীতির পরিভাষায় একে বলা হয় pre-conflict posture—এক ধরনের অঘোষিত যুদ্ধ প্রস্তুতি।

মিডিয়ার নিরবতা ও আন্তর্জাতিক নজরদারি

ভারতের প্রভাবশালী মিডিয়া যেমন টাইমস নাউ, রিপাবলিক, হিন্দুস্তান টাইমস—সবাই আশ্চর্যজনকভাবে চুপ। কেউ সরাসরি বলছে না কিছু, কেউ বলছে বাংলাদেশ চীনের কৌশলে জড়াচ্ছে, আবার কেউ বলছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এতটাই বন্ধুত্বপূর্ণ যে এমন কিছু হবার কথা নয়। কিন্তু এই নিরবতা বিশ্লেষকদের মতে “ভয়ের প্রতিফলন”।

যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, রাশিয়ার এফএসবি ও চীনের MSS—সবাই এখন বাংলাদেশে নতুন কূটনৈতিক ধারা এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে নজর রাখছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নয়া রেখা আঁকা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের দ্বিধাবিভক্ত জোট ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিতে পারে।

একটি নীরব বিপ্লবের সূচনা

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে পুরনো পরিত্যক্ত এক টেক্সটাইল মিল আর শুধু একটি ঐতিহাসিক জমি নয়—এটি আজ একটি প্রতিরোধের প্রতীক। এখানে গড়ে ওঠা অস্ত্র কারখানা কেবল বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নয়, বরং কৌশলগত অবস্থান, কূটনৈতিক শৃঙ্খলা ও ভূরাজনৈতিক মনোভঙ্গির এক মৌলিক রূপান্তরের সূচনা করছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই রূপান্তর কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে? বাংলাদেশ কি সফলভাবে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে? নাকি এক সময় এই অস্ত্র কারখানাই পরিণত হবে আঞ্চলিক উত্তেজনার উৎসে?

সত্যিটা হলো—ইতিহাস নীরবতায় গঠিত হয় না, তবে অনেক সময় নীরবতা থেকেই ইতিহাস শুরু হয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ