মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় উন্মুক্ত: সর্বশেষ যা জানা গেল

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৬ ১৫:২২:০২
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় উন্মুক্ত: সর্বশেষ যা জানা গেল

এক বছরের দীর্ঘ অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে আবারও উন্মুক্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। বহুল কাঙ্ক্ষিত এই ঘোষণাটি শুধু একটি সরকারি সিদ্ধান্ত নয়, বরং লাখো প্রান্তিক পরিবারের জন্য নতুন আশার আলো, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার এবং দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়।

নীতিগত সিদ্ধান্ত: কূটনৈতিক তৎপরতার সফল ফল

গত ১৫ মে মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায় অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল, মানবসম্পদ মন্ত্রী স্টিভেন সিম চি কেও এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মালয়েশিয়া নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা বাংলাদেশসহ সাতটি দেশ থেকে শ্রমিক নেবে। এই প্রক্রিয়ায় আগামী ছয় বছরের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ থেকেই মালয়েশিয়া ১২ লাখ শ্রমিক নিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। আশার কথা হলো—প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক বিনা খরচে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাবেন।

বিশ্ব রাজনীতির পটভূমি ও বন্ধুত্বের প্রতিফলন

২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশ সফরে আসেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশি শ্রমিকরা আধুনিক দাস নয়—তাদের মর্যাদা রক্ষা করা হবে।” সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটছে এখন। এটি শুধু একটি অর্থনৈতিক উদ্যোগ নয়, বরং কূটনৈতিক বন্ধুত্বের আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ।

শর্তাবলি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের অঙ্গীকার

মালয়েশিয়া এই শ্রমবাজার চালু করার পূর্বশর্ত হিসেবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:

১। মানব পাচার ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি বা প্রত্যাহার – মালয়েশিয়া সরকারের মতে, এসব মামলা অভিবাসন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।

২। সহযোগী এজেন্সি প্রথা বিলুপ্ত করা – মালয়েশিয়া চায়, অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে একটি প্রতারণামুক্ত, স্বচ্ছ ও নিরাপদ প্রক্রিয়া গড়ে তোলা হোক।

৩। অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ – শ্রমিক যেন সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকার মধ্যে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।

৪। শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা – বাংলাদেশি কর্মীরা যেন কর্মস্থলে হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ পক্ষ থেকে এসব শর্তের বাস্তবায়নে ইতিবাচক অবস্থান নেওয়া হয়েছে। উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও স্বচ্ছ করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রথম ধাপে ১৭ হাজার আটকে পড়া শ্রমিকের মধ্যে ৭,৯২৬ জনের তালিকা ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত করা হয়েছে, যারা খুব শিগগিরই মালয়েশিয়া যেতে পারবেন।

অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শ্রমবাজার সচল হলে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বছরে অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যুক্ত হতে পারে। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় একজন সাধারণ শ্রমিকের মাসিক বেতন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ, এমনকি তিনগুণও হয়ে থাকে। ফলে শুধু কর্মীরাই নয়, তাদের পরিবার এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এ থেকে উপকৃত হবে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৪.৭৬ লাখ শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় গেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে এই সংখ্যাটি ১২ লাখ ছাড়াতে পারে—যা দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসন ইতিহাসে একটি বড় মাইলফলক।

প্রযুক্তি ও দক্ষতা ভিত্তিক অভিবাসনের সম্ভাবনা

মালয়েশিয়া শুধু সাধারণ শ্রমিক নয়, বরং সিকিউরিটি গার্ড, নার্স, কেয়ারগিভার এবং দক্ষ কর্মী নিয়োগেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটি বাংলাদেশের তরুণ-যুব সমাজের জন্য নতুন এক সুযোগ। দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে শুধু নির্মাণশ্রমিক নয়, উচ্চমানের পেশাগত অভিবাসনের পথও উন্মুক্ত হচ্ছে।

প্রতারণা ও হয়রানি বন্ধে কঠোর নজরদারির আহ্বান

বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার প্রক্রিয়াটি হতে হবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও শ্রমিকবান্ধব। যেহেতু অতীতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নামে অসংখ্য প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে, তাই সরকারকে আরও কঠোর নজরদারি করতে হবে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, “কে পাঠাচ্ছে সেটা মুখ্য নয়, বরং শ্রমিকরা যেন নিরাপদ ও সাশ্রয়ী অভিবাসনের সুযোগ পান সেটাই আমাদের লক্ষ্য।”

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ২১ মে

২১ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। এরপর শুরু হবে চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিক পাঠানোর আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।

সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় উন্মুক্ত হওয়া শুধু একটি সরকারি ঘোষণা নয়, এটি একটি বাস্তব আশার নাম। যেখানে কোটি কোটি মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন, বৈধভাবে অভিবাসনের মাধ্যমে তারা পরিবার, সমাজ এবং দেশকে এগিয়ে নিতে পারবেন। আর দেশের জন্য বাড়বে রেমিট্যান্স, বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, কমবে বেকারত্ব। সরকার যদি প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ ও শ্রমিকবান্ধব করে রাখতে পারে, তবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অভিবাসন ইতিহাসের অন্যতম সফল অধ্যায়।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত