বিদায় হজ: মানবতার চূড়ান্ত বার্তা

ধর্ম ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ২৬ ১৭:৩০:৫৯
বিদায় হজ: মানবতার চূড়ান্ত বার্তা

ইতিহাসের পাতায় কিছু মুহূর্ত থাকে, যা সময়ের সীমা অতিক্রম করে চিরন্তন শিক্ষায় পরিণত হয়। হিজরতের দশম বছর, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে তেমন এক অবিস্মরণীয় দিন উদিত হয়েছিল। পবিত্র আরাফাতের ময়দানে এক লাখের বেশি সাহাবি ও অনুসারী একত্রিত হয়েছিলেন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে। এটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম এবং একমাত্র হজ, যা ইসলামের ইতিহাসে "হজ্জাতুল বিদা" বা বিদায় হজ নামে পরিচিত।

এক সর্বজনীন ভাষণ: ‘হে মানুষ!’

বিদায় হজের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল আরাফার ময়দানে নবীজির ঐতিহাসিক ভাষণ। তাঁর মুখে উচ্চারিত শব্দগুলো শুধু ধর্মীয় নির্দেশনা নয়, বরং এক বিস্তৃত মানবিক ও নৈতিক ম্যানিফেস্টো। তাঁর ভাষণের সূচনা ছিল এইভাবে "হে মানুষ!" এটি ছিল নিছক মুসলমানদের উদ্দেশে নয়; বরং পুরো মানবজাতির প্রতি একটি সার্বজনীন আহ্বান।

তিনি বলেন: “তোমাদের প্রভু একজন। তোমরা সবাই আদমের সন্তান, আর আদম সৃষ্টি হয়েছেন মাটি থেকে। কোনো আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠতা নেই, কিংবা অনারবের ওপর আরবের; শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে।”

এই এক ঘোষণার মাধ্যমে তিনি বর্ণ, জাতি, ভাষা ও শ্রেণিভেদে বিভক্ত পৃথিবীতে গড়ে তোলেন এক অখণ্ড মানবসমাজের দর্শন। এটি ছিল মানবাধিকার ও সাম্যবাদের চূড়ান্ত নিদর্শন।

নারীর অধিকার ও সম্মান

নারীর মর্যাদা রক্ষার বিষয়েও নবীজির বক্তব্য ছিল যুগান্তকারী। তিনি বলেন:“নারীদের সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করো। তারা তোমাদের জীবনসঙ্গী এবং তোমাদের ওপর অর্পিত একটি আমানত।”

এই ঘোষণায় ফুটে ওঠে নারীদের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা ও সম্মান একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের জন্য অপরিহার্য ভিত্তি।

অর্থনৈতিক শোষণ ও প্রতিহিংসার অবসান

অর্থনৈতিক অবিচার প্রতিরোধে তিনি সুদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেন:“আজ জাহিলিয়াতের সকল সুদ আমি বাতিল করলাম। প্রথম যে সুদ আমি বাতিল করলাম, তা হচ্ছে আমার চাচা আব্বাসের সুদ।”

রক্তপাত ও প্রতিহিংসার চক্র থামাতে তিনি ঘোষণা দেন:

“আজ আমি জাহিলিয়াত যুগের সকল রক্তের প্রতিশোধ বাতিল করলাম। প্রথম যে রক্ত আমি মাফ করলাম, তা হলো রাবি ইবনে হারিসের পুত্রের রক্ত।”

জবাবদিহিতা ও দায়িত্বের শিক্ষা

বিদায় হজের ভাষণে নবীজি (সা.) সকলকে আমানতের প্রতি যত্নবান হতে বলেন এবং সততা, জবাবদিহিতা ও ন্যায়ের পথে চলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন:“তোমরা কারও ওপর জুলুম করবে না। আমানতের খেয়ানত করবে না। অন্যায়ের পথে হাঁটবে না।”

ঐশী ঘোষণায় নবুয়তের ইতি

এই হজের সময়ই আল্লাহ তাআলা কোরআনের একটি চূড়ান্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন:“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য জীবনব্যবস্থা হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সুরা মায়েদা, আয়াত ৩)

এই আয়াত ছিল নবুয়তের সমাপ্তি এবং ইসলামের পূর্ণতার আলোকবর্তিকা।

‘হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন’

ভাষণের শেষদিকে নবীজি তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন কি না, তা সাহাবাদের কাছে জানতে চান। তারা সম্মিলিতভাবে হ্যাঁ বললে তিনি আকাশের দিকে তর্জনী তুলে তিনবার বলেন:“হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।”

এটি ছিল নবুয়তের দায়িত্ব হস্তান্তরের মুহূর্ত এক প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া হয় ইসলাম প্রচারের ভার।

আজকের পৃথিবীর জন্য বিদায় হজের ভাষণ কেন জরুরি?

আজ যখন দুনিয়াজুড়ে জাতিগত হিংসা, ধর্মীয় উগ্রতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন চলছে, তখন বিদায় হজের সেই ভাষণ হয়ে উঠতে পারে এক শক্তিশালী উত্তরণপথ। "তোমাদের প্রভু একজন", "তোমরা সবাই ভাই ভাই" এই চিরন্তন বার্তাগুলো আমাদের পারস্পরিক সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও মানবিক মূল্যবোধে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

বিদায় হজ শুধুই অতীত নয়, এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। নবীজির (সা.) ঐ ভাষণ প্রতিটি সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের নৈতিক মানদণ্ড হয়ে উঠতে পারে শুধু মুসলমান নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত